banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ছোটগল্প: প্রতিবেশী

সৌরভ হাওলাদার

অক্টোবর ১, ২০২১

The Neighbouring countries
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

এমন ঘন পাতার আস্তরণ, যে রোদ পৌঁছবার আগে অনুমতি চায় গাঢ় পাতার কাছে। দু’এক কুচি অভ্রের মতো আলোর রেখা পুরো জায়গাটা একটা স্থায়ী সুখের চাদরে মুড়ে রেখেছে। মনখারাপের মধ্যেও বিদিশা সেই নিবিড় ছায়াকে অনুভব করে। গভীরতর খানাখন্দ ঠান্ডা প্রলেপে ভরাট হয়ে যায়। একরাশ পাখির কিচিরমিচিরে এক বিষণ্ণ নীরবতার পাড় ভেঙে পড়ে, ছলাৎ ছলাৎ। প্রাচীন গাছটার নিচে একটা পুরনো স্যাঁতলা পড়া বেঞ্চিও পাতা আছে। 

সীমান্ত লাগোয়া ছোট্ট লোকালয় গহীনপুর। বিদিশা এই গহীনপুর হাসপাতালের ডাক্তার। একমাস হল বদলি হয়ে এসেছে। কোনও এক সময়ের উদার মনের জমিদার তাঁর বিশাল বসতবাটি হাসপাতালকে দান করে গিয়েছেন। এই বিরাট চৌহদ্দির অনেকটা অংশে কেউ আর আসে না। সেখানে গাঢ় ছায়া মেলে বৃদ্ধ বনস্পতিরা দাঁড়িয়ে আছে, সেই কবে থেকে। রাতে শিয়াল ডাকে, দিনের বেলায় বেজি পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একটা বুড়ো দাঁড়াশ সাপ বুকে হেঁটে চলে। শালিখরা এসে হুজ্জুতি করে, ঠোকরায়। সাপটা কিছু বলতে পারে না। চুপ করে থাকে। পাখির দল চলে গেলে আবার যেমন এসেছিল, তেমন ভাবে ঝোপঝাড়ে ঢুকে যায়। 

বিদিশা প্রতিদিন সকালে এখানে এসেই বসে। পরপর কয়েকটা ফোন করে। এই তার দিন শুরু হওয়ার নিয়ম। প্রথমে কলকাতায় ছেলের খবর নেয়। পাঁচ বছরের সুষেণ থাকে ওর আয়ামাসি জয়মালার কাছে। জয়মালা না থাকলে যে কী হত? বিদিশা জানে না। সুষেণ আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়, ওর মধ্যে অটিজ়ম স্পেক্ট্রাম ডিজর্ডার-এর লক্ষণ দেখা দিয়েছে। খুব গম্ভীর বাচ্চা। কম কথা বলে। সব সময় নিজেকে নিয়েই আছে। ওর মা-কেও চাই না। সুষেণের জন্য একটা কষ্টের পাথর বুকের ওপর চেপে আছে সব সময়।

আরও খারাপ লাগে, সুষেণ এটা বুঝতেও পারে না। নিজের পৃথিবীতে ও ভালোই আছে। মা হিসেবে, ডাক্তার হিসেবে বিদিশার নিজের ওপর নিজেরই ঘৃণা জন্মায়। ওর জন্যেই সুষেণ এমন হয়েছে বলে ভাবে। এরপর ফোন করে সুষেণের বাবা দেবাশিসকে। দেবাশিসও ডাক্তার। দেবাশিসের কর্মস্থল অন্য জেলায়। দু’জনে এইভাবে প্রায় সাত বছর কাটিয়ে, এবার ভেবেছিল এক শহরে বদলি হবে। কিন্তু বিদিশাকে গহীনপুরের মতো প্রান্তিক জায়গায় চলে আসতে হল। শ্বশুর শাশুড়ি কলকাতার কাছেই থাকেন, তবু সুষেণকে জয়মালার দায়িত্বে রেখে ও বেশি নিশ্চিন্ত থাকে।

হাসপাতালের মূল ভবনের এক দিকে বহির্বিভাগ। সেখানে গ্রামের অসুখে পড়া মানুষজন এসে লাইন দেয়। সীমান্ত লাগোয়া জনপদ হওয়ার জন্য, প্রতিবেশী দেশ থেকেও অনেক মানুষ চিকিৎসার আশায় এখানে আসেন। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা আরও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার খোঁজে পাড়ি জমান মাদ্রাজ, মুম্বই বা কলকাতা। শিরিন এমনই একজন মানুষ। সীমানা ডিঙিয়ে গহীনপুরে এসেছে চিকিৎসার জন্য। আঠাশ পেরিয়ে উনত্রিশে পা দিয়েছে। বিয়ে হয়েছে আট বছরের ওপর। এখনও সন্তানাদি হয়নি। চিকিৎসার জন্য এদিকে এসেছে। সীমান্ত লাগোয়া গহীনপুরের হাসপাতালেই একজন মহিলা ডাক্তার আছে জেনে, এখানেই থেকে গেছে। ঘর ভাড়া করেছে হাসপাতালের পাশেই।

পাখিগুলো এত কী কথা বলে? নিজেদের কথা নিজেরা শুনতে পায়? বা বুঝতে পারে? সবাই মিলে এমনভাবে একসঙ্গে কথা বললে, কে কাকে কী বলতে চাইছে, কী করে বোঝে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাসপাতাল চত্বরে ঘুরতে আসে শিরিন। সিংদরজার পাল্লা কবেই ভেঙে গেছে। যে কেউ ভেতরে চলে আসতে পারে। মাঝখানে একটা বড় পুকুর আছে। পুরনো চাঁপা গাছের মোটা ডাল জলের ওপর হেলে রয়েছে। কবেকার পুরনো সিঁড়ির ধাপগুলো অবিন্যস্ত শ্যাওলায় পেছল। ইট খসে জায়গায় জায়গায় গর্ত দেখা যায়। পায়ে পায়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঢালু হয়েছে। নিশ্চয় কোনও একসময় জমিদার বাড়িতে ব্যস্ততা ছিল। পুকুর ঘাটে বৌ-ঝিয়েরা নাইতে আসত। জামাকাপড় কাচত। 

ভেবে ভেবে কেমন অবাক লাগে শিরিনের। হুশ করে এত দোর্দণ্ডপ্রতাপ পরিবার কেমন ফুরিয়ে যায়! সময়ের কাছে কোনও ফেরেস্তার কোনও বল খাটে না। দূরে ঝোপঝাড়ের ভেতর একটা পুরনো বেঞ্চের ওপর একজন বসে আছে। পরনে একটা ধূসর সালোয়ার কামিজ। প্রথমে একটু থমকে যায়। এত ভোরে এই গাছগাছালির আবরণের অভ্যন্তরে কোনও মানুষের দর্শন পাবে, সে ভাবতে পারেনি। একটু কাছে যেতে বুঝতে পারে, হাসপাতালের ডাক্তার-আপা। কয়েকদিন আগে এঁকেই দেখাতে এসেছে। শিরিন পায়ে পায়ে একটু এগিয়ে এসে বলে,
– আপা কি এখানেই থাকেন? তারপর একটু থেমে বলে,
– আপা বললাম বলে কিছু মনে করেননি তো দিদি?

কোনও এক সময়ের উদার মনের জমিদার তাঁর বিশাল বসতবাটি হাসপাতালকে দান করে গিয়েছেন। এই বিরাট চৌহদ্দির অনেকটা অংশে কেউ আর আসে না। সেখানে গাঢ় ছায়া মেলে বৃদ্ধ বনস্পতিরা দাঁড়িয়ে আছে, সেই কবে থেকে। রাতে শিয়াল ডাকে, দিনের বেলায় বেজি পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একটা বুড়ো দাঁড়াশ সাপ বুকে হেঁটে চলে। শালিখরা এসে হুজ্জুতি করে, ঠোকরায়। সাপটা কিছু বলতে পারে না।

বিদিশা ফোন রেখে একটু আনমনা হয়ে বসেছিল। পুকুরের দিক থেকে শিরিনকে আসতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে। হেসে জবাব দেয়,
– না না, মনে করব কেন? মিষ্টি লাগে শুনতে। 
শিরিন বলে,
– এত ভোরবেলা? আপনি কি এখানেই থাকেন? 
– আমার বাড়ি কলকাতায়। ডিউটির ক’দিন হাসপাতালের পাশেই থাকি। কোয়ার্টার আছে, তবে সেটা বাসযোগ্য নয়। তুমি কোথায় থাকো?
শিরিনের ঠিকানা শুনে বুঝল, ওর বাড়ির আশেপাশেই হবে। এই মেয়েটির সঙ্গে কিছুদিন আগেই আউটডোরে পরিচয় হয়েছে বিদিশার। এই আধাগ্রাম্য পরিবেশে ওকে যেন মানায় না। ওপার থেকে এদেশে আসা, এমন পেশেন্টের সাধারণতঃ মাদ্রাজ গন্তব্য হয়।

এত ভোরবেলায় হাসপাতালের এই অংশে মাঝে মাঝে বিদিশা হাঁটতে আসে। একটু পরেই সারাদিনের কাজ শুরু হয়ে যাবে। শিরিনের চেহারায় আলগা আভিজাত্য আছে। এত সকালেও বেশ পরিপাটি করে শাড়ি পরেছে। বিদিশা জিজ্ঞেস করে,
– তুমি কি এখন এখানেই থাকবে? 
– ভাবছিলাম, অ্যাপোলোতে যাব। আমার হাজ়ব্যান্ড এখনও আসতে পারেনি। অফিস থেকে ছুটি পায়নি। তার মধ্যে অভিবাসন কাউন্টারে স্থানীয় মানুষরা আপনার খুব প্রশংসা করছিল। তাই ভাবলাম, আপনার কাছেই কয়েকদিন চিকিৎসা করাই। 
বিদিশা বলে,
– এই চিকিৎসা তো সময়সাপেক্ষ। তুমি বা তোমার হাজ়ব্যান্ড এতদিন সময় পাবে? 
শিরিন বড় করে হাসে। বিদিশা ওর সারিবদ্ধ সুন্দর দাঁতগুলো দেখতে পায়। একটু থেমে বলে,
– তোমার রিপোর্টগুলো এসে গেলে ওষুধ দিয়ে দেব। সেগুলো মাস দুয়েক খেয়ে আমাকে জানালেই হবে। আর এই চিকিৎসার জন্য তোমাদের দু’জনকে নিয়ম করে একসঙ্গে থাকতেও হবে। অত দিন ধরে বিদেশে পড়ে থাকলে হবে না।
শিরিন মেয়েটি একটুতেই হাসে। বিদিশার ভালো লাগে। শিরিন বলে,
– পশ্চিমবাংলা আমার বিদেশ মনে হয় না। একইরকম গাছ, একইরকম ছায়া, একই মানুষ আর একই ভাষা। এখানে থাকা আর যশোর বা ঢাকায় থাকা আমার কাছে সমান।
বিদিশার ভালো লাগে। সকালে সুষেণের জন্য যে চাপ জমেছিল, এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে যেন তার অনেকটা কমছে।

Zamindar House
পশ্চিমবাংলা আমার বিদেশ মনে হয় না। একইরকম গাছ, একইরকম ছায়া, একই মানুষ আর একই ভাষা

ডাক্তার আপা-র সঙ্গে কথা বলতে পেরে শিরিনেরও ভালো লাগে।
– জানেন আপা, আমার এক পরিচিতের বাড়ির উঠানে কামরাঙা গাছ আছে। আমার তো এমন ভোরে ওঠা অভ্যেস। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়িতে কিছু সময়ের জন্যে গিয়েছিলাম। একটা কাজও ছিল। গিয়ে দেখি উঠানে পাকা কামরাঙা ছড়িয়ে আছে। ঢাকা শহরে আজকের তারিখে এই দৃশ্য বিরল। পুরনো দিনের বাড়ির ফটকের কাছে গাছ বোনার একটা প্যাটার্ন থাকত, আমার পরিচিতের বাড়িতেও সেইরকম আছে।
বিদিশা বলে,
– ঠিকই বলেছ। আগের কলকাতাতেও এমন উঠোন, বাগান, গাড়ি-বারান্দা নিয়ে বাড়ি ছিল।
শিরিন বলে,
– আমি পুরো উঠোন বারান্দা, দরদালান ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। উঠোনের কোণে, মূল ফটকের কাছে দীর্ঘদেহী কামরাঙা গাছটা, কেমন বেহিসাবে ফল ফলিয়ে যাচ্ছে। পাকা হলদে হলদে কামরাঙা। আমাকে কয়টা পাকা কামরাঙা পেড়ে দিতে ওদের অনুরোধ করলাম। ওরাও সাগ্রহে দিল। ফেরার পথে কিছুমিছু বাজারও করার ছিল। সে সব সেরে বাড়ি ফিরে কুটনো কাটা, রান্না করা। ফ্রিজে রাখা ইলিশ মাছের মাথা ল্যাজা কানকো নামালাম। কেবল নিজের জন্য, হ্যাঁ কেবল নিজের জন্য রান্না করলাম কামরাঙা দিয়ে বেগুন ইলিশ। ফরিদ তো বেশি সময় অফিস ট্যুরে থাকে। পাকা কামরাঙাগুলো এত মিষ্টি ছিল, যে তরকারিটাই হাল্কা মিষ্টি হয়ে গেল।

 

আরও পড়ুন: স্বপ্না রায়ের কলমে: ফুল বলে ধন্য আমি

 

বিদিশা মন দিয়ে শুনছিল।
– তুমি রান্না করতে ভালোবাসো?
শিরিন হেসে বলে,
– ওই আর কী! ছেলে মেয়ে নাই। এইসব করে সময় কাটাই।
– বাঃ তাহলে তোমার হাতের রান্না খেতে হবে। আমি তো এখানে একাই থাকি। পরপর কয়েকদিন ডিউটি করে কলকাতা ফিরে যাই। 
শিরিন খুশি হয়।
– নিশ্চয়ই আপা, মনে হচ্ছে আমার বাসাও আপনার বাসার কাছে। 
এর মধ্যে ফরিদ ফোন করে। শিরিন তার দিনের হিসেব দেয়। ফোন শেষ হলে, দু’জনে উঠে দাঁড়ায়। বিদিশাকে তৈরী হয়ে বহির্বিভাগে বসতে হবে। হাসপাতাল ছোট হলেও সকালে লম্বা লাইন পড়ে। বিদিশা থাকার জন্য কাছাকাছি অঞ্চলের মেয়ে বৌ, বেশি দেখাতে আসে।

পরপর পঞ্চান্নজন পেশেন্ট একটানা দেখে চেয়ার থেকে ওঠে বিদিশা। কোমর ধরে গেছে। আয়া জয়িতা এসে বলে,
– দিদি আর একটু চা করে দিই?
বহির্বিভাগ থেকে উঠে নিজের ঘরে আসে বিদিশা। ঘরটা বড় অগোছালো। বিদিশা এটাকে নিজের বাসা ভাবতে পারেনি। আশা করে আছে, যে কোনওদিন বদলির অর্ডার চলে আসবে। সেই কটাদিন মাথা গোঁজার আস্তানা। 

চারদিনের পোশাক ব্যাগে করে নিয়ে আসে। প্রতিদিন একটা বার করে। আর বাসি পোশাক, দলা করে এক কোণে রেখে দেয়। সপ্তাহান্তে বাড়ি গিয়ে সব একসঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে ফেলবে। টেবিলে কয়েকটা বই, মেডিক্যাল জার্নাল, ওষুধের বাক্স, স্টেথো, বিপি মেশিন ডাঁই করা। সেখানেই চা দিয়ে গেছে। বিদিশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বড় বড় গাছের ফাঁকে অনেকটা রোদ এসে পড়েছে। হাসপাতালের উল্টো দিকে ওষুধের দোকান, চায়ের দোকান, কয়েকটা ভাতের হোটেল। 

কাজ করতে বিদিশার ক্লান্ত মনে হয় না। কাজ থেকে বেরিয়ে এলেই, একরাশ দুশ্চিন্তা চেপে ধরে। গহীনপুরের পোস্টিং নিয়ে ওপরমহলে চিঠি দিয়েছে। টানা আট বছর এই রকমই একটা গ্রাম, সুজাপুরের হাসপাতালে ডিউটি করে ভেবেছিল, এবার কলকাতায় বা কাছের মফসসলে বদলি হবে। অন্ততঃ ছেলেটার জন্য। দেবাশিস ওর হয়ে এতটুকু চেষ্টা করবে না। যেন, একসঙ্গে থাকতে না পারার ছুতো। সুজাপুরে থাকতে প্রথম কয়েক বছর, দেবাশিস প্রতিদিন রাতে একবার ফোন করত। এখন মনে পড়ে না, বিনা কাজে, কবে শেষ ফোন করেছে? বিদিশা নিজে থেকে প্রতিদিন সকালে একবার যোগাযোগ করে। ব্যাস ওইটুকুই। 

উঠোনের কোণে, মূল ফটকের কাছে দীর্ঘদেহী কামরাঙা গাছটা, কেমন বেহিসাবে ফল ফলিয়ে যাচ্ছে। পাকা হলদে হলদে কামরাঙা। আমাকে কয়টা পাকা কামরাঙা পেড়ে দিতে ওদের অনুরোধ করলাম। ওরাও সাগ্রহে দিল। ফেরার পথে কিছুমিছু বাজারও করার ছিল। সে সব সেরে বাড়ি ফিরে কুটনো কাটা, রান্না করা। ফ্রিজে রাখা ইলিশ মাছের মাথা ল্যাজা কানকো নামালাম। কেবল নিজের জন্য, হ্যাঁ কেবল নিজের জন্য রান্না করলাম কামরাঙা দিয়ে বেগুন ইলিশ।

ঘরে এসে পিঠ টান করে শুয়ে থাকে বিদিশা। দুপুরে আর কিছু খেতেই ইচ্ছে করছে না। একটা কৌটোতে ওটস আছে। একটা পাত্রে কিছুটা ওটস নিয়ে ইনডাকশান ওভেনে জ্বাল দিতে বসিয়ে দেয়। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, বিদিশা জানে না। দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, শিরিন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– একি তুমি?
শিরিন আবার সেই হাসিটা দিয়ে বলে,
– আমি আপনার পড়শি। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই ঘর দেখিয়ে দিল। 
শিরিন এক ঝলক দেখে বুঝতে পারে বিদিশার এখনও স্নান হয়নি, আর ইন্ডাকশান ওভেনের ওপর একটা পাত্রে ওটস ফুটে শুকিয়ে গেছে। ওই দিকে তাকিয়ে বলে,
– এটা বুঝি আপনার লাঞ্চ ছিল? চিন্তা করতে হবে না। আমি একটু মাছ ভাত নিয়ে এসেছি। আপনি মাছ খান তো?
বিদিশা কী বলবে বুঝতে পারে না। খুব ক্লান্ত মুখে বলে,
– একটু বসো। আমি স্নান করে আসছি। আমার ঘর খুব এলোমেলো, গুছোনোর সময় পাইনা। একটু কষ্ট করে বসো।

একটু একটু করে শিরিন ঘর আর ডেস্কটা গুছিয়ে ফেলে। কতকটা নির্মমভাবে সে অনেক কাগজ, ক্লিপ, ওষুধের ফয়েল, ভেঙে যাওয়া দুল, চুড়ি ফেলে দেওয়ার জন্য আলাদা করে রাখল। স্নান সেরে বেরিয়ে বিদিশা অবাক!
– বাবাঃ তুমি তো খুব কাজের মেয়ে দেখছি!
শিরিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
– আপা, এভাবে আর জঞ্জাল জমাবেন না। একেবারেই না। 
বিদিশা হাল্কা হাসি মেখে বলে,
– জীবনের জঞ্জালগুলো থেকে মুভ অন করা এতো সহজ না। টেবিলে না থাকলেও মনে রয়ে যায়। থেকে যায় কোনও নিউরনের সাব ডিজিট সিনপ্সিসে।

 

আরও পড়ুন: রতন সিদ্দিকীর ছোটগল্প: অপছন্দ

 

দু’জনে মিলে মাছ ভাত খায়। অনেকদিন পর এমন তৃপ্তি করে খায় বিদিশা। শিরিনের হাত ছুঁয়ে বলে, “আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে।” সেদিন শিরিন চলে যেতে, বিদিশা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রইল। মেয়েটা কোথা থেকে এসে, কেমন আপন হয়ে গেল। পরদিন বহির্বিভাগে রুগি দেখতে দেখতে বার বার লাইনের দিকে তাকাচ্ছিল। বিদিশা এখন অপেক্ষা করে থাকে, কখন শিরিন আসবে?

শিরিনের রিপোর্ট এসে গেছে। সেই অনুযায়ী বিদিশা ওষুধ লিখে দেয়। বিকেলে বিদিশার ঘরে শিরিন এসেছে। আজ বেশ সুন্দর করে সেজেছে। যদিও প্রতিদিনই শিরিনের পোশাকে চেহারায় একটা মার্জিত আবেদন থাকে। খুব উচ্চকিত নয়, ঝোপঝাড়ের আড়ালে গোপনে ফুটে থাকা বনফুলের মতো নরম তার আভা। শিরিন বলে,
– আপা, আজ আপনাকে সাজিয়ে দিই।
বিদিশা হেসে ফেলে।
– দূর পাগলি! আমার কী সেই সুযোগ আছে, না মানায়?
শিরিন জোর খাটিয়ে বলে,
– খুব মানায়! একবার দেখুন না।
এই বলে ওর ব্যাগ থেকে কিছু প্রসাধনের সামগ্রী বার করে আনে। আলতো করে চুল বেঁধে দেয়। আর বেলফুলের মালা চুলে জড়িয়ে দেয়। বিদিশা অবাক হয়ে বলে,
– এই সব কোথা থেকে জোগাড় করলে?
শিরিন ওর সেই সুন্দর দাঁতের সারি বার করে হাসে।
– আপা, প্রতিদিন তো চাঁদ বের হয় না। শুক্লপক্ষে তার উদ্ভাস দেখা যায়, তাতেও সময় সংক্ষিপ্ত। সেইটুকু সময়ের অনেকটা নিয়ে নেয় ট্রাফিক জ্যাম, দায়িত্ববোধ, আরও অনেক কিছু। মৃদু কিন্তু স্নিগ্ধ আলো হয়ে খোলা আকাশে আমাদের আর থাকা হয়না। আমরা ঘুরতে থাকি আমাদের গণ্ডিতে, ক্রমান্বয়ে ঘুরতেই থাকি। আমি তাই একটু সুযোগ পেলেই আলো হয়ে যাই, চাঁদের সঙ্গে দেখা করে আসি।

চারদিনের পোশাক ব্যাগে করে নিয়ে আসে। প্রতিদিন একটা বার করে। আর বাসি পোশাক, দলা করে এক কোণে রেখে দেয়। সপ্তাহান্তে বাড়ি গিয়ে সব একসঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে ফেলবে। টেবিলে কয়েকটা বই, মেডিক্যাল জার্নাল, ওষুধের বাক্স, স্টেথো, বিপি মেশিন ডাঁই করা। সেখানেই চা দিয়ে গেছে। বিদিশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।

এই বলে দু’জনে ঘর থেকে বার হয়। প্রথমে বিদিশার একটু লজ্জা করছিল। এই হাসপাতাল চত্বরে ওকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখে। চশমা আঁটা ডাক্তার দিদি। আজ কিশোরীর মতো দুজনে, পাতার মোড়কে ঢাকা পথে বের হয়। পায়ে পায় পুকুরটার কাছে যায়। আজ বোধহয় দ্বাদশী বা ত্রয়োদশী হবে। পুকুরের জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব। একটা নরম জ্যোৎস্নায় গাছগাছালি কেমন মায়াময় লাগছে। চাঁপা গাছেও ফুল হয়েছে। খোঁপার বেল ফুলের সাথে চাঁপার গন্ধ মিশে কেমন মন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিদিশা জিজ্ঞেস করে,
– ফরিদবাবু তোমায় খুব ভালোবাসেন, তাই না? 
শিরিন বলে,
– কী জানি? আমায় এখানে পাঠিয়ে দিয়ে এখনও আসার সময় করতে পারল না। 
– এবার কিন্তু তোমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। না হলে, ওষুধে কাজ হচ্ছে কিনা বুঝতে পারব না। 
শিরিন মাথা নিচু করে থাকে। বিদিশা বলে চলে,
– তোমার শরীরে তেমন কোনও অসুবিধা নেই। শিগগিরি তোমার ঘর আলো করে কেউ আসবে। তুমি কাকে চাও? ছেলে না মেয়ে?
ঘাটের ওপর দু’জন এসে বসেছে। চাঁদের আলোতে সিঁড়ির ওপর জল রুপোর পাতের মতো ঝকঝক করছে। শিরিন মুখ তুলে বলে,
– মেয়ে চাই। আপনার মতো মেয়ে, আপা, যে কিনা নিজের ক্ষমতায় সব জয় করে নিতে পারবে। 
– আমি আর কোথায় জয় করতে পারলাম? সব জায়গাতে হেরে বসে আছি। আমার যে একজন বর আছে, আমি ফোন না করলে বুঝতে পারি না। দেবাশিসের সঙ্গে কতদিন যে একসঙ্গে থাকি না কে জানে? প্রাণে ধরে ছেলেটাকে পৃথিবীতে এনেছি, সে যেন আমায় চিনতেই পারে না। আর এমন একটা চাকরি, ছেলেকে যে সময় দেব, তাও পারি না। এর পরে কোথায় জয় দেখলে?
– এবার আপনার বদলির অর্ডার ঠিক এসে যাবে, দেখবেন।
বিদিশা হাসে।
– তোমার কথা যেন সত্যি হয়। না হলে, আমায় অন্য বদলির ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সমস্ত সহ্যের সীমা পার করেছি। আর পারব না। 
শিরিন বলে,
– অন্য বদলি মানে?

 

আরও পড়ুন: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়ের কলমে: হারানোর পুজো

 

বিদিশা কিছু বলার আগেই ফরিদ ফোন করে। শিরিন ওকে ফিরে যাওয়ার কথা বলে। ওষুধ খেয়ে আবার দু’মাস পর আসতে হবে। ফোন রেখে শিরিন বলে,
– ফরিদকে আসতে না করে দিলাম। আমি একাই ফিরে যেতে পারব। পরেরবার ওকে নিয়ে আসব।
– পরেরবার হয়তো আমি এখানে থাকব না।
শিরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। ওর বড় বড় চোখের পাতায় চাঁদের কুচি লেগে আছে। বিদিশা বলে,
– বাঃ রে, আমার বদলির অর্ডারটা আসবে, বললাম না?
শিরিন বলে,
– ঠিক তো, ভুলেই গেছিলাম। তবে ফোন করে আপনি যে হাসপাতালে যাবেন, সেখানে গিয়েই দেখাব। 
– বেশ তাই হবে।

শিরিন যাওয়ার দিনে বিদিশাকে একটা কার্ড দিয়ে যায়। সেখানে লেখা, 

তাদের জন্য আমার করুণা হয় যারা নারী নয়। 
দুর্ভাগাদের জন্য আমার দুঃখ হয়, যারা নারী নয়। 
অবিশ্বাস্য এই শিল্প, অতুলনীয় শিল্প এই নারী, বিশ্বের বিস্ময়, বিচিত্রিতা। 
আমি নারী, বারবার চাই, শতবার চাই নারী হতে, নারী হয়ে জন্ম নিতে। সহস্র জন্ম চাই আমি, 
নারী জন্ম চাই।

বিদিশা বড় চোখে তাকিয়ে বলে,
– বাঃ কার লেখা?
– তসলিমা নাসরিন।
– ওঃ খুব সন্দর তো! আমি তেমন পড়ার সুযোগ পাই না আসলে।
– বেশ, পরেরবার আমি আপনার জন্য কয়েকটা বই নিয়ে আসব। 
বিদিশা কথা গুলো শুনে কেমন হারিয়ে যায়। তারপর বলে,
– আসলে মানুষ একরকম ভাবে, আর অন্যরকম হয়। কলেজে আমার সঙ্গে যখন দেবাশিসের দেখা হয়, তখন মনে হয়, ঠিক এমনটাই তো খুঁজেছি। আসলে, আমি নিজেকে স্যাপিওসেক্সুয়াল মনে করতাম। 
শিরিন জিজ্ঞেস করে,
– মানে? 
– মানে, মানুষ যখন কারও প্রেমে পড়ে তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সে চেহারা, বাহ্যিক সৌন্দর্য ইত্যাদি দেখে প্রেমে পড়ে। কিন্তু এমনকিছু মানুষ আছেন যারা চেহারা কিংবা শারীরিক সৌন্দর্য নয়, শুধু বুদ্ধিমত্তা দেখেই প্রেমে পড়েন, তারা। বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’।

আরও পড়ুন: শ্রাবণী রায় আকিলার কলমে: প্রবাসে পুজোর বাজার


বিদিশা বলে চলে,
– স্যাপিওসেক্সুয়ালদের প্রেম ও যৌনতার আবেদন জারিত হয় মস্তিষ্ককে নিয়ে। শারীরিক সৌন্দর্য বা সামাজিক অবস্থানের চেয়ে তাঁদের কাছে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায় অপরদিকের মানুষটির বুদ্ধিমত্তা। অপরদিকের মানুষটির গভীর চিন্তাশক্তি, কৌতূহলী মনোভাব, কৌতুকপ্রিয়তা, প্রচলিত ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার মানসিকতা, তাঁদের প্রচণ্ড আকৃষ্ট করে। মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক আলোচনা থেকে তারা রসদ সংগ্রহ করেন, এবং মনে করেন কারও যৌন আকর্ষণ শরীরে নয়, বরং তার মেধায় লুকিয়ে থাকে। তাই কখনওই সাজগোজ করা বা ভালো পোশাক পরা, এসবের কথা ভাবিনি। 
একটু থেমে বিদিশা বলে,
– একই কারণে স্যাপিওসেক্সুয়ালেরা কখনওই হুট করে প্রেমে পড়েন না। যেহেতু শারীরিক সৌন্দর্য তাঁদের টানে না, তাই প্রেমে পড়তে তাদের সময় লাগে। ফলতঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে বন্ধুত্ব হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও বৌদ্ধিক সংযোগ হলে তবেই আসে প্রেমের প্রশ্ন। মেধা বা বুদ্ধির আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি হলেও শারীরিক আকর্ষণ যে একেবারেই নেই, তা নয়। কিন্তু স্যাপিওদের কাছে শারীরিক আকর্ষণটা খুবই সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের জন্য কখনওই চেহারাটা বড়ো হয়ে দাঁড়ায় না তাদের কাছে। স্যাপিওদের কাউকে পছন্দ মানে, সত্যিই পছন্দ। 
– এর একটা কারণ, স্যাপিওদের সহজে কাউকে পছন্দ হয় না, অনেকটা সময় লাগে। উলটোদিকের মানুষটার সঙ্গে মেধা ও বৌদ্ধিক সংযোগ স্থাপনের পরই আসে তাকে ভালোলাগার প্রশ্ন। ফলে যখন কাউকে তাদের ভালো লাগে, তখন সেটা বেশ সিরিয়াসই হয়। স্যাপিওসেক্সুয়ালদের সব সম্পর্কই শুরু হয় বন্ধুত্ব দিয়ে, সেখানে প্রেমের ছিটেফোঁটাও থাকে না। তাই যখন প্রথম আমার মনে প্লেটোনিক স্তর পেরিয়ে প্রেমের সূত্রপাত হয়, তখন দেবাশিসও একইরকম ভাবছে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ফলে বহুদিন দেবাশিসকে মনের কথা বলব কি বলব না, তা নিয়ে আমার মনে সংশয় তৈরি হয়েছিল।

প্রথমে বিদিশার একটু লজ্জা করছিল। এই হাসপাতাল চত্বরে ওকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখে। চশমা আঁটা ডাক্তার দিদি। আজ কিশোরীর মতো দুজনে, পাতার মোড়কে ঢাকা পথে বের হয়। পায়ে পায় পুকুরটার কাছে যায়। আজ বোধহয় দ্বাদশী বা ত্রয়োদশী হবে। পুকুরের জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব। একটা নরম জ্যোৎস্নায় গাছগাছালি কেমন মায়াময় লাগছে। চাঁপা গাছেও ফুল হয়েছে। খোঁপার বেল ফুলের সাথে চাঁপার গন্ধ মিশে কেমন মন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিদিশা জিজ্ঞেস করে, ফরিদবাবু তোমায় খুব ভালোবাসেন, তাই না? 

শিরিন খুব মনযোগী ছাত্রীর মতো শুনছিল। বিদিশা বলে, 
– যারা অতিরিক্ত চিৎকার করে, মেজাজ দেখায়, কিংবা বোকামি করে, তারা স্যাপিওদের দু’চক্ষের বিষ। যারা নিজেদের অনুভূতিকে যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারে, যারা চট করে মেজাজ হারায় না, জটিল পরিস্থিতিকেও শান্তভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন, সেরকম মানুষকেই পছন্দ করে স্যাপিওরা। দেবাশিসকে আমার সে রকম মানুষই মনে হয়েছিল। 
– খুব বেশি মানুষের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় না সচরাচর। প্রেমের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সাধারণত নিজের ছোট বৃত্তেই থাকতে পছন্দ করি। তাই হয়তো আশপাশের অনেকেই আমাকে অহঙ্কারি বলে ভুল করে। তাই যখন দেবাশিসের সঙ্গে বিয়েটা হয়, ভেবেছি বোধহয় অঙ্কটা মিলল। কিন্তু পরে বুঝেছি, সুন্দরী হওয়াটা বা সাজগোজ করাটাও মেয়েদের একটা যোগ্যতা। দেবাশিসের আজকাল আমায় তেমন ভাবে মনেই পড়ে না।
শিরিন মাথা নিচু করে থাকে। বিদিশা একটু থেমে বলে,
– অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেলেছি। তোমার গাড়ি কখন?
শিরিন বলে,
– এই তো পাঁচটা নাগাদ বর্ডারের ওপারে গাড়ি পাঠাবে। আমার এখান থেকে সীমান্ত পার হতে বড় জোর এক ঘণ্টা লাগবে। বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর, বিদিশা যেন শিরিনের অভাবটা অনুভব করতে পারে। ওর সঙ্গে কয়েকদিন থেকে, মেয়েটা বিদিশার অভ্যাস পাল্টে দিয়ে গেল।

 

আরও পড়ুন: ইন্দ্রাণী দত্তের ছোটগল্প: রথসচাইল্ডের জিরাফ

 

ঢাকাতে ফিরে যাওয়ার পরেও শিরিনের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে যায়। ওকে নিয়মিত ওষুধের খবর দেয়, ব্যালকনির ছোট্ট বাগানে কী ফুল ফুটল, তার খবর দেয়। যেমনভাবে বিদিশা, ওকে আর ফরিদকে চলতে বলেছে সে সবের খবরাখবর জানায়, হোয়াটস্যাপে ছবি পাঠায়। বিদিশা সেই সব খবর পড়ে, তবে সবসময় ব্যস্ততার কারণে উত্তর দিতে পারে না। শিরিন লিখেছে
– পাশের বারোতলা বাড়ির কন্সট্রাকশনের ফলে আমার বারান্দায় অনেক গাছ মরে গেছে। বারান্দাগুলো একেবারে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আমার স্টাডিরুমটাও ভীষণ অন্ধকার হয়ে গেছে।  এ ঘরে আসলে বড্ড ডিপ্রেসিং লাগে। আজ ডেস্ক, আলমারি, সাইড টেবিল। সব কিছু গুছিয়ে শীতল পাটি পেতে বিছানায় বসে রইলাম কিছুটা সময়। আপা আপনার কি বদলির খবর এলো?

বিদিশার জীবন এখনও একটা স্যুটকেস নির্ভর হয়ে আছে। সোমবার আসে, স্যুটকেস খোলে, টানা কয়েকদিন ডিউটি করে আবার বৃহস্পতি কী শুক্রবার ফিরে যায়। দেবাশিস যে ওই দিনগুলো বাড়ি ফিরতে পারে তা নয়, হয়তো চায়ও না। সুষেণ একইরকম আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। মা এলো, কি এলো না, ওর কিছু এসে যায় না। জয়মালা বুক দিয়ে একমাত্র সেতুটিকে আগলে রাখে। বিদিশা বুঝতে পারে, তার ক্ষয় হচ্ছে। খুব ধীরে হলেও অবধারিত সেই ভাঙন। নিজে থেকে একবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়। তিনি কিছু ওষুধ খেতে বলেন। বিদিশার উদ্যোগী হয়ে সে ওষুধ খাওয়া হয় না।

শিরিন খেয়াল করে, এ মাসে তার তারিখ পার হয়ে গেছে। ফরিদকে এখনও কিছু বলেনি। নিজে নিজে ফার্মেসি থেকে প্রেগনেন্সি দেখার কার্ড নিয়ে এসেছে। সকালে চানঘরে গিয়ে, কার্ডে দুটো দাগ আবিষ্কার করে চোখে জল এসে গিয়েছে। খবরটা প্রথমে বিদিশা আপাকে দিতে হবে। অনেকবার ফোন করে, কিন্তু ফোনটা ‘নট রিচেবেল হয়ে আছে। খুশির খবরটা ফোন করে জানাবে ভেবেছিল। শেষে বাধ্য হয়ে হোয়াটস্যাপে লেখে। কিন্তু উত্তর তো আসেই না, উপরন্তু লক্ষ্য করে মেসেজ ডেলিভারির সঙ্কেতও দেখায় নি। খবরটা এখন ফরিদ জানে। নিজেই বলেছে আপার সঙ্গে দেখা করে আসবে। অন্ততঃ প্রথম তিনমাস শিরিনকে কোথাও বেরতে দেবে না। যতটা পারছে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। 

যারা নিজেদের অনুভূতিকে যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারে, যারা চট করে মেজাজ হারায় না, জটিল পরিস্থিতিকেও শান্তভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন, সেরকম মানুষকেই পছন্দ করে স্যাপিওরা। দেবাশিসকে আমার সে রকম মানুষই মনে হয়েছিল। খুব বেশি মানুষের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় না সচরাচর। প্রেমের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সাধারণত নিজের ছোট বৃত্তেই থাকতে পছন্দ করি। তাই হয়তো আশপাশের অনেকেই আমাকে অহঙ্কারি বলে ভুল করে। তাই যখন দেবাশিসের সঙ্গে বিয়েটা হয়, ভেবেছি বোধহয় অঙ্কটা মিলল। 

সেদিনও এক চাঁদের রাত। শহরে বাস করে আকাশকে তেমন করে পাওয়া যায় না। তবু তার মধ্যে যতটুকু ধরা দেয়, তার জন্যে নিজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় শিরিন। হঠাৎ করে খেয়াল করে, বিদিশাকে করা ওর মেসেজ ডেলিভারি হয়েছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা খবর আসে,

“অত্যন্তঃ দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, গত সোমবার গহীনপুরে ডাঃ বিদিশা আমাদের ছেড়ে চলে যান। আপনার চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও তথ্যের জন্য আপনাকে সরাসরি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।”

মুহূর্তে শিরিনের চতুর্দিক কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নীচ দিয়ে অবিশ্রান্ত গতিতে গাড়ি বয়ে চলেছে সময়ের এক কোটর থেকে অন্য কোটরে। শুধু পড়ে থাকে মানুষের উষ্ণতার স্মৃতি। অতি শূন্যতার মাঝে শিরিন নিজের পেটের ওপর হাত দিয়ে অনুভব করে, নতুন মানুষের আগমনী। বিদিশার ভালোবাসাতে ভরিয়ে সে আসছে, নতুন করে গড়ে তুলবে শিরিনের সংসার। আর অনেক দূরে বিদিশার সবকটা ভেঙে যাওয়া স্বপ্নেরা পড়ে থাকবে, তাদের অপূর্ণতাকে পাথেয় করে।

 

*ভেতরের ছবি: Wikipedia

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com