banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

অতিমারী ও প্রকৃতি-বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু (প্রবন্ধ)

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

অতিমারীর সঙ্গে যুদ্ধ   

যুদ্ধ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়? মানুষ যুদ্ধ করে চলেছে এই অতিমারীর সঙ্গে। দেশে দেশে সভ্যতার সব রকম দুর্বলতা কুৎসিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে এই যুদ্ধে। সামাজিক অসাম্য, অর্থনৈতিক অসাম্য, স্বাস্থ্যখাতের কম বরাদ্দ, বৈজ্ঞানিক গবেষণাখাতের কম অর্থবরাদ্দএ সব দুর্বলতা নিয়ে মানুষ মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। যুদ্ধের মাটিতে একযোগে লড়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। নিজের ঘরে বন্দি থাকা, যুদ্ধের প্রধান কৌশল। 

মানুষ নিজের ঘরে বন্দি থাকলে প্রকৃতিতে কী ধরনের বদল আসতে পারে, সেটা দেখতে পাচ্ছি। আশ্চর্যজনক ভাবে বদলে গেছে পৃথিবীর বাতাস, আবহাওয়া। অনেক জায়গায় দূষণ কমে গেছে। আবহবিদরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই কোয়ারান্টাইন হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে বাতাসের চরিত্র নিরূপণের জন্য। তার মানে কি বাতাস অতি সুবোধ বালক? ‘মানুষনামক বখে যাওয়া বদমাশের পাল্লায় পড়েই পৃথিবীর বাতাসের এই দূষিত দশা?

বাতাস শুদ্ধ হচ্ছে     

বাতাসের এই শুদ্ধিকরণের ব্যাপারটা নাসার উপগ্রহ চিত্রে প্রথম ধরা পড়েছিল চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে চিনের আকাশে, যখন সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে জেরে চলছিল লকডাউন। এই প্রথম এত বিশাল এলাকা জুড়ে দূষণ একেবারে কমে যাওয়ার মত একটা নাটকীয় ঘটনা আমি দেখতে পাচ্ছি!বলেছিলেন ফেই লিউ; বাতাসের গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করছেন এই বিজ্ঞানী নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে। লিউ আরও জানান, অতীতে যে এ রকম দূষণ কমে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটেনি, এমন নয়। ঘটেছিল একবার। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময়। কিন্তু এ বারের মত ব্যাপক এবং বিশাল এলাকা জুড়ে বাতাস একেবারে পরিষ্কার দেখানোর মত ঘটনা অতীতে ঘটেছে বলে মনে করতে পারছেন না লিউ।

ওই সময়ে প্রতিবছর চিনে নববর্ষ পালিত হয়। স্কুল কলেজ কলকারখানা ছুটি থাকে, অতএব ওই সময়ে ফি বছরই বাতাস একটু পরিষ্কার হয়। কিন্তু এবারের ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। নববর্ষের উৎসব নয়, মানুষ ভাইরাসের আতঙ্কে একেবারে ঘরবন্দি ছিল সে সময়। ফলে বিশাল এলাকা জুড়ে গাড়িঘোড়া, কলকারখানা সবই বন্ধ ছিল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত গ্যাস, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি একেবারেই বেরোয়নি। ফলে বাতাস ধীরে ধীরে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠছিল। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়া, শিল্পাঞ্চল, কলকারখানা থেকে নির্গত দূষণবিষ কমে যাওয়ার ঘটনা অবশ্য এরপর আর শুধুমাত্র চিনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। করোনার আক্রমণ ক্রমে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, ভারত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, মানুষ লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং সারা পৃথিবীর বাতাসই পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

তেল পুড়লে তবে রাধা নাচে। এই প্রবাদের সঙ্গে অর্থনীতির সরাসরি যোগ আছে কিনা জানা নেই, তবে যে দেশ যত বেশি তেল পোড়ায়, তার অর্থনীতি তত শক্তিশালী। কোন দেশ তেল বেশি পুড়িয়ে বাতাস নোংরা করছে, সে খবর চেপে রাখা যায়না। উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়ে দূষিত বাতাসের জন্য সেই দেশে বদলে যাওয়া আকাশের রং। আজ যখন প্রায় সারা পৃথিবী গৃহবন্দি, তেল পুড়িয়ে বাতাস নোংরা করতে পারছে না কেউই! 

প্রকৃতি ফিরছে নিজের ছন্দে       

মানুষের মৃত্যুমিছিল বেড়ে চলছে পৃথিবীতে, কিন্তু মানুষকে বাদ দিয়ে প্রকৃতির বাকি অংশ কি তাহলে আপন  ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে? যে বদল প্রথমে শুধুমাত্র নাসার উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছিল, আজ সেই বদল মানুষ নিজের চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে মাথার উপরে দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে আকাশের নীল, দূষণমুক্ত মেঘের চেহারাফুসফুস ভরে নিতে পারছে বিশুদ্ধ বাতাস! বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডের মত ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ প্রায় চল্লিশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হাঁপানি, হৃদযন্ত্রের এবং ফুসফুসের অসুখ হওয়ার মূল কারণটি অপসারিত হয়েছে।  

Har ki pouri
হরিদ্বারের হর কি পৌরিতে দেখা গিয়েছে দূষণহীন গঙ্গার জল। ছবি – psuconnect.in

মার্চের মাঝামাঝি থেকেই উড়ান চলাচল সারা পৃথিবীতে কমেছে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। যান চলাচল কমেছে সত্তর শতাংশের বেশি। এই অতিমারীর সময়ে একেবারে কমে যাওয়া কালচারাল নয়েজ’-এর কথাও বলছেন ভূকম্পন- বিশারদরা। সভ্যতার লাফঝাঁপ, কাঁপুনি- এসব কম নয়। যান-চলাচলে মাটি কাঁপে, খনিগর্ভের খননে, রাস্তা তৈরির জন্য ডিনামাইট বিস্ফোরণে মাটি কাঁপে। এখন সে সব কিছু স্তব্ধ। কাজেই ভূকম্পন-বিশারদরা যে সমস্ত কম্পন এই সময়ে রেকর্ড করছেন সেখানে মানুষের অবদান নেই বললেই হয়। পুরোটাই প্রকৃতির নিজস্ব। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, কার্বন-বাজেট হ্রাস করে এবং জৈব বা জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া পৃথিবীর চেহারা কেমন হতে পারে, আমরা হয়তো তার একটা ঝলক দেখছি। মানুষ আজ নাহলেও কাল করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে যাবে; ভ্যাক্সিনের সফল প্রয়োগ এখন সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু পরিবেশ? তার কী হবে? করোনা-যুদ্ধে জিতে মানুষ কি আবার ফিরে যাবে দূষিত বাতাসের পৃথিবীতে? দীর্ঘমেয়াদী যে পরিকল্পনা, পরিবেশ দূষণ দূর করবার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সেগুলির কি বিশেষ কোনও পরিবর্তন হবে? প্রকৃতির থেকে, প্রকৃতির জন্য সভ্যতা তথা মানুষ কী ভাবে শিক্ষা নেবে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে, এটাই এখন বিশ্বব্যাপী একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।

জীবনযাত্রার বদল কতটা স্থায়ী হবে?

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, যে এই বিশ্বব্যাপী লকডাউনের ফলে বিরাট ধাক্কা খেতে চলেছে জৈব জ্বালানির বাজার। তেলের দাম তলানিতে। গাড়ি বিক্রি কমে গিয়েছে তার আগে থেকেই। লকডাউনের ফলে বহু মানুষ বাড়িতে বসে কাজ করছেন। প্রচুর বেড়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম।  অফিসের কাজকর্ম, স্কুলে-কলেজে পড়াশুনার ক্লাস, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বৈঠক সবই চলছে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে। অতএব যানবাহনের চেয়েও এখন মানবজাতির প্রধান প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেট। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা ততখানি কঠিন হয়ে উঠছে না ইন্টারনেটের দরুণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন পরবর্তী সময়েও ইন্টারনেটের সর্বব্যাপী প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো কমে আসবে তেলের চাহিদা। যদি সেটাই হয়, তাহলে অবশ্য প্রকৃতির জন্য ভালো খবর। তেল কম পুড়লে মানুষের কার্বন বাজেটও কমবে। গত একশো বছর ধরে প্রকৃতিকে নষ্ট করার পাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে সভ্যতা।

দূষণবিষের নিঃসরণ সারা বিশ্বে নজিরবিহীনভাবে কমে গিয়েছে!বলেছেন রব জ্যাকসন, গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্টের চেয়ারম্যান… বেশিরভাগ এলাকায় পরিবেশ দূষণ কমে গিয়েছে। কত তাড়াতাড়ি বাতাস পরিষ্কার হয়ে প্রকৃতির পুনর্নবীকরণ সম্ভব, তা বুঝবার একচিলতে সুযোগ দিয়েছে এই ভাইরাস।কিন্তু একইসঙ্গে তিনি এও বলছেন যে, এই সুযোগের বিনিময়ে অনেক বড় মূল্য দিতে হল মানুষকে। চলে গেলো অজস্র প্রাণ; এছাড়াও আবহাওয়ার এই যে হঠাৎ ভীষণ ভালো হয়ে ওঠা, এই ব্যাপারটা হয়তো বা সম্পূর্ণ সাময়িক! … বিষাক্ত নিঃসরণ কমে যাওয়ায় আমি বিশেষ আহ্লাদিত হতে পারছি না, কারণ শুধু প্রাণ যাওয়াই নয়, অজস্র মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন এবং হারাবেন এই লকডাউনে। বিভিন্ন ধরনের শক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে আমাদের পরিকাঠামো আরও উন্নত করা প্রয়োজন, নচেৎ আবার পরিবেশ দূষিত হয়ে যাবে।’  

বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য, পরিবেশকে বিষমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ এতদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল, ফাইলবন্দি হয়েছিল লাল ফিতের ফাঁসে; এই অতিমারীর জন্য প্রায় এক ধাক্কায় সরে গেল সে সব বাধা। হয়তো এ রকম একটা অবস্থার কথাই বলতে চেয়েছিলেন কানাডিয়ান লেখক তথা সমাজ-কর্মী নাওমি ক্লাইন তাঁর শক ডকট্রিন; দ্য রাইজ অফ ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজমবইটিতে। তিনি লিখেছিলেন, কী ভাবে জাতীয় সংকটকে কাজে লাগিয়ে সারা বিশ্বে শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণী পরিবেশ ও শ্রমের অধিকারের ব্যাপারে চরম পদক্ষেপ করতে পারে।  

কিন্তু সারা বিশ্বে লকডাউন শিথিল হয়ে গেলে আবার কী হতে পারে, তার আঁচ আমরা এখন থেকেই পাচ্ছি। তখন দ্বিগুণ বিক্রমে সভ্যতা আবার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবার চেষ্টা করবে এবং তার প্রস্তুতি অনেক দেশেই শুরু হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে মানুষ অতীতের শিল্পোদ্যোগের পুরনো রাস্তা ছেড়ে চট করে অন্য কোনও নতুন রাস্তা নিতে পারবে না। ফলে পরিবেশ আবার সাঙ্ঘাতিক বিষাক্ত হয়ে উঠবে। মার্চের শেষে চিনের উহানের আকাশের যে উপগ্রহ চিত্র পেয়েছেন নাসার বিজ্ঞানীরা, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে দূষণ বাড়ছে আবার।           


বন্যপ্রাণী ও মানুষ

পরিবেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লকডাউনে আরও একটা জিনিস লক্ষ করা গিয়েছে, তা হল বন্যপ্রাণীরা নিজেদের হারিয়ে যাওয়া বাসস্থান পুনরুদ্ধার করতে নেমেছে। ইতালিতে ভেনিসের জলপথে নাকি ফিরে এসেছে ডলফিন। উড়িষ্যার উপকূলে বহুদিন পরে এসে ডিম পেড়ে যাচ্ছে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, দিল্লির রাজপথে ঝাঁক বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে ময়ূর, জাপানে কিম্বা লন্ডনে রাজপথে প্যারেড করে যাচ্ছে হরিণএ সব দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। তবে এইসব ছবির মধ্যে অনেকগুলিই সত্যি নয়। কিছু সত্যি। মানুষের প্রচণ্ড দুর্দশার মধ্যে এ যেন অদ্ভুত মজা! কার্টুনিস্টরা এমন ছবি আঁকছেন, যেন পর্যটক বন্যপ্রাণির দল শহরে এসেছে ঘরবন্দি মানুষদের দেখতে, যে ভাবে মানুষ সাধারণত চিড়িয়াখানায় জন্তুজানোয়ার দেখতে যায়! এমনও শোনা যাচ্ছে যে মানুষপ্রাণিটির মেয়াদ এখন এই গ্রহে শেষ হওয়ার মুখে প্রায়। এইসব মতবাদে কিম্বা কার্টুনের মজায় তাৎক্ষণিক হাসি পেলেও মহাপ্রলয় আসন্ন জেনে আমরা খুশি হতে পারছি কই? যদিও অনেকেই ভাবতে পারেন যে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলে কিম্বা লকডাউনের ফলে প্রকৃতির লাভ বই ক্ষতি হবেনা। কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে অনেকে এরকম কথাও বলছেন যে, তাহলে কি প্রকৃতিকে সুস্থ রাখার জন্য, পরিবেশের দূষণ কমাবার জন্য মাঝেমাঝেই লকডাউন করা প্রয়োজন?      

ঠিক এই জায়গাটাতেই কিছু কিছু পরিবেশবিদ আপত্তি জানাচ্ছেন। তারা বলছেন যে এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই যে লকডাউনের ফলে প্রকৃতির এবং পরিবেশের প্রভূত উন্নতি হবে। ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা ইন্টারন্যাশনালসংস্থার সচিব ম্যাট ওয়ালপোল বলেছেন, অর্থনীতির সংকটের ফলে প্রকৃতির কল্যাণ হবে, সাময়িক ভাবেও এরকম ভাবনা অত্যন্ত বিপজ্জনক!

কেন? 

ওয়ালপোলের মতে, বড়লোক দেশ, কিম্বা শিল্পাঞ্চলে সাময়িক কিছু উন্নতি চোখে পড়তে পারে। কিন্তু গরিব দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ গোলার্ধে মানুষ, বন্যপ্রাণি, প্রকৃতিসবার জন্যেই অভিশাপ বয়ে এনেছে এই অতিমারী। লকডাউনের ফলে গরিব দেশ আরও গরিব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ফলে সেই দেশের অরণ্যভূমি, বন্যপ্রাণ, বিরল প্রাণি সংরক্ষণের জন্য যে টাকাকড়ি প্রয়োজন, সেই ভাঁড়ারে টান পড়াই স্বাভাবিক। আমাজনের জঙ্গলে পরিবেশ কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং সুরক্ষা জোরদার করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাসাইমারা এবং সেরেঙ্গেটির জঙ্গলে পর্যটকের ভিড় কমায় আয় কমে গিয়েছে; রেঞ্জারদের বেতন দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। জঙ্গলে সুরক্ষা না থাকলে বেআইনি চোরাশিকার, খননকাজ এসব বেড়ে যেতে পারে; মানুষের হাতে পর্যাপ্ত কাজ না থাকলে বেআইনি কাজকর্ম বেড়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়।

সব মিলিয়ে লকডাউন যে প্রকৃতির জন্য পুরোপুরি মঙ্গলের ব্যাপার, সে ভাবে না ভাবাই ভালো। এছাড়াও অনেক প্রাণি আছে, যারা মানুষের দেওয়া খাবারের উপরে নির্ভরশীল। শহরে বন্যপ্রাণ ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেক জায়গায়, কারণ যে মানুষ তাদের খাবার যোগাত, আজ তারা ঘরবন্দি। জাপানের নারা শহরে হরিণদের পর্যটকরা খাবার দিতেন। আজ পর্যটক নেই। তারা রাস্তায় ঘুরছে, যদি কেউ খেতে দেয় সেই আশায়। ভারতেও শহর গ্রাম নির্বিশেষে রাস্তার কুকুর-বেড়াল মানুষের দেওয়া খাবারের উপরেই নির্ভরশীল। লকডাউনের ফলে সেই খাবারেও টান পড়বে। সব মিলিয়ে প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখা মুশকিল হবে।

দূষণ কমেনি  

অতিমারীর জন্য পরিবেশের ক্ষতির অন্যতম কারণ, সাঙ্ঘাতিকভাবে বেড়ে যাওয়া প্লাস্টিক এবং মেডিকাল বর্জ্য। দেশে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য যে সচেতনতার প্রসার ঘটাবার চেষ্টা চলছিল, তা একেবারে জলে গেল বললে ভুল হবে না। আক্রান্ত দেশগুলিতে প্রায় চার পাঁচগুণ বেড়ে গেছে মেডিকাল বর্জ্যের পরিমাণ, যার মধ্যে প্লাস্টিকের অংশ নেহাত কম নয়। এছাড়াও ভাইরাসের ভয়ে এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে আবার বেড়ে গেছে ইউজ অ্যান্ড থ্রোব্যাগের ব্যবহার। মানুষ ঘরে বসে অনলাইন বাজার করছেন অনেক বেশি, ফলে প্যাকেজিং- ইত্যাদিতে ব্যবহৃত কাগজ, পিচবোর্ড, প্লাস্টিক সবকিছুর ব্যবহার বেড়ে গেছে একধাক্কায়। সভ্যতা ভেবেছিল কাগজের ব্যবহার কমিয়ে ফেলবে, যাতে গাছ কম কাটা পড়ে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে চেয়েছিল, কারণ প্লাস্টিক ধ্বংস করা যায় না, মাটিতে মেশে না। মাটি, জল সব নষ্ট হয় প্লাস্টিক বর্জ্যে। অতিমারী সভ্যতার সব সংকল্প ধুলোয় মিশিয়ে দিল।          

তেল পোড়েনি, এটা ঠিক। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রয়োজনীয় শক্তিটুকুও কিন্তু প্রকৃতিকে উত্যক্ত না করলে মেলে না। ইন্টারনেটের ব্যবহার সাঙ্ঘাতিক বেড়ে যাওয়ার ফলে লকডাউনে মানুষ গাড়ি চালানো বন্ধ করে, নিজের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে যে পুণ্যটুকু অর্জন করেছিল, সেখানে কিছুটা হলেও কালির ছিটে লাগল বৈকি। এছাড়া ওয়াটার ফুটপ্রিন্টের হিসেব তো ছেড়েই দিলাম এখন। বারে বারে হাত ধুয়ে, কাপড় কেচে, বাড়ি ঘর ধুয়ে মুছে সুস্থ থাকার জন্য জলের ব্যবহার মানুষ এখন কমাতে পারবে না। কাজেই সে হিসেব করার সময় এখন নয়।

দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ      

খাদ্যদ্রব্য, অবশ্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা না কমলেও লকডাউনের ফলে মানুষ বাধ্য হয়েই নিজের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমিয়ে এনেছে। অর্থনীতিতে এবং প্রকৃতির উপরে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব জানবার জন্য অবশ্যই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য এই বছরের শেষ দিকে গ্লাসগোতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের যে কনফারেন্স হওয়ার কথা ছিল, তা আপাতত স্থগিত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নেতা, বৈজ্ঞানিক এবং সক্রিয় পরিবেশকর্মী, সবার মতে, পরিবেশবান্ধব জীবিকা এবং স্বচ্ছ শক্তির উৎস সন্ধানে দ্রুত জনমত গঠন করা প্রয়োজন। অতিমারীর পরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর উন্নতিসাধনের প্রধান লক্ষ্য এমন হওয়া জরুরি, যা প্রকৃতির হাত ধরে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। 

লস অ্যাঞ্জেলেস শহর থেকেই স্পষ্ট পিছনে সান গ্যাব্রিয়েল পাহাড়ের বরফঢাকা চুড়ো। ছবি সৌজন্য – getty images

একটা বিরাট রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে।’ এ প্রসঙ্গে বলেছেন ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের মুখ্যসচিব লরেন্স টুবিয়ানা, যিনি প্যারিস চুক্তির রূপকার। এই চুক্তিতে গতানুগতিক ব্যবসায়িক অর্থনীতির বদলে, যাতে বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবেশবান্ধব জীবন ও জীবিকা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ব্রতী হয়, সেই বিষয়ে অগ্রগণ্য বিজ্ঞানীরা সমবেতভাবে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।  

শেষ পর্যন্ত, অতিমারী এবং লকডাউনের সবচেয়ে জরুরি পরিবেশগত প্রভাব নিহিত আছে মানুষের ধ্যানধারণার মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করা এবং রাজনৈতিক লাল ফিতের ফাঁসে আটকে যথাসময়ে প্রকল্প রূপায়িত না হওয়ার মাশুল কী মারাত্মকভাবে দিতে হচ্ছে আজ মানুষকে! বন্যপ্রাণী চোরাশিকার, চোরাচালান এবং অরণ্যভূমি নষ্ট করার শাস্তি হিসেবেই প্রাণি থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটেছে এই মারণ ভাইরাসের। পৃথিবীতে বন্যপ্রাণি মাংসের সর্ববৃহৎ বাজার আছে চিনে। আপাতত চিন এ ধরণের কেনাবেচা বেআইনি ঘোষণা করলেও, মানুষ আপনা থেকে যদি সতর্ক না হয়, হয়তো আরও কোনও বিপদ অপেক্ষা করছে তার জন্য।                    

দূষণ যে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, অতিমারীর ফলে তা প্রমাণিত। দূষণের বিষ ইতিমধ্যেই মানুষের ফুসফুস এবং শ্বাসযন্ত্রকে দুর্বল করে রেখেছে, ফলে এই করোনাভাইরাস বিরাট বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের জন্য, এই তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মুখ্য পরিবেশবিদ ইঙ্গার অ্যান্ডারসন বলেছেন, যদি আমরা পৃথিবীকে অবহেলা করি, তাহলে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনব।

মানুষের কাছে সুযোগ         

অতিমারীর দুর্যোগের শুরুতে কেবলমাত্র মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে অন্যরকম দেখিয়েছে, এমন নয়। লকডাউনের ফলে অনেক অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে। মানুষের অবস্থান বদলেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক উদারপন্থী সরকার বাধ্য হয়েই মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন। জনস্বাস্থ্যের খাতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়া জরুরি ছিল, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর অনেক দেশেই। সবচেয়ে জরুরি হল, রাজনৈতিক ভাবনার কেন্দ্র ব্যক্তিবিশেষের বদলে সমষ্টির ভালো থাকা এবং প্রয়োজন ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তন কিম্বা বিপ্লব সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হয়তো অনেকখানি বদলে যাবে অতিমারী-পরবর্তী পৃথিবীতে। গতানুগতিক পুরনো ব্যবসায়িক শিল্পের পথ ছেড়ে সভ্যতা যদি পরিবেশবান্ধব প্রকৃতিনির্ভর শিল্পের এবং শক্তির উৎসের দিকে পা না বাড়ায়, প্রকৃতি তথা মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির কোনও লক্ষণ দেখা যাবে না।

এই অতিমারী প্রকৃতি এবং পরিবেশের জন্য ভালো না খারাপ, সেটা ভাইরাসের উপরে নিশ্চিত ভাবে নির্ভর করবে না, নির্ভর করবে মানুষের উপরে। আজ সব মানুষ সমান!বলেছেন দলাই লামা। একই ভয়, একই আশা, একই রকম অনিশ্চয়তা অনুভব করছি আমরা; তবুও আমরা সুখের আকাঙ্ক্ষায় এক হয়েছি। বিষয়টার বাস্তবতা বুঝে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারবে মানুষ। এই কষ্টকে সুযোগে রূপান্তরিত করবার মত ক্ষমতা মানুষেরই আছে।আজ দলাই লামার সুরে সুর মিলিয়ে সমবেত প্রার্থনায় আমরা চাই, যে এই যুদ্ধে জিতে মানুষ নিজের দক্ষতা প্রমাণ করুক। এই যুদ্ধ দুর্যোগ নয়, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আজ মানুষের কাছে এক বিরাট সুযোগ।           

তথ্যসূত্র; ‘স্পেসপত্রিকা,  ‘গার্ডিয়ানপত্রিকা

জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com