banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

একের মধ্যে এক সহস্র…

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Mediterranean - The Melting pot of Food Habits

“…food is first and foremost a constituent theme of human identity rather than of a regional or national identity”
– Mohammed Yassine Essid-

আমার এই এতটুকু একপাতা জীবনে উপার্জিত প্রতিবেশীদের নিয়ে ভাবতে বসলেই দিন কেটে যায়; একে একে পরপর ভেসে ওঠে অনেকগুলো ছবি। শুনেছি ছোটবেলায় গড়িয়ার বাড়ির একতলায় বারান্দার রোদ্দুরে শুইয়ে মা যখন তেল মাখাতেন, এক আধটা শেয়াল নাকি গেটের বাইরে সিড়ির উপর শুয়ে ল্যাজ নাড়ত। কী তাদের মতলব তা বলা শক্ত, তবে সাদা মনে কাদা না রেখে ভাবলে মনে হয়, তারাই বোধহয় আমার প্রথম প্রতিবেশী। এরপর বাড়ির সামনের পুকুর বুজে একের পর এক পরিবারের আগমন- তারা আমার পাড়া প্রতিবেশী। পাড়া ছেড়ে বেরলে এলাকা, এলাকা ছাড়ালে অঞ্চল, অঞ্চল ছাড়ালে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি-রাজনীতি-শহর। আমার সঙ্গে আমার প্রতিবেশীর বৃত্তও দিনে দিনে নেহাত কম বড় হয়নি।

আর আজ এই মাঝবয়সের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে বিগত দশকের প্রবাসযাপনের দিকে তাকালে মনে হয়, গোটা পৃথিবীটাই এক বিরাট আড্ডাখানা। আমার মন-জোড়া বৈঠকখানায় পাড়া-শহর-রাজ্য-দেশ-জগৎজোড়া প্রতিবেশীর কেউ না কেউ রোজ-কে-রোজ বসে আড্ডা দিয়ে যায়। এই যেমন এখন, ভূমধ্য সাগরের গা ঘেষে দক্ষিণ ফ্রান্সের বুকে যে কাফেটায় বসে এসব আকাশকুসুম ভাবছি, তার আশেপাশের সুন্দর মানুষগুলোর কেউ হাসছে, কেউ ঝগড়া করছে, কেউ বা আমার পাগলামো লক্ষ্য করে সন্দিগ্ধ চোখে মেপে নিচ্ছে! হাজারো মুখের হাজারো আবেগ, আর সেই চোখে-চোখ পড়া আড্ডায় আমরা সবাই তো প্রতিবেশীই হলাম?

এখন প্রশ্ন হল, শুধুমুখে কি আড্ডা জমে? এই যে ক্যাপুচিনোটা কখন শেষ হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি? কিম্বা পাশের টেবিলের ‘ম্যাডমোয়াজেল’ তাঁর সাধের “কিশ”-খানা চট করে শেষ হয়ে যাওয়ায় যে মোটেই খুশি হননি, তাঁর বিরক্তিমাখা চাহনিতে তা স্পষ্ট। কাজেই সে কথাটাই হবে, তবে তার আগে আর এক কাপ কফি নিয়ে আসি, দাঁড়ান!

মেডিটারেনিয়ান ডায়েট! খায় না মাখে?

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইস্তানবুল আসা ইস্তক বিগত নয় বছরে কাজ বা অকাজে ইউরেশিয়ার যে সমস্ত শহর বা দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তার বেশিরভাগই ভূমধ্যসাগর উপকূলবর্তী। মাঝে কিছু দিন জার্মানির হাওয়া খেয়েছি ঠিকই, কিন্তু আবহাওয়া, এক আকাশ উষ্ণতায় ভরা মানুষ এবং মূলত খাবার আমায় ফের ভূমধ্যসাগরের তীরেই নিয়ে এসে ফেলেছে। এবং নিজের বিজ্ঞানগবেষণা বাদ দিলে যেটুকু সময় বাঁচে, তা দিয়ে আমি প্রাণপণে সেই রন্ধনশৈলীর নির্যাসের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছি। 

তাতেই বুঝেছি, ইউরেশিয়ার (আমার মতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও) ইতিহাস জুড়ে একের পর এক কোন্দল ও যুদ্ধের প্রতিপক্ষ অথবা সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলো নিজেদের দৈনন্দিন অভ্যেসের মাধ্যমে কোথায় যেন একাত্ম হয়ে যায়। যুগের পর যুগ ধরে নিজের মতো করে বিবর্তিত প্রতিবেশী সভ্যতাগুলো রাজনৈতিক কাজকর্মের পদ্ধতি, শিল্পকলা, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে যতই আলাদা হোক না কেন, খাদ্যরীতি, ও রন্ধনকৌশলের অভিন্নতা তাদের একই সুতোয় বেঁধে রেখেছে। তবে সেক্ষেত্রেও তাদের দৈনন্দিন দিনযাপন, ভৌগোলিক বিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস, ধর্ম, কৃষি উৎপাদন ক্ষমতা, অর্থনৈতিক বিবর্তন ইত্যাদির কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। কারণ এই সমস্তই একটি নির্দিষ্ট সভ্যতার খাদ্যাভাসের জটিলতা ও পরিশীলতার মান ধার্য করে। 

Mediterranean-Wine-Braised-Lamb-Shank
ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সভ্যতাগুলোতে মাংসের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য

মাংসের ব্যবহার যেমন বিবর্তনের এক ধাপে মানুষকে ঈশ্বরের থেকে আলাদা করেছিল, তেমনই আঙুর থেকে ওয়াইন অথবা গম (বা অন্যান্য শস্য) থেকে রুটি তৈরির পদ্ধতিগত জটিলতা এক-একটি নির্দিষ্ট জাতিকে মাংসভূক বর্বরতার গণ্ডি ছাড়িয়ে উপহার দিয়েছে সভ্য-মানবের রাজমুকুট। অন্যদিকে ধর্মের বা ধর্মতান্ত্রিক খাদ্যাভাসের কথাই বা ছাড়ি কীভাবে? ভূমধ্যসাগর সৈকতে অবস্থিত সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস জুড়েই ফুড রিচুয়াল বা খাবার নিয়ে ধর্মীয় আচার আচরণের ছড়াছড়ি। শিশুর জন্ম কিংবা সুন্নত (সারকামসেশান) উদযাপনে সুহৃদদের মধ্যে কেক-কনফেকশনারি বিতরণের অভ্যেস, বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে পশুবলির ঐতিহ্য, অন্ত্যেষ্টিতে “অনন্তের প্রতীক” হিসাবে ডিমের ব্যবহার, ইত্যাদির হাত ধরে জীবনের প্রতিটি পর্বেই ভূমধ্যসাগর উপকূলে অবস্থিত মানুষের জীবনে খাবার ও নানা রন্ধনপ্রণালীর উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে।

আবার অন্যদিকে, ধর্মভিত্তিক বিভাজনের মাঝেও সেই খাদ্যাভ্যাসই তাদের একত্রিত করেছে বারবার। একদিকে যেমন বৈবাহিক অনুষ্ঠানে ইহুদি এবং মুসলমান উভয়ের খাবার থালাতেই মাছের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক, অন্যদিকে তেমনই মুসলমান ও খ্রিস্টান, দুই ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেই জীবন-উদযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পোলট্রি, ডিম, ড্রাই ফ্রুট ইত্যাদির ব্যবহার আজও চোখে পড়ে। কাজেই প্রশ্ন ওঠে: ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভাস বলতে আসলে কোনটি বোঝায়? সে প্রশ্নের উত্তর খুজতে হলে ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলানো প্রয়োজন! 

মেডিটেরেনিয়ান খাবারের বিবর্তনের উপকেন্দ্র খুঁজতে হলে আমাদের খানিকটা পূর্বে অর্থাৎ উত্তর ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গমভূমি থেকে শুরু করা দরকার। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব নবম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী। অর্থাৎ কথা হচ্ছে কার্থেজিনিয়ান ও ফোনেশিয়ান সাম্রাজ্যের ব্যাপারে। ইলিয়াড-ওডিসি-খ্যাত হোমার সাহেব পর্যন্ত তাঁর রচনায় লিবিয়াবাসীর সঙ্গে (খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত) ফোনেশিয়ানদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ফলাও করে বলে গেছেন।  লিবিয়ার তখন গবাদি পশু থেকে সংগৃহীত মাংস, দুধ, ও নানারকম চিজ়ের জন্য বিশ্বজোড়া নাম। সমুদ্র থেকে নিষ্কাশিত লবণ মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। 

ইউরেশিয়ার (আমার মতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও) ইতিহাস জুড়ে একের পর এক কোন্দল ও যুদ্ধের প্রতিপক্ষ অথবা সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলো নিজেদের দৈনন্দিন অভ্যেসের মাধ্যমে কোথায় যেন একাত্ম হয়ে যায়। যুগের পর যুগ ধরে নিজের মতো করে বিবর্তিত প্রতিবেশী সভ্যতাগুলো রাজনৈতিক কাজকর্মের পদ্ধতি, শিল্পকলা, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে যতই আলাদা হোক না কেন, খাদ্যরীতি, ও রন্ধনকৌশলের অভিন্নতা তাদের একই সুতোয় বেঁধে রেখেছে।

সে সময়ের খাদ্যাভাসে আর একটি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ অবশ্যই জঙ্গল, তার কারণ বনবাদাড় থেকে পাওয়া নানা শাক-সবজি, শেকড়বাকড়, ফল, এবং অবশ্যই অ্যান্টিলোপ, হরিণ, বনমুরগি বা ছাগল ইত্যাদি বহু সহস্রাব্দ পর্যন্ত এই এলাকার মানুষের প্রধান খাবার ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য সভ্যতার হাত ধরে ফোনেশিয়ানদের খাদ্যতালিকায় গম, বার্লি এবং একই ধরনের অন্যান্য দানাশস্যের প্রবেশ ঘটে। নানা শস্য দিয়ে তৈরি “পরিজ” যা এখন ভূমধ্য-সৈকত ভিত্তিক কিছু দেশের প্রধান খাবার, তার শুরু ফোনেশিয়ানদের হাত ধরেই পরিজের সঙ্গে বিজকোষধারী বা লেগুমিনাস তরিতরকারি খাওয়ারও প্রচলন ছিল। এর সঙ্গেই যোগ হয় সিরিয়া এবং প্যালেসটাইন থেকে আসা তেল, খেজুর, আমন্ড, পেস্তা, ডুমুর ইত্যাদি। আসলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের পক্ষে ব্যয়বহুল মধু কিনে খাওয়া অসম্ভব, তাঁরা এ সমস্ত ফল থেকেই গ্লুকোজের জোগান পেতেন। পাশাপাশি খেজুরক্ষেতের হাত ধরে ওয়াইন খাওয়া ধীরে ধীরে ফোনেশিয়ানদের খাদ্যাভ্যাসে প্রবেশ করে। 

Mediterranean Veg Dish
দানাশস্য দিয়ে তৈরি নোনতা-মিষ্টি হালুয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য

কারথেজের ব্যাপারটা আর একটু আলাদা, কারণ কারথেজের কৃষি বিবর্তন অনেকক্ষেত্রেই মেডিটেরেনিয়ান বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। পিউনিক যুগের পরপরই ইউরোপে ফোনেশিয়ান উপনিবেশের সূত্রপাতের হাত ধরে মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটে কারথেজের খাদ্যপ্রণালীর প্রত্যক্ষ প্রভাবের প্রমাণ মেলে। আরও মজার ব্যাপার হল, “টাবুনাস” নামক যে ধরনের মাটির উনুনে বিস্কুট বা পরিজ বানানো হত; মরক্কো ও টিউনিশিয়ার মত ম্যাগ্রেবীয় দেশে আজও তেমন আভেনের প্রচলন রয়েছে। শস্য ছাড়াও শহরের বিরাট বিরাট বাগানে নানান সবজির চাষ হত। এছাড়াও ছিল অলিভ।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে যখন ইউরোপের বিরাট অংশ ধীরে ধীরে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হচ্ছে, তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমধ্যসাগর এলাকার প্রায় সর্বত্র বহুলপরিমাণে অলিভ এবং আঙুরের চাষ শুরু হয়। পাঠক একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, ২০১৯ সালেও পৃথিবীর অন্যতম অলিভ উৎপাদনকারী প্রথম পাঁচটি দেশ ছিল স্পেন, ইতালি, তুরস্ক, গ্রিস ও মরক্কো- ভূগোলটা কেমন মিলে যাচ্ছে, তাই না? এছাড়াও উৎকৃষ্ট সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে রোমানরা উত্তর আফ্রিকার নিজ-অধীনস্থ বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে আধুনিক শস্যচাষের উপকেন্দ্র করে তোলে। সে কারনেই উত্তর আফ্রিকার ম্যাগ্রেবীয় দেশগুলির (যেমন টিউনিশিয়া ইত্যাদি) নামকরণ হয় “ব্রেড বাসকেট”

mediterranean-olive-bread
ভূমধ্যসাগরীয় অলিভ ব্রেড

এমনকি মুসলমান হানাদারদের আগমণের পরেও ম্যাগ্রেবীয় দেশগুলির এই নাম বহু দশক পর্যন্ত ব্যবহৃত হত। সে সময়ে ইজিপ্ট এবং লিবিয়াই ছিল গবাদি পশু চাষবাসের মূল কেন্দ্র। আরব সম্রাটদের প্রভাবে মেডিটেরেনিয়াল উপকূলবর্তী দেশগুলির খাদ্য পরিস্থিতি ক্রমে আমূল পালটে যায়। তার প্রধান কারণ, চাষের কাজে বিজ্ঞানের ব্যবহার। আমরা আজ “অ্যাগ্রোনমি বা কৃষিবিজ্ঞান” বলতে যা বুঝি, তা এই মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলে আগত আরবদেরই দান। এছাড়াও আরবদের হাত ধরেই নানান লেবু জাতীয় ফল, চাল, চিনি, পাস্তা এবং অবশ্যই কুসকুস-এর আগমন ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য-ইতিহাসে এক বিরাট মোড়। পালং শাক বা স্পিনাচ, গ্রিক বা রোমানদের কাছে একেবারেই অপরিচিত হওয়ায় সে গাছের “প্রিন্স অফ অল হার্বস” নামকরণ হয়। এশিয়া ফেরত আরব সদাগরদের হাত ধরে ভারতীয় মহাদেশ থেকে বেগুন (“অবেরজিন”)-এর আগমন, অথবা ইথিয়োপিয়া থেকে ফুলকপি, ওকরা, শশা ইত্যাদির অভ্যুত্থান এক বিরাট অধ্যায়। কাজেই রোম সাম্রাজ্যের সমকালীন শস্য-চাষ ভিত্তিক খাদ্যাভাস আরব তথা মুসলমান আমলে সম্পূর্ণ পালটে “পাস্তোরাল” বা সবজিভিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়।

Meatless-Monday-Stuffed-Eggplant
মেডিটেরেনিয়ান স্টাফড অবারজিন…

স্পেনের যে বিস্তৃত অঞ্চল অষ্টম শতাব্দী থেকে মুসলমানদের অধীনস্থ ছিল, বারোশো শতকে সেই আইবেরিয়ান উপদ্বীপে বসবাসকারী প্রায় ৫৫ লাখ মুসলমানদের নামকরণ হয় আল-আন্দালুস। পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টান ক্রুসেডের হাত ধরে এই এলাকার মুসলমান জনসংখ্যা কমতে শুরু করে; এবং সবশেষে ১৬০০ শতকের শুরুর দিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রায় এক লক্ষেরও বেশি মানুষ (মরিস্কো বা আন্দালুসিয়ান) তাঁদের শিল্পকলা, কৃষি-বিজ্ঞান, খাদ্য প্রণালী ইত্যাদি সমস্ত সমেত ম্যাগ্রেবীয় দেশগুলিতে স্থানান্তরিত হন। এই মরিস্কদের হাত ধরেই “নিউ ওয়ার্ল্ড” অর্থাৎ অতলান্তিক পারের (মেক্সিকো এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ) বহুবিধ শাকসবজি যেমন টমেটো, আলু, মরিচদানা, বিভিন্ন ধরনের লংকা ও বিনস, অলিভ, মার্টল-পেপরিকা ইত্যাদি প্রথমবারের জন্য ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ম্যাগ্রেবীয় অঞ্চলে আবির্ভূত হওয়ার ফলে ঘটে এক কৃষি বিপ্লব। মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া আঙুরের ক্ষেত ও ওয়াইনের কারখানাগুলিও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে আবার। গবাদি পশুর মধ্যে ষাঁড়, ভেড়া ইত্যাদি ছাড়াও আন্দালুসিয়ানরা মৌমাছির চাষও করতেন। 

এই অনুষঙ্গে তুরস্কের কথাই বা ছেড়ে যাই কীভাবে? আসলে আরব সভ্যতাগুলো তাদের উপর ওসমান অর্থাৎ অটোম্যানদের প্রভাব সর্বত্রই সঙ্গে করে বয়ে বেরিয়েছেন! এর প্রথম প্রমাণ অবশ্যই “বুলগুর”, যা কিনা আদপে গমের খুদ যা দিয়ে ওসমানরা পিলাফ (ইরানি পোলো বা আমাদের পোলাউয়ের সমগোত্রীয়) তৈরি করে খেতেন। এছাড়া কঠিন শৈত্যপ্রবাহের জন্য বানিয়ে ও জমিয়ে রাখা নানান শস্য দিয়ে তৈরি রুটি, শুকনো ফল, এবং দুধ থেকে তৈরি নানান ধরনের অন্যান্য খাবারের কথা উল্লেখযোগ্য।

তু ‘চিজ়’ বড়ি হ্যায় মস্ত!

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেডিটেরেনিয়ানের পাড়ে ফ্রান্সের নিস শহরে আসা ইস্তক আমি যাকে বলে সর্ব-চিজ়-ভুক হয়ে উঠেছি। নয় নয় করে চারশো রকম চিজ়ের মধ্যে মধ্যে অন্তত পঞ্চাশ রকম তো বিগত ছ’মাসেই পেটে পুরেছি। আসলে চিজ়ের প্রতি আমার সুপ্ত প্রেমটা ২০১২ সালে ইস্তানবুলে গিয়ে, যাকে বলে, মধ্যগগনে পৌছয় ফ্রান্সে আসা ইস্তক একটা ব্যাপারে বড়ই খটকা লেগেছিল। টক দইয়ের বাক্স কিনতে গিয়ে মাঝে সাঝে লোকজনকে বলতে শুনেছি, “দ্যাট ইজ় হাফ ইয়োগার্ট অ্যান্ড হাফ চিজ়” (ফ্রোমাজ ব্লঙ্ক)! ব্যাপারখানা কি?

সেটাই বলার কথা। ভূমধ্য উপকূলের খাদ্য সংস্কৃতিতে উপরোক্ত সমস্তকিছুর সঙ্গে সঙ্গে চিজ় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেবলমাত্র তুরস্ক, ফ্রান্স, ও গুটিদুয়েক ম্যাগ্রেবীয় দেশ মিলিয়েই এ সভ্যতাকে কম করে সাতশো রকমের চিজ় উপহার দিয়েছে। সেই অনুষঙ্গেই “চিজ়”-এর সাময়িক ও ভৌগোলিক বিবর্তনটায় একবার চোখ বোলাতেই হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে চিজ়ের এই যে আস্ফালন, তার শুরুটা কোথায় ঠিক করতেই শ’খানেক ইতিহাসবিদ এখনও ভিরমি খেলেও কালক্রমে মোটামুটি দুটো গল্পই উঠে এসেছে। প্রথমটাই সর্বোত্তম। 

Mediterranean Cheese
ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার রকমারি চিজ়

সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ সন। স্থান আজকের ইরাক অর্থাৎ টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীদুটির মধ্যবর্তী উর্বর ভূমি বা “ফার্টাইল ক্রেসেন্ট”। এক যাযাবর ব্যবসার কাজে মরুভুমির পথে যাবেন, তাই ঠিক করলেন পথের ক্ষিধে ও তৃষ্ণা মেটাবার প্রয়োজনে শুকিয়ে নেওয়া ভেড়ার পাকস্থলীর মধ্যে খানিকটা দুধ ভরে নিয়ে বেরবেন। যাত্রার কয়েকঘণ্টা পর তেষ্টা নিবারণের জন্য থলে খুলতেই দেখলেন, সে দুধ আর দুধ নেই! বরং কঠিন ও তরল এই দুইভাগে ভাগ হয়েছে। তরলটি খেলে দিব্যি তেষ্টা মেটে আর কঠিন পদার্থটি বেশ টক টক সুস্বাদু। 

ব্যাস! সেই আমরা আমাদের চিজ় খুঁজে পেলুম! প্রিয় পাঠক, খেয়াল করুন, এ আসলে কেবল চিজ়ই নয়, আমাদের প্রথম টক দইও বটে। (কাজেই দিব্যি বোঝা যায়, ফরাসি দেশের আধা চিজ়-আধা দই ব্যাপারটি কেমন খাদ্যযোগ্য হল?) পৃথিবীর খাদ্য ইতিহাসে মোড় ঘোরানো এই ঘটনাটির পিছনে চারটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি দুধ, দ্বিতীয়টি উটের হাঁটার পদ্ধতির ফলে অত্যধিক ঝাঁকুনি, তৃতীয়, মরুপ্রান্তরের চড়চড়ে গরম আবহাওয়া, এবং লাস্ট বাট নট দা লিস্ট, ভেড়ার পাকস্থলীতে থাকা “রেনিন” নামক একটি হজমে সাহায্যকারী উৎসেচক (এনজ়াইম)। এই চিজ়ের গঠন ভবিষ্যতের গ্রিসে সর্বত্র ব্যবহৃত ফেটা চিজ় বা আমাদের পনিরের মতোই ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের মত। এমনই কিছু আরব সদাগরদের হাত ধরে ভূমধ্য-সাগরপারে আমার সাধের চিজ়ের আগমন ঘটে।mdl

এ ঘটনার অনেক পরে, গ্রিক সভ্যতা যখন তার আকাশচুম্বী শ্রেষ্ঠত্বে, আমরা হোমার সাহেবের ইলিয়াড-এ মানুষখেকো (ওডিসিউসের সাঙ্গপাঙ্গ) সাইক্লপ্স-কেও মাঝেসাঝে তার গুহায় কাঠের বাক্সে চিজ় বানাতে দেখি। তাছাড়া একেবারে বর্তমান সময়ে রবার্ট কার্লটন ব্রাউন রচিত “দা কমপ্লিট বুক অফ চিজ়” বইতেও ভূমধ্য-সৈকতের বিখ্যাত চিজ়-ওয়াইন যুগলবন্দির ঐতিহাসিক প্রমাণও পাই। 

এ অঞ্চলে চিজ়ের রমরমা গল্প বলতে বসে রোমকে বাদ দেওয়া যায় না। তার কারণ, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে এত ধরনের শুকনো চিজ়ের (সঙ্গে নিয়ে বহুদূর পথ চলা যায়) প্রচলন হয়েছে, তা রোমান চিজ়-বিজ্ঞানীদেরই অবদান। চেদ্দার (১৫০০ শতাব্দী), পারমিজিয়ানো-রেজ্জিয়ানো বা পারমেশান (১৬০০ শতাব্দীর শুরু), গুডা (প্রায় ১৭০০ শতাব্দী) ইত্যদি এমনই কিছু নাম। রোমান সাম্রাজ্যের শুরু থেকে ১৭০০ শতাব্দী পর্যন্ত মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলে ইতালিই নিজেকে চিজ় তৈরির কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।  এছাড়া এ গল্পের শুরুতে যেমন বললাম, ফরাসি দেশে চিজ়-ওয়াইন যুগলবন্দির এই যে বাড়াবাড়ি, অর্থাৎ এই যে প্রায় চারশো ধরনের চিজ়, এর বেশিরভাগের নামই তার ভৌগোলিক জন্মস্থানের সঙ্গে জড়িত। যেমন ব্রি শহরে তৈরি চিজের নাম ব্রি, অথবা ১৮০০ শতাব্দীতে নরম্যান্ডির ক্যামেমব্যের শহরে তৈরি হওয়া সাদা রাইন্ডে আবৃত নরম চিজের নামও ওই শহরের নামেই।

গ্যাস্ট্রনমিকাল নেবার্স!

অতএব সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ জুড়ে বিবর্তিত ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল জোড়া সভ্যতার নাট্যমঞ্চে নানারঙের মানুষ এবং তাদের খাদ্যাভাসের প্রবেশ ও প্রস্থান ঘটে গিয়েছে। শুরুর দিন থেকেই এসব সভ্যতার স্থান-কাল-ধারাবাহিকতার, পরিবর্তনশীলতার মধ্যেই ভূমধ্য-খাদ্যপ্রণালীর বেড়ে ওঠা। সে প্ল্যাটারে এশিয়া, তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, নিউ ওয়ার্ল্ড ইত্যাদির অবাধ আনাগোনা। ঠিক যেমন খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ শতাব্দীতে গ্রিসে তৈরি হওয়া প্রথম কেবাব- মধ্যযুগীয় পারস্যের এক সৈন্যের তরোয়ালে গাঁথা পোড়ানো মাংস (কেবাপ) হয়ে- তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের দোনার বা শাবার্মা বা শিস কেবাপ হিসাবে গোটা পাশ্চাত্যে তথা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। 

Mediterranean Donair
দোনার বা রুটিতে মোড়ানো মাংস ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির প্রধান খাদ্য

ড্রেসডেনে থাকতে আমার এক তুরস্ক-বিদ্বেষী জার্মান সহকর্মীকে বলতে শুনেছি, তাঁর নাকি হপ্তায় চারদিন দোনার না হলে চলেই না। কাজেই রাজনীতি, ধর্ম, যুদ্ধ, অর্থনীতি ইত্যাদি মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলের মানুষকে যতই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আলাদা করতে চেষ্টা করে এসেছে, ততই বুক চিতিয়ে বাধ সেধেছে সাধারণ গৃহিণীর রান্নাঘর। আসলে রান্নাঘর নিজেই বোধহয় স্থানকাল নির্বিশেষে সমস্ত রকম পৃথকীকরণের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদ; তা সে ২০১৬ পরবর্তী তুরস্কই হোক বা ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ। তাই যতদিন পর্যন্ত আমার আপনার মা কাকিমাদের বাড়ির ঝোল-তরকারি বা টিউনিশিয়া কিংবা টাসকানির কোনও মাঝবয়সি গৃহিণীর বানানো কেক-পাঁউরুটির বাটি পাশের পড়শি-বাড়ি আসা যাওয়া চালিয়ে যেতে পারবে, আমরা, সাধারণ মানুষরা হাজার যুদ্ধ উপেক্ষা করে নির্ভয়ে ঐক্যের গান গেয়েই যাব

সবশেষে এত চর্বিতচর্বনের পর যেখান থেকে শুরু করেছিলাম যদি সেই “মেডিটারেনিয়ান ডায়েট”-এর প্রশ্নেই আবার ফিরে যাই, তবে তন্নতন্ন করে খুজলে একটাই উত্তর পাবেন: “আ থাউজেন্ড থিংস ইন ওয়ান!” অর্থাৎ সেই “বৈচিত্র্যর মাঝে একতা”র কথা। দেখলেন তো, আমাদের দেশের সংবিধানের সঙ্গে অজান্তেই কেমন মেডিটেরেনিয়ান খাদ্য-ইতিহাস একাত্ম হয়ে রয়েছে! আর হবে না-ই বা কেন? হাজার হোক, “উই আর আফটার অল এ জায়েন্ট পুল অফ গ্যাস্ট্রোনমিকাল নেবার্স!”

 

*ছবি সৌজন্য: themediterraneandish, eatwell, eatsmarter, ovenhug 

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

One Response

  1. রূপক বর্ধন রায় যে সুলেখক তা বোধ হয় অ‍ামার মত অনেকেই মনে করেন। এত বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখেন যে চোখ খুলে যায়। মনে হয় আহা যদি একটু সেসব জায়গায় গিয়ে চিজ খেতে পারতাম! লেখককে অকুন্ঠ ধন্যবাদ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com