Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দুটি কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে

জয় গোস্বামী

ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩

Two books review by Joy Goswami
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

১৯২৭ কি? যখন অবনীন্দ্রনাথ ‘শব্দচিত্র’ নাম দিয়ে কয়েকটি রচনা লিখলেন? বাংলা ভাষার এক প্রধানতম কবি, তার অন্তত ৫৫ বছর পরে, একটি প্রবন্ধগ্রন্থে এমন উল্লেখ রাখবেন যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উৎসাহিত এবং খানিকটা উত্তেজিতই করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথকে বাংলায় ‘Free verse’ কেমন দাঁড়ায় তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। অবনীন্দ্রনাথ এই পথটি নিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হননি। কিন্তু ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬-এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের হাতে এল চার-চারটি গদ্যকবিতার বই। নিন্দিতও হলেন তাঁর ভক্তজনেদের দ্বারাই, রবীন্দ্রনাথ। ‘গবিতা’ নামক বিশেষণ জুটল রবীন্দ্রনাথের সেই নতুন কাব্যপরীক্ষার ললাটে। এগুলো নিশ্চয়ই সবাই জানেন। বৃদ্ধ হলে বেশি কথা বলার প্রবণতা জন্মায়, তাই বললাম এসব।

আরও পড়ুন: কবিতার সঙ্গে বসবাস- কবিতাসত্য, কবিতাচিন্তা

চর্যাপদ থেকে ধরলে, ১৩০০ বছরের বাংলা কবিতার দিকে তাকালে, সকলেই নিশ্চয় এটা দেখেছেন যে তার চার ভাগের সাড়ে তিন ভাগ কবিতাই ছন্দে নিবদ্ধ। ১৯২৭ এর উল্লেখ করলাম, যখন অবনীন্দ্রনাথের খেয়ালখুশির সৃষ্টিমাদকতার কথা মনে রেখে রবীন্দ্রনাথ উশকে দিচ্ছেন অবনঠাকুরকে ‘Free verse’ লেখার জন্যে। তারপর নিজে পুরোদমে অবতীর্ণ হচ্ছেন সে কাজে। এটা ২০২৩, অর্থাৎ বাংলায় গদ্যকবিতার বয়স ১০০ বছরও হয়নি এখনও। অথচ বাঙালি কবিদের কাছে, ছন্দ স্বীকার না- করেই, মুক্তগদ্যে কবিতা লেখা এবং সার্থক কবিতা লেখা এখন খুব স্বাভাবিক বিষয়। সেই রকমই কয়েকটি কবিতার পরিচয় আজ পাঠকের সামনে রাখতে চাই।

চোখের আলোয় চোখের বাহিরে কিছু দেখা তো দূরস্থান, লোডশেডিংয়ে
হারমোনিয়ামের রিড পিছলে যাচ্ছে। পাড়াসংগীতের মরমিয়া দিদিমণি গানের খাতা নিয়ে নিভন্ত পাড়ায়। প্রাণপণে বেলো টিপছে ম্লান কণ্ঠ আর বিএ পার্ট ওয়ান। মোমবাতির নাতিসামান্য আলোটুকু জেগে থাকে তার গৃহকর্ম এবং সংগীতকুশলতার পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের কলমে।

‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামক একটি কবিতাসিরিজের চার নম্বর কবিতা এটি। এখানে দেখা যায় এক নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ি, সে-বাড়ির এক তরুণীর গানের দিদিমণি এবং ম্লান মোমবাতির আলোয় গান শেখার দৃশ্য। যে দৃশ্য আসলে অপেক্ষা করে আছে ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনের জন্য। আজও নিম্নবিত্ত ঘরের বাঙালি মেয়েদের জীবন কোন দিকে বয়ে যেতে দিচ্ছেন তাদের অভিভাবকেরা, তারও একটা সময়চিত্র ধরে রাখে এই কবিতা। কিন্তু আমার কাছে, এ-কবিতা সবমিলিয়ে একটি করুণসুন্দর মুহূর্তদীপ হয়ে থাকে।

Two Books

দোকানে গিয়ে মেয়েটি দাম জানতে চাইল। ছেলেটি জানতে চাইল ভঙ্গুরতার কথা। বিস্মিত দোকানি জানায়, ভাঙবে না, এতই টেঁকসই! শুনে ওরা যুগপৎ বেরিয়ে আসে। কাচের চুড়ির দোকানটিতে একটুকরো হাসি কিছুক্ষণ লেগে থাকে শেষ বিকেলের আলোর মতো

‘সব কল্পনাই চরিত্রহীন’ নামক কবিতা-সিরিজের আরম্ভ এই কবিতাটি দিয়ে। এখানে বলে নেওয়া দরকার, ‘কবিতাসিরিজ— কথাটি বলছি তো? হ্যাঁ, সব সিরিজেরই একটি মূল শিরোনাম থাকছে— আর এক, দুই, তিন এইভাবে সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হচ্ছে সিরিজের কবিতাপথকে।
উপরোক্ত কবিতাটিতে কবির সৌন্দর্যদৃষ্টি আবারও প্রমাণিত হয়। প্রথম কবিতাটির মতো এই কবিতাও একেবারে নিরাভরণ। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলতে গেলে: ‘কোনো আয়োজন নাই একেবারে’। এমন নিরাভরণ কবিতা লিখতে সাহস লাগে। কিন্তু সৌন্দর্য যদি আরাধ্য হয় কোনও কবিতার, তবে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিরাভরণতার সাহস অর্জন করে নেয়। দুটি যুবক যুবতী কাচের চুড়ি কিনতে দোকানে এসেছে। তারপর বেরিয়ে আসছে। চুড়ি কিনেছে কি কেনেনি সে-বিবরণের দিকে যাচ্ছে না কবিতা। তবে দোকানে দাঁড়িয়ে ওই দুই প্রেমিক প্রেমিকা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হেসেছিল মাত্র। সেই হাসিটুকুই নগণ্য এক চুড়ির দোকানকে সূর্যাস্তের রঙে মহৎ করে তোলে। এত সামান্য বিষয়কে এক সংগীতময় আনন্দ-উচ্চতায় নিয়ে যেতে আমার নিজের কোনও কবিতায় আমি সারা জীবনেও পারিনি।

Couple painting
ছেলেটি জানতে চাইল ভঙ্গুরতার কথা

তবে কেবলমাত্র সৌন্দর্য রচনা করাই আমাদের এই কবির উদ্দেশ্য নয়। এই কবি মানে, যাঁর কবিতা নিয়ে এখন কথা বলছি আমি। জীবনের যন্ত্রণাময় দিকগুলি, বয়সের শেষ সীমায় পৌঁছোনো চরিত্রদের স্মৃতিযন্ত্রণার নিরুপায় সমন্বয়— তাও কিন্তু এই কবির লেখায় ধরা পড়ে।

একটির সঙ্গে অন্য বিদ্যুৎরেখার ভাবভালবাসা হয় না কোনওদিন। অথচ একই আকাশে তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং ফুরিয়ে যাওয়া -সবই সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। কিন্তু একটি বিদ্যুৎচমক ভাগ করে নেওয়া যেসব মানুষেরা পারস্পরিক বজ্রপাতের শিকার হয়ে একে একে বসেছিল পোস্টারে নীল বিপ্লব আর কয়লা কালো গ্রাফিতিময় দেওয়ালে পিঠ দিয়ে, তারা আজ কীভাবে ফিরবে বর্ষাঠাকরুন? জলভারনত ধোঁয়া আর অনিবার্য শ্রীরবিঠাকুর ঘুরছেন কল্কের মতো ঠোঁট থেকে ঠোঁটে। দম আটকে যাওয়া অন্ত্যাক্ষরির ঘর্ঘর শব্দ তুলছে ফ্যানের ব্লেড, বাইরে বৃষ্টি যখন নামল! ফেলে আসা আয়ুর মতো দীর্ঘ করিডরে নিজেদের উষ্ণতা ফিরে পেতে বিষণ্ণ খোলা ছাতার ভিড়, যারা গোপনে নিজেদের কমা সেমিকোলনগুলি বিনিময় করে নেয়! একই ওয়ার্ডে পরপর শুয়ে বসে থাকা প্রৌঢ় আত্মীয়-বিরহিত রুগির মতো মেলে ধরে নিজেদের। জংধরা শরীর ওষুধের বড়ি গিলে হিম হয়ে যাওয়া বড়ছেলের গল্প বলে পাশের তাপ্পিমারা বিবর্ণকে। বলে, বাতে পঙ্গু পা টেনে টেনে দুর্যোগের রাতে তার কাজে বেরনোর ক্লান্তিকথা। ওদের এই শোকগ্রন্থনাকে বৃষ্টি বড় যত্নে ঘিরে রাখে

এই কবিতাসিরিজের নাম ‘মল্লার। তার তিন নম্বর কবিতাটি এখন পড়ছি আমরা। এই কবিতার প্রথম দুটি বাক্য প্রকৃতির এমন এক অমোঘ সত্যকে উচ্চারণ করে, যা আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। কিন্তু বুঝতেই পারিনি কোনওদিন, ঠিক এমন অব্যর্থ সত্যর দ্বারা বুঝতে পারিনি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক গদ্যরচনায় জানিয়েছিলেন যে সার্থক বা শ্রেষ্ঠ কবিতা আমরা কাকে বলতে পারি? নিজেই দিয়েছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর। লিখেছিলেন, সে কবিতা পড়ে মনে হবে যে এই অভিজ্ঞতা ও অনুভব তো আমার মধ্যেও ছিল — ‘কিন্তু এমন কৃতার্থ সংস্থানের মধ্যে ছিল না।’ এই কবিতাটির ক্ষেত্রে আমার ঠিক তাই ঘটল। একটি বিদ্যুৎরেখার সঙ্গে অন্য বিদ্যুৎরেখার সম্পর্ক যে কখনোই হতে পারে না, একথা তো আমি ভাবিনি। অথচ কবিতার প্রথম বাক্যদুটি পড়ামাত্রই মনে হল যেন আমার অভিজ্ঞতাকেই প্রকাশ করলেন এই কবি। লেখাটি নিজের উপসংহারের দিকে যত যায় ততই জীবনের অবসানকালীন বয়সগুলিকে স্পর্শ করতে করতে চলে। হাসপাতালে আমি অনেকবার গিয়েছি। দেখেছি সেখানকার বয়স্ক রোগীদের— যেসব রোগীকে ভিজিটিং আওয়ারে দেখার জন্য কোনও আত্মীয়বন্ধু উপস্থিত হন না। দেখেছি তাদের। কিন্তু তাদের কথা লিখতে পারিনি পঞ্চাশ বছর কবিতাচর্চার পরেও। ড্রাগ আডিক্ট বড় ছেলের ওভারডোজের কারণে মৃত্যুর কাহিনি বলছেন হাসপাতালের শয্যায় শায়িত এক বৃদ্ধ, তাঁর পাশের ‘তাপ্পিমারা বিবর্ণ’কে। ‘তাপ্পিমারা বিবর্ণ’। মাত্র দুটি শব্দ। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ অচেনা এক ব্যক্তির পুরো জীবনকে আমার সামনে তুলে ধরল এই শব্দদুটি। এমনকি, অদেখা সেই ব্যক্তির চেহারাও যেন আমি দেখতে পেলাম। ‘বাতে পঙ্গু পা টেনে টেনে দুর্যোগের রাতে কাজে বেরোনোর ক্লান্তিকথা’— শুধু বাঙালি সমাজকে নয়, দরিদ্র এ-দেশের, এই ভারতবর্ষের সং্খ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযুদ্ধ ও তার ক্লান্তিকর পরিণামকে তুলে ধরল মাত্র এই একটি লাইন। তারপর কবি তাঁর কাজ করলেন। কীভাবে? লিখলেন এই লাইন: ‘ওদের এই শোকগ্রন্থনাকে বৃষ্টি বড় যত্নে ঘিরে রাখে’

অর্থাৎ, কবি এসে বৃষ্টিরূপ ধ’রে এসকল যন্ত্রণার এক প্রগাঢ়, করুণাভরা উত্তরণে নিয়ে যান কবিতার চরিত্রগুলিকে। ‘মল্লার’ এই নামকরণটি আমাদের এই কবিতার প্রথমলাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে দিতে তার শিরোনামের অনন্য সার্থকতা  প্রকাশ করে। কবিকে আমরা বলি: ‘হে অনন্তপুণ্য, করুণাঘন, ধরনীতল কর কলঙ্কশূন্য’…

lightning
একটির সঙ্গে অন্য বিদ্যুৎরেখার ভাবভালবাসা হয় না কোনওদিন। অথচ একই আকাশে তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং ফুরিয়ে যাওয়া

২ 

 

কলঙ্ক তবু যাওয়ার নয়। সে লেগে থাকবেই আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীর জীবনে।

একটি খরার প্রতিবেদন

গোটা গ্রাম যখন তার জ্বলন্ত পয়ঃপ্রণালী আর ঝেঁঝে যাওয়া ঘাসজমির গেরস্থালি নিয়ে বৃষ্টি-বাদলার জন্য অবাধ্য ছাত্রের মতো নিলডাউন হয়ে বসে থাকে, তখন তোমার চশমার দামি লেন্স ঘেঁষে রিপোর্টাজ লিখতে বসি। কি-বোর্ড এবং সাঁতারু আঙুলের যোগাযোগ থেকে যুক্তি খসে গিয়ে অন্য সেচব্যবস্থা ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। তাপমাত্রার কথা বলা হয় না, ছেলেবেলার ভুলগুলি মেঘ হয়ে নেমে আসে নিউজ়প্রিন্টের উপর। সঙ্গে আনে রিটায়ারমেন্টের গলিমুখে দাঁড়ানো ভূগোল স্যারের টিফিন কথা-কাটাকুটি। ঝাপট আসতে থাকে অক্সফোর্ড অ্যাটলাসের রেগিস্তান থেকে, আর ধুলোবাতাসের শুকনো দুঃখে বানান একটু একটু করে বদলে যায়। স্থানীয় সংবাদদাতার বদলে লিখে ফেলি মৃত বন্ধুনাম। খেতের মরামুখের ছবি সুপার কম্পোজে বসানো হয়। গোপন আর্দ্রতার খবর পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না।

এই কবিতাটি কোনও সিরিজভুক্ত নয়। কিন্তু এ-কবিতা বলে এক সংবাদদাতার দেখা জীবনকথা। সেখানে আমরা আবারও ভারতবর্ষকে দেখতে পাই। এই কবির কাব্যশক্তি এমনই জোরালো যে তিনি গোটাগ্রাম ও তার জলন্ত পয়ঃপ্রণালী এবং তার ঝেঁঝে যাওয়া ঘাসজমির গেরস্থালির পাশে মৃত বন্ধুনাম দেখতে পান। খেতের মরামুখের ছবির পাশে মরাবন্ধুর অদৃশ্য মুখও যাওয়া-আসা করে। এই কবি, খরাদগ্ধ গ্রামের কথা যখন লেখেন তখন দেশের রাজনীতিও তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না।ফসল হয় না খরায়। কিন্তু ফসল যেখানে হয়? যখন হয়? তখন?

গরম বাতাস সেঁক দিচ্ছে চাকরি যাপনের সেলাইয়ে। গোটা দিন শরীর জুড়ে অপেক্ষা নিশি তরকারিওয়ালির জন্য। সে সাজিয়ে রাখবে টমেটোর লাল বিলাস আর সজনেডাঁটার ছিপছিপে সবুজকে। সবজিমাণ্ডির বিষণ্ণ আলোয় ভোগে যাওয়ার জন্য লাইন লাগিয়েছে কাটা কুমড়োর হলুদ, ডবকা বেগুনের বাসনা-পোকা, মেধাহীন লাউ, প্রভুভক্ত পটলের অনুচ্চারিত কামকথাকলি। সাবধান! এরা সবাই মিলে বদলে দিতে পারে আমার আপনার সরকারকে

nature-drought-cracks
গোটা গ্রাম যখন তার জ্বলন্ত পয়ঃপ্রণালী আর ঝেঁঝে যাওয়া ঘাসজমির গেরস্থালি নিয়ে বৃষ্টি-বাদলার জন্য অবাধ্য ছাত্রের মতো নিলডাউন হয়ে বসে থাকে

বাজারের ছদ্মবেশ ধারণ করে এই কবিতার মধ্যে বলা আছে একাধিক অন্য সাংকেতিক কথা। কবিতাটি পড়তে পড়তে দেখি একেকটা সবজির মধ্যে বিশেষভাবে মানবচরিত্র তথা মানবীচরিত্র প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিশি তরকারিওয়ালিকে তো ভুলতেই পারি না আমরা। গোটা দিনের পরিশ্রম অপেক্ষা করে থাকে সেই নিশি তরকারিওয়ালির জন্যই। এই কবিতার মধ্যেই আমরা পাব’ ডবকা বেগুনের বাসনা-পোকা’— পাবো ‘কামকথাকলি’।

কিন্তু কবিতাটি পড়তে-পড়তে যা আমরা ভাবতে পারব না, তা হল এর শেষ লাইনটি: ‘সাবধান! এরা সবাই মিলে বদলে দিতে পারে আমার আপনার সরকারকে’— এইভাবে কবিতাটি যে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, — জানিয়ে দিতে পারে ভারতবর্ষ নামক কৃষিপ্রধান একটি দেশের অবধারিত সত্যকে, কবিতাটির সূচনায় এবং মধ্যদেশেও তাকে আমাদের ধারণার বাইরে রেখেছিল কবির অনবদ্য রচনাকৌশল।

ছ’লেনের রাস্তার মোড়ে রাতে গাড়ি দাঁড় করালে খোঁপায় কবরফেরত ফুল গোঁজা বৃহন্নলাদের বৃন্দগান ঝাপট মারে কাচে। গ্লোসাইনের আভা যাদের মুখশ্রীকে আরও মীনাকুমারী করে দিল! সামান্যের বিনিময়ে কিলোমিটার উজিয়ে ওরা পৌঁছে দেবে নীল জন্নতে। জবরজং সুর্মায় বদলে বদলে যাবে গাড়ির নম্বর। তারপর জামানতটুকু বাঁচাতে ফের লড়ে যাবে পরের রাতে, সিগন্যালের লাল হলুদ সবুজে

‘প্রলাপ নামচা’ নামক সিরিজের প্রথম লেখাটি এর আগেই দিয়েছি, যেখানে নিশি তরকারিওয়ালির কথা আছে। এবার দিচ্ছি ওই একই সিরিজের চার নম্বর কবিতাটি। ট্রাফিকে দাঁড়ানো গাড়ির কাচে টোকা দিয়ে টাকা চাইতে আমি দেখেছি বৃহন্নলাদের। তাদের সাজগোজ দেখেছি। হ্যাঁ, তাদের কারও কারও মাথায় ফুল থাকে। সে-ফুল কবরফেরত, সে-কথা কবি আমাদের মনে করিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল এদের জীবনও কি কবরফেরত নয়? তাও এরা হাসে, গান গায়। বুদ্ধদেব বসুর শেষতম কবিতার বই ‘স্বাগত বিদায়’-এ ‘কিম্পুরুষ’ নামে একটি কবিতা ছিল। সে কবিতা বলেছিল বন্ধ্যা এক কবির কথা। আর এই কবিতা দেখাচ্ছে যে, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার উজিয়ে কীভাবে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে মহানগরের এই বৃহন্নলারা, ট্রাফিক সিগনালের মোড়ে-মোড়ে রাস্তার আলো যাদের মুখশ্রীকে মীনাকুমারী করে দেয়। এখানে ‘মীনাকুমারী’ কথাটির অভাবনীয় প্রয়োগ আমাদের অবাক করার আগেই মনকে বেদনায় ভরে তোলে, কারণ এরা কোনও কুমারী নয়, কোনও কুমারও নয়। ঈশ্বর এদের নারীরূপে গড়েননি, পুরুষ-রূপেও না। তবু তারা কোথাও হার মানে না। যেকোনও জীবিকাই সম্মানের। জন্ম থেকে প্রাপ্ত দৈহিক অক্ষমতা ভুলে এরা নিজেদের সংগ্রাম নিজেদের মতো করেই চালিয়ে যাচ্ছে, বেঁচে থাকছে। 

hijra painting
খোঁপায় কবরফেরত ফুল গোঁজা বৃহন্নলাদের বৃন্দগান ঝাপট মারে কাচে

এই বেঁচে থাকার লড়াই-এর কথাই অন্যভাবে এসেছে এই কবির ‘সুন্দরবন’ নামক কবিতাসিরিজে। তা থেকে একটা কবিতা বলি—

জলের বিষাদটুকু শেষ হয়ে যাওয়া বিড়ির মতো ছুড়ে ফেলে গিয়ে বইঠা চালু করে বিপদভঞ্জন। বাঘের আতঙ্ক তাকে ঘুম কেড়ে নেওয়া স্বপ্ন দিয়েছে। জঙ্গলের সব দাগ হাতের রেখার মতো সে চেনে, আর স্মৃতিখাওয়া লাশের রক্তদাগ। এমনকী সে এটাও জানে যে শেষপর্যন্ত বাঘ নয়, বাঘের আতঙ্কই তাকে ছিঁড়ে খাবে।

আগের কবিতায় আমরা পেলাম শহরের রাস্তায় বৃহন্নলাদের জীবনধারণ প্রণালীর কথা। এই কবিতাটিতে আমরা দেখছি সুন্দরবনে, রাত্রে মাছ ধরতে যাওয়া এক জেলের কথা যার নাম কবি রেখেছেন ‘বিপদভঞ্জন’। অথচ কবিতাটি সারাক্ষণ ভরে রয়েছে বিপদের ভয়ে। এ কবিতার শেষ লাইনও আমাদের পক্ষে অকল্পনীয় হয়ে দাঁড়ায়। যেন গ্রিক ট্রাজেডির নেমেসিসের মতো এই মাঝি জানে যে আতঙ্কই তার জীবিকার প্রথম ও শেষ কথা। না, এই বিপদভঞ্জনকে আমি দেখিনি। তাই তার আতঙ্ক, আতঙ্কের মধ্যেও জীবিকা সন্ধান করার সত্য আমার কবিতা কোনওদিন ধরতে পারেনি। তবে শহরের প্রধান প্রধান ট্রাফিক জয়েন্টে থেমে থাকা গাড়ির দিকে দৌড়ে আসা, কাচে টোকা দেওয়া বৃহন্নলাদের আমি দেখেছি বারবার— কিন্তু এমন করে তাদের মর্মকথা কবিতায় প্রকাশ করতে পারিনি। সত্যি বলতে, এদের জীবন নিয়ে কিছু লেখার ক্ষমতা আমার জন্মায়নি কোনওদিন। কিন্তু আমার দু-দশক পরে লিখতে আসা একজন কবি মর্মগ্রাহীরূপে ধারণ করলেন শহরের সঙ্গে অচ্ছেদ্যবন্ধনে জড়িত এই চরিত্রদের কথাচিত্র।

Painting of Tiger
শেষপর্যন্ত বাঘ নয়, বাঘের আতঙ্কই তাকে ছিঁড়ে খাবে

এই কবির নাম অগ্নি রায়। ইনি পেশায় একজন লব্ধ-প্রতিষ্ঠ সাংবাদিক। সাংবাদিকতার পেশার মধ্যে থেকেও কীভাবে সার্থক কবিতার বিষয়কে সার্থকতর করা যায়, তার প্রমাণ ইনি রেখেছেন তাঁর ‘জর্দা বসন্ত’ এবং ‘শিস কাটছে অহিফেন’ নামক দুটি কাব্যগ্রন্থে। এই বইদুটির কবিতা নিয়েই কথা বললাম আজকে। আমি যে কবিতাগুলি তুলে দিয়েছি পাঠকদের জন্য তা সবই ছন্দমুক্ত প্রকরণকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু, অগ্নি রায়, এই দুটি গ্রন্থে, কিছু ছন্দবদ্ধ রচনাও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাঠক, সিগনেট প্রকাশিত এই বইদুটি থেকে সে-রচনাগুলি দেখে নিতে পারবেন। আমি, আমার স্বল্পবুদ্ধির কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে দিয়েছি— তা দিয়ে নিশ্চয়ই আমি এ-কবির কোনও সর্বাঙ্গীন মূল্যায়ন করার ক্ষমতা রাখি না। কারণ, সবাই তো সব পারে না। যে যেটুকু পারে। আমি এইটুকু পারলাম। অন্য কোনও আলোচক— যেমন, জহর সেনমজুমদার বা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়— নিশ্চয়ই এই কবির অন্তর্লীন কাব্যপ্রভা আরও নিখুঁতভাবে দেখাতে পারতেন। হয়তো পারবেনও ভবিষ্যতে। এ লেখার উপসংহারে আমি ছোট একটি কবিতা দিই, যে কবিতা পাঠকের মনের মধ্যে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ুক, আমার আশা এইটুকুই।

সুন্দরবন

দুই

কুমিরের একাকিত্বের কাছে জলের দাঁত বসে গ্যাছে। সুন্দরীর শ্বাসমূল তার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয় রাতে। এইসব উভচর বেদনার কাছে গ্রীষ্মের ছুটির দরখাস্ত চাইছে আকাশ।

ইয়ের নাম: শিস কাটছে অহিফেন
লেখক: অগ্নি রায়
প্রকাশক: সিগনেট প্রেস
প্রচ্ছদ: রচিষ্ণু সান্যাল
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২২
বিনিময়: ২৫০ টাকা

বইয়ের নাম: জর্দা বসন্ত
লেখক: অগ্নি রায়
প্রকাশক: সিগনেট প্রেস
প্রচ্ছদ: দেবশিস সাহা
প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০২০
বিনিময়: ১০০ টাকা

ছবি সৌজন্য:Istock, Adobestock

Author Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

Picture of জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
Picture of জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com