(Chabimura) শৈলশহর জম্পুইতে রাত্রিবাসের পর এবার গন্তব্য ত্রিপুরার দক্ষিণে। মাথায় গেঁথে গেছে ঊনকোটির শিলা শিল্প। গভীর থেকে গভীরতর হয়ে সে রহস্য প্রবাহিত হল গোমতী নদীর স্রোতধারায়। দক্ষিণ ত্রিপুরার ৮৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দেবতামুড়া পর্বতমালা দেখতে চলেছি। তারই একটি অংশ ছবিমুড়া। এখন তো হাতের মুঠোয় সব ব্রিফিং পেয়ে যাই আমরা, কিন্তু চাক্ষুষ না করা অবধি শান্তি নেই। গোমতী নদীর তীর থেকে খাড়া উঠে যাওয়া পাথুরে কালাঝারি পাহাড়ে কারা যেন অসীম মমতায় কুঁদে রেখে গিয়েছে দেবী দুর্গা, গণেশ ও কার্তিক সহ আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি।
আগের পর্ব পড়ুন: ত্রিপুরার ৭ কাহন – [১], [২]
কারা বানিয়েছিলেন এই দৃষ্টিনন্দন মূর্তিগুলি, কারা করেছিলেন পৃষ্টপোষকতা, সে বিষয়েও বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ ইতিহাস। তবে ইতিহাসবিদেরা বলেন দেবতামুড়ার ভাস্কর্যগুলি ঊনকোটির থেকে ৫০০ বা ৭০০ বছর পরে তৈরি। তাহলে কি আরেকদল ভাস্করের কল্পনাপ্রসূত এই ছবিমুড়া? তারা কি ঊনকোটির মতোই তীর্থস্থান বানাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন? (Chabimura)

আসলে বৈচিত্র্যময় উপজাতিদের আখড়া হলেও উত্তরপূর্বের মণিপুর যেমন সনাতনী বৈষ্ণবদের, অসম যেমন মা কামাখ্যার মাহাত্ম্যে ভরপুর শক্তিপীঠ, সেভেন সিস্টার্সের অন্যতম ত্রিপুরা রাজ্যটিও যেন শক্তিময়ী দুর্গা বা কালীর আরাধনায় এখনও সোচ্চার।
হাঁটুজল মাড়িয়ে সেখানে গেলে দেখা যাবে স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইটের প্রাকৃতিক স্থাপত্য, যা স্থানীয় উপজাতিদের কাছে পরম পূজ্য ছড়াদেবতা। আর এক জায়গায় বোট থেকে নেমে দুর্গম হাঁটাপথে দেখে নেওয়া যায় এক ঝরনা ও গুহা। পায়ে হাঁটা পুরো পথটাই গেছে ঝরনার জলে সিক্ত পাথরের উপর দিয়ে।
কেউ বলে ছবিমুড়া। কেউ চাবিমুরা বা চোবিমুরা। ঢুকেই মনে হল ত্রিপুরার আমাজন রেইন ফরেস্ট। গোমতী নদীর কোল ঘেঁষে চির বসন্তের দেশ। আর এই ছবি বা চাবি যাই হোক না কেন তার আসল অর্থ হল দেবতা। তাই স্থানীয়দের মুখে এই ছবিমুড়া হল দেওতাদের গ্রাম। সেখানে যেতে গেলে প্রথমে পৌঁছতে হবে গোমতী জেলার অমরপুরে। সেখান থেকে ১২ কিমি দূরে রাজকং গ্রামে গোমতী নদীর পাড় বরাবর এই দেওতামুড়া পাহাড়। আশপাশে বসবাস করেন জামাতিয়া উপজাতির মানুষ।

এই রহস্যময় পাহাড় দেখতে গেলে হাতে সময় নিয়ে যেতে হবে। গোমতী নদীতে ভেসে ভেসে এক অলস শীতের দুপুরে নৌকা বিলাসে দেখা যাবে অরণ্যসঙ্কুল নদী। আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অভিনব শিল্পকর্ম। প্রধানত হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি সম্বলিত এই অভিনব শিল্পকর্ম নজর কাড়ে। দেবতামুড়া পাহাড়শ্রেণি বিস্তৃত রয়েছে উদয়পুর ও অমরপুরের মধ্যে (দুটি জায়গার মধ্যে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার)।

পৌষ-সংক্রান্তির সময় প্রতি বছর ‘ছবিমুড়া উৎসব’ হয় এখানে। উপজাতিদের নাচ-গান সমৃদ্ধ সেই রংবাহারি উৎসব স্থানীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্পর্কে একটা আকর্ষণীয় ছবি তুলে ধরে পর্যটকদের সামনে। প্রামাণ্য তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০-১৬০০ শতাব্দীর সময়কালে নির্মাণ হয়েছিল এই সব শিল্পকর্ম। এই রহস্যময় পাহাড়ের এসব শিল্পকর্ম হয়ত ত্রিপুরার কোনও প্রাচীন রাজানুগ্রহেই নির্মিত হয়েছিল। কারও মতে আবার অষ্টম শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল খোদাইয়ের কাজ। তাঁদের লোককথা অনুযায়ী, পুরো এলাকাটি দেবী রুদ্র ভৈরবীর স্থান। জামাতিয়াদের রাজা ছিলেন চিচিংফা। তাঁর ঠাকুরদার বাবার আমলে তৈরি হয় ওই সব ভাস্কর্য।

এখানকার বিশেষত্ব হল গোমতী নদীর জলে নৌকা বা মোটরবোটে ভেসেই দেখতে হবে এই সব অনুপম সৃষ্টি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, গণেশ, কার্তিক, বিশ্বকর্মা-সহ আরও অজস্র দেবদেবী ও পশুপাখির মূর্তি খোদাই করা রয়েছে পাহাড়ের উঁচু প্রাচীরে। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া গোমতী নদীর জলে এই নৌকাযাত্রা (আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে একদিকে যেতে) উপভোগ্য হবে প্রতিটি মুহূর্তে। আমাজনের মত ঘন জঙ্গলে ঢাকা নিঃস্তব্ধ পরিবেশে বিচিত্র পাখির বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাগমও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। (Chabimura)

তবে এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাস্কর্যটি হল জামাতিয়াদের ‘দেবী চাক্রক-মা’। এক ঝলক দেখলে মনে হবে আমাদের অতি চেনা মহিষাসুরমর্দিনী। দেবীর দশ হাত। নয় হাতে অস্ত্র, একদম নীচের বাম হাতে অসুরের চুলের মুঠি। নীচের ডান হাতের ত্রিশূল অসুরের বুকে বিদ্ধ। দেবীর মাথায় চুলের বদলে সাপ। ফেরার পথে নদীর পাড়ে দেখা মিলবে একটি গুহামুখের। লোককথা অনুযায়ী, সেখানেই রাজা চিচিংফা সব সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছেন। সেখানে নেমে কিছুদূর যাওয়া যায়। তারপর রাস্তা বন্ধ। (Chabimura)

বর্তমানে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে পাহাড়গাত্রের ভাস্কর্যগুলি। নৌকায় ভাসতে ভাসতে চোখে পড়ল পড়ন্ত রোদের আলোয় জলের ধারে কিছু উপজাতীয় মানুষের রোজনামচা। কেউ খুঁজে নিয়ে ঝুলিতে ভরছে ভেষজ লতা, শাকপাতা। কেউ বুঝি ঘাসের ফাঁকে খুঁটে খুঁটে প্যাকেট বন্দী করছে মাছ ধরার লোভনীয় কৃমিকীট। কেউ ততক্ষণে জাল ফেলে গোমতীর জলে ধরছে চুনোচানা মাছ। তারপর দল বেঁধে দিনের শেষে সেটুকুই হয়ত পরমানন্দে রেঁধে বেড়ে সেদিনের মত দিনলিপিতে ইতি টানবে। (Chabimura)

এখনও সেই জায়গাগুলোয় ঘন সবুজ মসের আস্তরণ। তার ফাঁক দিয়েই দেখা যায় সব দেবদেবীর মূর্তি। নামা যায় দু’জায়গায়। তবে আমরা নামিনি। হাঁটুজল মাড়িয়ে সেখানে গেলে দেখা যাবে স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইটের প্রাকৃতিক স্থাপত্য, যা স্থানীয় উপজাতিদের কাছে পরম পূজ্য ছড়াদেবতা। আর এক জায়গায় বোট থেকে নেমে দুর্গম হাঁটাপথে দেখে নেওয়া যায় এক ঝরনা ও গুহা। পায়ে হাঁটা পুরো পথটাই গেছে ঝরনার জলে সিক্ত পাথরের উপর দিয়ে। (Chabimura)

ছবিমুড়া দর্শন সেরে এবার আমাদের উদয়পুরের দিকে পা বাড়ানো। সারা ভারত জুড়ে না জানি কত বিচিত্র, সব উদয়পুর রয়েছে। দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার সদর শহরের নামও উদয়পুর। আগরতলা থেকে দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। মধ্যযুগে ত্রিপুরার রাজাদের রাজধানীও ছিল এই উদয়পুর। সে সময় রাঙামাটি নামেই পরিচিত ছিল স্থানটি। রাজস্থানের উদয়পুরের মতো ত্রিপুরার উদয়পুরকেও ‘লেক সিটি’ বলাই যায় নির্দ্বিধায়। রুদ্রসাগর, কল্যাণসাগর, সুখসাগর, অমরসাগর, কমলাসাগর, জগন্নাথ দিঘি, মহাদেব দিঘি ইত্যাদি সুদৃশ্য জলাশয় সৌন্দর্য বাড়িয়েছে উদয়পুরের। (Chabimura)

ত্রিপুরা আবার সর্বার্থে মন্দির-নগরীও। ত্রিপুরাসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী, গুণবতী মন্দির, চতুর্দশ দেবদেবী মন্দির, দুর্গামন্দির, জগন্নাথ মন্দিরের মতো প্রাচীন ও বিখ্যাত মন্দিরগুলির অবস্থান এখানেই। ত্রিপুরার রাজাদের আমলেই তাঁদের অনুগ্রহেই একের পর এক এইসব মন্দির নির্মিত হয়েছিল। উদয়পুরের মন্দিরময়তা আছন্ন করে রাখে। তথ্যতালাসে উদগ্রীব হয়ে পড়ি। (Chabimura)

জানতে পারি এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব খারচি পুজোর কথা। আগরতলায় সাড়ম্বরে পালিত হয় এই উৎসব। ত্রিপুরার রাজবংশের ঐতিহ্য মেনে এখানে নানা স্থানে চতুর্দশ বা চৌদ্দ দেবতার পুজো হয় সমবেতভাবে। প্রতিবছর জুলাই মাসে অমাবস্যার অষ্টম দিনে পালিত হয় এই খারচি পুজো। “খারচি” শব্দটি “খ্যা” শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ “পৃথিবী”। খারচি মূলত মাটির পুজো। (Chabimura)

সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে লেপটে থাকে ত্রিপুরার উপজাতীয় বংশোদ্ভূতদের আচার বিচার। যার মধ্যে চৌদ্দ দেবতা এবং ধরিত্রীমায়ের আরাধনা মূলত পাপের বিনাশের পুজো। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, ঋতুমতী পৃথিবীমাতার ঋতুস্নান। তাই টানা সাত দিন ধরে পুজো চলে। পুজোর দিন, চন্তাইয়ের সদস্যরা চৌদ্দ দেবতাকে “সাইদ্রা” নদীতে নিয়ে গিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবতাদের পবিত্র জলে স্নান করান। অতীব সমারোহে ফুল ও সিঁদুর নিবেদন করে তাদের মন্দিরে উপবেশন করানো হয়। পশুবলিও এই উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছাগল ও কবুতর বলি দেওয়া হয়। লোকেরা মিষ্টি এবং বলির মাংস ঈশ্বরকে নিবেদন করে। উপজাতীয় এবং অ-উপজাতি উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা নিষ্ঠার সঙ্গে এই উত্সব উদযাপন করে। এই উপলক্ষ্যে একটি বিশাল মেলা বসে। (Chabimura)
এই পুজোর এক পৌরাণিক পটভূমি আছে। ত্রিপুরী কিংবদন্তি অনুসারে, “আমা পেচি” হলো মাতৃদেবী বা পৃথিবী মায়ের ঋতুস্রাব। এই সময়ে কোথাও লাঙল চালনা বা মাটি খনন করা হয় না। ত্রিপুরী লোকদের মধ্যে ঋতুস্রাব অপবিত্র বলে বিবেচিত এবং মহিলাদের দ্বারা সমস্ত পুজোর কাজ নিষিদ্ধ। (Chabimura)
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক, শ্রেয়সী লাহিড়ী, Tusk travel
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।