সেপ্টেম্বর ২৬,২০২১ এর সন্ধ্যে। কেমব্রিজ মাল্টিকালচারাল সেন্টার, ম্যাসাচুসেটস। নাটক চলছে। অফ কেন্দ্রিক নাট্যগোষ্ঠীর -অলীক রাস্তা। স্টেজে নীলাভ অন্ধকার। সাদা চাদর ঢেকে বিছানায় শুয়ে আছেন নাটকের প্রোটাগনিস্ট নির্দেশক জয় সেন। স্পটলাইট এসে পড়েছে শ্রেয়ার মুখে। ইউক্যালেলি বাজিয়ে গেয়ে চলেছে সে-
I’d never seen your eyes before
In the sunlight and earth so close
I think trees have shown me now
That the sea belongs to you.
শ্রেয়ার গানের বিষাদ-মাধুরী ছড়িয়ে পড়ছে অপূর্ব কারুকাজে ভরা উঁচু সিলিংয়ের প্রেক্ষাগৃহের ইথারে। টানটান সেই স্তব্ধতা যেন আঙুল দিয়ে ছোঁয়া যায়। এরকম কিছু মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়ে যায় নাটক। এর জন্যই এত পথ হাঁটা। কিন্তু… এরকম একটা মূহুর্তে পৌঁছনো কি সোজা কথা? এ নাটকের পাঁচালির পিছনে কত ডোবা-ভাসা রোমাঞ্চগাথা..
কত শত পরিকল্পনা,কতরকম মত
কত হাতের রশির টানে, চলে নাটক রথ
ভালোবাসায় মিশে যায়, শ্রম প্রাণপাত
শেষে এসে ধরা দেয়, এমন একটা রাত।
প্রবাসে বাংলা নাটক, যেমন তেমন কাজ?
একটুখানি পিছিয়ে দেখি- ধৈর্য ধরুন আজ-
সময়টা গ্রীষ্মকাল,প্যান্ডেমিক সন
মনুষ্যজাতি গেল হাইবারনেশন।
নাট্যোৎসাহী মানুষ যত হল চিন্তান্বিত,
গোটা বছরের প্ল্যান- পুরো ভূপতিত?
‘কানা মামার’ ব্যবস্থা অচিরেই ত্বরান্বিত
সমস্ত অনুষ্ঠানাদি হল Zooমান্তরিত।
অফ-কেন্দ্রিক নাট্য দল, ঠিকানা বস্টন।
Zoom গড্ডালিকাতেই দেয় সন্তরণ।
একুশের বসন্ত এল- বদলে গেল সিন,
মঞ্চে হলেন আভির্ভূতা- দেবী ভ্যাকসিন।
ওয়ার্কশপ ও শ্রুতিনাটক- সহ্য আর হয় না…
ও আর্ট ডিরেক্টর- এবার মঞ্চে চল না।
স্ক্রিপ্ট লেখা, মঞ্চ খোঁজা, সাজোসাজো রব
সেপ্টেম্বরের শেষে ঠিক হবে নাট্যোৎসব।
অ্যাক্টর রেডি, ভেন্যু রেডি, শুরু অডিশন
শুধু স্ক্রিপ্ট প্রতিদিনই হয় আলাদা ভার্শন।
‘অলীক রাস্তা’ নাম নাটকের, গল্প সিনেমার।
এ নাটকে নায়ক এক হেরো ডিরেক্টর।
সিনেমার চরিত্ররা মঞ্চে জীবন ফিরে পায়
ডিরেক্টরের সাথে তাদের কথোপকথন হয়।
লোভ, আশা, ব্যথায় বোনা নকশিকাঁথা
স্বপ্নভাঙা, ভুলে যাওয়া কবিতার খাতা।
নাটক জুড়ে গান, কবিতার জমাট কারুকাজ
ক্লাসিকস অরিজিনালে বোনা শহুরে মন্তাজ।
শুরু হল রিহার্সাল সাজো সাজো রব।
সমস্ত কুশীলবের আছে ফুল টাইম জব।
সাথে বাচ্চা, ঘর সংসার- সময় অতি অল্প
বাইরে ঘরে কোনও কাজেই নেই কোন হেল্পও
বিনা মেঘে বজ্রপাত- জুন মাসের শেষে
দীপকদা চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
ছেড়ে যাওয়া শেষ কাজ- পথনাটিকা ‘খেলুড়ে’
করবই আবার আমরা, দাবি দল জুড়ে।
খেলুড়ের কুশীলব – অ্যাডিকটেড গেমার্স,
জ়ম্বি নিধন, রোবট চালন ,আছে আরো লেয়ার্স।
খেলার পরতে রাজনীতির ছক লুক্কায়িত।
কে আসল দেশবাসী? কেই বা বহিরাগত?
হ্যাশট্যাগ-টুইটে খেলা-গানে জমজমাট ব্যাপার।
মাথার ওপর নাটের গুরু -গেম মাস্টার / ড্রামার।
ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং আছে, আছে ফোক-রক-র্যাপ
কোরিওগ্রাফি এক্সিকিউশনেও নেই কোন গ্যাপ।
ছোট বড়ো বাধা পেরিয়ে রিহার্সাল চলে।
উইকডেজ়-এর রাত্তির, উইকএন্ডের সকালে।
অ্যাক্টর আর ডিরেক্টররা, পণ করে প্রাণ
খেটে চলে, অফ কেন্দ্রিকের রাখতে হবে মান।
অ-বাংলাভাষীদের দিতে স্পেশাল ট্রিট,
নাটকের পাশে পাশেই চলবে সুপার-স্ক্রিপ্ট।
লাইট, মিউজিক, সেট, কস্টিউম, হরেক কিসিম
অবশেষে নামল মাঠে প্রোডাকশন টিম
ফেবু, ইন্সটা, ওয়েব, ইমেইল, আর ফোনকলিং
কোথাও কসুর রাখল না, টিম মার্কেটিং।
বাকি যখন হপ্তা দুয়েক এনথু সবার তুঙ্গে…
দেবী করোনা ভাবেন এবার মাতবেন কী রঙ্গে!
কেমব্রিজ সরকার বলে করতে পারো অ্যাক্টও
কিন্তু মঞ্চে মাস্ক ম্যান্ডেটরি- সেটাই ডিফ্যাক্টো |
যদি মাস্ক না পরো, তবে ছ’ ফিট ডিসটেন্স
রাখতেই হবে স্টেজের ওপর, উইদাউট নেগলিজেন্স।
মুখোশ পরে অভিনয় করা? সেটা কেমন কথা?
কীভাবে ফুটবে মুখে আনন্দ আর ব্যথা?
হচ্ছে সম্পর্কের গল্প, কিন্তু ছ’ফুট দূরত্ব?
কোনওভাবেই সম্ভব নয়, মানা এই শর্ত।
তার থেকে নাটক হোক অন্য কোনও সময়
যখন দর্শক, অভিনেতা আসবেন হয়ে নিঃসংশয়।
কেমব্রিজের নাটকের গ্রুপরা হল এককাট্টা,
ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের হল কী লাভটা?
দর্শকরা ভ্যাকসিন কার্ড দেখান বরং দরজায়,
হলের ভেতর মাস্ক পরুন, নাটক চলার সময়।
স্কুল, কলেজ খুলে গেছে, খেলা ও কনসার্ট
শুধু নাটক নিয়ে কেন এতটা বিভ্রাট?
অবশেষে গভর্মেন্টের বদলে গেল মর্জি
ভেবেচিন্তে মেনে নিলেন নাট্যদলের আর্জি।
আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই নতুন উৎসাহে
ব্যুরোক্রেসির জ্বালায় অনেক সময় গেল বহে।
সেট তৈরি, লাইট, সাউন্ড, স্টেজ রিহার্সাল
পেরিয়ে শেষে এসে গেল নাটকের বিকাল।
গান, র্যাপ, ড্রাম, কবিতা- গেম মাস্টার, গেমার
কুড়ি মিনিটের খেলাতেই গোটা স্টেজ অন ফায়ার।
মুখে হাসি খেলুড়েদের বুক করে টনটন,
দেখলে তুমি দীপকদা, তোমার ‘শো ডিড গো অন!’
শুরু এবার ‘অলীক রাস্তা’ আলোছায়ায় ঘেরা,
স্বামী-স্ত্রী-প্রেমিকার শেষ থেকে ফেরা।
নাটক, ফিল্ম, পিছনে হাঁটা, বাস্তব-না-কল্পনা
কোন চরিত্র সত্যি তবে, কোন ঘটনা সত্যি না?
সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রত্যাশা আঘাত
আদর্শ আর বাস্তবের অনিঃশেষ সংঘাত
স্বপ্ন আর ভালোবাসা জীবিত ও মৃত
আজও দরজায় ফিরে আসে অতীত বিস্মৃত।
দর্শকদের ভাবানোর উপাদান যত
লেখক-পরিচালক মেশান নিজের রুচিমতো।
অলীক রাস্তা- সবার মতে চমৎকার প্রয়াস।
অফ-কেন্দ্রিকের মেম্বার আমি, হতেই পারি বায়াস-ড!
নাটকটা শেষ হবার পর মঞ্চে এসে পড়েছে জোরালো আলো। অভিনেতা, পরিচালক, দর্শকদের মুখোমুখি। পরিচিতির পালা। অভিনন্দন। উইংসের পাশ থেকে দেখতে দেখতে অনেক অনুভূতি এসে গলায় আটকে যায়… প্রতিবারই। করতে পেরেছি আমরা সবাই মিলে। তবে এবারটা যেন ছিল অন্যরকম। নাটক যখন চলে, তখন স্টেজের পৃথিবীর সঙ্গে একটা সেতু তৈরি হয় দর্শকের। একটা ম্যাজিকের মতো। যদি স্টেজের পৃথিবী চেনা হয়, তাহলে একাত্ম হয়ে যাওয়া; আর অচেনা হলে এক অন্য পৃথিবীর ওপর এসে পড়ে এক ঝলক আলো। গল্প, চরিত্রদের হাত ধরে সেই অচেনা পৃথিবীতে যাত্রা। কিন্তু সেদিন যখন আমাদের অভিনেতারা দর্শকদের সামনে, আমি দেখছিলাম আমরা সবাই যেন একই মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছি। এ যেন শুধু নাটক নয়; আর আমাদের নাটকও নয়… এ যেন এক বিশাল যুদ্ধের পর, আহত, কিন্তু হার-না-মানা মানুষের স্বাভাবিকতায় ফেরার উদযাপন।
এই প্রথম মনে হল, আমিও নাটকের জন্য কাজ করা আর নাটক ভালোবাসা মানুষের হাত ধরে আছি- পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। একাত্ম।
অতিমারী হারছে।
ভয় পিছু হঠছে।
ফিরে আসছে জীবন।
মহাসমারোহে।
*ছবি সৌজন্য: দ্যুতি মজুমদার, অরূপ দে, সন্দেশ ভাট
*সঙ্গীত সৌজন্য: অন্বেষা ভৌমিক
জন্ম, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। গত একুশ বছর ম্যাসাচুসেটস,আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এখন পর্যন্ত লেখা বেরিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন পরবাসে এবং আনন্দবাজারে।