banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

এলোমেলো বেড়ানো: ৬

অমিতাভ রায়

ডিসেম্বর ২, ২০২২

Amitabha Ray lakhpat
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] []

লাখপত

লাখপত। না, লাখপতি নয়, লাখপত। মানুষের নয়, একটা জায়গার নাম। কোথায়? ভারতের মানচিত্রেই রয়েছে। তবে খুঁজে পাওয়া কঠিন। গুজরাটের রান অফ্ কছ্-এর মানচিত্র ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বাঁদিকের একেবারে উপরের দিকে এক কোনায় নিশ্চয়ই লাখপত নজরে আসবে। রান অফ্ কছ্-এর বড় বড় বিজ্ঞাপনে কিন্তু লাখপতের নাম থাকে না। 

কেনই বা থাকবে? শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী লাখপতের জনসংখ্যা কমবেশি পাঁচশো। কাছেপিঠে নেই কোনও দোকান বাজার। নেই কোনও হোটেল বা এখনকার হোম-স্টে। থাকার মধ্যে রয়েছে একটা পুরনো আমলের দুর্গ। ভূতুড়ে দুর্গ বলে চিহ্নিত করার আদর্শ জায়গা। তবে দুর্গের পশ্চিম পাশে রয়েছে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত ‘কোরি’ খাঁড়ি। আদতে এই খাঁড়িই ভারত-পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করে। খাঁড়ির ওপারে পাকিস্তানের তটভূমি স্পষ্ট নজরে আসে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ঢলে পাড়ার সময় ছড়িয়ে পড়া সোনালি আলোয় এপার-ওপার মিলিয়ে কোরি খাঁড়ির জলরাশির উপর তৈরি হওয়া প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে এমন একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে মনেই হয় না দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বৈরিতা সতত বিরাজমান।  স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য উপস্থিত বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)।

Rajasthan BSF border
সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য উপস্থিত বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স

গান্ধীধাম শহর থেকেই সফর শুরু করা যাক। কারণ, দেশের প্রায় সমস্ত প্রান্ত থেকে রেলগাড়ি চড়ে গান্ধীধামে পৌঁছনো যায়। আবার এখান থেকেই কছ্ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সহজে যাতায়াত করতে অসুবিধা হয় না। উপরি পাওনা দেশভাগের অব্যবহিত পরেই পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য গড়ে তোলা একটি পরিকল্পিত শহরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়। তখনই মনে পড়ে যেতে পারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অগণিত ছিন্নমূল মানুষ যখন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রান্তে এতটুকু মাথাগোঁজার ঠাঁই খুঁজতে পরিবার পরিজন সহ জীবন বাজি রেখে দিবারাত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই মরশুমে দেশের অন্য প্রান্তে সরকারি দাক্ষিণ্যে নির্বিঘ্নে নীরবে গড়ে উঠেছিল উদ্বাস্তুদের জন্য এক পরিকল্পিত শহর। প্রাথমিক পর্যায়ে সাড়ে তেষট্টি বর্গকিলোমিটার আয়তনের গান্ধীধামে লোকসংখ্যা তেমন বেশি না হলেও তেরো কিলোমিটার দূরের কান্ডলা বন্দরের কর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থা এখানে করার পর এখন লোকসংখ্যা কমবেশি আড়াই লক্ষ।

গান্ধীধাম থেকে সকাল সকালই বেরিয়ে পড়া ভালো। প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরের জেলা-সদর ভুজ শহরে প্রথম বিরতি। ঘণ্টা দেড়েক সময়, এবং এখানেই যেন অপেক্ষা করছে এক অপার বিস্ময়। ২০০১-এর ২৬শে জানুয়ারি যে শহরটি প্রবল ভূমিকম্পের দাপটে আক্ষরিক অর্থেই ধূলিসাৎ হয়েছিল এখনকার ভুজ শহরে তার কোনও স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আরও বিস্ময়কর বিষয় পুরো শহরটি গত দুই দশকে নতুন করে গড়ে তোলা হলেও পুরোনো আমলের প্রাসাদগুলিতে কোনও সংস্কারের প্রয়োজন হয়নি। ভূমিকম্পের সময়ও প্রাচীন অট্টালিকাগুলি অক্ষত ছিল।

ভুজ পেরোলেই শুরু হবে সত্যিকারের রান অফ্ কছ্। অর্থাৎ মরুভূমির আগুন ঝলসানো সৌন্দর্য। লাখপত পর্যন্ত প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দীর্ঘ পথের ধারে দেবপুর, নাত্রাখানা ইত্যাদি লেখা সড়ক-ফলক নজরে এলেও কোথাও জনমনিষ্যির চিহ্নটি নেই। হালকা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মসৃণ রাস্তা এগিয়ে চলেছে। আর দু’ধারে ছড়িয়ে রয়েছে বালির ঢিপি। মনে হয় কোনও এক অজানা সময়ে কোত্থেকে যেন বালির ঢেউ আছড়ে পড়ে এখন স্থির হয়ে গেছে। রবিরশ্মির ছটায় সেই বালির কী বাহারি রং! কোথাও গলানো সোনার মতো ঝকঝকে, কোথাও আবার ম্যাড়মেড়ে সাদা। তার মধ্যেই হঠাৎ করে যেন হানা দিয়েছে কোনও এক নাম না জানা গুল্ম। বেঁচে থাকার কী নিদারুণ প্রচেষ্টা! স্বভাবতই তার আশপাশের বালির রঙে লেগেছে ফ্যাকাশে সবুজের কালচে ছোপ।

Bhuj City
ভুজ পেরোলেই শুরু হবে সত্যিকারের রান অফ্ কছ্

এপ্রিলের তাপদগ্ধ প্রকৃতিতে এই পথেই সত্যিকারের মরীচিকার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যেতে পারে। কোনও চড়াইয়ের শীর্ষে পৌঁছনোর পর দূরের উতরাইয়ের দিকে নজর পড়লেই মনে হবে সামনেই অপেক্ষা করছে এক উজ্জ্বল জলাশয়। এলোমেলো হাওয়া ক্রমাগত বয়ে যাওয়ার জন্য মনে হবে সেই কল্পিত জলাশয়ের জলে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। একেই কি বলে মরীচিকা!

এমন পরিস্থিতির সঙ্গে চোখ সইয়ে নেওয়ার সময় হঠাৎ করেই নজরে আসে একদল নারী-পুরুষ, কারও কোলে শিশু, মাথায় ঝুড়ি নিয়ে মরুভূমির বালির মধ্যে গড়ে তোলা এক রাস্তা দিয়ে কোথায় যেন এগিয়ে চলেছে। ঝুড়ির ভেতরে কী আছে বোঝা না গেলেও ফুল রয়েছে তা দূর থেকেই বোঝা যায়। মরুভূমির তল্লাটে, তাও আবার এই প্রবল গরমে কী করে এত ফুল ফোটে কে জানে! রীতিমতো ভাবনার বিষয়। একইরকমভাবে উল্টো দিক থেকেও আসতে থাকা দলবদ্ধ মানুষের সারি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না কোনও এক নির্দিষ্ট গন্তব্যের লক্ষ্যেই এই যাতায়াত। তবে ফিরতি পথের যাত্রীদের মাথার ঝুড়িতে ফুল অনুপস্থিত।

সত্যি সত্যিই একটু দূরের এক পাহাড়ের উপরে দেখা যাচ্ছে এক মন্দিরের চূড়া। অনেক উঁচু পাহাড় নয়। টিলা, নাকি বালির উঁচু স্তূপ, এইসব ভাবনার মধ্যে গাড়ির চালক যদি প্রস্তাব দেন যে মন্দিরে গেলে চায়ের দোকান পাওয়া যাবে, তাহলে কি না বলা যায়! ভুজ থেকে একশো কিলোমিটারের বেশি পথ প্রখর গরমে মরুভূমিতে পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। সেই পরিস্থিতিতে চা পানের সুযোগ হাতছাড়া করা কোনও মতেই উচিত নয়। কাজেই অপ্রশস্ত, তবে পাকা রাস্তা ধরে গাড়ি চড়াই ভাঙতে শুরু করে। রাস্তার দু’পাশে অবিশ্যি পদাতিক পুণ্যার্থীদের আসা যাওয়ায় বিরতি নেই।

মরুভূমির তল্লাটে, তাও আবার এই প্রবল গরমে কী করে এত ফুল ফোটে কে জানে! রীতিমতো ভাবনার বিষয়। একইরকমভাবে উল্টো দিক থেকেও আসতে থাকা দলবদ্ধ মানুষের সারি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না কোনও এক নির্দিষ্ট গন্তব্যের লক্ষ্যেই এই যাতায়াত। তবে ফিরতি পথের যাত্রীদের মাথার ঝুড়িতে ফুল অনুপস্থিত।

দূর থেকে দেখা পাহাড়ের উপরের মন্দির ১৮১৯-এর ভূমিকম্পের পর থেকেই পরিত্যক্ত। ভূমিকম্পের পরে, পাহাড়ের পাদদেশে একটি নতুন মন্দির তৈরি করা হয়। এখন সেখানেই পুণ্যার্থীদের নিত্য আনাগোনা। 

মন্দিরের আরাধ্যা দেবী আশাপুরা মাতা বা আশা পূরণের মা। তবে মন্দিরের দেওয়ালে খচিত আছে,-মাতা নো মাধ। সরকারি নথিতেও এমনটাই লেখা আছে। সাবেক আমলে কছ্ দেশিয় রাজ্য ছিল। সেখানকার জাদেজা রাজবংশের গৃহদেবতা মাতা নো মাধ। এখন রাজার রাজত্ব বিলুপ্ত। তবে প্রজাদের মধ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে আশা পূরণের দেবীর প্রভাব। সেই কারণেই গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ উপেক্ষা করে মরুভূমিতে কষ্টকর পথ পরিক্রমা। একেই হয়তো বলে অন্ধ ভক্তি অথবা পরম আসক্তি।

মন্দিরের আরাধ্য দেবী আশাপুরা মাতা বা আশা পূরণের মা

বেলা দ্বিপ্রহর। চায়ের দোকানে ঝাঁপ পড়ে গেছে। তবে মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে খিচুড়ি, পুরি, তরকারি, চাটনি এবং লস্যি। একপাতেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণ।

অতঃপর আবার যাত্রা। আরও প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। তবে এবার যেন প্রকৃতি কিঞ্চিৎ সদয়। বালির সমুদ্রে একটু একটু সবুজের ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে। দেখতে দেখতে এসে গেল চিরকার্তা অভয়ারণ্য। সত্যি সত্যিই তারের জালে ঘেরা একফালি সবুজ। ভেতরে কোন জন্তু জানোয়ার রাখা আছে জানা হয়নি। তবে মূল সড়কের সমান্তরালে দু’-তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সবুজের অস্তিত্ব চোখের জন্য নিশ্চিত স্বস্তি।

অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকায় গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র একটু বিশ্রাম নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়ায় বাধ্য হয়েই জানালা খুলতে হয়। হই হই করে ছুটে আসে মরুভূমির গরম হাওয়া। তবে পুরোপুরি শুকনো গরম নয়, সঙ্গে যেন একটা ভেজা ভেজা ছোঁয়া রয়েছে। বোধ হয় কাছাকাছির মধ্যে কোনও জলাভূমি আছে। আর একটু এগোলেই বোঝা যায় কোরি খাঁড়ির দিকে পথ এগিয়ে চলেছে, এবং সেই মুহূর্তে একেবারেই আকস্মিকভাবে সম্মুখে উপস্থিত লাখপত দুর্গ।

সামনে দুর্গের দেওয়াল। আর বাঁ দিকে কোরি খাঁড়ি। অর্থাৎ দেশের এই প্রান্তের শেষ বিন্দুতে শেষ পর্যন্ত সুস্থ শরীরে পৌঁছনো গেছে। পাশের ছোট্ট গুমটিতে ওই গরমেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত বিএসএফ-এর জওয়ান দেখিয়ে দিলেন দুর্গের প্রবেশপথ। খাঁড়ির ওপারে তখন প্রতিবেশী দেশের তটরেখা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। 

rann of kutch
হই হই করে ছুটে আসে মরুভূমির গরম হাওয়া

প্রাচীন ও কিছুটা বিধ্বস্ত হলেও লাখপত দুর্গের আয়তন তো কম নয়। এক পাশে সমুদ্রের খাঁড়ি থাকায় বাদবাকি তিনদিক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের উঁচু প্রাচীর। কিন্তু তার প্রবেশপথ এত সঙ্কীর্ণ কেন? তখনই খেয়াল হল সে আমলের সব দুর্গের স্থাপত্যরীতির এটাই ছিল দস্তুর। বাইরের লোক যেন হঠাৎ করে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পাঁচিলের ওপরে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। একটু এবড়োখেবড়ো। ভগ্নদশা। তবে সাবধানে সামলেসুমলে ওপরে উঠে গেলে বোঝা যাবে এই কষ্টকর সফর পুরোপুরি সার্থক। একদিকে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য আর অন্যপ্রান্তে দিগন্ত বিস্তৃত রান অফ্ কছ্ বা বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর। আর দুর্গের প্রাঙ্গণে অবস্থিত তিন ধর্মের উপাসনালয়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

কথিত আছে যে রাও লাখার নামে দুর্গটির নামকরণ করা হয়েছিল। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সিন্ধুতে রাজত্ব করতেন। তখন সিন্ধু নদ এই এলাকা দিয়ে বয়ে যেত। ফলে লাখপত ছিল কৃষিনির্ভর এক সমৃদ্ধ অঞ্চল। তাছাড়া সমুদ্রের খাঁড়ি পাশে থাকায় বৈদেশিক বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা ছিল। ফলে এখানে ছিল বহু ধনী মানুষের নিয়মিত বসবাস। চলতি কথায় ধনী মানেই লাখপতি। অন্ততঃ সাবেককালে বলা হত। সেই যুক্তি মেনে নিলে লাখপত নাম নিঃসন্দেহে সময়ের নিরিখে সার্থক। আবার নৌ-বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ায় নিয়মিত জাহাজের আনাগোনা ছিল। অর্থাৎ অনেক পোত এখানে নোঙর করত বলে জায়গাটার নাম ‘লাখ পোত’ থেকে লাখপত হতেই পারে। ঐতিহাসিকভাবে লাখপত একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-শহর ছিল। বলা হয় সেই সময় এখান থেকে বছরে এক লাখেরও বেশি ‘কোরি’ (সেই সময়ের মুদ্রা) রাজস্ব আদায় করা হত। হয়তো, সেই কারণে (এক লাখ কোরির জমি) সিন্ধু নদীর অববাহিকায় অবস্থিত শহরটির এমন নামকরণ হয়েছিল।

এখনকার পরিত্যক্ত দুর্গটির নির্মাণকাজ ১৮০১ নাগাদ শেষ হয়। দুর্গের উত্তর দিকে বয়ে যাওয়া সিন্ধু নদী ছিল সিন্ধু প্রদেশ আর  কছ্-এর সীমান্তরেখা। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে লাখপতে আসে সমৃদ্ধির জোয়ার। জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। কৃষির সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য মিলে যাওয়ায় লাখপত তখন এক সমৃদ্ধ জনপদ।

তখন সিন্ধু নদ এই এলাকা দিয়ে বয়ে যেত। ফলে লাখপত ছিল কৃষিনির্ভর এক সমৃদ্ধ অঞ্চল। তাছাড়া সমুদ্রের খাঁড়ি পাশে থাকায় বৈদেশিক বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা ছিল। ফলে এখানে ছিল বহু ধনী মানুষের নিয়মিত বসবাস। চলতি কথায় ধনী মানেই লাখপতি। অন্ততঃ সাবেককালে বলা হত। সেই যুক্তি মেনে নিলে লাখপত নাম নিঃসন্দেহে সময়ের নিরিখে সার্থক।

তবে এই জৌলুশ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৮১৯-এর বিধ্বংসী ভূমিকম্প লাখপতে নিয়ে আসে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ভূমিকম্প এতটাই বিধ্বংসী ছিল যে সিন্ধু নদীর গতিপথ সম্পূর্ণভাবে সরে যায়। দুর্গের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি সিন্ধু প্রদেশে নতুন গতিপথ খুঁজে নিল। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগর-বন্দর লাখপত পরিত্যক্ত জনপদে রূপান্তরিত হয়ে গেল।

দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আজ লাখপতের প্রধান আকর্ষণ। যদিও দুর্গের অভ্যন্তরে একটি নির্জন প্রাঙ্গণ এবং বিগত যুগের অনেকগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন রয়েছে, তবে দুর্গের প্রাচীরটি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দুর্গটির বেশ কয়েকটি ফটক ও বুরুজ রয়েছে যা এখনও দেখা যায়। 

Ruins of Lakhpat Fort
দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আজ লাখপতের প্রধান আকর্ষণ

সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দুর্গের মধ্যে রয়েছে একটি গুরুদোয়ারা, একটি সুফি মাজার আর একটি মন্দির। মন্দিরে শিবলিঙ্গের পাশেই অবস্থান করছেন অন্যান্য অনেক দেবদেবীর মূর্তি। কোনওটাই বিশালাকার নয়, এবং নেই তাঁদের নাম-মাহাত্ম্য। স্থানীয় ভাষ্যে অবশ্যি মন্দিরটি ‘হাটকেশ্বর মহাদেব’ মন্দির নামে পরিচিত।

দুর্গের প্রাঙ্গণে অবস্থিত গুরুদোয়ারার গ্রন্থী অতিথি আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখতে রাজি নন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একতলা বাড়িতে সর্বক্ষণ মৃদু স্বরে চলছে গুরবাণী (সুর করে গ্রন্থসাহেব পাঠ)। কবে নাগাদ গুরুদোয়ারাটি স্থাপিত হয়েছিল তা বলতে না পারলেও তিনি অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না যে গুরু নানক অন্ততঃ দু’বার লাখপতে বসবাস করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর অবস্থানের পরে ষোড়শ শতাব্দীর কোনও এক সময়ে এই গুরুদোয়ারাটি স্থাপিত হয়েছিল।

সুফি পীর গাউস মোহাম্মদের সমাধিটি নজর কাড়ে। গাউস মোহাম্মদকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করা হত এবং তার অনেক অনুসারী ছিল বলে শোনা যায়। ১৮৫৫-য় মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীদের অনুদানে সমাধিটি নির্মিত হয়। সম্পূর্ণ কালো পাথরে তৈরি অষ্টভুজাকৃতি সমাধিসৌধটি ‘কুবো’ নামে পরিচিত। কুবোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নয়টি গম্বুজ। পাথরের সমাধিসৌধের পাশে রয়েছে একটি জলের ট্যাঙ্ক। লোকের বিশ্বাস এই ট্যাঙ্কের জল নাকি সর্বরোগের নিরাময়ের উপযোগী। হবেও বা!

মন্দিরে শিবলিঙ্গের পাশেই অবস্থান করছেন অন্যান্য অনেক দেবদেবীর মূর্তি। কোনওটাই বিশালাকার নয়, এবং নেই তাঁদের নাম-মাহাত্ম্য। স্থানীয় ভাষ্যে অবশ্যি মন্দিরটি ‘হাটকেশ্বর মহাদেব’ মন্দির নামে পরিচিত।

মরুপ্রান্তরের এক প্রান্তে পরে থাকা লাখপত দুর্গের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বধর্ম সমন্বয়ের নিদর্শন। নির্জন জনবসতি, পরিত্যক্ত বাড়িঘর, দুর্গ-বন্দর ইত্যাদি বিশেষত বিপর্যয়ের নীচে চাপা পড়া জনপদের বিস্ময়কর আখ্যান, লোকশ্রুতি এবং ইতিহাস মিলেমিশে যে কাহিনি নির্মিত হয় তা সর্বদেশে সর্বকালে আকর্ষণীয়। লাখপতও ব্যতিক্রম নয়।

শেষপাতে বলে রাখা ভালো ফিরতি যাত্রায় অন্য পথ বেছে নিলে সফর সার্থক হতে পারে। কোরি খাঁড়ির উপকূল ধরে যে পথ গেছে তা যথেষ্ট উপভোগ্য। গোধূলি লগন পেরিয়ে যাওয়ার পর সেই পথে যাত্রা শুরু করলে আলো-আঁধারের মধ্যে সমুদ্রের লোনা হাওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি অনেকটাই লাঘব হবে। কোটেশ্বর মন্দিরের লাগোয়া খাবারের দোকানে বিশুদ্ধ গুজরাটি খাবার পাওয়া যায়। একটু এগিয়ে নারায়ণ সরোবরের পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছনোর পর কোরি খাঁড়িকে বিদায় জানিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরতে হবে। তারপর বারান্দা, ভালসার, কোঠারা হয়ে মুন্দ্রা বন্দর। অর্থাৎ একই দিনে প্রাচীনকাল থেকে আবার আধুনিক সময়ে প্রত্যাবর্তন।

ছবি সৌজন্য: Flickr, Wikimedia Commons

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com