banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দিনের পরে দিন: অজানা বৃতানি

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Audierne by the Atlantic

বেশ কয়েকমাস আগে আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু ফিলিপ বেনোয়া-র আমন্ত্রণে প্যারিস যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। এটা আমার প্রথম প্যারিসযাত্রা নয় অবশ্য। আশির দশকে একবার গিয়েছিলাম নামকরা এক ভ্রমণসংস্থার সঙ্গে, তিন রাত দু’দিনের এক ঝটিকা সফরে। তারই মধ্যে লুভর মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার, নোতরদাম গির্জা প্রভৃতি দ্রষ্টব্য স্থানে বুড়ি ছুঁয়ে ক্যালে থেকে জাহাজে ডোভার পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম লন্ডনে।

অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘পথে প্রবাসে’ বইতে লিখেছিলেন, প্যারিস হল অর্ধেক নগরী আর অর্ধেক কল্পনা। এমন একটা শহরকে কি এত স্বল্প সময়ে চেনা যায়? তাই সত্তর ছুঁইছুঁই বয়স ও নানাবিধ শারীরিক সমস্যা নিয়েও ফিলিপের আমন্ত্রণ এড়াতে পারলাম না। আপনজনদের সস্নেহ নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে উড়োজাহাজের টিকিট কেটে পাড়ি দিলাম প্যারিস, এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে।

ফিলিপ থাকে এক শহরতলি এলাকায় — প্যারিসের গা ঘেঁসে নোয়াজি শ’তে। সে সরবোঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা সংস্থায় বাংলা পড়ায়। নব্বুইয়ের দশকে কৃত্তিবাস ও বাল্মীকি রামায়ণের ওপর গবেষণার কাজ করেছে দীর্ঘ দিন, কলকাতায় বসে। বাংলা ভাষাকে সে তার দ্বিতীয় মাতৃভাষা বলে মনে করে। বছর দু’তিনেক আগে সে ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে, অতলান্তিক মহাসাগরের পারে বৃতানির ওদিয়ের্নে একটি বাড়ি কিনেছে। সেই থেকে তার সাধ, এই দিদিটিকে তার সেই স্বপ্নের আবাসে নিয়ে যায়।

এক সময়ে এই বৃতানি ছিল এক স্বাধীন সামন্ত রাজ্য। দু’টি কেল্টিক ভাষা, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সংস্কৃতি নিয়ে বৃতানির মানুষ নিজেদের মতো করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাঁচতে চেয়েছিল। ঢিল ছোড়া দূরত্বে ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা খুব সহজ ছিল না। নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে দীর্ঘ লড়াই চালাতে হয়েছে বৃতানির সামন্তদের। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে বৃতানির সিংহাসনের একমাত্র ওয়ারিশ, সামন্ত কন্যা অ্যান বিবাহ-সূত্রে আবদ্ধ হলেন ফ্রান্সের তরুণ রাজা অষ্টম চার্লসের সঙ্গে। বহু দিন থেকেই বৃতানির ওপরে ফ্রান্সের শ্যেন দৃষ্টি ছিল। অতএব এই বৈবাহিক সম্পর্ক পাকাপাকি হওয়ার আগেই বৃতানির সামন্তর সঙ্গে চুক্তি হল ফ্রান্সের রাজার। এই চুক্তি অনুযায়ী বৃতানি যুক্ত হয়ে গেল ফ্রান্সের সঙ্গে। সেই থেকেই বৃতানি ফ্রান্সের এক অঙ্গ রাজ্য।এখানকার মানুষজন এখন ফরাসিভাষী হলেও আজও এলাকার প্রবীণেরা নিজেদের আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলতে পছন্দ করেন।

প্যারিস থেকে বৃতানির দূরত্ব ৪০০ মাইল। এক সকালে ফিলিপের গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়া হল। গাড়ি চালানোর সময় ফিলিপের অভ্যেস সিডি চালিয়ে গান শোনা। কোনও দিন সে শোনে সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, কোনও দিন শোনে লোকসঙ্গীত। আজ সে আমাদের শোনালো মেহদি হাসানের সব অসাধারণ সব গজল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বৃতানিতে পৌঁছলাম। এবার আমাদের সঙ্গী অতলান্তিক। স্থানীয় ভাষায় তার নাম হল মের দিরোয়াজ। এখন আমাদের গন্তব্য হল ব্রিতানির এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, ওদিয়ের্ন। সেখানেই ফিলিপের বাসস্থান।

পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে সাতটা পেরিয়ে গেল। হাতঘড়ির দিকে না তাকালে অবশ্য সে কথা বোঝার উপায় নেই, সূর্যের আলোয় এমন উজ্জ্বল হয়ে আছে চারপাশ। ফিলিপের গাড়ি এসে থামল ওদিয়ের্ন শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। সেখানে এক দিকে সারি সারি দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, পানশালা, ক্রেপ খাবার দোকান। ছোটখাটো একটি বাজারও আছে যেখানে টাটকা শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ থেকে শুরু করে সংসারের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্তর মেলে। ফিলিপের উদ্দেশ্য, আজকের রাতের জন্য কিছু সবজি, মাছ কিনে নিয়ে যাওয়া। আমি ক্লান্তির অজুহাত দিয়ে গাড়িতে বসে রইলাম।

Audierne Church
ওদিয়ের্নের প্রাচীন গির্জা। ছবি তুলেছেন লেখক।

কিন্তু সমুদ্রের আকর্ষণ অমোঘ। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে অতলান্তিকের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারলাম না। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু নীল জলরাশি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মায়াময় দেখাচ্ছে সমুদ্রতটের দৃশ্য। এখনো এই অঞ্চলের মানুষের একটি বড় অংশ মৎস্যজীবী। সাগরের তীর ঘেঁসে তাই নানা মাপের, নানা ধরনের ছোটবড় জেলে নৌকোর ভিড়। অবস্থাপন্ন মৎস্যজীবীরা আবার মাছ ধরা ছাড়াও গ্রীষ্মকালে নৌকো নিয়ে লম্বা পাড়ি জমান সমুদ্রের বুকে। তার জন্য ওঁরা ব্যবহার করেন বিলাস-বহুল সব নৌকো। নোঙর বাঁধা সে রকম কিছু নৌকোও চোখে পড়ল। ক্যামেরা বন্দি করলাম এ রকম কিছু দৃশ্য। ইতিমধ্যে ফিলিপ বাজার-হাট সেরে ফিরে এসেছেন। ফিলিপ বলল, বাড়িতে ঢোকার আগে সে আমাকে কাছাকাছি কিছু জায়গা ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ততক্ষণে সমুদ্রের হাওয়ায় আমিও পথ-ক্লান্তি কাটিয়ে উঠেছি। তাই সানন্দে ফিলিপের প্রস্তাবে সায় দিলাম।

লোকালয় পেরিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল সবুজ গাছপালা ঘেরা পথ দিয়ে। খানিকদূর গিয়ে গাড়ি এসে থামল এক নদীর ধারে। মেঠো পথ ধরে আমরা খানিকটা হেঁটে নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছুলাম। অতলান্তিকের মতো এই নদীরও একটি স্থানীয় নাম আছে — গুয়াইয়েন। এই নদীর জলে গাছের ছায়া পড়ে জলের রং দেখাচ্ছে ঠিক যেন গাছের পাতার গাঢ় সবুজ। নদীর পাড় ঢাকা পড়ে গেছে বনানীতে। কী শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ। আমরা তিন শহরের মানুষ এই সবুজের রূপে মুগ্ধ, নির্বাক। মাঝে মাঝে শুধু কানে ভেসে আসছে পাখির কলতান, তার সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস আর জল তরঙ্গের যুগলবন্দি।

Audierne by Atlantic
ওদিয়ের্নের আর এক গির্জা। পাথরের তৈরি। দরজায় টুকটুকে লাল রং। ছবি- লেখক

আবার গাড়িতে করে পথ চলা শুরু। সমুদ্রকে এক পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি। সামান্য ব্যবধানে চোখে পড়ছে প্রাচীন সব গির্জা আর তাদের আঙিনায় নানা রঙের ফুলবাগিচা। কোথাও আবার বনবন করে ঘুরছে বায়ুকলের চাকা অর্থাৎ উই। এবারে ফিলিপের বাড়ির রাস্তা। উঁচুনিচু রাস্তা পেরিয়ে হাল্কা বসতির মধ্যে ওর বাড়ি। বাড়ির রঙে সাদার সঙ্গে সমুদ্রনীলের ছোঁয়া। বাড়ির সামনে, পিছনে বাগান।ফুটে আছে গোলাপ, হাইড্রেনজা, আরও কত বাহারি ফুল। রয়েছে দেবদারু গাছের ঝাড়। ভারি মনোরম পরিবেশ। বাড়ির ভেতরটা পুরনো ধরনের আসবাব দিয়ে সাজানো। একটা ঐতিহ্যের পরশ আর সাবেকিয়ানা আছে এ বাড়ির ছন্দে। জানলায় ঝুলছে লেসের পর্দা। কাঠের পালিশ করা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম দোতলায়। এখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা। কারুকাজ করা খাট। নরম গদির ওপরে বিছনো রয়েছে ধবধবে সাদা লেসের চাদর। আমার কিটব্যাগ ফিলিপই নিয়ে এল। বললো ও চা বানাবে এবার। আমি যেন নেমে আসি।

ফিলিপের রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা একতলায়। তার এক পাশে ওর বসার ঘর। প্রাণ চা চা করছিল। তাই নিচে নেমে এলাম। বৃতানির সুস্বাদু বিস্কুট দিয়ে গরম গরম চা খেয়ে প্রাণ জুড়োল। সবাই ক্লান্ত। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে আমিই একটু হাত লাগালাম এবার। ফিলিপ বেচারা সারাদিন গাড়ি চালিয়েছে। যদিও তাতে তার কোনও হেলদোল নেই। তবু ওকে আমি রেহাই দিলাম। ফিলিপের ভাঁড়ারে দেখলাম কোনও কিছুর অভাব নেই। চারটে বার্নার-ওলা উনুন। চটপট বানিয়ে ফেললাম ভাত, ডালসেদ্ধ, বেগুনভাজা। সদ্য কিনে আনা সামুদ্রিক মাছ নিয়ে এসেছে ফিলিপ। তায় আবার ইয়া জাম্বো সাইজ করে কাটা। নুন, হলুদ মাখিয়ে বাঙালি প্রক্রিয়ায় মাছও ভেজে ফেললাম।মাছের স্বাদ অপূর্ব। দারুণ খাওয়া হল।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আকাশের মুখ ভার। ঝিরঝিরে বৃষ্টি, তার সঙ্গে এলোপাথাড়ি হাওয়া বইছে। এরকম দিনে বেরুনো মুশকিল। ফিলিপ বলল বেলা বাড়লে, আবহাওয়ার উন্নতি হতে পারে। খাওয়াদাওয়া সেরে তখন বেরিয়ে পড়া যাবে। এ দিকে বৃষ্টি দেখেই আমার আবার খিচুড়ি খাবার সাধ জাগল। ফিলিপকে সে কথা জানাতে দেখলাম, এ ব্যাপারে তার উৎসাহ কিছু কম নয়! ওদিয়ের্নের বাজার থেকে কেনা ফুলকপি, আলু, পেঁয়াজ দিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে ফেললাম। তার সঙ্গে আলু আর ডিম ভাজা। জমিয়ে খাওয়া হল। ইতিমধ্যে সূয্যিমামা মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছেন। ফিলিপের কথাই সত্যি হল। কালক্ষেপ না করে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম।

গুয়াইয়েন নদীর উৎসস্থলে ছবির মতো ছোট্ট মফস্বল শহর এই ওদিয়ের্ন। এক সময়ে এখানে লোহা আর কাঠ আমদানি করা হত মাছ আর শষ্যের বিনিময়ে। সে সব দিন এখন অতীত। সমুদ্রের গা ঘেষে এখন এখানে কর্মচঞ্চল সারি সারি জেটি, মাছধরা ডিঙি, পাথরকাটা সরু সরু রাস্তা, পর্যটকদের আকর্ষণ ত্রেসকাদেক, সোনালি বালু মাখা সমুদ্রতট – সব মিলিয়ে ভারি আকর্ষণীয় ভরা গ্রীষ্মের সুন্দরী ওদিয়ের্ন।
সমুদ্রতটে মস্ত ছাতার তলায় সাহেব মেমসাহেবরা রোদ পোহাচ্ছেন, কেউ সমুদ্রের জলে সাঁতার কাটছেন, বাচ্চারা বালির পাহাড় বানাচ্ছে। একটু সাহসিরা পালতোলা ইয়টে করে পারি দিচ্ছেন দূর সাগরের বুকে। প্রাণ ভরে নোনতা হাওয়ায় নিশ্বাস নিলাম, উপভোগ করলাম সমুদ্রের সৌন্দর্য।

ওদিয়ের্নের কেন্দ্রস্থলও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। সূর্য অস্ত গেলে রঙিন আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এখানকার এক নামী রেঁস্তোরা অ্যান তিউযার খ্যাতি তাদের নানা ধরনের নোনতা, মিষ্টি ক্রেপের জন্য। লেলরইসের খ্যাতি তাদের স্থানীয় পিকো প্রভৃতি রকমারি বিয়ারের জন্য। এ অঞ্চলের ভোজন-রসিক মানুষ আর পর্যটকদের ভিড়ে সারা দিনই জোর কেনাবেচা চলে রেস্তোরাঁগুলোতে। এ রকমই একটা রেঁস্তোরাতে রাতের খাওয়া সারতে ঢুকলাম আমি আর ফিলিপ। যেহেতু আমার ভাষা নিয়ে সমস্যা, খাবার নির্বাচনের কাজটা ফিলিপের ওপরেই বর্তালো। ফরাসি মেনু কার্ড পড়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করে ফরমাসটি ওই দিল। ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতেই হাজির হল মস্ত আকারের গরম গরম স্বাদের ক্রেপ। শেষ পাতে মিষ্টি খাবার অভ্যেস দুই বন্ধুরই। নোনতা ক্রেপ শেষ করে আমরা তাই খেলাম মিঠা ক্রেপ।
যে ফরাসি ক্রেপের খ্যাতি বিশ্বজোড়া তার জন্মও কিন্তু এই বৃতানিতে।

ক্রেপকে প্যানকেকের জাতভাই বলা যেতে পারে। সে অনেক কাল আগের কথা। ময়দার দাম তখন এমন আকাশ-ছোঁয়া, যে তা ছিল বৃতানির সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই ক্রেপ বানানো হত বাকহুইট নামে সস্তার আটা দিয়ে। এখনও ফরাসিরা ক্রেপ বানাতে ময়দার সঙ্গে এই আটা মেশান, কারণ তাতে নাকি ক্রেপের স্বাদ বাড়ে। প্রথম দিকে মিষ্টি পদ হিসেবে ক্রেপ খাওয়ার চল ছিল। সিডারে চুবিয়ে ক্রেপ খেতেন ওঁরা। পরে অবশ্য আমিষ, নিরামিষ নানা রকম পুর দিয়ে ক্রেপ খেতে শুরু করেন ফরাসিরা।

পরের দিন সকালে ফিলিপের গাড়িতে করে গেলাম পোঁয়া দ্যু রা (Pointe Du Raj)। এটি একটি অন্তরীপ, যেখানে পশ্চিম ব্রিতানির সেইন ভূখণ্ডের একটি অংশ এসে মিশেছে অতলান্তিকের মধ্যে। সমুদ্র এখানে উত্তাল ও বিপজ্জনক। সেই প্রাচীন কালে কত যে নাবিক এ অঞ্চলে জাহাজডুবি হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তার আর আজ কোনও হিসেব নেই। ফিলিপের গাড়ি সরকারি পর্যটন অফিস পর্যন্ত যেতে পারল। গাড়ি থেকে নেমে বাকি পাহাড়ি পথ হেঁটে যেতে হবে। বয়স্ক মানুষদের জন্য অবশ্য টিকিট কেটে সরকারি গাড়ির ব্যবস্থা আছে। আমার দুই সঙ্গী মণীশ এবং ফিলিপ দু’জনেই হাঁটতে ওস্তাদ। কিন্তু আমার যেহেতু পায়ের সমস্যা তাই স্থির হল গাড়ি করে যাওয়া। আমাদের সঙ্গে এক জাপানি ভদ্রমহিলা উঠলেন গাড়িতে। তাঁর পায়ের অবস্থা আরও সঙ্গীন। ক্লাচ হাতে নিয়ে চলাফেরা। বয়স নব্বুইয়ের কোঠায়। প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে সুদূর টোকিও থেকে তিনি একা একা ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছেন তিন মাসের জন্য। ছোট্টখাট্টো মানুষ, মুখে সদাই স্মিত হাসি। কী মনের জোর এই বয়সেও! আমিও অনুপ্রাণিত হলাম ওঁকে দেখে।

গাড়ি থেকে নেমে বেশ খানিকটা উঁচুনিচু অসমতল পথ হেঁটে একটা পয়েন্টে পৌঁছলাম। এখান থেকেই সমুদ্রের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পর্যটকেরা ভিড় করেন। কিন্তু সে দিন আমাদের কপাল খারাপ। কুয়াশার জালে চতুর্দিক এমন ঢাকা পড়ে রয়েছিল যে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করব কী, কয়েক হাত দূরের মানুষজনকেও প্রায় দেখা যাচ্ছে না। যদি রোদ ওঠে, সেই আশাতে দেখলাম অনেকেই ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঝড়ের মতো সমুদ্রের হাওয়া বইছে। আমার মাথার ফরাসি লাল বেরে প্রায় উড়ে যাবার জোগাড়। এই টুপিটি আবার দিয়েছেন কলকাতার সুভাষদা। আমার সাদা মাথায় এ টুপি নাকি মানাবে ভালো! আমি একটা পাথরের ওপরে বসে সূর্যদেবের অপেক্ষায় রইলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে কুয়াশা কাটতে শুরু করল। দূরে সমুদ্রের বুকে এবার চোখে পড়ল এক আলোকস্তম্ভ। নাবিকদের সঠিক পথ দেখাবার জন্য কয়েক হাজার বছর ধরে সমুদ্রের বুকে সে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপর দিয়ে কত যে ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে তার প্রমাণ রয়েছে স্তম্ভের দীর্ঘ শরীর জুড়ে। শিশু যিশু কোলে মা মেরির এক অসামান্য মূর্তি আছে এখানে। তাঁর পায়ের কাছে সামুদ্রিক ঝড়ে পর্যুদস্ত এক নাবিকের মূর্তি। নাবিকের চোখেমুখে কিসের যেন এক আকুতি। এই অঞ্চলের জনশ্রুতি, সেই প্রাচীন কালে ডুবো জাহাজ থেকে ভেসে যে স্বল্প সংখ্যক নাবিক জনমানবশূন্য এই ডাঙা পর্যন্ত পৌঁছতে পারত, তারা এসে মা মেরির পায়ের কাছে আছড়ে পড়ত প্রাণভিক্ষা চেয়ে। এই মূর্তি তাদেরই প্রতিভূ।

Quimper in Brittany
কিম্পের-এর শহরতলিতে এক সাঁকোর ধারে লেখক। ছবি – লেখকের সৌজন্যে

ওদিয়ের্ন-এর নিষ্কলুষ বাতাসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিয়ে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হতে হতেই ক’দিনের অবকাশ যাপনের পালা শেষ। ফিলিপেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শেষ। তাই ওদিয়ের্নকে বিদায়। কিন্তু বৃতানির বৃত্তান্ত যে তখনও শেষ হয়নি তা বুঝতে পারলাম, যখন প্যারিস ফেরার সময়, ঘন্টা দুয়েকের পথ অতিক্রম করে এক নদীর ধারের ছোট শহরে এসে ফিলিপের গাড়ি ভিড়লো। জায়গাটির নাম কিম্পের (Quimper)। ছবির মতো সুন্দর প্রাচীন জনপদ একটি। সেই কোন রোমানদের রাজত্বকালে এখানে বসতি শুরু হয়েছিল। তারপর কত যুগ কেটে গিয়েছে। সারাটা দিন এখানে কাটাবার পুরো পরিকল্পনাটাই ফিলিপের। এখানে ঘুরে বেরিয়ে এখানকার বিখ্যাত ক্রেপ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে, বেলাশেষে আবার রাজধানী প্যারিসের পথ ধরব আমরা। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়ল নদীর ওপর দিয়ে পায়ে হাঁটা সাঁকো। পদব্রজে ভ্রমণ। যে দিকে চোখ যায় নানা রঙের ফুলের মেলা। নদীর পাড় ঘেঁষে পুরনো সব ঘরবাড়ি। সব মিলিয়ে মনে হল কয়েক হাজার বছর পেছনে ফিরে গেছি যেন।

Quimper in Brittany
কিম্পেরে গাছের গুঁড়ির তৈরি বাড়ি। তার তলায় ক্যাফে। ছবি তুলেছেন লেখক।

কয়েক পা হেঁটেই কিম্পের-এর বিখ্যাত সেণ্ট করেনটিন গির্জা, যার তৈরির কাজ ত্রয়োদশ শতকে শুরু হলেও শেষ হয়েছিল ষোড়শ শতকে। ১৬২০ সালের এক বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল গির্জার বেল টাওয়ার। ওই অংশটি বাদ দিয়ে বাকি অংশ নিয়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই অসাধারণ প্রাচীন গির্জাটি। আজও বৃতানির কিম্পের-এ আসা পর্যটকদের কাছে এই গির্জার আকর্ষণ একটুও কমেনি । সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনেও মানুষের ভিড় যথেষ্ট। কিন্তু অত লোকের মাঝখানেও কী শান্ত পরিবেশ! গির্জার জানলার রঙিন কাচে খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজকদের ও বাইবেলের নানা কাহিনি নিয়ে অসাধারণ সব ছবি এঁকেছেন পঞ্চদশ শতকের শিল্পীরা। চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা ভাস্কর্য – শিল্পের অপরূপ নিদর্শন। যিশুর সমাধিস্থ করার (entomb) মূর্তি দেখে মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল আমার। গির্জা থেকে বেরিয়ে হাঁটা পথে এগুলাম। পথে চোখে পড়ল গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো কাঠের সব বাড়ি আর তাতে নানা রঙের পালিশ। দেখে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন জন্মদিনের কেকের ওপরে নানা রং দিয়ে আইসিং করা!

এ অঞ্চলের লোকেদের ক্রেপ-প্রীতির পরিচয় মেলে অগুন্তি ক্রেপ-রেস্তোরাঁ দেখে। এ রকমই একটায় ঢুকলাম ক্রেপ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারব বলে। ততক্ষণে আমাদের দু’জনেরই খিদেয় ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। শুধু কী তাই? স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার পায়েরও তো একটু বিরাম নেবার প্রয়োজন! নোনতা, মিষ্টি দু’রকমের ক্রেপ দিয়ে ভূরিভোজ হল। স্বাদেগুণে আমার তো কিম্পের-এর ক্রেপ মনে হল সবার সেরা। কিম্পের-এর কুটিরশিল্পের খ্যাতি তামা, ব্রোঞ্জজাত দ্রব্য নিয়ে হলেও, ওদের মৃৎশিল্পও কিন্তু অনবদ্য। তার কিছু নিদর্শন মেলে ওদের প্রাচীন সব সংগ্রহশালায়। পর্যটকদের কাছেও কারুকাজ করা সে সব মৃৎপাত্রের আকর্ষণ কিছু কম নয়। সেটা বেশ বোঝা গেল দোকানগুলো দেখে। দোকানিরা এমন ভাবে পসরা সাজিয়ে বসে আছে যে দেখে চোখ ফেরানো যায় না। এ সব দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল খানিকটা। সারাদিন হেঁটেছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কিন্তু তাতে উৎসাহ কমেনি! এমনই আকর্ষণ সৌন্দর্যে ভরপুর এই ছোট্ট শহরটার।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এবার তাই ফেরার তাড়া। ক্লান্ত পায়ে হাঁটাপথ পেরিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম। বৃতানির রানি কিম্পেরকে পিছনে ফেলে, এক অপরূপ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে ফিরে চললাম প্যারিসের দিকে।

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com