banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

রবিরাগে- চতুর্থ পর্ব: রবীন্দ্রনাথ ও মাইহার

সুভদ্রকল্যাণ

মে ১৫, ২০২৩

Classical Music and Rabindranath part4
Classical Music and Rabindranath part4
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

আগের পর্ব পড়তে: [১] [] []

গত পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, রবীন্দ্রনাথের গানে মাজ-খাম্বাজ রাগের প্রয়োগ নিয়ে; আমার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ গানটি। মাজ-খাম্বাজ রাগের উৎস হিসেবে মাইহার ঘরানাকে চিহ্নিত করার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও এমন মতও যে প্রচলিত, মাজ-খাম্বাজ একটি সুপ্রাচীন রাগ, যা আলাউদ্দিন খাঁ রামপুরে ওয়াজির খাঁর কাছে শিখেছিলেন, সে কথারও উল্লেখ করেছি। মাজ-খাম্বাজের উৎস যাই হোক, আলাউদ্দিনের ঘরের শিষ্যরাই যে তা বাজিয়ে তার প্রচার করেছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন ওঠে, রবীন্দ্রনাথ এ রাগের সন্ধান পেয়েছিলেন কীভাবে! এই প্রশ্ন ওঠা অসমীচীন নয়, কারণ ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ গানটি রচিত হয়েছিল মাইহার ঘরানার প্রধান দুই প্রতিনিধি, আলি আকবর খাঁ ও রবিশঙ্করের জন্মের প্রায় পনেরো বছর আগে এবং রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন ওঁরা জনসমক্ষে বাজানো শুরু করার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। আলাউদ্দিন খাঁ নিজে এই রাগ বাজিয়ে রেকর্ড করেছিলেন, বা কোনও অধিবেশনে বাজিয়েছিলেন, এমন খবর আমার কাছে নেই। সুতরাং এক্ষেত্রে আলাউদ্দিনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলাপই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাজ-খাম্বাজের পরিচয় ঘটিয়েছিল, এমন ভাবা হয়ত খুব অন্যায় নয়। এত কিছু সত্ত্বেও একটা বড়রকম খটকা থেকেই যায়, কারণ— রবীন্দ্রনাথ যখন ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ রচনা করেন, অর্থাৎ ১৯০৪ সালে, বা তারও অনেক আগে যখন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র জন্য রচনা করেন ‘ব্যাকুল হয়ে বনে বনে’, তখনও আলাউদ্দিনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়নি।

মাজ-খাম্বাজ রহস্যের চেয়েও মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাউদ্দিনের দেখা হওয়া এবং তাঁদের সাংগীতিক আদান-প্রদান অনেক বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে, তাই এই পর্বের আলোচনা সীমিত থাকবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাইহার ঘরানার প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগের কথায়।

Rabindranath Tagore

রবীন্দ্রনাথের সংগীত-দর্শন যাঁরা বুঝেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আলাউদ্দিন অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ও আলাউদ্দিন সমসাময়িক, এক বছরের ছোট-বড়। আলাউদ্দিন ছিলেন কট্টরপন্থী; সংগীতের ক্ষেত্রে নিয়মলঙ্ঘন সহ্য করতেন না, যদিও নিয়মের স্থাবর-অস্থাবর কোনও অস্তিত্বই রবীন্দ্রনাথের কাছে কোনোদিনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আলাউদ্দিনের এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও যে ব্যাপারে সংগীত-দার্শনিক হিসেবে আলাউদ্দিন, রবীন্দ্রনাথ দুজনেরই বেশ মিল পাওয়া যায়, তা হল সংগীতকে মুক্তি দেওয়ার কথা চিন্তা করা। তফাত এই, রবীন্দ্রনাথ ওস্তাদদের বলেছিলেন সংগীতকে ব্যাকরণমুক্ত করতে; আর আলাউদ্দিন সংগীতকে বলেছিলেন ওস্তাদমুক্ত হতে।

১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ আলাউদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানালেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, আলাউদ্দিন শান্তিনিকেতনে যন্ত্রসংগীতের তালিম দেবেন। ওদিকে মাইহারের রাজা কিছুতেই আলাউদ্দিনকে ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, আলাউদ্দিন ব্যবস্থা করেন, তাঁর ভাই আয়েৎ আলি খান শান্তিনিকেতনে থাকবেন, শেখাবেন। সেই বছর হয়ত রবীন্দ্রনাথ আলাউদ্দিনের বাজনা শুনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ ছিলেন, বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে হয়ত যেতেন না। কিন্তু হঠাৎই তিনি সেখানে উপস্থিত হন। সেই অনুষ্ঠানে আলাউদ্দিন বাজাবেন, এমনই কথা ছিল। উল্টো তথ্যও পাওয়া যায়— শ্রী সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি একটি সভায় বলেছিলেন, আলাউদ্দিন নাকি তাঁকে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ থাকার দরুণ সেদিন বর্ষামঙ্গলে তাঁর বাজনা শুনতে যেতে পারেননি।

আলাউদ্দিন ও রবীন্দ্রনাথের একটি নিভৃত সাক্ষাতে, উত্তরায়ণে, আলাউদ্দিন কোনও এক অপ্রচলিত রাগ গেয়ে শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, যা রবীন্দ্রনাথ শুনে চিনতে পারেন। কী রাগ, আমরা তা জানি না। এই গোপন সাক্ষাৎ পরবর্তীকালে কোনও সংগীতরচনার জন্ম দিয়েছিল কিনা, আমরা সে বিষয়েও নিশ্চিত নই। হয়ত দিয়েছিল। কী সেই অপ্রচলিত রাগ, সে বিষয়ে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। সেই রাগ কি মাজ খাম্বাজ?

Ustad Alauddin Khan
আলাউদ্দিন খান

রবীন্দ্রনাথ ও আলাউদ্দিন নিয়ে বলতে গেলে যে কথা বলতেই হয়, তা হল, ১৯৬১ সালে পার্কসার্কাস ময়দানে রবীন্দ্রনাথের জন্ম-শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আলাউদ্দিন তাঁর ভাষণে রবীন্দ্র-স্মৃতিচারণের সময় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত তাঁর নবসৃষ্ট রাগ, রবীন্দ্রকল্যাণ গেয়ে শোনান এবং বাজান। সরোদশিল্পী ও সংগীত-বিশেষজ্ঞ অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কিছু বছর পর ওই একই রাগ আলাউদ্দিন শ্রী অরবিন্দর জন্মদিনে অরবিন্দ ভবনে বাজান; রাগের নাম বলেন গুরু কল্যাণ। পরবর্তীতে আলাউদ্দিনের শিষ্য, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, ওই একই রাগ মলুহা কল্যাণ বলে প্রচার করেন।

আলাউদ্দিনের পুত্র আলি আকবর খানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎটি বড়ই মজাদার একটি ঘটনা। আলি আকবর যখন আলাউদ্দিনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাছে দেখা করতে যান, তখন তিনি বেশ ছোট। আলাউদ্দিন রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করে আলি আকবরকেও বলেন তাঁকে প্রণাম করতে। রবীন্দ্রনাথ আলি আকবরকে কোলে বসিয়ে প্রথমে নাম জিজ্ঞাসা করেন এবং তারপর বলেন একটি গান গেয়ে শোনাতে। সেই সময় আলি আকবর বাবা আলাউদ্দিনের কাছে গানও শিখছিলেন, তাই। গান শুনিয়ে আলি আকবর রবীন্দ্রনাথকে প্রতি-অনুরোধ করেন একটি গান গেয়ে শোনানোর। রবীন্দ্রনাথের তখন বয়স হয়েছে, গানের গলা আর তত সচল নয়, তাই আলি আকবরের সেই গান ভালো লাগেনি। আলি আকবর রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে বসেন, কেন তিনি নাকি-সুরে গান গাইছেন? এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ হেসেছিলেন প্রশ্রয়ের হাসি। এর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁদের রসগোল্লা খেতে দেন; এবং আলি আকবর রসগোল্লা খেয়ে হাত মুছেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লম্বা সাদা দাড়িতে। তিনি বুঝতে পারেননি, ওটা দাড়ি; তিনি ভেবেছিলেন, ওটা একটা সাদা কাপড়।

আলি আকবরের সংগীতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কতখানি পড়েছিল তার হদিশ মেলে আলি আকবরের দুটি রাগ— মেধাবী ও নন্দিনীতে। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে কল্যাণ, নট ও বিলাবলের সংমিশ্রণে আলি আকবর সৃষ্টি করেন মেধাবী। নন্দিনীর সৃষ্টি ১৯৮৯ সালে, লন্ডনের টেগোর সোসাইটির নিমন্ত্রণে বাজাতে গিয়ে। রাগ নন্দিনীর রূপ আমরা পেতে পারি প্রচলিত রাগ রাগেশ্রীতে শুদ্ধ নিখাদ ও পঞ্চম যোগ করে। মাইহার ঘরানায় রাজ্যেশ্বরী রাগের প্রচলন ছিল, যা প্রচলিত রাগেশ্রীতে শুদ্ধ নিখাদ যোগে বাজানো হত। রাগেশ্রীর প্রাচীন রূপেও আরোহীতে শুদ্ধ নিখাদ বা তীব্র নিখাদ লাগার নজির রয়েছে। আলি আকবর এবার সেই রাগেই অবরোহীতে পঞ্চম যোগ করে সৃষ্টি করলেন রাগ নন্দিনী।

Ali Akbar Khan
আলি আকবর খান

এবার আসি আলাউদ্দিন খানের প্রিয়তম শিষ্য, রবিশঙ্করের কথায়। রবিশঙ্করের বিভিন্ন লেখা পড়লে জানা যায়, রবিশঙ্কর রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’র নির্বাচিত অংশ এবং ‘সামান্য ক্ষতি’ অবলম্বনে তাঁর দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালের জন্য অর্কেস্ট্রাল সুর তৈরি করেছিলেন। তাতে, রবিশঙ্করের কথাতেই, রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের লেশমাত্রও ছিল না। ‘চণ্ডালিকা’ নিয়েও রবিশঙ্করের কাজের কথা আমরা জানি, কিন্তু সেইখানেও রবীন্দ্র-গানের সুর কিছু রাখেননি রবিশঙ্কর; কারণ রবিশঙ্কর সেখানে পৌঁছোতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্র-ভাবের কাছাকাছি; যে ভাবের প্রায়োগিকতা কোনও কোনও রাগকে দিয়েছে নতুন রূপ— যেমন খাম্বাজ। রবীন্দ্র-গান সম্বন্ধে রবিশঙ্করের মতামত একটু জেনে নিই:
“ওঁর [রবীন্দ্রনাথের] গানের কথার অংশই ধরুন না কেন। কথায় উনি তো রাজা, বাদশা, যাই বলুন, ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর বহু গানে এত সুন্দর বাণী ও সুরের যোগাযোগ, যে ঐ বাঁধুনিতে মানুষটা এত গান ফাঁদলেন কী করে, ভাবতে হয়। তারপর ধরুন নিছক সুরেরই combination; এবং এ সমস্ত কিছুই সব গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে গিয়েই। …ওঁর ব্রহ্ম সঙ্গীতই ধরুন। তাতে কতই না রাগ-রাগিণীর প্রয়োগ পদ্ধতি আছে। একেবারে ধ্রুপদের মত। অদ্ভুত সুন্দর পঞ্চম সওয়ারি তালে, তেরো মাত্রার তালে, নয় মাত্রার তালে, কত কী! তাতে বোঝা যায় উনি একটা বয়সে এ সমস্তই শিখেছিলেন, জেনেছিলেন, চর্চা রাখতেন ক্ল্যাসিকাল গানের…বিশেষত ধ্রুপদ, ধামারের। এ একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত। …তারপর ওঁর সেই সুরের ঘোরাঘুরি…হয়ত নিলেন একটা ইমন কল্যাণের মুখ, কোথায় গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হামীর হয়ে গেল, কি কেদারা হয়ে গেল। এই যে একটা কোথায় না কোথায় গিয়ে সুরকে মিলিয়ে দেওয়া, এটা ওঁর অদ্ভুত কল্পনার কাজ। আমি চিরদিন মুগ্ধ হয়েছি এতে।”

আলাউদ্দিনের কন্যা, অন্নপূর্ণা দেবীর রবীন্দ্রচর্চা সম্পর্কে খুব কিছু জানা যায় না; তবে তাঁর জীবনীতে পড়েছি, রবিশঙ্করের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনি গীতাঞ্জলি পড়েছিলেন এবং রবীন্দ্র-দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বাজনা যতটুকু আমরা শুনতে পাই, বেশ বুঝতে পারি, খুবই উচ্চ দর্শনবোধ না থাকলে তা বাজানো সম্ভব নয়। তাঁর বাজানো মাজ-খাম্বাজের সঙ্গে রবীন্দ্র-গানে প্রাপ্ত মাজ-খাম্বাজের রূপের সাদৃশ্যের কথা গত পর্বে বলেছি; যদিও যে সময়ের বাজনা, সেই সময়েই বা তার আশেপাশে তিনি গীতাঞ্জলি পড়েছিলেন কি না, জানার কোনও উপায় নেই। যতীন ভট্টাচার্য আবার তাঁর বিতর্কিত একটি গ্রন্থে যা উল্লেখ করেছেন, তা থেকে বোঝা যায়, তাঁর কিছু প্রচেষ্টা ছিল অন্নপূর্ণা দেবীকে রবীন্দ্র-সাহিত্যানুরাগী করে তোলার।

Ravi Shankar
পণ্ডিত রবিশঙ্কর

আলাউদ্দিন খান, আলি আকবর খান, রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবীর শিষ্য নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় আদ্যন্ত রবীন্দ্র-চেতনায় সিক্ত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি রাগের কথা উল্লেখ করেই নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র-ভাবনা সম্পর্কে বলি— ‘পূরবীকল্যাণ’। অসুস্থ অবস্থায় শান্তিনিকেতনে এক সন্ধ্যায় অতিথিশালার বাইরে পায়চারি করার সময় দূর থেকে সম্ভবত, নিখিলবাবু শুনতে পান, ভেসে আসা রবীন্দ্রনাথের গান, ‘আজি এ আনন্দসন্ধ্যা’। রবীন্দ্রনাথের এই গান পূরবী রাগে, এমনই সবাই জানেন। অথচ উত্তরভারতীয় রাগসংগীত পদ্ধতিতে প্রচলিত পূরবীর সঙ্গে তার অনেকই তফাৎ; মূলত ধৈবতের ব্যবহারে— প্রচলিত পূরবীতে ব্যবহৃত হয় কোমল ধৈবত, আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে পূরবীতে লাগিয়েছেন শুদ্ধ ধৈবত। নিখিলবাবু সেই গান শুনেই ফিরে আসেন তাঁর ঘরে। সেতার ধরেন, রবীন্দ্রনাথেরই দেখানো পূরবীর রাস্তা অনুসরণ করেন; নিখিলবাবুর জীবনীকারের দাবি, এভাবেই ‘পূরবীকল্যাণ’ রাগের জন্ম। রবিশঙ্কর পরে দাবি করেন, রাগটি তাঁর সৃষ্টি। সেই দাবির সত্যতা যাচাইয়ে যাব না, কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তি সাজাতে গিয়ে পূরবী রাগ সম্বন্ধে তাঁর কিছু মন্তব্য আমাদের এই রাগটি বুঝতে বা বোঝার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে আরও একটু সাহায্য করতে পারে। রবিশঙ্কর জানান, প্রাচীনকালে পূরবীতে ‘চড়ি কোমল ধৈবত’ প্রযুক্ত হত, যা উত্তর ভারতে গিয়ে কোমল ধৈবত আর বাংলায় এসে শুদ্ধ ধৈবত হয়ে যায়। যদি ধরে নিই তাই হয়েছে, তাহলে বিষ্ণুপুর ঘরানায় শিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা অনুসারে পূরবী রাগই ব্যবহার করেছেন, এবং সেক্ষেত্রে পূরবীকল্যাণ রাগের সৃষ্টি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক হয়ে পড়ে।

তিমিরবরণের পুত্র ও আলাউদ্দিন খানের শিষ্য ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য, তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কাটান শান্তিনিকেতনে। তাঁর কন্যা, রঞ্জনী সরকার জানান, ইন্দ্রনীলবাবুর মন জুড়ে সর্বদাই বিরাজ করতেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে যোগ দেওয়া ইন্দ্রনীলবাবুর কাছে ছিল যেন ঘরে ফিরে আসার মতো। কোথাও হয়ত তিনি অনুভব করতেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কের অনুরণন। শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়ে ইন্দ্রনীলবাবু বলেছিলেন, তাঁর বাবা, তিমিরবরণ শান্তিনিকেতনে আসতে পারেননি, রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ সত্ত্বেও, কিন্তু তিনি এলেন; এও নিশ্চয়ই সেই অনুরণনেরই রেশ। ইন্দ্রনীলবাবুর শান্তিনিকেতনে পরিচয় হয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন ও আরও অনেকের সঙ্গে, যা নিশ্চিতভাবে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতভাবনা তথা রবীন্দ্র-দর্শন আরও অনেক কাছ থেকে জানতে সাহায্য করেছিল – রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই নতুন পরিচয় শেষ দিন পর্যন্ত ইন্দ্রনীলবাবুর চলার পথের সঙ্গী ছিল। রঞ্জনীদেবীর কথা অনুযায়ী, শান্তিনিকেতনের পরিবেশ তাঁর কাছে ছিল তাঁর সঙ্গীতসাধনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত; কিছুতেই তিনি চাইতেন না, শান্তিনিকেতন ছেড়ে বেরোতে। হয়ত, মাইহারে আলাউদ্দিনের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার সময় যে প্রশান্তি তিনি সেখানকার সামগ্রিকতায় লক্ষ্য করেছিলেন, সেই একই প্রশান্তির খোঁজ তিনি শান্তিনিকেতনেও পেয়েছিলেন; ওই জন্যই হয়ত শান্তিনিকেতনে আসা তাঁর কাছে ছিল ঘরে ফেরা; কে বলতে পারে? 

আমরা দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে পড়েছে ভারতের যন্ত্রসঙ্গীতের অন্যতম ঘরানা, মাইহার ঘরানা। শুধু সঙ্গীতরচনা নয়, সামগ্রিক রবীন্দ্র-দর্শন এতদূর প্রভাবিত করেছে একটি ঘরানার এতজন শিল্পীকে, প্রতিনিধিকে, প্রজন্মগত ব্যবধান অতিক্রম করে, যে আমাদের সামনে উঠে আসা গত শতাব্দীর এই ঐতিহাসিক সাঙ্গীতিক মিলন অচিরেই আমাদের পৌঁছে দেয় এক অনন্য মায়াবী সুরলোকে।

Nikhil Banerjee
নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়

তথ্যসূত্র:

১। সঙ্গীতচিন্তা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২। আমার জিবনী: আলাউদ্দিন খান, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদনা)
৩। আপনাদের সেবায়: স্বরসম্রাট আলি আকবর খান-এর আত্মজীবনী, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদনা)
৪। অন্নপূর্ণা: স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৫। Annapurna: An Unheard Melody
৬। রাগ অনুরাগ, রবিশঙ্কর
৭। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও আমরা, যতীন ভট্টাচার্য
৮। একত্র মিলিল যদি: আলাউদ্দিন ও রবীন্দ্রনাথ, সর্বানন্দ চৌধুরী
৯। গান-গপ্পো, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

এই পর্বের জন্য বিশেষ ধন্যবাদজ্ঞাপন:

১। অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
২। রঞ্জনী সরকার

ছবি সৌজন্য: Flickr, Wikimedia Commons, Wikipedia, Facebook

* পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ১৩ জুলাই।

সুভদ্রকল্যাণ বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র। বাংলা ও ইংরাজি উভয় ভাষাতেই তাঁর লেখা সংগীত ও সাহিত্য বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বহু বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছেন, সেগুলিও প্রকাশিত ও সমাদৃত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরাজি ভাষায় কবিতা লেখেন সুভদ্রকল্যাণ। তাঁর আরেকটি পরিচয় রাগসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। সংগীতশিক্ষা করেছেন আচার্য শঙ্কর ঘোষ, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, ডঃ রাজিব চক্রবর্তী প্রমুখ গুরুর কাছে। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা।

One Response

  1. অপূর্ব তথ্যসমৃধ্য লেখা। লেখক এতগুলো বই থেকে তার নির্যাস বের করে অল্প কথায় এক অনবদ্য সৃষ্টি করেছেন। আমরা তার আরো লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষায় রইলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com