banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

‘নবনীতার নোটবই’

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Nabanita Dev Sen
নবনীতা দেবসেন মানেই একমুখ হাসি, বড় একটা টিপ, একটা বড় আঁচিল আর একটা বড় আঁচল৷ সেই আঁচলে আছে গিঁটবাধা ভরসা, ভালোবাসা আর ভাল আশা ৷ কখনও দূরের মনে হয়নি মানুষটাকে৷ কবিতা, গল্প, রূপকথা, প্রবন্ধ বা টুকরো কথার ঝাঁপি নিয়ে বসলেই মনে হয় নিজের মা, দিদি বা দিদিমার ছত্রছায়ায় একটু জিরিয়ে নেওয়া৷ বাংলালাইভের খুব কাছের মানুষ ছিলেন নবনীতাদি। তখনকার দায়িত্বে ছিল সুকন্যা, নবনীতাদির আদরের ছাত্রী৷ তারই আবদারে, সেই কুড়ি বছর আগে প্রথম কলম ধরেছিলেন আন্তর্জালের পাঠকদের জন্য। একটা নোটবই। দিন প্রতিদিনের যাপনচিত্র৷ পাঁচবছর ধরে তা বেরিয়েছিল বাংলালাইভের ই-পত্রিকায়, ৮৬টা পর্ব৷ সেই ৮৬টা টুকরো পরপর সাজিয়ে দিয়েছিলেন বাংলালাইভের আর এক স্বজন, অমিতাভদা (রায়), যিনি এখনও সমানভাবে ভালবাসেন বাংলালাইভ পরিবারের সব্বাইকে আর আবদার মিটিয়ে যান সাধ্যিমতন৷
১৩ জানুয়ারি ২০১১, বাংলালাইভের আরও এক ভালোবাসার বন্ধু অপু, দে’জ পাবলিশিংয়ের ‘সুধাংশুদা জুনিয়র’, দুই মলাটে বন্দি করেছিল ‘নবনীতার নোটবই’৷ আজও ১৩ জানুয়ারি। নবনীতাদির আর একটা জন্মদিন৷ এবার তাঁর চুরাশিতে পা। শুভ জন্মদিন নবনীতাদি! এখনও আকঁড়ে আছি তাঁকে, ঠিক আগেরই মতো, আনন্দের রোববারে বা মনখারাপের দুপুরে। তাঁর পুরনো নোটবই ঘাঁটতে ঘাঁটতে আর এক শ্রদ্ধার মানুষের জন্মদিনের দিনলিপি পেয়ে গেলাম। দশক পেরিয়ে, সেই নোটবই থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক, কবি ও আমাদের ভালবাসার রাধারাণী দেবীর শতবর্ষ উদযাপনের ছবিলিখন৷ যিনি ছিলেন বলেই আমরা পেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় নবনীতাদিকে। যিনি ছিলেন বলেই আমরা আজও পারি নতুন পথ ধরে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে৷ আমাদের ‘ভালোবাসা’-র দুই প্রজন্মের দুই প্রবর্তককে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণতি।

— মৌসুমী দত্ত রায়, প্রধান সম্পাদক। বাংলালাইভ ডট কম। 

জেঠিমার জন্মশতবর্ষ উৎসব

– ‘দিদি, পাড়ার ছেলেরা এসেছে।’
– ‘কেন? এখন তো কোনও পুজো নেই।’ ভাবতে ভাবতে যাই— দেখি পাড়ার কর্মকর্তা ছেলেমেয়েগুলি এসেছে। পাড়ার সব ব্যাপারেই এদের ক’জনকে দেখি।
– ‘দিদি, জেঠিমার এ বছর শতবর্ষ হচ্ছে নভেম্বরে, শুনেছিলাম। নভেম্বর তো চলছে—আমরা কিছু করতে চাই। তারিখটা কত?’

এইভাবে শুরু। হিন্দুস্থান পার্কের প্রতিবেশীরা কবি রাধারাণী দেবীর জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করছেন— রবিবার, ৩০ নভেম্বর ২০০৩, তাঁর শততম জন্মদিনে। কর্মকর্তা-কর্মকর্ত্রীরা সকলেই আমার পুত্র-কন্যার বয়সী। আমার মেয়েদের খেলার সাথী ছিল। আমার মা রাধারাণী তাঁদের বাবামায়ের জেঠিমা। এ পাড়ায় যে ছেলেমেয়েরা জন্মে বড় হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই আমার বাবাকে ভালরকম মনে আছে, বাবা কবি নরেন্দ্র দেব ছোটদের সঙ্গে ভাব জমাতে পারতেন। কিন্তু মা তো ইদানিং ঘরে থাকতেই ভালবাসতেন। মাকে এঁরা ততটা কাছ থেকে দেখেননি। এঁরা না দেখুক, এঁদের মা-বাবারা তো দেখেছেন— তাঁরাই আমার সমবয়সী, তাঁদেরই জেঠিমা আমার মা। পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে কবি রাধারাণী দেবী জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি গঠন করে ফেলেছে— তাঁদের ভালবাসার সীমা নেই, উৎসাহের শেষ নেই। তাঁরা সকলেই ব্যস্ত মানুষ— কেউ ডাক্তার, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শিক্ষিকা, কেউ সাংবাদিক, উচ্চপদস্থ চাকুরে প্রায় সবাই— তারই মধ্যে সময় করে এঁরা ‘জেঠিমা’র জন্মশতবর্যের উৎসব করছে।

Bhalobasha House
হিন্দুস্থান পার্কের ভালো-বাসা বাড়ি

মিটিংগুলো বসে রাত দশটার পরে। তার আগে কি ডাক্তারের সময় হয়? কখনও রাত ১১টার পরে। তার আগে কি সাংবাদিকের সময় হয়? আবার ভোরে বেরুতে হয় স্কুলে। সকলেরই ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে পৌঁছনো আছে না? বাচ্চারা তো ছোট ছোট। কত উৎসাহ প্রতিবেশীদের। রাধারাণী দেবী-নরেন্দ্র দেবের নামে সড়ক নেই কেন? রাস্তার নামকরণ করা দরকার, সে বিষয়ে খোঁজখবর চলছে— কীভাবে কী করতে হয়। 
— ‘দিদি, এত বছর ধরে আপনি কিছুই করতে পারলেন না?’ চিংড়ি তো বকেই দিল। 
গোপাল, মুন, মোহর, তপা, দেবাশিস- প্রত্যেকেরই উৎসাহ অসীম— সত্যিই তো এতদিন ধরে আমি কিছুই করতে পারিনি। আমি ব্যস্ত হয়ে থেকেছি নিজের কাজে, আমার কবিদম্পতি বাবা-মায়ের নামে রাস্তার নামকরণ করাটাও যে নিজেরই কাজ— সেটা মাথাতেই আসেনি। এল পাড়ার ছেলেমেয়েদের মাথায়।

এই রবিবার, ৩০, হিন্দুস্থান পার্কের রাস্তায় খোলা মঞ্চ বেঁধে রাধারাণী দেবীর জন্মশতবর্ষের উৎসব হবে। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়। সকল শুভানুধ্যায়ীর সাদর আমন্ত্রণ সেখানে। ছেলেমেয়েরা কার্ড ছাপিয়ে ফেলেছে। কার্ড বিলিও শুরু হয়ে গিয়েছে। এখনও চাঁদা তোলা হচ্ছে বলে মনে হয় না— কেউ তো আমার কাছে বিলবই নিয়ে আসেনি এখনও। কিন্তু তাদের ছুটোছুটির শেষ নেই। গান গাইতে আসছেন অর্ঘ্য সেন, পূরবী মুখোপাধ্যায়, অভিরূপ গুহঠাকুরতা (যদিও সেইদিনই তাঁর পুত্রের বৌভাত), শ্রমণা চক্রবর্তী, মৌসুমি বিশ্বাস এবং হৈমন্তী শুক্লা। কথা কইবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত— গদ্য-পদ্য পাঠ করবেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ, চৈতালী দাশগুপ্ত।

Radharani Devi
কবি রাধারাণী দেবী

এছাড়া অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে ‘সই’ সংস্থা, রাধারাণী দেবীর জন্মদিনেই যার জন্ম। রাধারাণী দেবীর ‘ভালোবাসা’ বাড়িতেই যার ঠিকানা। ‘সই’-এর পক্ষ থেকে রাধারাণী দেবীর ছোট গল্প ‘গতানুগতিক’-কে শ্রুতিনাটকের রূপ দিয়েছেন বাণী বসু। তাতে অংশ নিচ্ছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য, চিত্রা লাহিড়ি, শবরী ঘোষ, কাবেরী রায়চৌধুরী, অপরাজিতা দাশগুপ্ত। কৃষ্ণা বসু পড়বেন রাধারাণীকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা, ‘অগ্রজাকে’। বিজয়া মুখোপাধ্যায় পড়বেন রাধারাণী বিষয়ে আশাপূর্ণা দেবীর একটি লেখার কিছু অংশ। এষা দে, অঞ্জলি দাশ, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, মিতা নাগ ভট্টাচার্য, কণা বসু মিশ্র পাঠ করবেন রাধারাণী এবং অপরাজিতার কবিতা। পড়া হবে রবীন্দ্রনাথের চিঠি, রাধারাণীকে লেখা এবং অপরাজিতাকে লেখা— রবীন্দ্রনাথ জেনে যাননি, যে অপরাজিতা দেবীর নামে রাধারাণীই লিখতেন অন্য স্বরের কবিতা। তিনি জানতেন নবীনা অপরাজিতা রাধারাণীর বান্ধবী, তাই রাধারাণীর প্রযত্নে তাঁকে চিঠি লিখতেন কবি।

এই যে যিনিই রাধারাণী, তিনিই অপরাজিতা এই খবর জানা ছিল না একমাত্র নরেন্দ্র দেব ভিন্ন কারোরই। এ বিষয়ে ১৯৮৯-তে অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন— ‘আশ্চর্য ক্ষমতা রাধারাণী দেবীর— তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি যে তিনিই অপরাজিতা দেবী- রহস্য ভেদ করতে আমারই প্রায় তিরিশ বছর কেটে গেল… একই লেখিকার দুই সত্তার রচনা দু’রকম। এর তুলনা বাংলা সাহিত্যে আর আছে কিনা সন্দেহ।’ (জুন, ১৯৮৯)

রাধারাণী দেবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন ১৯৫৪-তে। ১৯৮৪-তে তাঁর ৮০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে অপরাজিতা রচনাবলী পুনঃপ্রকাশিত হল। ১৯৮৬-তে অপরাজিতা পেলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। রাধারাণী দেবী ছোটদের জন্য অসাধারণ রূপকথা লিখে গেছেন— ছড়াও লিখতেন দারুণ। পাড়ার বাচ্চারা দুটি ছোটদের ছড়া আবৃত্তি করছে ৩০শে– ছিঁচকাঁদুনি আর হিংসুটি— সেগুলি কিন্তু অপরাজিতা দেবীর শেষ রচনা। এবং ছোটদের জন্য অপরাজিতার ওই একমাত্র লেখা।

পাড়ার ছেলেমেয়েরা রাস্তায় মঞ্চ বেঁধে পাড়ার মহিলা কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছে— এমন সুখবর যিনিই শুনছেন তিনিই মুগ্ধ হচ্ছেন। জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাক্তন অধ্যক্ষ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বললেন— ‘পল্লিহৃদয় তাহলে এখনও বেঁচে আছে? সবটা হারিয়ে যায়নি? যাক—’  রেসপন্সের কর্ণধার রাম রে বললেন— ‘সত্যি? পাড়ার ছেলেমেয়েরা রাধারাণী দেবীর নজন্মশতবর্ষ সেলিব্রেট করছে? এটা খুবই বিশেষ ব্যাপার—খুবই আশাপ্রদ ঘটনা।’ আমাকে একগুচ্ছ কার্ড দিয়েছে— যাকেই দিচ্ছি, তিনিই বলছেন— ‘আমরা এইটেতেই যাব।’

এ তো আচ্ছা মুশকিল! তবে শিশির মঞ্চে আসবে কে? আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে যে প্রচুর খেটেখুটে ১৪ই অগ্রহায়ণ, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ওই বিকেল সাড়ে পাঁচটাতে শিশির মঞ্চে অসাধারণ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি, সেখানে তবে আসবেন কারা? আপনারা সকলেই নিমন্ত্রিত। দয়া করে সবাই আসবেন। দু’দিনই। আমাদের খুব ভাল লাগবে।

নভেম্বর ২৯, ২০০৩

শনিবার ২৯ থেকেই পাড়ায় উৎসব-উৎসব ভাব, মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে, বাচ্চারা খুব উত্তেজিত। মাইক বাজছে, আলো লাগছে, আবার যেন পুজো এসে গেছে। সত্যি সত্যি তাহলে একশো বছর পূর্ণ করলেন মা? ভাবা যায়?? পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলে শাঁখ বাজিয়ে একশো প্রদীপ জ্বেলে খুব আনন্দ করে মায়ের শতবর্ষের জন্মদিনের উৎসব পালন করলেন। পাড়ার আহ্লান্দ যেন আর ধরে না। জ্যোতিবাবুর বাড়ি আর নরেন্দ্র দেবের বাড়ির মধ্যিখানে রাস্তার মোড়ে অতি সুশ্রী, মস্ত বড় এক মুক্তমঞ্চ বাঁধা হল, তাতে বিশাল সুচারু ব্যানার পড়ল— ‘রাধারাণী দেবী জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন’— সারা রাত আলোয় ঝলমল করে উঠল। 

তিনশো সাদা সুন্দর চেয়ার সাজানো হল রাস্তায়- সে সমস্ত ভর ভর্তি হয়েও প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে রইলেন পথে ভিড় করে। রাস্তায় বড় বড় সোফাও পাতা হয়েছিল গোটা-ছয়েক। লাল ভেলভেটের রাজকীয় আসন! পাড়ার ছেলেমেয়েরা সমবেত সঙ্গীত গাইলেন। পাড়ার কচি শিশুরা অপরাজিতা দেবীর লেখা বাচ্চাদের কবিতা ‘হিংসুটি’ আর ‘ছিঁচকাঁদুনি’ অপূর্ব আবৃত্তি করে শোনাল। আর পাড়ার লোকেদের আবেদনে সাড়া দিয়ে কলকাতার মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় সস্ত্রীক এসে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে পল্লীবাসীদের কাছে ঘোষণা করে গেলেন, নরেন্দ্র দেব-রাধারাণী দেবীর নামে রাস্তার নামকরণ করে দেওয়া হবে।

Radharani and Nabanita
কবি রাধারাণীর কোলে সদ্যোজাত কন্যা নবনীতা

বুলবুলদিদি আমাকে বহু বৎসর ধরেই ওঁর জ্যাঠামণি-মামণির নামে রাস্তার নাম দেওয়ানোর জন্যে বলছেন। চেষ্টা কর। আবেদন কর। মেয়রকে চিঠি লেখ, ফোন কর। কিন্তু আমার এতই আলস্য যে সে প্রয়াসটুকুও আর করা হচ্ছিল না। এবারে পাড়ার ছেলেদের তাগিদে একটি চিঠি লিখেই ফেলেছি। ভেবেও রেখেছি মেয়র এলেই তাঁর হাতে ভাঁজ করে দেব। কিন্তু এ কী? এ যে মেঘ না চাইতেই জল! চিঠিটা লেখা, ছ’কপি জেরক্স করা, সবই বৃথা— অকারণ? নষ্ট হল। আমার পড়শিরা আমার চেয়ে ঢের বেশি করিৎকর্মা, সন্তানের বাড়া কাজ করে ফেলেছেন তাঁরাই। বাড়ি গিয়ে মেয়রের কাছে করে এসেছেন রাস্তার নামকরণের আবেদন।

অপূর্ব আয়োজন হয়েছিল। প্রচণ্ড পরিশ্রম শুধু নয়, প্রচুর ভাবনা-চিন্তা, পরিকল্পনা এবং অর্থব্যয় করে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গেই তাঁরা জ্যাঠাইমার শতবর্ষ উদযাপন করেছে। আল্পনায়, ফুলে-মালায়, আলোয়, গানে সারা মঞ্চ, সারা পাড়া উদ্বেল। অর্ঘ্যর উদ্বোধনী গান দুটি প্রাণ ঢালা। একশো প্রদীপ জ্বালাও, এগিয়ে এল একশো হাত—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে— রাধারাণীর নাতনীরা এবং পাড়ার শিশুরা সবাই। কান্দি থেকে এসেছেন গীতা সিংহ ভারতী, পদ্মফুলের মালা গেঁথে এনেছেন। ব্যানার্জির চক থেকে এসে পড়েছে আমাদের কালীপদ, ছেলেকে নিয়ে। মার কাছে সে প্রায় কুড়ি বছর কাজ করে গেছে। কাগজে পড়ে সে চলে এসেছে ৩০ তারিখে ‘ভালোবাসা’ বাড়িতে। তিরিশ বছর বাদে। আবার। সে আহ্লাদের হিসেব হয় না।

পনেরো বছর আগে আমার বাবা নরেন্দ্র দেবের শতবর্ষ উৎসবে যাঁরা গান গেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনজনকে আজও ধরে এনেছিলেন এঁরা। অর্ঘ্য, পূরবীদি (মুখোপাধ্যায়) আর অভিরূপকে। অভিরূপের আজ বাড়িতে চলছে পুত্রের বৌভাত— তারই মধ্যে ঠিক সময় করে এসে গান শুনিয়েছিলেন তিনি। শ্রমণা চক্রবর্তী সবচেয়ে ছোট হলে কী হবে, অতি অপূর্ব গাইলেন। তিনিও ছুটছেন অভিরূপের ছেলের বৌভাতে, বর যে তাঁর খুড়তুতো ভাই। এত ব্যস্ততার মধ্যেও এঁদের ভালবাসার অন্ত নেই। সুন্দর গেয়েছিলেন হৈমন্তী শুক্লাও। খুব পা ব্যথা নিয়ে এসেছিলেন, পা ভাঙা সবে সেরেছে। এঁদের সঙ্গে দেবদুলাল ও প্রদীপ ঘোষের আবৃত্তি এবং চৈতালি দাশগুপ্ত ও ঋতচেতা সেনগুপ্তর সাবলীল সংযোজন— এমন উৎসবের সার্থক না হয়ে উপায় কী? এবং তারই সঙ্গে আছি আমরা, ‘সই’-রাও।

একটু বলে নিই বরং।

Nabanita Dev Sen
রাধারাণী দেবীর জন্মদিনেই ‘সই’ সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর কন্য়া নবনীতা দেব সেন

‘সই’ মানে ‘পশ্চিমবঙ্গ লেখিকা সংঘ’। ‘সই’ শব্দের বাংলায় তিনটি অর্থ– স্বাক্ষর, সখী এবং সহ্য করা। তিনটিই আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যুক্ত— শুধু ‘সহ্য করাটার সঙ্গে কিন্তু সইব না। এটাও অনুচ্চারিত। এই ‘সই’ সমিতির জন্মদিনও রাধারাণীর জন্মদিনে। ৩০ নভেম্বর। আমাদেরও সেদিন তিন বছর পূর্ণ হল। এক অগ্রজার শতবর্ষে তাঁকে স্বরচিত কবিতায় প্রণাম জানলেন কবি কৃষ্ণা বসু। আর খবর পেয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েরা কিন্তু ‘সই’-কেও শুভ জন্মদিন জানাতে ভোলেনি। মস্ত একখানা মিষ্টি, বিশাল এক গুচ্ছ ফুল দিয়ে। এই পাড়াতেই তো ‘সই’য়ের ঠিকানা। এই ‘ভালো বাসা’ বাড়িতেই গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র লেখিকা সংঘ। বইমেলাতে প্রত্যেক বছরই ‘সই’ থেকে একটি অনুষ্ঠান হয়, ‘বইমেলাতে সই-মেলা’। এবছরেও হবে।

রাধারাণী দেবীর শতবর্ষেও ‘সই’ থেকে ছোট একটি অনুষ্ঠান হল পাড়ার ছেলেদের অনুরোধে। তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি। তাঁর বিষয়ে লেখা আশাপূর্ণা দেবীর প্রবন্ধ থেকে পাঠ করলেন অপরাজিতা দাশগুপ্ত ও বিজয়া মুখোপাধ্যায়। অপরাজিতা দেবীর কবিতা ‘মুখরা’ পড়লেন মিতা নাগ ভট্টাচার্য। তারপরে হল আমাদের পাঠ-নাটিকা ‘গতানুগতিক’, বিয়ের পরে সংসারের চাপে মেয়েদের শিশুর সম্ভাবনা কীভাবে ঝরে যায়। সে বিষয়ে রাধারাণী দেবীর একটি ছোট গল্প ‘গতানুগতিক’-কে বাণী বসু নাট্যরূপ দিয়েছেন। সেটি পাঠ করলেন বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, শবরী ঘোষ, কাবেরী রায়চৌধুরী ও চিত্রা লাহিড়ী। আবহে এস্রাজে ছিলেন শিউলি বসু। আমি নিজেই পড়লুম মাকে নিয়ে লেখা ছোট একটি কাহিনি, — ‘মাতৃয়ার্কি’-র একটি স্কেচ। ও মা! কী আশ্চর্য। পরের দিন শিশির মঞ্চে ঊর্মিমালাও দেখি সেই দু’নম্বর স্কেচটিই পছন্দ করেছেন পাঠ করবার জন্যে। পড়লেনও দুর্দান্ত।

nabaneeta-dev-sen
পড়শিদের উদ্যোগে মায়ের জন্মশতবর্ষ পালন অনুষ্ঠানের আয়োজনে মুগ্ধ হয়েছিলেন নবনীতা

কিন্তু সে তো পরের দিনের কথা। আমি আজ বলছি শুধু আমার পড়শিদের কাণ্ডকারখানা। অনুষ্ঠানের অতিথি যাঁরা রাস্তার চেয়ারে বসে আছেন আর যাঁরা দণ্ডায়মান, আমাদের বাড়ির মেয়েরা তাদের সব্বাইকে গরম গরম মাছের চপ আর নলেন গুড়ের কাঁচাগোল্লা ট্রে করে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে লাগল। পাড়ারই ছেলে চিংড়ির লোকেরা এসে আমাদের গ্যারেজে চপ ভাজছে, ফুটপাথে পাড়ার ছেলেরা কফির মেসিনও বসিয়েছে— গরম গরম কফি বিলি হতে লাগল অতিথিদের মধ্যে। খুব চমৎকার চপ বানিয়েছিল চিংড়ি। ‘চিংড়ির চপ’ আসলে কিন্তু রুইমাছের। 

চিংড়ির ভাল নাম ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত। বিখ্যাত সেনগুপ্ত কেটারার্স তার কোম্পানি। আমার মেয়ের বিয়ে সেই সামলেছে— চিংড়ি আমাদের পাড়ারই ছেলে। আমাদের বাড়িটিও টুনিবাল্ব দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল ৩০ নভেম্বর এবং ১ ডিসেম্বর, দুদিনের জন্য। ঠিক যেন বিয়েবাড়ি। অবিকল পুজোর মতন ঝলমলে দেখাচ্ছিল পাড়াটাকে— কী আনন্দ, কী আনন্দ। যিনিই দেখেছেন, বলেছেন— ‘পাড়া প্রতিবেশীর কোনও মহিলা কবির জন্মশতবার্ষিকী করছেন এত সাড়ম্বরে? বিশ্বাস হচ্ছে না।’ অনেকের আবার ধারণা হচ্ছে আমি নিজেই এসব করছি— আর পাড়ার ছেলেদের নামে বলছি। আহা হা, আমি কি বোকা? নিজে করব এমন ভাল কাজটি— আর সুখ্যাতি হবে পাড়ার লোকের? (নিজেরা তো করেছিই ১ ডিসেম্বর শিশির মঞ্চে)

প্রথা ভেঙে, পাংচুয়ালি বিকেল ৫-৪০-য়েই শুরু হয়ে গেল পাড়ার উৎসব এবং রাত্রি ৯-৩০-এ সভা ভাঙল। চার ঘণ্টা একটানা প্রোগ্রাম চলল একবারও বিশ্রাম না নিয়ে। মানুষ মুগ্ধ হয়ে বসে গান আর কবিতা শুনলেন। (চপ সন্দেশ আর কফি ঘণ্টা তিনেক চলেছিল) আমার মায়ের মহাপুণ্যের ফল, আমারও বিপুল সৌভাগ্য।

দুদিন বাদে, বারান্দার লাইট খুলতে এসেছে। আমি বললুম, বিল কত? আমার মেয়ে বললে, আগে পাড়ার দাদাদের কাছে জেনে নিয়ে তবে দাও। যেই জিজ্ঞেস করা, তাদের-
-‘সেকি, দিদি? আপনি কেন দেবেন? না না, ওটা তো আমাদেরই হিসেবে। ওকে পাঠিয়ে দিন।’
তার পরের দিন— চিংড়িকে ফোন করেছি। বিল চাই, চপের দামটা দেব। আমারই অর্ডারে সাতশো পঞ্চান্নটি বড় বড় মাছের চপ ভেজেছে তার লোকেরা, আমাদের গ্যারাজে বসে বসে। চিংড়ি বললে— “থাক দিদি। চপটা আমিই খাওয়াচ্ছি– আপনি শুধু ওই লোকগুলোর মজুরিটা দিয়ে দেবেন যদি ইচ্ছে হয়। মাসিমার জন্মশতবর্ষ উৎসব পাড়াতে হচ্ছে— আমিও তো কিছু করব?’’

Narendra and Radharani Dev
বাবা নরেন্দ্র দেব ও মা রাধারাণী দেবীর সঙ্গে কন্যা নবনীতা

আজকালকার দিনে এরকম পাড়ার ছেলে নাকি পাওয়া যায় না? তবে বলি শুনুন— গোপন কথা— হিন্দুস্থান পার্ক পাড়াতে আমার বাড়ির ঠিক দু’পাশে পাশাপাশি দুটি পুজো হয়। স্বাভাবিকভাবেই দুটি দলে রেষারেষি খুব। একটি দল এই শতবর্ষ উৎসব করছে শুনলে, অন্য দলটি, তাদের অর্থকৌলীন্য কম— এ ব্যাপারে হয়তো কোনও বিঘ্ন সৃষ্টি করলেও করতে পারে, এমন ভেবে কেউ কেউ ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু উৎসবের খবর শুনেই প্রতিদ্বন্দ্বী সংঘের তরুণ সেক্রেটারিটি নিজে এসে এঁদের কাছে নিমন্ত্রণপত্র চেয়ে নিয়ে গিয়ে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বিলি করে এল। এবং সভায় সবচেয়ে মোটা মালাটি, সবচেয়ে বিরাট ফুলের গুচ্ছটি মায়ের ছবির কাছে পরিয়ে দিয়ে গেল তারাই। শুধু তাই নয়, সপরিবারে এসে ওই ক্লাবের হর্তাকর্তাদের সঙ্গে বসে শেষ পর্যন্ত উৎসব উপভোগ করে গেলেন। এইভাবে মায়ের শতবর্ষ উৎসবটি শেষ অবধি সত্যিই হয়ে উঠল হিন্দুস্থান পার্কের সকল অধিবাসীর উৎসব— সকল পল্লিবাসীর। সকল প্রতিবেশীর সম্মিলিত আনন্দানুষ্ঠান। সারা পাড়ার হৃদয়ের স্পর্শে পূণ্য হয়ে ওঠা সন্ধ্যা। আমার মায়ের ফুলেভরা ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে আমার চোখে কেবলই জল আসছিল— মা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, এঁরা সবাই তোমাকে কত ভালবাসতেন, এখনও? কেউই তো তোমাকে ভুলে যায়নি, মা। ছোটরাও না।

Nabanita Devsen
অনন্যা নবনীতা

শুনে মনে হবে নবনীতা গল্প বানাচ্ছে। একটা আদর্শপল্লির আদর্শ সন্ধ্যা বানিয়ে লিখেছে। কিন্তু কালীপদ সর্দার আর গীতা সিংহ ভারতী কবে থেকে শুরু করে চিংড়ির চপ আর পাশের পুজো কমিটির সবচেয়ে মোটা মাল্যদান পর্যন্ত সবকটাই নিখাদ সত্যি সত্যি সত্যি। প্রমাণ চাই? তাও আছে। আজ আমাদের গড়িয়াহাট পুলিশ থানায় একটা নাগরিক কমিটির মিটিং ছিল। নাগরিক কমিটি মানে চাঁদের হাট আর কি! গড়িয়াহাট সোজা পাড়া? সুচিত্রা মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল, দিব্যেন্দু পালিত, পি সি সরকার কেই-বা তার সদস্য নন? মিটিংয়ের পরে আমাকে পৌঁছতে এসে পুলিশের তরুণ অফিসারটি বলে ফেললেন— ‘আপনাদের পাড়ায় সেদিন যেটা হল, তার তুলনা হয় না। কলকাতা শহরে এমন পাড়াও যে আছে এখনও—এত ভদ্রসভ্য, এত আন্তরিক। এভাবে একজন পাড়ার কবির জন্মদিন করে। এটা আমরাও ভাবতে পারিনি।’

সত্যি তো? মা তো এখানে এজন্যেই আদর পাচ্ছেন। ‘পাড়ার কবি’ বলেই! কে বলেছে গেঁয়ো কবি মালা পায় না? তারা এসে দেখে যাক হিন্দুস্থান পার্কের পল্লি-হৃদয়! জয় গুরু!

 

ডিসেম্বর ১৫, ২০০৩

*২০০৩ থেকে টানা পাঁচ বছর বাংলালাইভে প্রকাশিত ‘নবনীতার নোটবই’ ২০১১ সালের বইমেলায় গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে দে’জ পাবলিশিং। সেই নোটবইয়ের আট নম্বর পরিচ্ছেদটি পুনঃপ্রকাশিত হল আজ, লেখকের ৮৪তম জন্মদিবসে। 
*ছবিগুলি নেওয়া হয়েছে ‘নবনীতা দেবসেন’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে। 

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com