Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ২০

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

জানুয়ারি ৪, ২০২৩

Novel Akashpradip part 20
Novel Akashpradip part 20
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯]

(৩৪)

সকালে অনেকটা সময় মেডিটেশন রুমে কাটায় সিমোন৷ আজকের দিনটা যদিও স্পেশাল, তবু নিয়মের কোনওরকম পরিবর্তন চায় না ও৷ সকাল থেকে রাত অবধি ওর একটা নিজস্ব প্যাটার্ন আছে৷ সেই প্যাটার্নটাকে প্রতিদিন অনুসরণ করে যায় ও৷ একটা সময় পর্যন্ত অনেক নিয়ম ভেঙেছে৷ এখন আর কোনও নিয়ম ভাঙতে চায় না সিমোন৷

সিমোন প্রতিদিন যোগা আর মেডিটেশন করে৷ ডিপ ব্রিদিং টেকনিকে ওর খুব উপকার হয়েছে৷ বিকেলে ঘড়ি ধরে একঘণ্টা বাগানের মাঝখানে জিগজ্যাগ করা পথগুলো দিয়ে হাঁটে ও৷ ইচ্ছে হলে জিমে গিয়েই হাঁটতে বা দৌড়তে পারে ও৷ বাড়িতে একটা মিনি জিমও আছে৷ কিন্তু উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে হাঁটতে বেশি ভালবাসে সিমোন৷ হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যে থেমে বাগানের গাছপালা পশুপাখির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় ও৷ অনেক রকম গাছ আছে ওদের বাড়ির বাগানে৷

ম্যাগনোলিয়া তিন-চার রকম, ক্যামেলিয়া, অ্যাডেনিয়াম হরেক রকম ফুল হয় এই সময়৷

‘হ্যাপি বার্থডে সিমোন’ সকালবেলা নক করে ওর ঘরে ঢুকে এসেছিল মানি৷ সঙ্গে একটা বড় বাস্কেটে হরেক রকমের ফুল আর পাতা সাজানো৷ ‘পঞ্চাশ রকম ফুল, লতাপাতা আছে এই ডালাটায়৷ তোমার পঞ্চাশে পৌঁছবার জন্মদিনের উপহার৷’ মানি বলেছিল৷

মানি এইরকমই৷ সো ইউনিক, সো ওরিজিন্যাল ইন থিঙ্কিং৷ ‘কখন এসব তুললে মানি? নিশ্চয়ই অনেক ভোরে উঠতে হয়েছে তোমাকে?’

‘নাঃ! সেরকম কিছু নয়, আমাকে শুধু হোমওয়ার্কটা করতে হয়েছে অনেকটা সময় ধরে৷ সেখানেও আমি জাস্টিনের হেল্প পেয়েছি৷’ জাস্টিন ওদের বাগানের চিফ গার্ডেনার৷ ওর একটা ছোট্ট কিন্তু চমৎকার টিম আছে তিন একরের এই বাগানের পরিচর্যা করার জন্য৷ বৃন্দা হিমালয়ের দুর্গম সব অঞ্চল থেকে দুষ্প্রাপ্য সব অর্কিড, ফার্ন নিয়ে এসে লাগিয়েছেন৷ সিমোন প্রায় সমস্ত গাছের নাম জানে৷ এই সাইপ্রেস, এটা তো পামলিফ, এটা পাইনের ফল, মেপল, ওক, উইলো, সিডার, বার্চ গাছের পাতাও চিনতে পারল ও৷ ‘এটা বোধহয় জুনিপার তাই না মানি?’ ও জিজ্ঞেস করল৷

মানির সঙ্গে সিমোনের অনেকটা বন্ধুর মত সম্পর্ক৷ ইন ফ্যাক্ট, সিমোন জানে, ওর কোনও সত্যিকারের বন্ধু নেই মানি ছাড়া৷ অথচ ছোটবেলায় ওর জীবনে মানির উপস্থিতি ছিল রীতিমত দুর্লভ৷ ইংল্যান্ডের যেখানে ও বড় হয়েছিল সেই আধা শহরটা ছিল খুব শান্ত, নিস্তরঙ্গ৷ সেই জীবনে একমাত্র কেউ এলে একটু তরঙ্গ টের পাওয়া যেত৷ আসার মধ্যে কে-ই বা ছিল? শুধু মানি যখন আসত তখন যেন একটা উৎসবের মতো মনে হত৷ প্রায় প্রতি বছরই মানি আসত একবার করে ইংল্যান্ডে৷ অনেক খেলনা, জামাকাপড় সব নিয়ে৷ তখন জানত না সিমোন, পরে জেনেছে মানি আর্থিকভাবেও অনেক হেল্প করত মাকে৷ সিমনের কাছে ড্যাডি ছিল এক দূরায়ত ফিগার৷ ড্যাডিকে এখনও কিছুটা মনে পড়ে সিমনের৷ কিছু তিক্ত স্মৃতি৷ ভীষণ ঝগড়া হচ্ছে৷ রাগে উন্মত্ত হয়ে প্লেট, সসার, টেলিভিশনের রিমোট ছুঁড়ছে মা, ড্যাডি বসে বসে ড্রিঙ্ক করছে, বাড়িতে নিত্যদিনের ঘটনা ছিল এটাই৷ নেবাররা একবার ট্রিপল নাইন কল করেছিল। দোষটা কার ছিল, ড্যাডি না মা, কোনওদিন বুঝতে পারেনি সিমোন। ড্যাডি অ্যালকোহলিক ছিল পরে শুনেছে ও৷ কিন্তু মাও ঠিক অন্যদের মতো নর্মাল ছিল না৷ হয়ত ওর এই ক্রোধ, সাংঘাতিক অপমানের অনুভূতি, সব ও মা’র থেকেই ইনহেরিট করেছে— পরে সিমনের অনেকবার মনে হয়েছে৷

ইংল্যান্ডের যেখানে ও বড় হয়েছিল সেই আধা শহরটা ছিল খুব শান্ত, নিস্তরঙ্গ৷ সেই জীবনে একমাত্র কেউ এলে একটু তরঙ্গ টের পাওয়া যেত৷ আসার মধ্যে কে-ই বা ছিল? শুধু মানি যখন আসত তখন যেন একটা উৎসবের মতো মনে হত৷ প্রায় প্রতি বছরই মানি আসত একবার করে ইংল্যান্ডে৷ অনেক খেলনা, জামাকাপড় সব নিয়ে৷ তখন জানত না সিমোন, পরে জেনেছে মানি আর্থিকভাবেও অনেক হেল্প করত মাকে৷

‘কী ভাবছ সিমোন? ইউ আর সাডেনলি ভেরি থটফুল৷’ মানি জিজ্ঞেস করছে৷

‘ইয়েস মানি৷ অনেকদিন বাদে আবার খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে৷’

মানি একটু চুপ করে আছে৷ মানির ছোট করে কাটা চুল৷ তিন বছর আগে অসুস্থতার সময় সব চুল উঠে গেছিল৷ তবু মানিকে এখনও কি সুন্দর দেখতে! এমনকি চোখের পাশের ক্রোজ ফিটও মানির মুখে যেন একটা বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে৷

মানি আজকাল বেশিরভাগ সময় স্যাফরন রঙের পোশাক পরে৷ শাড়িও পরে সাদা খোলের৷ আগে মানি ততটা শাড়ি পরত না৷ এখন ইন্ডিয়া গেলে তো বটেই, এদেশেও মানি শাড়ি বা ঢিলেঢোলা সালোয়ার কুর্তা পরতে বেশি পছন্দ করে৷

Birch Fall
বার্চ গাছের পাতাও চিনতে পারল ও

‘সিমোন, আমার মনে হয় তুমি এখন ওই ফেজটা পেরিয়ে এসেছ৷ ট্রাই নট টু রিমেমবার দ্যাট৷ তাতে তোমার শরীর মন দুটোরই ক্ষতি হবে৷’

সিমোন জানে মানি কী বলছে৷ সত্যি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে সে৷ এখন অতীত আর তাকে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে না৷ বরং পুরনো দিনের কথা মনে পড়লে কেমন যেন অবাস্তব, আনরিয়েল মনে হয় গোটাটা৷ নাঃ আর সে পিছনে তাকাতে চায় না৷ তার পুরনো রক্তাক্ত অতীত থেকে বার করে আনার জন্য সে মানির কাছে চিরঋণী৷ মানি তাকে পাঁক থেকে টেনে তুলেছে, আশ্রয় দিয়েছে, নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷

‘না মানি৷ আর ভাবব না৷’ সিমোন এক মুহূর্ত থেমে ভাবছে বলবে কি না… ‘অ্যান্ড মানি৷ ওয়ান মোর থিং৷ আই ডোন্ট থিঙ্ক আই হ্যাভ টোল্ড ইউ দিস বিফোর৷ ইউ আর দ্য সেকেন্ড মাদার, দ্য রিয়েল মাদার টু মি, অ্যান্ড ইউ নো দ্যাট৷ তুমিই আমার সত্যিকারের মা৷ এই তিরিশ বছর ধরে, আই ক্যান ফিল দ্যাট৷’

মানি একটু হাসে৷ বলে, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, উই ক্যান ডিসকাস দিজ লেটার৷ এখন যাও তোমার রেগুলার যোগা অ্যান্ড মেডিটেশন করে নাও। তারপর আই হ্যাভ সাম সিরিয়াস ম্যাটার্‌স্‌ টু ডিসকাস৷’

‘রিগার্ডিং ওয়াট?’

‘রিগার্ডিং আওয়ার স্কুল্‌স্‌ অ্যান্ড রিহ্যাব সেন্টারস্‌৷’ 

‘ওকে, আমি দুপুরে পোস্ট লাঞ্চ বসছি তোমার সঙ্গে৷’

‘অ্যান্ড ডোন্ট ফোরগেট, উই হ্যাভ টু গো টু দ্য মিশন ইন দ্য ইভনিং৷’ মানি মনে করাচ্ছে৷

‘নো, আই ওন্ট ফোরগেট৷’

প্রতি সপ্তাহেই বেদান্ত মিশনে যায় ওরা শনিবার করে৷ আর স্পেশাল দিনগুলোতে মিশনে যাবেই মানি৷ অরফানেজে আর ওল্ড এজ হোমে গোলস্টাইন ট্রাস্টের মোটা অঙ্কের অর্থ জমা পড়ে প্রতি মাসে৷ আবার বাচ্চা আর বয়স্কদের জামাকাপড়, খাবার দেওয়ার নিয়ম মানি চালু করেছে বিশেষ বিশেষ দিনে৷ সিমোনের জন্মদিন— এরকমই একটা বিশেষ দিন৷ মার্টিনের মৃত্যুদিনটাও বিশেষভাবে পালন করে মানি৷ আরও একটা বিশেষ দিন আছে৷ অক্টোবরের শেষদিকে কোন একটা দিনে মিশনে গিয়ে মানি একটা আশ্চর্য জিনিস করে৷ একটা মাটির প্রদীপ একটা লম্বা লাঠির আগায় বেঁধে, প্রদীপ জ্বালায় মানি৷ তারপর সোজা সেটা তুলে দেয় আকাশের দিকে৷ আকাশে অনেক উঁচুতে প্রদীপটা জ্বলতে থাকে৷ আকাশপ্রদীপ বলে ওকে— মানি বলেছিল৷ এই রিচুয়ালটা প্রতি বছরই করে মানি কেন যেন৷ সেই রিচুয়ালটা যে মানি কার জন্মদিন বা মৃত্যুদিন ভেবে করে জানে না সিমোন৷ পুরো ব্যাপারটাই খুব ইনট্রিগিং৷ কী ভেবে করে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে মানিকে৷ ভাবতে ভাবতে যোগার সাইক্‌ল্‌টা কমপ্লিট করতে থাকে সিমোন ৷

দুপুরে হালকা লাঞ্চ। সাধারণতঃ সবজি সেদ্ধ আর বেকড স্যামন বা গ্রিলড ভেটকি ফিলে এরকম কিছু দিয়ে লাঞ্চ সারে দুজন৷ আজকে তার সঙ্গে একটু পায়েস করেছে মানি, দেশের গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে৷

‘পায়েসটা খেও, ওটা আমার নিজের করা৷’ মানি বলল৷

সিমোনের জন্মদিন— এরকমই একটা বিশেষ দিন৷ মার্টিনের মৃত্যুদিনটাও বিশেষভাবে পালন করে মানি৷ আরও একটা বিশেষ দিন আছে৷ অক্টোবরের শেষদিকে কোন একটা দিনে মিশনে গিয়ে মানি একটা আশ্চর্য জিনিস করে৷ একটা মাটির প্রদীপ একটা লম্বা লাঠির আগায় বেঁধে, প্রদীপ জ্বালায় মানি৷ তারপর সোজা সেটা তুলে দেয় আকাশের দিকে৷ আকাশে অনেক উঁচুতে প্রদীপটা জ্বলতে থাকে৷ আকাশপ্রদীপ বলে ওকে— মানি বলেছিল৷ এই রিচুয়ালটা প্রতি বছরই করে মানি কেন যেন৷

এটা না বললেও বুঝতে পারত সিমোন। এই তিরিশ বছর ধরে এই রিচুয়ালটাও ওর জন্মদিনে মানি করে থাকে৷ জীবনে যতদিন ও মার সঙ্গে কাটিয়েছে মানির আর মার্টিনের সঙ্গে কাটিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দিন, অনেক বেশি বছর৷ মার্টিনের মতো মানুষ খুব বেশি দেখেনি সিমোন ৷ সদাহাস্যময়, প্রসন্ন এক বৃদ্ধ৷ মার্টিনের সাদা দাড়ি, গোঁফটা ঝুলে গিয়ে মিশে গেছে দাড়ির সঙ্গে৷ চোখে রিমলেস চশমা, আর বাদামি চোখের মণিতে মার্টিনকে প্রথম দেখে খুব আশ্চর্য লেগেছিল কুড়ি বছরের সিমোনের৷

মানির চেয়ে প্রায় তেত্রিশ বছরের বড়৷ ও মার্টিনকে যখন প্রথম দেখে তখনই মার্টিনের বয়স সত্তরের উপর৷ কিন্তু মার্টিনকে দেখে সেকথা বোঝার উপায় ছিল না৷ সবসময়ই প্রাণশক্তিতে ভরপুর৷ পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি চষে বেড়াচ্ছে৷ নিজেকে মার্টিন বলত ‘আই অ্যাম আ ইয়াং ম্যান ইন অ্যান ওল্ড ম্যান্‌স্‌ বডি৷’ অদ্ভুত স্নেহপ্রবণ ছিল৷ সিমোনের কুড়ি বছরের জীবনে ও কোনও পুরুষের সংস্পর্শে আসেনি৷ ওর নিজের ড্যাডের অসংযত জীবনযাপন, মদ্যপ অবস্থায় চিৎকার করা, ওদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করা— এইসবই ওর মধ্যে এক ধরণের পুরুষ-বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল৷ পাঁচ বছর একসঙ্গে কাটাবার পর ওর মা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ তিরিশ বছরের সহায়সম্বলহীন সেই মেয়ে নিজের সাড়ে চার বছরের শিশুকন্যাকে বুকে জড়িয়ে পাড়ি দিয়েছেল অনিশ্চিতের পথে৷ তার জীবনে দ্বিতীয়বারের জন্য স্বেচ্ছায় ছিন্ন করেছিল দাম্পত্যবন্ধন। যদিও সিমোন বহু বছর পর্যন্ত তার মায়ের আগের জীবনের কথা জানত না৷ বেশ কিছুদিন পরে মানির কাছ থেকে সব কিছু জেনেছিল ও৷ তখন সানফ্রানসিস্কোর  জীবন খাপে খাপে বসে গেছে৷ যেন চিরকাল এইরকমই ছিল৷ এই খাপে খাপে বসে যাওয়ার জন্য মানি আর মার্টিনের ভূমিকা ছিল অসামান্য৷ বিশেষ করে মার্টিনের৷ মানি সিমোনের মা’র অভাব পূরণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু মানি তো আফটার অল মা’র বোন৷ রক্তের সম্পর্ক৷ কিন্তু মার্টিনের সঙ্গে তো ওর কোনও সম্পর্ক ছিল না৷ নিজের স্ত্রীর ভেসে যাওয়া দিদির খাবি খেতে থাকা কিশোরী কন্যাটিকে উদ্ধার করে কার্যত ডাঙায় তুলেছিল মার্টিন৷ আশ্রয় দিয়েছিল তাকে৷ মার্টিনের কথা মনে করে একচিলতে হাসি ফুটল সিমোনের মুখে৷ মানির কিছুই চোখ এড়ায় না৷ বলল— ‘হাসছ যে? বললে না পায়েসটা কেমন হয়েছে!’

‘সুপার্ব মানি৷ আ্যাজ ইউজুয়াল৷’ সিমোন একটু থেমে বলল ‘মার্টিনের কথা মনে পড়ছে৷ আই মিস হিম আ লট৷’

একটু লম্বা একটা শ্বাস ফেলছে মানি৷ ‘আই নো৷ হি লাভ্‌ড্‌ ইউ ডিয়ারলি৷’ 

‘হি ওয়াজ সো ফুল অফ লাইফ! লাস্ট বার্থডেতেও কী ভীষণ এনজয় করেছিল! আই স্টিল ভিভিডলি রিমেমবার হি টোল্ড এভরি ওয়ান প্রেজেন্ট— আই উইল লিভ টু বি হান্ড্রেড৷ আর তিন বছর হলেই হয়ে যেত সেটা৷ সিমোনের গলায় একটু আফসোসের সুর৷’

মানি হাসছে— ‘কাম অন সিমোন! হি উড হ্যাভ বিন হান্ড্রেড অ্যান্ড টু নাও৷ একশো দু বছর কেউ বেঁচে থাকে না৷ হি লিভ্‌ড্‌ আ ভেরি গুড অ্যান্ড ফুলফিলিং লাইফ— সেটাই আসল কথা৷ নাও, চিয়ার আপ৷ আমার অনেক জরুরি জিনিস ডিসকাস করার আছে৷

বৃন্দার কর্মকাণ্ড অনেক ছড়ানো৷ ফিলাডেলফিয়ার বাড়িটা এখন একটা কেয়ার গিভিং হোম৷ বেশ কিছু আর্থিকভাবে অসচ্ছল বৃদ্ধবৃদ্ধার বসবাস সেখানে৷ সানফ্রানসিস্কোর বেদান্ত সোসাইটির জন্য মোটা অর্থ বরাদ্দ রয়েছে গোল্ডস্টাইন ট্রাস্টের পক্ষ থেকে৷ নিউ ইয়র্কের দুটো আর্ট গ্যালারি এবং ফ্রিসকোর একটা আর্ট পাবলিশিং হাউস— এসবের দেখভালের দায়িত্ব বৃন্দারই উপর৷ যদিও ব্রুকলিনে মার্টিনের বড় মেয়েও অনেক দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছে৷ কিন্তু এখন বৃন্দার সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল কলকাতা উপকণ্ঠের দুটো স্কুল৷ স্কুল শুধু স্কুল নয়, তার সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের থাকার হস্টেল, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা৷

New York art gallery
নিউ ইয়র্কের দুটো আর্ট গ্যালারি এবং ফ্রিসকোর একটা আর্ট পাবলিশিং হাউস, এসবের দেখভালের দায়িত্ব বৃন্দারই উপর

প্রথম অনাথ বাচ্চা ও পথশিশুদের কথা ভেবেই এই প্রজেক্টে হাত দিয়েছিল বৃন্দা৷ এখন আশপাশের গ্রামের গরীব পরিবারের বেশ কয়েকটি শিশুও এই স্কুলে পড়ে। প্রথম যখন খুলেছিল তখন শুধু প্রাইমারি সেকশন ছিল৷ এখন বৃন্দা দৌড়ঝাঁপ করে সরকারি সাহায্যে মাধ্যমিক অবধি চালু করেছে৷ মার্টিন যতদিন বেঁচেছিল, ততদিন সেও এই স্কুলের বিষয়ে খুব উৎসাহী ছিল৷ এখন বৃন্দা আর সিমোন পালা করে গিয়ে স্কুলদুটোর তত্ত্বাবধান করে আসে৷ দৈনন্দিন সমস্যা মেটানোর জন্য অবশ্য খাতায় কলমে একটা এন.জি.ও আছে৷ অনেক অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে কাজ করে সেখানে৷ তাদেরই দু-এক জনকে নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে৷ সেসব নিয়ে বেশ ডিটেইলে কথা বলল বৃন্দা৷

সিমোন বেশ কয়েক বছর ধরে স্কুলের ব্যাপারে খুব ইনভলভড৷ ও আবিষ্কার করেছে এটা ওর আনন্দের জায়গা৷ ইদানীং বছরে দুবার করে ও ইন্ডিয়া যেতে চেষ্টা করে৷ নিজের ভিতরের তাগিদ থেকে৷ বৃন্দার অসুস্থতার পর থেকে কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব ওর উপর পড়ে গেছে৷ তবে দায়িত্বটা বেশ এনজয় করে সিমোন৷

বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মিশনে যাওয়ার জন্য বেরোলো সিমোন আর বৃন্দা৷ আজ যেহেতু স্পেশাল দিন, তাই দুজনেই শাড়ি পরেছে৷ বৃন্দার পরনে একটা ঘিয়ে রঙের গাদোয়াল, কালো জরির পাড়৷ সিমোন পরেছে একটা স্নাফ রঙের গাদোয়াল, মেরুন পাড়ের৷ সিমোন জানুয়ারি মাসে কলকাতায় গিয়ে পাঁচ-ছটা শাড়ি কিনে এনেছে৷ শাড়ি কেনার সময়ও সিমোন একটু দোনামোনা করছিল— এতগুলো শাড়ি কিনবে কিনা৷ অসুস্থতার পর থেকে শাড়ি প্রায় পরেই না মানি৷ লং স্কার্ট, ঘাঘরা এসবই পরে থাকে৷ তবে স্পেশাল দিনগুলোতে, অন্তত মানি যেগুলোকে স্পেশাল দিন বলে ভাবে, সেই দিনগুলোতে মানি শাড়িই পরে৷ সিমোনকেও শাড়ি পরতে শিখিয়েছে বৃন্দা৷ কুড়ি বছরে যখন সিমোন প্রথম এখানে আসে, তখন প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়েছিল অ্যাডজাস্ট করতে৷ মনে হত একছুটে চলে যায় স্কটল্যান্ডের ফেলে আসা ওই একচিলতে বাড়িটায়, যে বাড়িটায় ও আর ওর মা পনেরো বছর ধরে ভাড়া ছিল৷ মা যখন ভায়োলেন্ট হয়ে গেল, তখন ল্যান্ডলেডিই ফোন করেছিল মানিকে৷ সিমোন তখন রিহ্যাবে৷ মানি এসে মার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিল৷ বাড়ির সেট-আপকে ওয়াইন্ড আপ করেছিল ল্যান্ডলেডিকে বলে৷ বছরে একবার করে যেত বলে বুড়ি ল্যান্ডেলেডি এডিথের সঙ্গে ভালো রকমই আলাপ ছিল মানির৷ মানি সেবার অনেকদিন ছিল ইনভারনেসে৷ মাকে হাসপাতাল হোমে এনে কেয়ার হোমে রাখার ব্যবস্থা, সিমোনের রিহ্যাবের ইন-চার্জের সঙ্গে কথা বলে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা, সিমোনের রি-প্যাট্রিয়েশনের ব্যবস্থা— সব একা হাতে করেছিল মানি৷ মার্টিনের আমেরিকান কনসুলেটের কন্ট্যাক্টরা কাজে দিয়েছিল খুব৷ ইনভারনেস থেকে সানফ্রানসিস্কো— এক নতুন জার্নির জন্য বৃন্দা খুব ধৈর্য নিয়ে আস্তে আস্তে প্রস্তুত করেছিল সিমোনকে৷

নর্থ সির খাঁড়ি— যাকে ওখানকার লোকেরা বলত মোরে ফার্ত— এসে যেখানে মিশেছে নেস নদীর সঙ্গে, সেইখানে একটা ছোট দোতলা বাড়ির একতলায় থাকত ওরা মা মেয়ে৷ ল্যান্ডলেডি এডিথ একটা স্কুলে পড়াত৷ সুন্দর, শান্ত, ছোট্ট একটা শহর ইনভারনেস৷ লোকজন শান্তিপ্রিয়, কেউ কারও ব্যাপারে মাথা গলায় না৷ সেই শহরে থেকেও কেন যে এত অশান্ত বিক্ষিপ্ত ছিল তাদের জীবন! দুটো সংসার ভাঙার জন্যই কি মা ওরকম হিংস্র হয়ে যেত মাঝে মাঝে? কিশোরী সিমোন নেশা করতে শুরু করে স্কুলের এক বন্ধুর প্রভাবে৷

সিমোন জানুয়ারি মাসে কলকাতায় গিয়ে পাঁচ-ছটা শাড়ি কিনে এনেছে৷ শাড়ি কেনার সময়ও সিমোন একটু দোনামোনা করছিল— এতগুলো শাড়ি কিনবে কিনা৷ অসুস্থতার পর থেকে শাড়ি প্রায় পরেই না মানি৷ লং স্কার্ট, ঘাঘরা এসবই পরে থাকে৷ তবে স্পেশাল দিনগুলোতে, অন্তত মানি যেগুলোকে স্পেশাল দিন বলে ভাবে, সেই দিনগুলোতে মানি শাড়িই পরে৷ সিমোনকেও শাড়ি পরতে শিখিয়েছে বৃন্দা৷

‘সুইট ড্রিমস্‌ উইল কাম আপ ইফ ইউ গেট ইউজ্‌ড টু দিস’ টিমোথি বলেছিল৷ ড্রাগের নেশায় তলিয়ে গিয়েছিল সিমোন৷ মানি এসে ভর্তি করে দিয়েছিল রিহ্যাবে৷ তারপরই মা’র ওই ভায়োলেন্ট অ্যাটাকটা হল৷ সিমোন ততদিনে অনেকটা সুস্থ৷ বাড়ি নিয়ে আসার পর একদিন ভোরে মানির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিল ইনভারনেস কাসলের দিকে৷ ঘোরানো পথ দিয়ে একদম চূড়োয় উঠে একটা পাথরের উপর পা ঝুলিয়ে বসেছিল মানির পাশে৷ উপর থেকে নেস নদী যেখানে নর্থ সি-তে গিয়ে মিশেছে সেই জায়গাটা দেখা যাচ্ছিল৷ নতুন ওঠা সূর্যের নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছিল জলে৷

‘সিমোন, ইট ইজ নাও দ্য টাইম ফর ইউ টু টেক আ হার্ড ডিসিশন৷’

সিমোন বুঝতে পারছিল কী আসতে চলেছে৷ ও চুপ করে ছিল মানিকেই পুরোটা বলতে দিয়ে… ‘সিমোন, লাস্ট ইয়ার যখন এসে তোমাকে রিহ্যাব নিয়ে গেলাম, তখন তোমার অবস্থা আমি দেখেছি৷ উইথ গডস গ্রেস, ইউ আর অলমোস্ট আউট অব ইট৷ এখন ইউ নিড আ প্রপার রিবুটিং অফ ইয়োর লাইফ, অ্যান্ড আ থরো ক্লেনজিং অফ ইওর সোল৷ কিন্তু এখন ইয়োর মা ইজ আনফরচুনেটলি নট ইন আ পোজিশন টু টেক কেয়ার অব ইউ৷’ বৃন্দা একটু থেমেছিল, যেন সাজিয়ে নিচ্ছে বাকি কথাটুকু কীভাবে বলবে৷

‘মা নেভার অ্যাক্টেভ অ্যাজ আ ট্রু মাদার৷ শি ওয়াজ নেভার দেয়ার ফর মি৷’ গভীর অভিমানে বলেছিল সিমোন৷ খুব কাটা কাটা ভঙ্গিতে৷

বৃন্দা ঘাড় নাড়ছিল, ‘না সিমোন৷ ডোন্ট বি আনগ্রেটফুল৷ অলওয়েজ রিমেমবার শি ব্রট ইউ আপ অ্যাজ আ সিঙ্গল পেরেন্ট৷ তোমার মা নিজেও অনেক ট্রমাটিক এক্সপিরিয়েন্সের মধ্যে দিয়ে পার হয়েছে৷ শেষে আর পারেনি৷ সি স্ন্যাপ্‌ড্‌৷’

থেমে থেমে বৃন্দা বলছিল, ‘তোমার মা কিন্তু আমারও দিদি৷ দ্য ক্লোজেস্ট কিন আফটার আওয়ার পেরেন্ট্‌স্‌৷ দিদি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে৷ অল্প বয়সে আমাদের মা পাগল হয়ে গেছিলেন৷ শি ওয়াজ কেপ্ট ইন আ মেন্টাল অ্যাসাইলাম৷ আমরা সবাই হুইমসিকাল৷ ওটা আমাদের জেনেটিক ট্রেট৷ দিদি হ্যাড টু অ্যাবানডন হার ওন ফ্যামিলি ব্যাক ইন কোলকাতা ফর ইয়োর সেক অ্যান্ড ফর ইওর ড্যাড৷ ডোন্ট ফোরগেট, টু লিভ আ টু ইয়ার ওল্ড কিড ইজ নট ইজি৷ দিদি ওয়ান্টেড টু ব্রিং হার অ্যালং৷ বাট হার ফার্স্ট হাজব্যান্ড ডিডন’ট অ্যালাও ইট৷’

সেই প্রথম শুনেছিল সিমোন৷ তার মার কলকাতায় আরেকজন হাজব্যান্ড ছিল? আরেকটা ফ্যামিলি? আরেকজন মেয়ে? সিমোনের মনে হচ্ছিল ও স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে৷ মা কেন বলেনি কলকাতায় ফেলে আসা পরিবারের কথা? অন্য আরেকটা হ্যাপি ফ্যামিলি গড়তে চেয়েছিল মা৷ সেই গড়তে না পারার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছিল৷ মাঝে মাঝে দু-দুবার ব্যর্থতার গ্লানি এড়াতে মা রাগে উন্মত্ত হয়ে যেত৷ নিজের উপর নিজে টর্চার করে প্রতিশোধ নিতে চাইত!

Calm and beautiful Inverness City
সুন্দর, শান্ত, ছোট্ট একটা শহর ইনভারনেস

বৃন্দা বলছিল— ‘ইউ উইল নট বি এবল টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য এনর্মিটি অব হার পেইন নাও৷ পরে হয়ত আস্তে আস্তে বুঝবে৷ কিন্তু এখন আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাই৷ ইউএসএ ইজ আ ল্যান্ড অব অপরচুনিটি৷ অন্যরকমভাবে জীবনটাকে গড়ে নিতে পারবে তুমি৷ আ ফ্রেশ স্টার্ট৷ এখানে একা থাকার মতো স্টেট অব মাইন্ড এখন তোমার নেই বলেই আমার বিশ্বাস৷ কিন্তু তুমি এখন অ্যাডাল্ট৷ তাই তোমার কনসেন্ট ছাড়া আমি কোনও মুভ করব না৷ কিন্তু আর কয়েকদিনের মধ্যে আমাকে ফিরতেই হবে৷ আই হ্যাভ অল সর্টস্‌ অব কমিটমেন্টস দেয়ার৷ ইউ হ্যাভ টু মেকআপ ইয়োর মাইন্ড রিয়েলি কুইকলি৷’

ভাবার আর বিশেষ কিছু ছিল না৷ মানি যেন চামচে করে সাজিয়ে রেখেছিল ওর নতুন জীবন৷ মাথা নেড়েছিল একটু অনিশ্চিতভাবে৷ যাবে ও। না গিয়েই বা উপায় কী? কোথায় থাকবে ও? মা তো অ্যাসাইলামে৷ 

‘মা’র কী হবে? উইল শি বি হিয়ার ইন দ্যাট হোম ফর দ্য রেস্ট অব হার লাইফ?’

‘সিমোন, মার্টিন আর আমি আমাদের ফিলির বাড়িটাকে একটা এল্‌ডারলি পিপল্‌স্‌ হোমে কনভার্ট করার প্ল্যান করছি৷ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি উইদিন টু ইয়ার্‌স্‌ আই উইল ট্রাই টু রিলোকেট হার দেয়ার৷ তখন মাসে একবার করে এসে তুমি তোমার মাকে দেখে যেতে পারবে৷ আপাতত তোমাকে ঠিকমতো একটা লাইফ দিতে চাই৷ অ্যান্ড আই প্রমিস ইউ, ইট উইল বি আ প্লেজেন্ট এক্সপিরিয়েন্স ফর ইউ৷ বৃন্দা ওর চুলগুলোয় হালকা হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।

‘যদি তোমার কখনও ভালো না লাগে সানফ্রানসিস্কোতে, ইউ ক্যান অলওয়েজ কাম ব্যাক হিয়ার৷ অফটার অল ইউ আর আ ব্রিটিশ সিটিজেন৷ শুধু আগে একটু শক্ত করে নাও পা দুটো৷ তারপর ভেবে দেখো তুমি কোথায় থাকতে চাও৷

ঠিক তিরিশ বছর আগের স্মৃতিগুলো— ইনভারনেস কাসলের উপর সেই পা ঝুলিয়ে বসে থাকা, সূর্যোদয়ে রঙিন হয়ে ওঠা নেস নদী আর নর্থ সি-র মোহনা, সব কিছু এই এত বছরের ব্যবধানেও বড় বেশি স্পষ্ট সিমোনের কাছে৷ এই তিরিশ বছর ধরে নিজেকে নতুন করে গড়ে নিয়েছে ও৷ শুধু এই বাড়ি বা মানির দেশজুড়ে কর্মকাণ্ডই নয়, ওর সত্তার কেন্দ্রে এখন রয়েছে ইন্ডিয়ার স্কুলদুটো৷ গরীব অনাথ বাচ্চাগুলোর জন্য কাজ করা, ওদের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা এবং এই সব কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এতে জীবনের অন্যরকম একটা মানে খুঁজে পায় সিমোন৷ শুধু একটাই আফশোস রয়ে গেছে৷ মাকে আর ফিলাডেলফিয়ার হোমে নিয়ে আসতে পারেনি ওরা, সিমোন আর বৃন্দা৷ সিমোন এদেশে আসার এক বছরের মধ্যেই মারা যায় রাধিকা৷ একটা স্ট্রোক হয়েছিল হোমে থাকার সময়৷ হোম থেকে ফোন করে জানিয়েছিল বৃন্দাকে৷ বৃন্দা আর সিমোন যখন গিয়ে পৌঁছয়, তখন রাধিকা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে৷ আর তোলপাড় চোখে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে৷ অনেকরকম নল লাগানো শরীরে৷ ‘মা, মা’ বলে মায়ের মুঠো করা হাতটা চেপে ধরেছিল সিমোন৷ 

‘কিছু খুঁজছিস্‌, দিদি? কী লাগবে বল?’ বৃন্দা জিজ্ঞেস করেছিল৷

ক্ষীণ স্বরে কিছু বলছিল মা৷ 

‘কী বলছ মা?’ কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিল সিমোন৷

‘সিমোন সী-মোন তি নি৷’ প্রথমবার মা’র মুখে নামটা শুনেছিল সে৷ সেই ভেঙে পড়ার মুহূর্তেও চকিতে উপলব্ধি হয়েছিল তার চেয়ে আড়াই বছরের বড় পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকা অচেনা একটা মেয়ের কাছে হেরে গেছে ও৷ ওর মা আসলে মনে মনে সেই মেয়েটার কথাই ভাবত৷ কাছে থাকা মেয়েটার মধ্যে দিয়ে সেই কুড়ি বছর আগে ফেলে আসা মেয়েটাকেই পেতে চাইত৷ এমনকি সিমোন আর সীমন্তিনীর মধ্যে যে ধ্বনিগতভাবে এত মিল, তা মার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমবার বুঝতে পারে ও৷

শুধু একটাই আফশোস রয়ে গেছে৷ মাকে আর ফিলাডেলফিয়ার হোমে নিয়ে আসতে পারেনি ওরা, সিমোন আর বৃন্দা৷ সিমোন এদেশে আসার এক বছরের মধ্যেই মারা যায় রাধিকা৷ একটা স্ট্রোক হয়েছিল হোমে থাকার সময়৷ হোম থেকে ফোন করে জানিয়েছিল বৃন্দাকে৷ বৃন্দা আর সিমোন যখন গিয়ে পৌঁছয়, তখন রাধিকা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে৷ আর তোলপাড় চোখে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে৷

মা চলে যাবার উনত্রিশ বছর পেরিয়ে গেল৷ মায়ের স্মৃতি অনেক ফিকে হয়ে এসেছে৷ প্রথম প্রথম খুব দুঃখ হত৷ কেন এত কষ্ট পেল ও? কেন ড্যাড ওর জীবনে একজন অনুপস্থিত ব্যক্তি, কেন ওর মা পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে ইংল্যান্ডে নির্বাসিত একাকী জীবনযাপন করতে করতে মারা যাবে? কেন সর্বনাশা নেশার প্রলোভন ওকে অতলে তলিয়ে দিয়ে টুঁটি টিপে মারার চেষ্টা করবে? কেন? কেন? কেন? প্রশ্নগুলো অনেকদিন পর্যন্ত ওকে খোঁচাত, বিব্রত করত, রক্তাক্ত করত৷ তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে৷

টাইম ইজ দ্য গ্রেট হিলার কথাটার মানে সিমোন ওর জীবন দিয়ে বুঝেছে৷ পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে এখন ও গভীরভাবে উপলব্ধি করে সারা জীবন ধরে একটা আনন্দ, একটা স্বপ্নের দিকে এগোতে চেষ্টা করছে৷ সুখের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে পায়ে পায়ে৷ যত অ্যাক্টিভ জীবন যাপন করছে, যত কাজের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে, তত বেশি করে নিজেকেও চিনতে পারছে ও৷ আত্মানাং বিদ্ধি। নিজেকে জানার এই প্রক্রিয়ায় বড় আনন্দ৷ আনন্দাৎ খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে— মানি বলে মাঝে মাঝে এইসব সংস্কৃত শ্লোক৷ অল্প থেকে বহুর এই অনুসন্ধানে নিজেকে জানার এই অসীম রহস্যের মধ্যে মেতে রয়েছে ও৷ আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না… গানটা মানি শুনতে খুব ভালবাসে৷ চুপচাপ নিজের ভাবনাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিঃশব্দে বেদান্ত সোসাইটির বিশাল মন্দিরটার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল সিমোন আর বৃন্দা৷

(৩৫)

তখন খুব টালমাটাল সময় কাটছিল অরুণাভর৷ একত্রিশ বছর আগে৷ কলকাতায় পৌঁছনোর আগে অবধি৷ বৃন্দা ফিলাডেলফিয়া থেকে সানফ্রান্সিসকোতে চলে যাওয়ার পর ফাঁকাই পড়ে থাকত ফিলাডেলফিয়ার বাড়ি৷ ছুটিতে এসে একবার অরুণাভ গাড়ি নিয়ে চলে গেছিল বাড়িটার পাশে৷ রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে দূর থেকে দেখেছিল বাড়িটাকে৷ প্রাসাদের মতো বাড়িটা কীরকম নিঃঝুম হয়ে আছে বৃন্দার অনুপস্থিতিতে৷ বাড়ির আত্মাটা যেন মিসিং মনে হয়েছিল অরুণাভর৷ ততদিনে ও ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছে৷ মেড স্কুলের প্রচণ্ড চাপেও বৃন্দার থেকে মন সরাতে পারেনি ও৷ বছরে একবার করে বৃন্দাকে দেখতে যাবার নিয়মটা নিজেই চালু করেছিল ও৷ কোনও একটা ছোট ছুটিতে সানফ্রান্সিসকোতে যাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল বেশ কয়েক বছর৷ প্রথম প্রথম বৃন্দাকে জানিয়ে যেত না ও৷ বৃন্দা যাতে ওকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কোনও অজুহাত না দিতে পারে৷ তাতেও কোনও লাভ হত না৷ বৃন্দা তখন থেকেই সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে৷ অ্যাকাডেমিক চাকরির বাঁধাধরা রাস্তায় না গিয়ে অ্যাক্টিভিজমের রাস্তা বেছে নিয়েছিল ও৷ অরুণাভ দু-একবার পায়নি ওকে৷ তারপর থেকে যাবার আগে বৃন্দাকে ফোন করে নিত ও, ‘বৃন্দাদি, উইল ইউ বি হোম অ্যারাউন্ড এন্ড মার্চ?’ অরুণাভ সরাসরি জানতে চাইত৷

Vedanta Society San Francisco
বেদান্ত সোসাইটির বিশাল মন্দিরটার সামনে এসে গাড়ি থেকে থামল সিমোন আর বৃন্দা

বৃন্দার অধিকাংশ সময়ই সময় থাকত না অরুণাভর জন্য৷ ওদের করা এন.জি.ও. তখন শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে৷ সারা পৃথিবীর আন্ডার প্রিভিলেজড্‌ শিশুদের জন্য তখন কাজ করতে শুরু করেছে বৃন্দা৷

ডাক্তারির ডিগ্রি পাওয়ার পর ডক্টর স্কিনারের অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে রেসিডেন্সি করতে শুরু করেছে অরুণাভ৷ সেবারই শেষ দেখা হয় বৃন্দার সঙ্গে৷ বস্টন থেকে বৃন্দাকে ফোন করেছিল অরুণাভ, ‘বৃন্দাদি, আই অ্যাম গোয়িং টু গেট আ ব্রেক ইন সাম কর্নার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড৷ আমাকে কোনও জায়গা সাজেস্ট করতে পারো? অ্যান্ড ওয়ান মোর থিং, ক্যান আই সি ইউ বিফোর আই গো দেয়ার?

ও প্রান্তে বৃন্দা প্রশ্ন করেছিল ‘কোথায় যাবে ভেবেছ?’

নাঃ! প্রথমে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই বৃন্দাদি৷ তারপর ভাবছিলাম যদি ইউরোপ ঘুরতে যাই৷ জাস্ট থিঙ্কিং৷’

একটু সময় নিয়েছিল বৃন্দা, যেন ভাবছিল কিছু৷ তারপর ঝরনার মতো ওর হাসির শব্দ ভেসে এসেছিল ফোনের মধ্য দিয়ে৷ ‘আমার উপর তুমি কতখানি ডিপেন্ড কর অরুণাভ? ইফ আই সাজেস্ট এনিথিং, উড ইউ এক্সেপ্ট ইট?’

‘হোয়াই আর ইউ আসকিং, বৃন্দাদি? ইউ অলরেডি নো দ্যাট, ডোন্ট ইউ?’ অদ্ভুত ব্যাকুলতা নিয়ে বলেছিল অরুণাভ৷

‘ইয়েস আই নো৷’ বৃন্দা আবার একটু সময় নিচ্ছিল, ‘কাম টু মি ইন এপ্রিল অ্যান্ড স্পেন্ড আ কাপল অফ ডেজ হিয়ার৷’ তারপর আমি তোমার সঙ্গে বসে তোমার ফিউচার প্ল্যানস, ডেস্টিনেশন সব আলোচনা করব৷ টেল ইওর পেরেন্টস্‌ দ্যাট ইউ আর কামিং টু মি৷ দাদা বৌদির আপত্তি হবে না৷’

এতটা ব্যগ্র বৃন্দার গলা কখনও শোনেনি অরুণাভ৷ আপত্তি করা দূরে থাক, জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখা হাতে যেন স্বর্গ পেয়েছিলেন৷ বৃন্দা সবসময় সুপরামর্শ দেবে বাবাইকে এরকম ধারণা বদ্ধমূল ছিল ওঁদের মধ্যে৷

এপ্রিল নয়, মার্চের শেষ দিনেই বস্টন থেকে সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছিল ও৷ বৃন্দা নিজেই নিতে এসেছিল ওকে৷

‘ইউ আর আ ফুল গ্রোন ম্যান নাও’ আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলছিল বৃন্দা৷ অভ্যস্তভাবে ড্রাইভ করছিল ও৷

‘ইউ হ্যাভ রিয়্যালায়িজড দ্যাট আ বিট লেট?’ ব্যঙ্গ কিংবা চাপা অভিমান ছিল অরুণাভর গলায়৷

রাস্তার দিকে চোখ, হাত স্টিয়ারিং হুইলে, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়ায় উড়ছে ওর কপালের পাশের ঝুরো চুলগুলো— চির রহস্যময়ী এই নারীর কোনওদিনই তল পায়নি অরুণাভ৷ সেদিনও না৷ বৃন্দার চোখে রে-ব্যানের একটা ঢাউস সানগ্লাস৷ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি৷

‘ডু ইউ নো, নট ওনলি ডু ইউ লুক লাইক ইওর আঙ্কল, বাট ইউ স্পিক লাইক হিম অ্যাজ ওয়েল!’ একটা দীর্ঘশ্বাস মিশেছিল কি বৃন্দার কথায়?

অরুণাভ তখন কোনও উত্তর দেয়নি৷ মনে মনে বলেছিল, আমাকে আমার মতো করে দেখতে পারো না বৃন্দাদি? সবসময় ছোটকুর ছায়া এসে দাঁড়ায় কেন তোমার আমার মধ্যে?

এতটা ব্যগ্র বৃন্দার গলা কখনও শোনেনি অরুণাভ৷ আপত্তি করা দূরে থাক, জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখা হাতে যেন স্বর্গ পেয়েছিলেন৷ বৃন্দা সবসময় সুপরামর্শ দেবে বাবাইকে এরকম ধারণা বদ্ধমূল ছিল ওঁদের মধ্যে৷

কিন্তু মার্সিডিস গাড়িতে বৃন্দার সঙ্গে একসাথে যেতে ওর ভালো লাগছিল৷ যদি এরপর আর কখনও বৃন্দার সঙ্গে দেখা না হয়, তাহলে একসঙ্গে এই শহরে চলার স্মৃতিটুকু ওর মধ্যে রয়ে যাবে৷ অরুণাভর কেমন যেন প্রিমনিশন হচ্ছিল।

সানফ্রন্সিসকো বে-এরিয়ায় বৃন্দাদের বাড়ি৷ এই স্প্যানিশ ভিলা মার্টিনের নিজের ডিজাইনে বানানো৷ আগে দু-তিনবার বৃন্দার সঙ্গে দেখা করতে এসে হোটেলে উঠেছে অরুণাভ৷ কফি শপে, রেস্তোঁরায় একসঙ্গে কাটিয়েছে ওরা৷ কিন্তু বৃন্দা কখনও ওর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়নি৷ এই প্রথম বৃন্দার নিমন্ত্রণে ওদের স্প্যানিশ ভিলায় থাকতে এসেছে ও৷ বাড়ির চত্বরে ঢুকে একটা অর্ধচন্দ্রাকার ড্রাইভওয়ে দিয়ে ঘুরে মূল ভিলার সামনে দাঁড়িয়েছিল বৃন্দার গাড়িটা৷

রাতে খাবার টেবিলে আলাপ হয়েছিল সকলের সঙ্গে৷ বৃন্দার স্বামী মার্টিনের সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ ছিল৷ দু-একবার দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে৷ মার্টিনের বয়স সত্তরের উপর৷ ওর চুলগুলো রুপোলি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, একমুখ সাদা দাড়ির এক হাস্যময় বৃদ্ধ৷ মার্টিনের প্রথম স্ত্রী মারা যাবার দশ বছর পর বৃন্দার সঙ্গে আলাপ৷ বৃন্দার সঙ্গে ওর কোনও সন্তান নেই৷ তবে মার্টিনের দুটি মেয়ে, একটি ছেলে৷ বড় মেয়ে বৃন্দার চেয়ে একটু বড়৷ বৃন্দার চেয়ে তেত্রিশ বছরের বড় মার্টিন৷ মার্টিনের ছেলে সুইৎজারল্যান্ডে থাকে৷ ছোট মেয়ে লরা এখন কয়েকদিন হল ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বৃন্দাদের ভিজিট করতে এসেছে৷ বৃন্দা খুব সহজভাবে লরার সঙ্গে আলাপ করালো, ‘দিস ইজ লরা— আওয়ার ইয়াংগার ডটার অ্যান্ড হার ফিয়াঁসে৷’ লরা বৃন্দার চেয়ে সামান্য ছোট৷ কত দিক সামলে চলতে হয় বৃন্দাকে, অরুণাভ না ভেবে পারেনি৷

San Francisco Bay area
সানফ্রন্সিসকো বে-এরিয়ায় বৃন্দাদের বাড়ি

পরদিন সকালে উঠে মন ভালো হয়ে গেছিল অরুণাভর৷ গেস্টরুমের বাইরে জানলা দিয়ে দূরে সমুদ্র দেখা যায়৷ মার্টিন ব্রেকফাস্টের পর চলে গেছে ওর অফিসে৷ লরা নিজের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকবে৷ বৃন্দা দু’দিন ওর কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে অরুণাভর সঙ্গে সময় কাটাবে বলে৷ সারাদিন গায়ে রোদ আর বালি মেখে সমুদ্রের ধারে সময় কাটিয়েছিল ওরা৷ মার্টিনের ফিরতে অনেক দেরি হবে৷ লরা বেরিয়ে গেছে ওর এখানকার বন্ধুদের একটা জমায়েতে৷ এখানেই বড় হয়ে উঠেছে লরা৷ তাই এখানে ওর বন্ধুবান্ধব চেনা-পরিচিত অনেক৷ সন্ধেবেলা আর্লি ডিনার খেয়ে স্নান সেরে বাড়ির ঢাকা পর্চে বসল অরুণাভ আর বৃন্দা৷ পর্চে বেতের সোফায় আরামদায়ক গদি৷ সেখানে পাশাপাশি বসেছে ওরা৷ সমুদ্রের থেকে উড়ে আসা লবণাক্ত হাওয়াতে একটুও শীত নেই৷ বরং বেশ মনোরম আরামদায়ক বাতাস৷

এখন বৃন্দার পরনে একটা ফুলছাপ ঢোলা শার্ট আর লং স্কার্ট৷ ওর মাথায় একটা রেশমি রুমাল ব্যান্ডানার মতো জড়ানো৷ তার ফাঁক দিয়ে ওর অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে দামাল বাতাসে৷ চুপ করে বসে আছে দু’জনে৷ অন্যান্যবারের থেকে এই নৈঃশব্দ্য সম্পূর্ণ আলাদা৷ অন্যবার অনেক সাধ্য সাধনার পর বৃন্দার মুখ থেকে কথা বের করা যায়৷ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া নিজের ব্যক্তিগত কথা বলতে কখনোই উৎসাহ বোধ করে না বৃন্দা৷ কিন্তু এবারের ঘটনাটা আলাদা৷ বৃন্দা এবার ওকে এড়িয়ে যায়নি৷ বরং ফোনে অরুণাভকে ও নিজেই আগ্রহ নিয়ে বলেছে— ওর সানফ্রান্সিসকোর বাড়িতে উঠতে৷ এমনকি অরুণাভ যখন ফোনে বলেছিল কোথায় একটু ডি-স্ট্রেস করতে যাওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে, তখনও বৃন্দা হেসে উড়িয়ে দেয়নি৷ বৃন্দার যে এবার সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা আছে, সে ব্যাপারে অরুণাভ মোটের উপর নিঃসন্দেহ৷ শুধু সেই পরিকল্পনাটা কী জাতীয়, সে ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই অরুণাভর৷ ও জানে সকলের সামনে বৃন্দা এসব কিছু নিয়ে আলোচনা করবে না৷ আজ মার্টিন গভীর রাতের আগে ফিরবে না৷ লরা আর তার বয়ফ্রেন্ড আজ রাতে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে মত্ত৷ আজই সুবর্ণ সুযোগ বৃন্দার মনের সব কথা বলার৷ ভিতরে ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে অরুণাভর মধ্যে৷ সারাদিন বৃন্দার সঙ্গে ও সমুদ্রে মেতেছিল৷ বৃন্দা ভালবাসে এইসব ওয়াটার স্পোর্টস৷ সি-র‌্যাফটিং, ডিপ-সি ডাইভিং, স্নরকেলিং— সব কিছু তুমুলভাবে উপভোগ করে ও৷ আজ অরুণাভকেও ও টেনে নিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের তলদেশের ঐশ্বর্য দেখাবার জন্য৷ বৃন্দাকে সমুদ্রের পোশাকে অবিকল মারমেডের মতো দেখতে লাগছিল৷ মনে মনে ওর আসঙ্গলিপ্সু অরুণাভ তীব্রভাবে কামনা করছিল ওকে৷ কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সংযত করেছিল ও৷ বৃন্দার কাছে দেহের ঐশ্বর্য কামনা করে করে— এ ক’বছর ধরে শুধু ব্যর্থই হয়েছে ও৷ বৃন্দার মনের ঐশ্বর্যের ছোঁয়া না পেলে এভাবেই কেটে যাবে এই ক্লান্তিময় জীবন৷ আঠাশ বছর বয়সেই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অরুণাভ৷ একমাত্র বৃন্দাই জানে অজানা রত্নভাণ্ডারের সন্ধান, যা ওকে এই কেজো জীবনের থেকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসিয়ে অনেকদূর নিয়ে যাবে৷

কী আশ্চর্য! বৃন্দা কি থট রিডিং জানে? সেই মুহূর্তে ও সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফেরাল৷ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অরুণাভর দিকে৷ বলল ‘তুমি অনেক দূরে কোথাও যেতে চেয়েছিল না?’

‘হ্যাঁ বৃন্দাদি৷’ অরুণাভর যেন হঠাৎ ঘোর লাগছে৷ ‘আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে চাই৷ ফর অ্যাট লিস্ট আ মান্থ অর মোর৷ যেখানে আমাকে কেউ চেনে না৷ আমার কাছ থেকে কোনও কিছু এক্সপেক্ট করে না৷ সেরকম একটা জায়গায় গিয়ে নিজের মতো করে শুরু করতে চাই আবার৷ আই অ্যাম সো টায়ার্ড৷’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরুণাভ৷

ভিতরে ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে অরুণাভর মধ্যে৷ সারাদিন বৃন্দার সঙ্গে ও সমুদ্রে মেতেছিল৷ বৃন্দা ভালবাসে এইসব ওয়াটার স্পোর্টস৷ সি-র‌্যাফটিং, ডিপ-সি ডাইভিং, স্নরকেলিং— সব কিছু তুমুলভাবে উপভোগ করে ও৷ আজ অরুণাভকেও ও টেনে নিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের তলদেশের ঐশ্বর্য দেখাবার জন্য৷ বৃন্দাকে সমুদ্রের পোশাকে অবিকল মারমেডের মতো দেখতে লাগছিল৷

‘আমি বলি!’ বৃন্দা নিজের হাত রেখেছে ওর হাতে৷ খুব আলতো করে, যেন ঘরের সন্ধান দিচ্ছে ঘরহারা শিশুকে৷ ‘আই হ্যাভ আ কংক্রিট সাজেশন৷ তুমি ফোনে সাজেশন চেয়েছিলে না আমার কাছে? ওয়েন ওয়াজ দ্য লাস্ট টাইম য়্যু ওয়েন্ট টু ইন্ডিয়া? কলকাতায় কবে গেছ মনে করতে পার?’

অরুণাভ আশ্চর্য হচ্ছে৷ কলকাতার কথা তুলছে কেন ও? পনেরো বছর আগে শেষ কলকাতায় যাওয়া দাদুর মৃত্যুর সময়৷ ‘কেন বলছ তুমি? তুমি কলকাতা নিয়ে যাবে আমাকে?’ অরুণাভ আাস্তে করে মাথা রাখে ওর কাঁধে৷ ফিসফিস করে বলে ‘তুমি সঙ্গে গেলে আই ক্যান ইভন গো টু হেল, লেট অ্যালোন কলকাতা৷ কিন্তু তুমি যে যাবে না, সে তো আমি জানি৷’

বৃন্দা আলতো করে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে৷ অরুণাভ মাথা রেখেছে বৃন্দার কোলে৷ আস্তে আস্তে আঙুল দিয়ে বৃন্দা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর চুলে৷ আরামে চোখ বুজে আসছে অরুণাভর৷ কিন্তু ও চোখ খুলে আছে জোর করে৷ ওর ঠিক চোখের সামনে আধো আলোছায়ায় ভেসে আছে বৃন্দার মুখ ঠিক স্বপ্নের মতো৷

‘তুমি কেন আমাকে কলকাতা যেতে বলছ বৃন্দাদি? তুমি জানো, তুমি বললে আমি যাবই, তাই না? আমাকে কলকাতা পাঠিয়ে তোমার কি লাভ?’

স্বপ্নের মুখ বলছে, ‘আমি তোমাকে শুধু কলকাতা যেতে বলছি না অরুণাভ৷ ইন্ডিয়া ইজ ফুল অফ ডাইভার্সিটি৷ ন্যাচারাল বিউটি যদি খুঁজতে চাও, তাও অফুরন্ত৷ আর মানুষগুলোর মধ্যেও কত বৈচিত্র৷ তুমি সত্যিকারের ঐশ্বর্য যদি খুঁজতে চাও, তবে নেচারের মধ্যে আর মানুষগুলোর মধ্যেই পেতে হবে৷ কলকাতা থাকবে তোমার জার্নির শেষপ্রান্তে৷ তোমারও তো একসময় কলকাতায় জন্ম হয়েছিল৷ পাঁচ-ছ বছর বয়স অবধি যেখানে বড় হয়েছো, সে জায়গাটা কেমন ছিল জানতে চাও না তুমি?’

‘কলকাতায় আমার কেউ নেই বৃন্দাদি! ইট হ্যাজ গটন নো চার্ম ফর মি৷’

‘আগে থেকেই ডিসিশন নিচ্ছ কেন? কোনও সত্যিই অ্যাবসলিউট নয়৷ গো অ্যান্ড এক্সপ্লোর দ্য সিটি৷ আই বিলিভ, ইয়োর পেরেন্টস্‌ উইল অলসো বি হ্যাপি ইফ য়্যু ওয়ান্ট টু এক্সপ্লোর ইয়োর রুটস্‌৷ যদি পুরনো কোনও চিহ্ন খুঁজে নাও পাও, য়্যু ক্যান ডিসকভার সামথিং ইন্টারেস্টিং দেয়ার, যার ফলে য়্যু ক্যান জাস্টিফাই ইয়োর ট্র্যাভেল অ্যাজ ওয়ার্থওয়াইল৷’ রহস্যময় হাসছে স্বপ্নের নারী৷

‘হোয়াট ডু ইউ মিন বৃন্দাদি? ঠিক কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘আমি কিছুই বলতে চাই না৷ আই জাস্ট ইমপ্লোর য়্যু টু গো অ্যান্ড এক্সপ্লোর ইয়োরসেল্ফ৷ অল আই ওয়ান্ট ইজ টু গিভ য়্যু দ্য অ্যাড্রেস অব আ জেন্টলম্যান৷ তুমি এবার কলকাতায় গিয়ে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা কর৷’

‘কে ভদ্রলোক? তোমার রিলেটিভ?’ অরুণাভ কৌতূহল বোধ করছে৷

‘রিলেটিভ?’ শব্দটাকে নিয়ে নিজের মনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে বৃন্দা, ‘তা বলতে পার৷ একসময় আত্মীয় ছিলেন৷ এখন আর নেই৷ লাস্ট ওঁদের আমি দেখেছি মোর দ্যান টুয়েন্টি ইয়ারস্‌ এগো৷’

‘ওঁরা মানে?’ রহস্যের সমাধান করার জন্য হাতড়াচ্ছে অরুণাভ৷

‘উনি আর ওঁর দু’বছরের সন্তান৷ সি মাস্ট বি টুয়েন্টি টু নাও৷ আর প্রশ্ন কোরো না প্লিজ৷ লেট মি টেল য়্যু আ স্টোরি৷’

‘আ স্টোরি অ্যাবাউট ইউ? লাইক দ্য ওয়ান য়্যু টোল্ড মি ইন ইয়োর ফিলি হোম?’

‘ইটস নট অ্যাবাউট মি৷ ইটস অ্যাবাউট সামওয়ান এলস্‌৷ ‘ইটস অ্যাবাউট অ্যানাদার উওম্যান, অ্যানাদার ফ্যামিলি৷’

‘হোয়াই আর য়্যু টেলিং মি দিস? ইট ডাজ নট কনসার্ন মি অর য়্যু৷’

‘আই অ্যাম টেলিং ইউ দ্য স্টোরি টু মেক য়্যু ফাস্ট অ্যাস্লিপ৷’ মধুর ভ্রূকুটি বৃন্দার চোখে… ‘অন আ সিরিয়াস নোট, ইট ইজ সামথিং দ্যাট হ্যাজ বিন বদারিং মি ফর টুয়েন্টি ইয়ারস্‌ দ্যো ইট ডাজ নট কনসার্ন মি ডিরেক্টলি৷’

water view San Francisco bay
সারাদিন বৃন্দার সঙ্গে ও সমুদ্রে মেতেছিল

বৃন্দা গল্পটা শুরু করে৷ এই গল্পে সে তৃতীয় ব্যক্তি৷ ও বলে, ‘মনে আছে তোমাকে যখন আমার নিজের গল্পটা বলেছিলাম— তখন বলেছিলাম আমার দিদির গল্পটা অন্য কোনওদিন তোমাকে বলব?’ সেই গল্পটাই বলতে বসেছে বৃন্দা৷ অন ওয়ান কন্ডিশন৷ অরুণাভ এই গল্পটা কাউকে বলতে পারবে না৷ লিস্ট অফ অল, ইয়োর পেরেন্টস্‌৷ আমি যেমন আমার অতীতটাও আড়ালে রেখেছি, তেমনই দিদির পরিবারের প্রাইভেসি রক্ষা করাটাও আমার দায়িত্ব৷ লোকে সেটা নিয়ে ভ্যালু জাজমেন্ট করুক আমি চাই না৷

‘যদি এসব গল্প তোমার এখনকার চেনাশোনা কাউকে না করে থাক, নট ইভন মার্টিন, দেন হোয়াই মি?’ ‘ডু ইউ ফিল আই অ্যাম সামওয়ান স্পেশাল ইন ইওর লাইফ?’ অরুণাভ জানতে চেয়েছিল৷

বৃন্দার মুখে খানিকক্ষণ কোনও কথা যোগায়নি৷ ও একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল অরুণাভর দিকে৷ তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘শুনতে চেয়েছ যখন শোনো৷ তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা তোমার মনে আছে কি না জানি না৷ আই রিমেমবার ইট ভিভিডলি৷ তোমার মা বাবার সঙ্গে একটা বঙ্গ সম্মেলনে আলাপ হয়েছিল আমার৷ মোহনানন্দজীর সঙ্গে ওঁদের বাড়িতে গিয়ে অনেক গান শুনিয়েছিলাম— সেটা মনে ছিল ওঁদের৷ আমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেছিল ওঁদের৷ আমার ভালো লেগেছিল৷ তবে সাংঘাতিক কিছু নয়৷ এমন কত বাড়িতেই একসময় মহারাজের সঙ্গে গিয়ে গান করেছি৷ তোমার বাবা মা যে মনে রেখেছিলেন, আই অ্যাম গ্রেটফুল ফর দ্যাট৷ দে প্রমিসড্‌ টু ব্রিং দেয়ার সান দ্য নেক্সট ডে৷’

বৃন্দা একটু চুপ করে আবার বলল, ‘পরের দিন তুমি এলে৷ তোমার সঙ্গে আলাপ করালেন তোমার মা-বাবা৷ আই ওয়াজ স্ট্রাক বাই আ লাইটনিং৷ আমি হঠাৎ দেখলাম যে স্বাধীনকে আমি তার আট বছর আগে কলকাতায় ফেলে চোরের মতো বিদেশে চলে গেছিলাম, পাঁচ বছর আগে যে মারা গেছে বলে খবর এসেছিল বন্ধুদের কাছ থেকে, সেই স্বাধীনকে আমি আবার আমার চোখের সামনে দেখছি৷ আমার ভিতরে আট বছর ধরে জমিয়ে রাখা সব পেন্ট-আপ ইমোশনগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷ ভাগ্যিস তোমার মা-বাবা কিছু বুঝতে পারেননি৷ তোমার বাবা যে স্বাধীনের দাদা বুঝতে পারলাম তোমাকে দেখে৷ তারপর তোমাদের বাড়ি যাতায়াত শুরু হল৷ দাদা বৌদি আমাকে খুব সহজভাবে অ্যাকসেপ্ট করেছিলেন— উইদাউট মাই ব্যাগেজ অ্যাজ গোল্ডস্টাইন৷ আমি সেজন্য ওঁদের কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ৷ আমি আস্তে আস্তে লক্ষ করছিলাম স্বাধীন সম্পর্কে ওঁদের একটা বিটারনেস ছিল৷ বিশেষ করে তোমার বাবার৷ স্বাধীন সম্পর্কে কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে নিতে পারতাম না৷ আজও পারি না৷ যদিও ওঁরা তো স্বাধীনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানতেন না৷ জানলে হয়ত ওর সম্পর্কে আলগা মন্তব্য করতেন না৷ কে জানে? ওঁরা বারবার বলার চেষ্টা করতেন, রাজনীতির নামে ওর মতো ছেলেরা পরিবারের প্রতি দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছিল৷ কী জানি, মানুষ তো বিভিন্ন পার্সপেক্টিভ থেকে একই ঘটনা দেখে৷ রশোমন এফেক্ট তৈরি হয়৷ একই গল্পেরও অনেক ভার্শান হয়৷ ঠিক করেছিলাম তোমাদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেব৷ বন্ধ হয়ত করেও দিতাম, কারণ স্বাধীন সম্পর্কে কোনও নেগেটিভ কথা শুনব না ঠিক করেছিলাম৷ শুধুমাত্র একটাই কারণে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে পারিনি৷ আশা করি বুঝতে পারছ কারণটা কী?’

বৃন্দা অপলক তাকিয়ে ছিল অরুণাভর দিকে৷

আমি হঠাৎ দেখলাম যে স্বাধীনকে আমি তার আট বছর আগে কলকাতায় ফেলে চোরের মতো বিদেশে চলে গেছিলাম, পাঁচ বছর আগে যে মারা গেছে বলে খবর এসেছিল বন্ধুদের কাছ থেকে, সেই স্বাধীনকে আমি আবার আমার চোখের সামনে দেখছি৷ আমার ভিতরে আট বছর ধরে জমিয়ে রাখা সব পেন্ট-আপ ইমোশনগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷ ভাগ্যিস তোমার মা-বাবা কিছু বুঝতে পারেননি৷ তোমার বাবা যে স্বাধীনের দাদা বুঝতে পারলাম তোমাকে দেখে৷ তারপর তোমাদের বাড়ি যাতায়াত শুরু হল৷

‘আই রিমাইন্ডেড য়্যু অফ হিম৷’ অরুণাভ প্রায় নিজেকেই নিজে বলছে৷

‘য়্যু স্টিল ডু৷ তোমাকে একবার দেখার জন্য আমি তোমাদের ওখানে ছুটে যেতাম৷ অ্যান্ড আই নোটিশড্‌ ইয়োর ফিলিং ফর মি ফ্রম ইওর ফেস৷ আমার ভয় করত তোমার মা-বাবা বুঝে ফেলবেন৷ আমার আরও বেশি ভয় হত নিজেকে নিয়ে৷ আমার নিজের ফিলিং তোমার কাছে ধরা পড়লে পৃথিবীতে আর কোনও শক্তি আমাদের আটকাতে পারত না৷

‘আটকাতে চাইলে কেন বৃন্দাদি? কেন দুজনের মনের ন্যাচারাল ইনস্টিংটগুলো চেপে রাখতে বাধ্য করলে? এখনও সময় আছে বৃন্দাদি৷ চল আমরা সবার থেকে দূরে কোথাও চলে যাই৷’

‘ভীষণ বোকা তুমি অরুণাভ৷ শুধু ইনস্টিংট দিয়ে কি মানুষ চলে?’ চোখের জল মুচ্ছে নিচ্ছে বৃন্দা— তাছাড়া আমি তো তোমার মধ্যে স্বাধীনকে পাচ্ছিলাম৷ সে যে কী ভীষণ সুখ আর দারুণ যন্ত্রণা! প্রতি মুহূর্তে গোপন আনন্দ আর গভীর দুঃখে মাখামাখি হয়ে যেতাম আমি৷ দ্বিতীয়বার স্বাধীনকে ফিরে পেয়েও তাকে অস্বীকার করার যন্ত্রণায় ফালাফালা হয়ে যেতাম আমি৷ তাছাড়া য়্যু ওয়্যার আ মিয়ার কিড৷ তোমাকে তো ঠকাতে পারতাম না আমি৷’

‘আর এখন! এখন তো আর টিন-এজার বয় নই৷ আঠাশ বছর বয়সের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ৷ এখন কেন আমাকে অস্বীকার করছ?’

বৃন্দা কাতরভাবে বলছে, ‘প্লিজ প্লিজ অরুণাভ৷ আমাকে এইভাবে দুর্বল করে দিও না৷ আমার বলা এখনও শেষ হয়নি৷’ খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে বৃন্দাকে৷ ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব মায়া হয় অরুণাভর৷

বৃন্দা কত বছর ধরে কত যন্ত্রণাকে বুকের মধ্যে বহন করছে৷ অরুণাভ খুব আস্তে আস্তে বলে— ‘বল তুমি৷ তোমার সব কথা শোনার জন্য তৈরি আমি৷’

বৃন্দা বলছে, ‘অরুণাভ, তোমাকে যেমন আমি ঠকাতে চাইনি, তেমনই মার্টিনকেও ঠকাতে চাইনি আমি৷ স্বাধীন আর কখনও ফিরবে না জেনেই মার্টিনকে বিয়ে করেছিলাম আমি৷ হি ইজ অ্যান অনেস্ট ম্যান৷ আই রেসপেক্ট হিম ফর দ্যাট৷ তোমার সঙ্গে যদি ভেসে যেতাম তবে মার্টিনের আমার প্রতি অগাধ আস্থার অপমান করতাম আমি৷ ট্রাস্ট অর্জন করা বড় ভাগ্যের কথা৷ সেই ট্রাস্টকে নষ্ট করতে আমার মন সায় দেয়নি৷ দিদির এক্সামপ্‌ল্‌টা মাথায় ছিল আমার৷ আমার দিদি লেফট্‌ হার হাজব্যান্ড অ্যান্ড টু ইয়ার ওল্ড ডটার ফর অ্যানাদার পার্সন৷ একটু সুখের সংসারকে নতুন প্রেমের টানে বিসর্জন দিয়েছিল আমার দিদি রাধিকা৷ ঘটনাটা পৃথিবীতে একমাত্র স্বাধীনকেই বলেছিলাম আমি৷ ও কোনও বিরূপ মন্তব্য করেনি৷ শুধু বলেছিল, ‘ভেরি আনফরচুনেট৷ ম্যারেজ নামক ইন্সটিট্যুশনের প্রধান কম্পোনেন্ট এলিমেন্ট ট্রাস্ট৷ সেই ট্রাস্টই যখন ভেঙে গেল, তখন তোমার দিদি আগের জীবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভালোই করেছেন৷

আমার মনেও তোলপাড় হয়েছিল অনেক৷ দিদিকে দুই বিপরীত স্রোতের মধ্যে পড়ে তলিয়ে যেতে দেখেছিলাম৷ ঠিক সময় শক্ত হতে পারেনি দিদি, নিজেকে দমন করতে পারেনি৷ যখন টের পেল আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷

বৃন্দা থামল৷

‘তোমার দিদি কোথায় থাকেন?’

‘দিদি থাকে ইংল্যান্ডে৷ দ্বিতীয়বার ভালবেসে বিয়ে করেছিল যাকে, সেও দূরে চলে গেছে অনেককাল৷ দিদি একাই থাকে আজকাল৷ বহুদিন ধরে৷’

‘আর তুমি যার ঠিকানা দিতে চেয়েছ আমাকে?’

‘হ্যাঁ, ওঁকেই প্রথম ভালবেসে বিয়ে করে দিদি৷ যতদূর জানি অম্বিকাদাও একাই থাকেন মেয়েকে নিয়ে৷ আমার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেননি ওই ঘটনার পর থেকে৷’

‘আমাকে ওখানে যেতে বলছ কেন? অ্যাজ ইওর রেপ্রেজেন্টিটিভ? ইফ হি থ্রোজ মি আউট অফ হিজ হাউজ?’

বৃন্দা ঈষৎ হাসে৷ ‘আমি যতদূর জানি উনি তোমাকে বাইরে বার করে দেবেন না৷ হি ইজ আ পারফেক্ট জেন্টলম্যান৷ অ্যাট লিস্ট হি ওয়াজ টুয়েন্টি ইয়ারস্‌ এগো৷ অ্যাজ লং অ্যাজ য়্যু ডোন্ট অ্যাপিয়ার টু বি আ থ্রেট কামিং ফ্রম হিজ এক্স ওয়াইফ, হি উইল বি ফাইন৷ আর আমি একটা লম্বা চিঠি লিখে রেখেছি ওঁর জন্য৷ ইউ উইল বি মাই মেসেঞ্জার৷ আর যদি বের করেই দেন, ইউ হ্যাভ ইয়োর ওন হোটেল টু স্টে ইন৷ তুমি তো আর ওঁর ভরসায় যাচ্ছ না৷

‘হোয়াট অ্যাবাউট দ্যন গার্ল? হাউ উইল শি রিঅ্যাক্ট?’ অরুণাভ একটু সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করেছিল৷

‘দ্যাট আই ডোন্ট নো৷’ বৃন্দা এবার সত্যি সত্যি হাসছে৷ ‘অনেস্টলি আই হ্যাভ নো আইডিয়া হাউ শি উইল টেক য়্যু৷ আমার বোনঝিকে আমি লাস্ট দেখেছি যখন ওর দুবছর বয়স৷ এখন হিসেব ম্তো, সি ইজ টুয়েন্টি-টু৷ সি মাস্ট বি আ ভেরি প্রিটি উওম্যান— লাইক হার মাদার৷ সবসময় কি আমি তোমাকে বলে দেব কীভাবে কার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে? গো টু দ্য সিটি, অ্যান্ড মেক সিয়োর টু গো টু দ্যাট অ্যাড্রেস৷ ওনলি টাইম উইল টেল, হোয়াট ইজ স্টোরড দেয়ার ইন দ্য হার্ট অফ দ্য ফিউচার৷

সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ভেজা বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল বৃন্দার শরীরের সুঘ্রাণ৷ প্রাচীন পৃথিবীর থেকে উঠে আসা জলকন্যার মতো মনে হচ্ছিল বৃন্দাকে, যাকে ঠিক ধরা যায় না, যার কষ্টকে ঠিক ছোঁয়া যায় না৷ অন্ধকারে দূর সমুদ্রে ভাসমান দু-একটা জাহাজের মাস্তুলের আলো ইশারা করছে অরুণাভকে, বন্দর ছেড়ে সাগরে পাড়ি জমাবার হাতছানি দিচ্ছে৷ সামনে খুব কাছে, তবু বহুদূরে জলমানবী মরীচিকার মতো ভেসে আছে৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১১ জানুয়ারি ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Istock, Maxpixel, Flickr, WikiMedia Commons, Pixnio

Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।
Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com