banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ১৬

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

ডিসেম্বর ৭, ২০২২

Novel Akashpradip part 16
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫]

(২৮)

‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি৷’ অরুণাভর লেটেস্ট শখ হল নতুন গাড়িটা৷ একটা ছোটখাটো বাসস্থানও বলা চলে৷ মিনি ক্যারাভানে দু’জনের শোওয়ার ব্যবস্থা, মিনি ফ্রিজ, মাইক্রোয়েভ আভেন, সোফা, ছোটো ডাইনিং কাম স্টাডি টেবিল সবই মজুত৷ ড্রাইভ করতে খুব ভালোবাসে অরুণাভ৷ সেই কবে থেকে ড্রাইভ করে সব জায়গায় চষে বেড়াত সে৷ মা বিরক্ত হতেন৷ একটু উদ্বিগ্নও৷ তেরো-চোদ্দ বছর বয়স থেকেই ড্রাইভিং-এ হাত পাকিয়ে ফেললেও বৈধ লাইসেন্স হল ষোল বছরে৷ আটাত্তরের শেষে বাবা টয়োটা গাড়ি কিনে দিলেন ওর জন্য৷ দিব্যি ছিমছাম গাড়ি৷ জ্যোতির্ময়ের ছিল পেল্লায় আমেরিকান গাড়ি৷ গ্যাস গাজ্‌লার৷ প্রতি মাসে গ্যাস স্টেশনে যে কত গ্যাস ভরতে হত সেই গাড়িটায়৷ তখন কত রকমের শখ ছিল অরুণাভর৷ সীমন্তিনীর সঙ্গে যখন দেখা হল, তখন ও আঠাশ বছর বয়সের এক ছটফটে তরুণ৷ অনেক স্বপ্ন ভেঙে গেছে, তবু অনেক স্বপ্ন ওর মনে৷ সীমন্তিনী নতুন কেনা গাড়িতে বসে আড়চোখে একবার অরুণাভকে দেখল৷ একমনে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে ও৷ মুখে গুনগুন করে সেই গানের কলিটাই ভাঁজছে, যা গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে চলছে৷ ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি৷’ যে কোনও সময় দুজনে একসঙ্গে কোথাও গেলেই অরুণাভর হাতে থাকে স্টিয়ারিং হুইল৷ সীমন্তিনী ভার নেয় গান ব্যাপারটার৷

অরুণাভর বাড়িতে সবাই অল্পবিস্তর গান গাইতে জানে৷ সীমন্তিনী বিয়ে হয়ে এসে দেখেছে অরুণলেখা আপন মনে গান করতেন৷ কাজ করতে করতে, গাড়িতে কোথাও যাবার সময়, সব সময়ই চলত তাঁর গান৷ রবীন্দ্রনাথের গান অরুণলেখা ছোট থেকেই শিখেছেন৷ জ্যোতির্ময় বিভিন্ন রকমের গান গাইতেন, শুনতেনও৷ পুরনো যুগের বাংলা সিনেমার গান সীমন্তিনী কলকাতায় থাকাকালীন যত না শুনেছে, বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে তার চেয়ে অনেক বেশি শুনেছে৷ জ্যোতির্ময় অরুণলেখার ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে প্রচুর লং-প্লেয়িং রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল৷ বন্ধুরা কেউ দেশে গেলেই জ্যোতির্ময় লিস্ট করে কলকাতা থেকে রেকর্ড আনাতেন স্পেশাল প্যাক করে৷ অরুণাভর গান-বাজনার কানটা তৈরি হয়েছে ওর বাবা-মা’র যৌথ প্রয়াসে৷ সীমন্তিনী এদেশে বিয়ে হয়ে আসার পর জ্যোতির্ময় প্রায়ই ওকে ডেকে বলতেন ‘এস মামণি! আমরা গান শুনি৷’ সীমন্তিনী শ্বশুরের সঙ্গে বসে বসে অনেক রকমের গান শুনত৷ সবরকম গান খোলা মনে শুনতে তখন থেকেই অভ্যস্ত হয়েছিল ও৷ একটা একলেকটিক টেস্ট তৈরি হয়েছিল৷

Long playing record
জ্যোতির্ময় অরুণলেখার ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে প্রচুর লং-প্লেয়িং রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল

একই ধরনের চিন্তা বোধহয় অরুণাভর মাথায়ও খেলা করছিল৷ ‘সীমন্তিনী, ডু ইউ রিমেমবার আওয়ার ফার্স্ট ডেজ আফটার ম্যারেজ?’ সহসা বলল অরুণাভ৷

‘ইয়েস, আই ডু রিমেমবার দোজ ডেজ৷ ইওর ড্যাড ইনিসিয়েটেড মি টু দিজ সংগস! ইন ফ্যাক্ট পথ নিয়ে অনেক গানই খুব প্রিয় ছিল ওঁর৷ ওই যে, ওই গানটা— এই পথ যদি না শেষ হয়, সপ্তপদীর গান বোধহয়৷ সিনেমাটা বিয়ের পর এখানে এসে মামণিদের সঙ্গে প্রথম দেখেছিলাম আমি৷ দে হ্যাড অ্যান অ্যামেজিং কালেকশন অফ ভিডিও ক্যাসেটস্‌ অলসো৷ বেশ কিছু পুরনো বাংলা আর হিন্দি সিনেমাও ছিল৷’

‘সপ্তপদীর রীণা ব্রাউন৷ দ্য ইটারনাল রম-কম৷’

‘বাবা তোমার মনে আছে?’ সীমন্তিনী বেশ অবাক বোধ করছে এতদিন বাদেও রীণা ব্রাউন, সুচিত্রা অভিনীত চরিত্রটা অরুণাভর মনে আছে দেখে৷

‘আমার সব মনে আছে৷ মনে থাকে৷ তোমারও থাকে সীমন৷ ইফ ইউ ওয়ান্ট টু রিমেমবার৷ আমাদের ব্রেন ইজ দ্য আল্টিমেট হার্ড ডিস্ক৷ স্টোরেজ স্পেস৷ ওনলি ইউ হ্যাভ টু পুশ্‌ দ্য রাইট বাটন্‌৷’

অনেকদিন বাদে লং ড্রাইভে বেরিয়েছে ওরা৷ নতুন গাড়িটা নিয়ে রণো, রোহিণী সবাইকে নিয়ে বেরনোর ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু রণোর কোনও সময় নেই৷ রোহিণীও ওর লেখালেখি নিয়ে খুব ব্যস্ত৷ অগত্যা ওরা দুজনেই বেরিয়ে পড়েছে একটা উইকেন্ড দেখে৷ এখন এই অঞ্চলে পাস্ট পিক ফল কালারস্‌৷ বিশেষত ওরা যেখানে যাচ্ছে সেই ওয়ালডেন পন্ড অঞ্চলে ইতিমধ্যেই পর্ণমোচী গাছেরা পাতা ঝরাবার উৎসব শুরু করে দিয়েছে৷ পাতা ঝরানোর আগে মনোহারী রঙ-বেরঙের সাজে সেজে ওঠে ওরা৷ তারপর পাতা ঝরানোর মরশুম শুরু হয়৷ প্রতিদিন মোটা গালিচার মতো আস্তরণে ছেয়ে থাকে মাটি৷

ওদের জীবনেও এখন হেমন্তের দিন৷ দেহে মনে প্রৌঢ়ত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে৷ প্রতিদিন সকালে শোবার ঘরের জানলা থেকে নীচে রাস্তার দিকটায় পুরু চাদরের মতো পাতায় ছেয়ে যাওয়া দেখে সীমন্তিনীর এই কথাটাই মনে হয়৷ কত বড় হয়ে গেল, বুড়ো হয়ে গেল ওরা৷ ভাবলেই এক সমুদ্র মনখারাপ সোঁ সোঁ করে হানা দিতে থাকে৷ আক্রান্ত হতে থাকে সীমন্তিনী৷ নিজের অন্যমনস্কতার মধ্যে, চাপ চাপ বিষণ্ণতার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে ও৷ মেনোপজের পর থেকেই এরকম হচ্ছে৷ ইদানীং প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে প্রফেশনাল কাউন্সেলরের কাছে যায় ও৷ ওকে অ্যাকটিভ লাইফ লিড করতে পরামর্শ দিয়েছে কাউন্সেলর৷

নতুন গাড়িটা নিয়ে রণো, রোহিনী সবাইকে নিয়ে বেরনোর ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু রণোর কোনও সময় নেই৷ রোহিনীও ওর লেখালেখি নিয়ে খুব ব্যস্ত৷ অগত্যা ওরা দুজনেই বেরিয়ে পড়েছে একটা উইকেন্ড দেখে৷ এখন এই অঞ্চলে পাস্ট পিক ফল কালারস্‌৷ বিশেষত ওরা যেখানে যাচ্ছে সেই ওয়ালডেন পন্ড অঞ্চলে ইতিমধ্যেই পর্ণমোচী গাছেরা পাতা ঝরাবার উৎসব শুরু করে দিয়েছে৷

‘তোমার কোনও সিক্রেট আছে? যা তুমি লুকোতে চাও কারোও কাছ থেকে? তেমন কোনও গোপন জগৎ?’

কাউন্সেলর জিজ্ঞেস করেছিল ওকে৷ সীমন্তিনী তরুণ ছেলেটিকে ঠিক বোঝাতে পারেনি জীবনের একুশ বাইশ বছরের ক্রূর সত্যকে প্রাণপণে অস্বীকার করে নিজের কাছ থেকেই পালাতে চায় ও৷ অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিল ও একত্রিশ বছর আগে৷ দীর্ঘ একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে প্রাণপণে পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজছিল৷ অরুণাভ এসেছিল ওর পরিত্রাতা হয়ে৷ আজ এতবছর পরে ভেবে পায় না সীমন্তিনী— এই পুরো ভুলতে চাওয়ার পন্থাটা সঠিক ছিল কি না? সঠিকই যদি থাকবে, তবে কেন এতকাল বাদেও চাপ চাপ অন্ধকারে তলিয়ে যায় ও?

Saptapadi-1961
সপ্তপদীর রীণা ব্রাউন৷ দ্য ইটারনাল রম-কম

অরুণাভ ব্যাপারটায় ইদানীং বেশ উদ্বিগ্ন৷

চোখের সামনে সীমন্তিনী গভীর বিষণ্ণতার খাদে তলিয়ে যাবে? ইদানীং নার্ভ স্যুদিং ওষুধের ডোজটা বাড়িয়ে দিয়েছে৷ এভাবে চলতে থাকলে তো ওষুধের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে যাবে ও! অরুণাভর অনেক চিন্তা ইদানীং৷ মা দিন দিন নার্সের উপর ডিপেন্ডেন্ট শিশুর মতো হয়ে যাচ্ছেন৷ খাইয়ে দিলে খান, নয়তো খাবার কথা মনে থাকে না অরুণলেখার৷ আবার মাঝে মাঝে খাবার একটু বাদেই বলতে থাকেন— আমাকে এখনও খাবার দিল না তো? জিনির সঙ্গে আলাচনা করেও দেখেছে অরুণাভ৷ জিনি আর ওর মায়ের ব্যাপারে অতটা কনসার্ন ফিল করে না৷ প্রায় দশ বছরের ছোট বোনটার প্রতি গভীর একটা মায়া রয়েছে অরুণাভর৷ বেশ রেগুলার কথা হয় ওর সঙ্গে৷ কিন্তু জিনি যে ওদের ছোটবেলার সেই জীবন থেকে অনেকটা সরে গেছে, সেটাও টের পায় অরুণাভ৷ এটাই হয়তো ডেস্‌টিনি৷ জিনি রুণকে নিয়ে, নিজের জীবনে রুটেড৷ বিয়াট্রিসকে নিয়ে, রুণকে নিয়ে ও নিজের জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছে হয়ত! জিনির বর্তমান এই জীবন সম্পর্কে মনের কথা কারোর সঙ্গেই শেয়ার করে না অরুণাভ৷ এমনকী সীমন্তিনীর সঙ্গেও নয়৷ সীমন্তিনীও এত বছর ধরে জানে অরুণাভ যতটা বলতে চায়, ঠিক ততটুকুই বলবে৷ জিনির এখনকার জীবনযাপন সম্পর্কে অরুণাভর মধ্যে একটা ‘জোন অফ সাইলেন্স’ রয়েছে৷ সীমন্তিনী কখনও অরুণাভর মধ্যে থেকে কথা বার করে আনতে চায়নি, তার জন্য অরুণাভ সবিশেষ কৃতজ্ঞ৷ সীমন্তিনী চিরকালই কম কথা বলে৷ একেবারে পারিবারিক বৃত্তের মধ্যেও তাও কিছুটা সহজ হতে পারে৷ কিন্তু ইমিডিয়েট পারিবারিক গণ্ডী ছাড়া বাইরের লোকের কাছে ও একটু গুটিয়ে থাকে৷ শামুকের খোলার মতো আত্মরক্ষার জন্য যেন গুটিয়ে নেয় নিজেকে৷ নিজের সমস্ত দোষ-গুণ, ভুলভ্রান্তিকে কখনও খুলতে চায়নি, খুলতে পারেনি বলেই কি ওর এত সমস্যা?ন

ইদানীং সীমন্তিনীকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন লাগে অরুণাভর৷ গত ত্রিশ বছর ধরে একটু একটু করে বদলে গেছে সীমন্তিনী৷ অসম্ভব একটা অ্যাংজায়েটি, একটা নার্ভাস ডিসঅর্ডার গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে৷ ওর গোটা ব্যক্তিত্বে একরকম রুক্ষ্ম ছাপ পড়েছে৷ ত্রিশ-একত্রিশ বছর আগেকার সেই তরুণী সীমন্তিনী কবে যে একটু একটু করে হারিয়ে গেল, বুঝতে পারে না অরুণাভ৷ এই যে সীমন্তিনী পাশে বসে লং ড্রাইভে যাচ্ছে, এখন এই মুহূর্তেও কী ভাবছে ও বুঝতে পারছে না অরুণাভ৷ ‘কী ভাবছ সীমন? ড্রাইভ করতে করতে আলতো করে প্রশ্ন করছে অরুণাভ৷ কথা না বললে আরও শামুকখোলের মধ্যে ঢুকে যাবে ও৷

মা দিন দিন নার্সের উপর ডিপেন্ডেন্ট শিশুর মতো হয়ে যাচ্ছেন৷ খাইয়ে দিলে খান, নয়তো খাবার কথা মনে থাকে না অরুণলেখার৷ আবার মাঝে মাঝে খাবার একটু বাদেই বলতে থাকেন – আমাকে এখনও খাবার দিল না তো? জিনির সঙ্গে আলাচনা করেও দেখেছে অরুণাভ৷ জিনি আর ওর মায়ের ব্যাপারে অতটা কনসার্ন ফিল করে না৷ প্রায় দশ বছরের ছোট বোনটার প্রতি গভীর একটা মায়া রয়েছে অরুণাভর৷ বেশ রেগুলার কথা হয় ওর সঙ্গে৷ কিন্তু জিনি যে ওদের ছোটবেলার সেই জীবন থেকে অনেকটা সরে গেছে, সেটাও টের পায় অরুণাভ৷ এটাই হয়তো ডেস্‌টিনি৷

‘কিছু ভাবছি না, গান শুনছি৷’ সীমন্তিনী জবাব দেয়৷ গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে এখন গান বাজছে — ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে, ডাক দিয়ে সে যায়৷ আমার ঘরে থাকাই দায়৷’

সীমন্তিনী পা ছড়িয়ে দিয়েছে৷ গাড়িটায় প্রচুর লেগ স্পেস৷ পাশে ট্রাভেল মাগে চা৷ মিনি ক্যারাভানের ভিতরে প্রচুর স্ন্যাক্স, স্যান্ডুইচ মজুত করে ওরা বেরিয়েছে৷ অরুণাভ নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় করে এসব৷ নিজে যদিও মেপে খায়, তবু ক্যারাভানের ফ্রিজে প্রচুর খাবার মজুত করে রেখেছে ও৷ একটা রেস্ট এরিয়ায় থেমে ফ্রেস চা বানিয়েছে সীমন্তিনী৷ বাড়িতে সুদৃশ্য পটে হালকা দার্জিলিং চা খেতে পছন্দ করে ও৷ পথের জন্য অবশ্য টি-ব্যাগ৷ জল গরম করে টি-ব্যাগ দিয়ে পথের চা করে পাশে রেখেছে৷ একটু একটু করে চায়ে চুমুক দিয়ে হাইওয়ের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চলেছে সীমন্তিনী৷ অরুণাভর পাশে বসে এমন কতবার কত জায়গায় গেছে ও৷ তবু যেন পুরনো হয় না পথ৷ একসঙ্গে কত পথ পেরিয়ে এল ওরা৷ এসব কথা আলগাভাবে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছে ও৷ হঠাৎ পাশ থেকে অরুণাভর প্রশ্নটা ভেসে এল,‘আর ইউ হ্যাপি সীমন?’

‘পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে, বাজে আমার বুকের মাঝে
বাজে বেদনায়৷ আমার ঘরে থাকাই দায়৷’

কণিকা, সুচিত্রা একসঙ্গে গাইছেন৷ কণিকার মধুঝরা কণ্ঠ, সুচিত্রার দৃপ্ত গায়নভঙ্গি এই গানে।

‘হ্যাপি অ্যাবাউট হোয়াট?’ সীমন্তিনী প্রতি-প্রশ্ন করে৷

‘হ্যাপি ইন জেনারেল! হ্যাপি অ্যাবাউট লাইফ? হ্যাপি অ্যাবাউট আওয়ার জার্নি টুগেদার?’

হ্যাপি কথাটাকে নিয়ে মনের মধ্যে খেলছে সীমন্তিনী৷ একত্রিশ বছর ধরে প্রতিনিয়ত সুখেরই অনুসন্ধান করে চলেছে ও৷ পারসুট অফ হ্যাপিনেস৷ এতদিন বাদেও শব্দটা খুব অলীক শোনায় কানে৷

‘পূর্ণিমাতে সাগর হতে ছুটে এল বান
আমার লাগল প্রাণের টান৷
আপন মনে মেলে আঁখি, আর কেন বা পড়ে থাকি
কিসের ভাবনায়?
আমার ঘরে থাকাই দায়৷’

তিল তিল করে সুখ খুঁটে খায় পায়রাটা৷ গমের দানার মতো৷ ভবানীপুরের বাড়ির বহুকাল আগের পায়রার ছবিটা ভেসে ওঠে মনে৷ সীমন্তিনী আরামদায়ক গাড়িতে পা ছড়িয়ে বসে পায়রাটাকে অনুসরণ করে যেতে থাকে৷

‘কই? জবাব দিলে না?’ বহুদূর থেকে অরুণাভর গলা ভেসে আসে৷

Tea pot
বাড়িতে সুদৃশ্য পটে হালকা দার্জিলিং চা খেতে পছন্দ করে ও

পায়রাটা খুঁটে খুঁটে গম খেতে খেতে ঘুরতে ঘুরতে দূরে চলে যেতে থাকে৷ পলাতক পায়রাকে অনুসরণ করে যায় সীমন্তিনী৷ অরুণাভ জবাব চাইছে৷ ‘আমাদের এখনও বোধহয় অনেক কথা বলা বাকি আছে৷’ ক্লান্ত গলায় বলে সীমন্তিনী

ওয়ালডেন পন্ড ঘুরে পরদিন ওরা বস্টন থেকে দক্ষিণমুখো এসেছে৷ শেনান্ডুয়া কেভের থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বে একটা চমৎকার এয়ার বি অ্যান্ড বি-তে উঠেছে সীমন্তিনীরা৷ অদূরেই ক্যারাভান পার্ক৷ বাড়িটা কাঠের, পিছনের চত্বরটায় হরিণ এসে উঁকি দেয় মাঝে মাঝে৷ একতলা বাড়ির সামনে পিছনে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে আছে৷ সারা দিনের পরে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে চা খেতে বসেছে ওরা৷ এখানে দু’দিন থাকার কথা৷ কালকে ওরা শেনান্ডুয়া কেভস্‌ ঘুরতে যাবে৷ এখানে ওরা আগেও এসেছে৷ এবার এল বহুদিন পরে৷ টানা বেশ কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে অরুণাভ একটু টায়ার্ড৷ পাজামা-পাঞ্জাবির উপর একটা শাল জড়িয়েছে গায়ে৷ সীমন্তিনীর পরণে একটা নীল রঙের কাশ্মীরি শালের শালোয়ার কামিজ৷ মাথার চুলগুলো চুড়ো করে একটা হর্সটেল বেঁধেছে ও৷ ফর্সা রঙে নীল রঙের শালোয়ার কামিজ খুব খুলেছে৷ এখন মোটা হয়ে গেছে ও৷ শার্প ফিচার্স কাটা কাটা নাক মুখ চোখ মেদবাহুল্যে ঈষৎ ম্লান৷

চেহারা ভারি হয়ে গেলেও সীমন্তিনী এখনও নিঃসন্দেহে সুন্দরী৷ ওকে সেভাবে আর খেয়াল করে না অরুণাভ৷ সীমন্তিনী ওর প্রাত্যহিকতার অভ্যেসে জড়িয়ে গেছে৷ আজ বহুকাল বাদে অচেনা বাড়ি, অজানা পরিবেশে সীমন্তিনীর সৌন্দর্য আরেকবার নতুন করে ধরা পড়ল অরুণাভর চোখে৷ তারিয়ে তারিয়ে ওকে দেখতে দেখতে সহসা বৃন্দার কথা মনে পড়ে গেল ওর৷ বৃন্দার সঙ্গে সীমন্তিনীর আশ্চর্য মিল৷ রক্তের সম্পর্ক বলে বোঝা যায়৷ অবশ্য বৃন্দার এখন কেমন চেহারা হয়েছে জানে না অরুণাভ৷ সীমন্তিনী সুযোগ দেয়নি৷ বৃন্দার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে কখনোই রাজি ছিল না ও৷

বাড়িটা কাঠের, পিছনের চত্বরটায় হরিণ এসে উঁকি দেয় মাঝে মাঝে৷ একতলা বাড়ির সামনে পিছনে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে আছে৷ সারা দিনের পরে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে চা খেতে বসেছে ওরা৷ এখানে দু’দিন থাকার কথা৷ কালকে ওরা শেনান্ডুয়া কেভস্‌ ঘুরতে যাবে৷ এখানে ওরা আগেও এসেছে৷ এবার এল বহুদিন পরে৷ টানা বেশ কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে অরুণাভ একটু টায়ার্ড৷ পাজামা-পাঞ্জাবির উপর একটা শাল জড়িয়েছে গায়ে৷

‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু নো হোয়াট হ্যাপেন্ড বিটুইন ইউ অ্যান্ড বৃন্দা৷ বাট ডোন্ট ফরগেট শি ইজ মাই আন্ট৷’ মায়ের নিজের বোন৷ আমার মা নামক ভদ্রমহিলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখব না আমি’৷ কঠোরভাবে বলেছিল সীমন্তিনী৷

বৃন্দার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ঠিক একত্রিশ বছর আগে৷ অরুণাভ মনে মনে হিসেব করে দেখেছে৷ বৃন্দা এখন অতীতের ছায়া, বৃন্দার কথা মনে হলে কোথাও যেন এক অব্যক্ত বেদনা বুকের ভিতর ছায়া ফেলে যায় অরুণাভর৷

‘কী ভাবছ?’ এবারে পাশে বসা সীমন্তিনী প্রশ্ন করছে৷ অনেক বছর পরে ও এই প্রশ্নটা করছে৷ ইদানীং বহু বছর ধরে নিজের গড়া সংসারের কেজো বৃত্তেই ঘুরপাক খায় ও৷ যেন ঠিক করেই রেখেছে অতীততে কোনওভাবে ছায়া ফেলতে দেবে না তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারটার উপর৷ সীমন্তিনী বা অরুণাভ কেউই পরস্পরের সঙ্গে গল্প করে না, স্মৃতি রোমন্থন করা দূরে থাক৷ অরুণাভকে নিজের প্রফেশনে অনেকটা সময় দিতে হয়৷ তারপর জিম, গল্‌ফ্‌, সাঁতার, ইয়টিং— ওর মন ভরাবার নানা উপকরণ হাতের কাছেই মজুত৷ সীমন্তিনী সময়টা ভরায়, অনেক অকাজ করে৷ কখনও বেকিং-এর ক্লাসে ভর্তি হয়, কখনও পাবলিক লাইব্রেরিতে ভলান্টারি সার্ভিস দেয়, কখনও নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শপিং করতে৷ লাইব্রেরি থেকে অডিও বুক্‌স্‌ ধার করে এনে কানে হেডফোন লাগিয়ে শোনে৷ টিভিতে কতগুলো সিরিজ ওর খুব প্রিয়৷ ব্রডচার্চ, স্টেঞ্জার থিংগ্‌স্‌, ট্র্যাভেলস্‌ উইথ মাই ফাদার সব এপিসোডগুলো মুগ্ধ হয়ে বারবার দেখে ও৷

pigeon
পলাতক পায়রাকে অনুসরণ করে যায় সীমন্তিনী

বহুদিন বাদে অরুণাভ সীমন্তিনী পরস্পরের মুখোমুখি বসেছে৷ সীমন্তিনী খুব আনেস্টলি জানতে চাইছে অরুণাভ কী ভাবছে৷ অরুণাভ উত্তরে একটু হাসে৷ ওর সল্ট অ্যান্ড পেপার চুল, চিবুকের কাছে গোটি আর হাসলে বাঁ গালে একটা টোল পড়ে৷ অরুণাভর আকর্ষণ এখনও তেমনই রয়ে গেছে৷ শুধু মাঝখানে কখন যেন পায়ে পায়ে পেরিয়ে গেছে ত্রিশটা বছর৷ অরুণাভর হাসিটা আজও একইরকম৷ অল্প অল্প করে স্মৃতির উজানে ফিরছে দু’জনে৷ কষ্টকর সেই যাত্রাপথ৷ তবু রোহিণী যেদিন খাবার টেবিলে প্রশ্নগুলো করল, তখন থেকেই ওরা জানে এবার উৎসমুখে ফিরতে হবেই৷ না ফিরলে এ জন্মে তাদের পরিত্রাণ নেই৷

রোহিণী খুব ইনোসেন্টলি জিজ্ঞেস করছিল৷ অরুণাভর সঙ্গে ওর খুনসুটির সম্পর্ক৷ ওর বিয়ের পর একদিন খুব হাসতে হাসতে বলেছিল ‘বাবাই, তুমি কি জানো আমাদের বাড়ির সব আত্মীয়দের তুমি মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছ৷ আমার মাসি-পিসিরা প্রত্যেকে, এভরিওয়ান ওয়াজ টকিং অ্যাবাউট ইউ!’

‘রিয়েলি! কী বলছে তোর মাসি-পিসিরা?’ অরুণাভও একটা মক সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানতে চাইছিল৷ ঠিক শ্বশুরসুলভ গাম্ভীর্য ওর ধাতে আসে না৷

‘নাঃ, সত্যি, দে আর ব্যাট শিট ক্রেজি অ্যাবাউট ইউ! ওরা একদম পাগলা হয়ে গেছে৷’ রোহিণী বলছিল৷

‘সীমন্‌, শোন শোন, ইউ আর দ্য সোল নন-বিলিভার ইন মাই এবিলিটিস৷’

অরুণাভর আকর্ষণ এখনও তেমনই রয়ে গেছে৷ শুধু মাঝখানে কখন যেন পায়ে পায়ে পেরিয়ে গেছে ত্রিশটা বছর৷ অরুণাভর হাসিটা আজও একইরকম৷ অল্প অল্প করে স্মৃতির উজানে ফিরছে দু’জনে৷ কষ্টকর সেই যাত্রাপথ৷ তবু রোহিণী যেদিন খাবার টেবিলে প্রশ্নগুলো করল, তখন থেকেই ওরা জানে এবার উৎসমুখে ফিরতে হবেই৷ না ফিরলে এ জন্মে তাদের পরিত্রাণ নেই৷

এরকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলে তাদের মধ্যে৷ সেদিন কিন্তু রোহিণী একটুও ইয়ার্কির মধ্যে গেল না৷ খাবার টেবিলে বসে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল— ‘বাবাই, তোমার পিসি আলোলিকা সেনকে মনে আছে তোমার?’

অরুণাভ বেশ চমকে গেছিলেন৷ ‘কোন পিসি?’ 

‘তোমার ছোটপিসি— যার নাম ছিল খুশি৷’

কতদিন পরে অরুণাভর আবছা মনে পড়েছিল ছোটপিসির চেহারাটা৷ দাদুর মৃত্যুর সময় শেষ দেখা হয়েছিল ছোটপিসির সঙ্গে— যাকে ছোটবেলায় ও বলত ‘ছোপিয়া’৷ ছোপিয়ার পরে ছোটকু৷ অরুণাভর কাকা স্বাধীন সেন৷ ওর বাবার সবচেয়ে ছোট ভাই৷ রোহিণী জ্যোতির্ময়ের একটা অসমাপ্ত ডায়েরি খুঁজে পেয়েছে৷ আবিষ্কার করেছে আলোলিকার ব্লগ৷ ওর চিঠির একটা বড় উত্তর দিয়েছেন আলোলিকা সেন৷ সব মিলিয়ে ও খুব উত্তেজিত৷ ‘মোটামুটি তোমাদের পুরো ফ্যামিলিটাই আমি ট্রেস করেছি৷ শুধু কতগুলো মিসিং লিঙ্ক-এর কথা বুঝতে পারিনি৷ আচ্ছা, বৃন্দা কে ছিল? এখন কোথায় থাকে?’

অরুণাভ বোধহয় জীবনে কখনও এত চমকায়নি৷ অফ অল পার্সনস্‌, রোহিণী জানল কী করে বৃন্দার কথা? টেবিলের উল্টোদিকে বসা সীমন্তিনীর মুখ মড়ার মতো সাদা হয়ে গেছিল৷ অরুণাভও লক্ষ না করে পারেনি৷ কোনওক্রমে সামাল দিয়েছিল সেদিন৷

‘রোহিণী৷ আই হ্যাড অ্যা লং ডে৷ তোর সঙ্গে পরে কথা বলব আমার আত্মীয়দের নিয়ে৷ তবে সবাইকে যে চিনবোই তার মানে নেই৷’ বলে আমতা আমতা করে উঠে গেছিল অরুণাভ৷ সীমন্তিনী মুখ নীচু একমনে খেয়ে যাচ্ছিল, যেন ওর আশেপাশে কেউ নেই৷ ব্যাপারটা নিশ্চয়ই একটু অদ্ভুত ঠেকেছিল রোহিণীর কাছে৷ তবু এছাড়া কীই বা করা যেত?

সীমন্তিনী মুখ নীচু একমনে খেয়ে যাচ্ছিল, যেন ওর আশেপাশে কেউ নেই

বৃন্দাকে অরুণাভ প্রথম দেখে যখন তার নিজের বয়স পনেরো কি ষোলো৷ বৃন্দাকে পিসি বলে ডাকতে শিখিয়েছিলেন অরুণলেখা৷ ওদের প্রতিবেশী হয়ত ছিল না, কিন্তু ফিলাডেলফিয়ার অন্য প্রান্তে বৃন্দার বাড়ি ছিল তখন৷ বৃন্দা গোল্ডস্টাইন৷ একটা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখার সঙ্গে দেখা হয় বৃন্দার৷ বৃন্দার তখন সাতাশ কি আঠাশ৷ যে কোনও সভা-সমিতিতে, বাঙালিদের আড্ডায়-মজলিশে, অনিবার্যভাবে নজর চলে যেত বৃন্দার দিকে৷ বৃন্দা অসামান্য রূপসী৷ আর পাঁচজনের সঙ্গে থাকলেও ওর দিকে দৃষ্টি চলে যাওয়া স্বাভাবিক৷ কিন্তু রূপের ছটার সঙ্গে যা আরও বেশি করে মুগ্ধ করত, তা হল ওর বৈদগ্ধ্য, শাণিত তরবারির মতো যে কোনও বিষয় নিয়ে ওর মতামত দেবার, প্রশ্ন বা মন্তব্য করার ক্ষমতা৷ বৃন্দার প্রেমে সেই সময় ফিলাডেলফিয়া, নিউজার্সি অঞ্চলের অনেক পুরুষই পাগল ছিল৷ অরুণাভ তখন সদ্য কৈশোর থেকে তারুণ্যে পদার্পণ করেছে৷ বয়ঃসন্ধির হরমোনেরা ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটাচ্ছে ওর শরীরে, মনে৷ সেই সময় নিতান্ত আকস্মিকভাবে বৃন্দার সঙ্গে দেখা হওয়াটা দৈবনির্দিষ্ট ছিল কি না, অরুণাভ এই বিয়াল্লিশ বছর পরেও বুঝতে পারে না৷ কিন্তু প্রথম বৃন্দাকে দেখা যে ওর শরীরে মনে দাউদাউ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই সত্যকে এখন আটান্ন বছর বয়সে পৌঁছেও অস্বীকার করতে পারে না ও৷

যে রাতে এসব কথা হল সে রাতে অরুণাভর অনেক রাত অবধি ঘুম আসেনি৷ তার মনে হঠাৎ হানা দিয়ে যাচ্ছিল শৈশব কৈশোরের নানা স্মৃতি৷ ছোপিয়ার নতুন করে খোঁজ পেয়েছে রোহিণী৷ ছ’বছর বয়স অবধি দমদমের বাড়িতে দাদু-ঠাম্মার সঙ্গে যৌথ জীবনের কিছু কিছু স্মৃতি মনে আছে অরুণাভর৷ ‘বাবাই, চল, রথের মেলা যাই৷’ ছোপিয়ার কোলে চেপে দমদমে নাগেরবাজার দিয়ে রথের মেলায় যাবার স্মৃতি৷ জেদ করে একটা দুর্গার মুখ কিনে এনেছিল বাবাই, পিসির কাছে বায়না করে৷ আর স্প্রিং-এর সাহায্যে ঘাড়-নাড়া সাদা দাড়িওয়ালা একটা বুড়ো৷ পরে গল্প শুনেছে বাড়িতে দুর্গার মুখ দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নিয়ে ঠাকুমা খুব আপত্তি করেছিলেন৷ ঠাকুরঘরে রেখে পুজো করার ইচ্ছে ছিল বুড়ির৷ দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার ভাবনাটা ছোপিয়ার৷ দাড়িওয়ালা ঘাড়-নাড়া বুড়োটাকে দেখে ছোটকু বলেছিল ‘বাঃ! এটা তো ভালো পছন্দ করেছে ব্যাটা! মার্ক্স-এর সঙ্গে মুখের একটু মিল আছে৷৷’ বুড়োর নাম হয়েছিল মার্ক্সবাবু৷ ইংল্যান্ডে যাবার সময় নাকি ছ’বছরের শিশু অরুণাভ দুর্গা আর মার্ক্সবাবুকে সঙ্গে নেবার বায়না জুড়েছিল৷ দুর্গা তাদের সঙ্গে আসেননি৷ দমদমের দেওয়ালেই ঝুলতেন তিনি৷ মার্ক্সবাবু কিন্তু ওদের বিদেশের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন৷ ছোটকু নাকি বলেছিল, ‘দাদা-বৌদি যতই ইম্পিরিয়ালিস্টদের দেশে যাক না কেন, বাবাই যে ভবিষ্যতে ঠিক রাস্তা নেবে, তা ওর মার্ক্সবাবুকে বগলদাবা করে যাওয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে৷’ মার্ক্সবাবু কেমব্রিজে ওদের লিভিংরুমের শো-কেসে অনেকদিন শোভা পেত৷ আমেরিকায় চলে আসার সময় সেটার কী গতি হল, তা আর মনে নেই অরুণাভর৷ ততদিনে দমদমের সেই ছোট্ট বাবাই অনেক বদলে গেছে৷ নতুন অনেক বন্ধু, স্কুল, জিনির মতো একটা জ্যান্ত পুতুল, আর দু-দুটো নতুন মহাদেশের সঙ্গে মোলাকাত একটু একটু করে ভুলিয়ে দিয়েছিল পুরনো অনেক কিছু৷

একটা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখার সঙ্গে দেখা হয় বৃন্দার৷ বৃন্দার তখন সাতাশ কি আঠাশ৷ যে কোনও সভা-সমিতিতে, বাঙালিদের আড্ডায়-মজলিশে, অনিবার্যভাবে নজর চলে যেত বৃন্দার দিকে৷ বৃন্দা অসামান্য রূপসী৷ আর পাঁচজনের সঙ্গে থাকলেও ওর দিকে দৃষ্টি চলে যাওয়া স্বাভাবিক৷ কিন্তু রূপের ছটার সঙ্গে যা আরও বেশি করে মুগ্ধ করত, তা হল ওর বৈদগ্ধ্য, শাণিত তরবারির মতো যে কোনও বিষয় নিয়ে ওর মতামত দেবার, প্রশ্ন বা মন্তব্য করার ক্ষমতা৷ বৃন্দার প্রেমে সেই সময় ফিলাডেলফিয়া, নিউজার্সি অঞ্চলের অনেক পুরুষই পাগল ছিল৷

ছোটকুর মৃত্যুর কথা বাবা-মা সযত্নে ঢেকে রেখেছিলেন তার কাছ থেকে যাতে ওর মনে কোনও অযথা চাপ না পড়ে৷ দাদুর মৃত্যুর সময় যেবার কলকাতা গেল, তার কিছুদিন আগে, অরুণলেখা ছোটকুর চলে যাওয়ার কথা ভেঙেছিলেন ওর কাছে৷ ততদিনে ছোটকুর স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে৷ ছোটকু, যাকে অরুণাভ কাকা না বলে অন্যদের মতোই ডাকনামে ডাকত, যে ছোটকু একসময় ওকে কাঁধে নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেড়াত, তার না থাকাকে আর বিশেষ কোনও ক্ষতি বলে মনে হয়নি অরুণাভর৷ দাদুর মৃত্যুতেও খুব একটা বিচলিত বোধ করেছিল বলে এখন আর মনে পড়ে না৷ শুধু মনে পড়ে দাদুর মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়েছিল বাবার পাশে ও৷ বৃদ্ধ মানুষটি কিছু যেন বলতে চাইছিলেন বাবার কাছে৷ দাদু তাঁর একমাত্র জীবিত ছেলের কাছে ওই অব্যক্ত চাউনি দিয়ে কী বলতে চেয়েছিলেন কে জানে? পরে ঐ দৃষ্টি মনের মধ্যে হন্ট করেছে অনেকবার৷ তার চেয়েও বেশি ওর মনে হচ্ছিল বাবার কথা৷ জ্যোতির্ময়ের দুচোখ বেয়ে জল পড়ছিল৷ আর তাঁর বাবার দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি৷ কিশোর বাবাই-এর ভিতরে কী অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিল ওর বাবার এখন কী মনে হচ্ছে তা ভেবে৷ বাবা চলে গেলে ছেলের ঠিক কেমন লাগে— বোঝার চেষ্টা করছিল ও, ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে৷

সেই প্রথম শ্মশানে গেছিল বাবাই৷ দাদুর চিতায় কাঠ সাজিয়ে রাখা, বাবা পাটকাঠি জ্বালিয়ে প্রদক্ষিণ করছে, আর আগুন ছুঁইয়ে দিচ্ছে দাদুর মুখে মাথায়৷ দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে চিতা, আর পুড়ে যাচ্ছে বৃদ্ধের দেহ, যে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আগেও অব্যক্ত চাউনি মেলে তাকিয়েছিলেন ছেলের দিকে। দৃশ্যটা পরে কখনও কখনও স্বপ্নে হানা দিয়ে গেছে তারপর বেশ কিছু বছর৷ শ্মশান থেকে আসার পর ছোপিয়া লোহার একটা জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্মশানযাত্রীদের অপেক্ষায়৷ শ্মশান ফেরৎ নাকি লোহা ছুঁতে হয়, নাহলে অতৃপ্ত আত্মারা চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের মধ্যে চলে আসে শ্মশানযাত্রীদের পিছু পিছু৷ আত্মীয়রা বুঝিয়ে দিচ্ছিল বালক অরুণাভকে৷

Burning ghat
সেই প্রথম শ্মশানে গেছিল বাবাই

ঘরের দেওয়ালে দুর্গার মুখটা টাঙানো রয়েছে বাবাই লক্ষ করেছিল৷ ‘এই মূর্তিটা আমার সঙ্গে গিয়ে জেদ করে কিনেছিলি বাবাই, মনে আছে? তেরো পেরিয়ে চোদ্দ ছোঁওয়া কিশোর ঘাড় নেড়েছিল৷ তার কিছুই মনে নেই। এই বাড়ি, ছোটকুর কথা, দুর্গার মুখ— সবকিছু তার মনে রয়েছে বাবা-মা’র গল্পের মাধ্যমে৷ সেই কিশোরের তখন স্মৃতি নিয়ে মত্ততার সময় কই? তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বিপুল বিশ্ব৷ তবু কোথাও হয়ত রয়ে যায় সব৷ নয়তো এতদিন বাদে সবকিছু ছবির মতো মনে পড়ে যাচ্ছে কী করে? বিছানা থেকে উঠে নিঃশব্দে ঘরের কোনায় রাখা রকিং চেয়ারে বসেছিল অরুণাভ৷ অদূরে খাটে শুয়ে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে সীমন্তিনী৷ ঘুমের ওষুধ খেয়ে শোয় ও৷ নয়তো বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে সীমন্তিনীর৷ চট করে ভেঙে যায়৷ কিন্তু ওষুধ খেয়ে শুয়েছে বলে সহজে ঘুম ভাঙবে না ওর৷ অরুণাভ আরামদায়ক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে৷ কৈশোর-বয়ঃসন্ধি ভারী গোলমেলে সময়৷ বয়ঃসন্ধিকালের জটিল সময়টার কথা মনে পড়ছে অরুণাভর, মনে পড়ছে বৃন্দার কথা৷

বৃন্দা তার বয়ঃসন্ধির দিনগুলোর প্রথম যন্ত্রণাবোধ, প্রথম রক্তক্ষরণ৷ প্রায় চার দশক পেরিয়ে গেছে বৃন্দার সঙ্গে পরিচয়ের৷ মাঝে ত্রিশ বছর ভুলেই ছিল অরুণাভ৷ অরুণাভ ভেবেছিল সে সরাতে পেরেছে, বিস্মৃত হতে পেরেছে বৃন্দা গোল্ডস্টাইনকে৷ যাকে ওদের মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায় বলে টোটাল সাবলিমেশন৷ কিন্তু যদি পারবেই, তবে এত বছর পরে স্মৃতির প্রকোষ্ঠে কেন হানা দিচ্ছে বৃন্দা! প্রথমদিন বঙ্গ সম্মেলনের আসরে গান গেয়েছিল ও৷ ওকে দেখে আর ওর গান শুনেই বারো বছর আগের সেই বালিকাটিকে চিনতে পেরেছিলেন অরুণলেখা আর জ্যোতির্ময়৷ গান শেষ হতেই ছুটে গিয়ে আলাপ করেছিলেন বৃন্দার সঙ্গে৷ হালে বৃন্দা গোল্ডস্টাইন হলেও আদতে দমদমের বাড়িতে মোহনানন্দ মহারাজের সঙ্গে গান গাইতে আসা সেই কিশোরীই বটে৷ মা আর বাবাকে এতটা উদ্বেলিত হতে খুব বেশি দেখেনি অরুণাভ৷ অরুণলেখা প্রায় জোর জবরদস্তি করেই বাবাইকে নিয়ে গেছিলেন বঙ্গ সম্মেলনের পরের দিনের অনুষ্ঠানে৷ সেদিন আর বৃন্দার গান নেই৷ কিন্তু জ্যোতির্ময়ের বিশেষ অনুরোধে ও আসতে রাজি হয়েছিল৷

তার কিছুই মনে নেই। এই বাড়ি, ছোটকুর কথা, দুর্গার মুখ— সবকিছু তার মনে রয়েছে বাবা-মা’র গল্পের মাধ্যমে৷ সেই কিশোরের তখন স্মৃতি নিয়ে মত্ততার সময় কই? তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বিপুল বিশ্ব৷ তবু কোথাও হয়ত রয়ে যায় সব৷ নয়তো এতদিন বাদে সবকিছু ছবির মতো মনে পড়ে যাচ্ছে কী করে?

এখনও ছবির মতো চোখের সামনে গোটা সিকোয়েন্সটা দেখতে পাচ্ছে অরুণাভ৷ মূল মঞ্চের পাশ দিয়ে আগুনের শিখার মতো বেরিয়ে আসছে একটি মহিলা, নাকি মেয়ে! মুহূর্তে সারা শরীরে বিদ্যুতের ছোবল অরুণাভর৷ ‘ওই যে বৃন্দা এসে গেছে’ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠছেন জ্যোতির্ময়৷

‘এসো বৃন্দা৷ তোমার কথা বলে বাবাইকে রাজি করিয়েছি আসতে৷ নয়তো বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে আসতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না ও৷’ অরুণলেখা হাসি হাসি মুখে বলেছিলেন৷

অরুণাভ হঠাৎ বুঝতে পেরেছিল শুধু সে-ই নয়, উল্টোদিক থেকে বৃন্দাও তাকে দেখে ভীষণভাবে চমকে গেছে৷ যদিও কারণটা তার অনেক বছর পরে বলেছিল বৃন্দা৷ ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ’ তখন তো তো করে ওর হাত ঝাঁকিয়ে ওটুকুই বলতে পেরেছিল অরুণাভ৷

‘ও কী রে? ওরকম ফর্ম্যালিটি করছিস্‌ কেন? ও তো আমাদের কলকাতার মেয়ে৷ বলছি না আমাদের দমদমের বাড়িতে এসে গান করেছে৷’ ঈষৎ অধৈর্য্যভাবে বলছিলেন অরুণলেখা৷

‘ঠিক আছে বৌদি, ওইসময় ও তো নিশ্চয়ই খুব ছোট৷ কিংবা জন্মায়ইনি৷ ওকে আর বকে কী হবে?’ মধুর হাসছিল বৃন্দা৷ অরুণাভর ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন আচ্ছন্নের মতো লাগছিল৷ সেদিনই অরুণলেখাদের সঙ্গে ঠিকানা, ফোন নম্বর বিনিময় হয়েছিল৷ কবে বৃন্দা আসবে, শুধু ও একা এলে চলবে না, ওর স্বামীকেও নিয়ে আসতে হবে, এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছেড়েছিলেন জ্যোতির্ময়রা৷

বৃন্দার স্বামী মার্টিন গোল্ডস্টাইন আর্টডিলার এবং কালেক্টর৷ তিন পুরুষের বিশাল বিজনেস ওদের৷ মার্টিন ওর চেয়ে বছর পঁয়ত্রিশের বড়৷ মার্কিন সমাজের ধনকুবেরদের মধ্যে একজন৷ এহেন লোককে বৃন্দা কী করে বশে আনল— সে নিয়ে বাঙালি সমাজে চর্চার অন্ত ছিল না৷ জ্যোতির্ময়-অরুণলেখার কানে এসেছিল সবই, কমন বন্ধুদের সূত্রে৷ ওঁরা মনের স্বাভাবিক ঔদার্যবশত এসব নিন্দে-মন্দকে প্রশ্রয় দেননি৷ মার্টিন কোনওদিনও বৃন্দার পিছু পিছু বাঙালিদের বাড়িতে যেত না৷

‘ও বাবা! সে তো বিশাল হাই-ফাই ব্যাপার৷ সে তো শুনি আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ডিনার খায়৷’ তির্যক হেসে অরুণলেখার এক বাঙালি বান্ধবী বলেছিলেন৷ বৃন্দার মুখে অবশ্য কখনও শোনা যেত না এসব গল্প৷ কলকাতায় একদা পরিচিত সাধারণ, পাশের বাড়ির মেয়েটির মতোই সে গল্প করত অরুণলেখাদের সঙ্গে৷

ফিলাডেলফিয়া আর্ট মিউজিয়ামের পাশে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন পার্কওয়েতে বৃন্দার বিশাল ম্যানসনে কয়েকবার জ্যোর্তিময়-অরুণলেখাও গেছেন৷ সঙ্গে জিনি আর অরুণাভও৷ প্রায় কখনই মার্টিনের সঙ্গে দেখা হয়নি৷ সব সময়ই ব্যবসার কাজে মার্টিন ওয়েস্ট কোস্ট বা ইউরোপে৷ মার্টিন যে একজন ধনকুবের, তা বৃন্দার বাড়ি দেখেই বোঝা যেত৷ বৃন্দার বাড়ির অ্যান্টিক ফার্নিচার, শ্বেতপাথরের মূর্তি আর বিশাল বাগান— এসব চেনা আর কারও বাড়িতেই দেখেননি অরুণলেখারা৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৪ ডিসেম্বর ২০২২

ছবি সৌজন্য: Istock, Peakpx, Pxhere, Wikimedia Commons, Negative Space,

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com