প্রফেসর পি লাল যেদিন শীতের সকালে সুট-বুট-টাইয়ে ওঁর ওই ছ’ফুট তিন ইঞ্চি হাইট নিয়ে দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ে আমাদের এলিয়ট পড়াতে এলেন, সে এক মনে রাখার মতো মুহূর্ত বটে। সেন্ট জেভিয়ার্সে ইংরেজি অনার্স করার সময়ে এই ইন্দো-ইংলিশ কবির নাটকীয় এবং কখনও কখনও প্রায় কাব্যিক লেকচারে আমরা বুঁদ হয়ে থাকতাম। যখন বার্নার্ড শ’য়ের ‘আর্মজ অ্যান্ড দ্য ম্যান’ নাটক পড়িয়েছেন, তখন তেমন-তেমন অংশ যেন কণ্ঠস্বরে অভিনয় করে গেছেন। আবার যখন চার্লস ল্যাম্বের ‘এসেজ় অফ ইলায়া’ পড়িয়েছেন, লেখকের অপরূপ গদ্যকে প্রায় কবিতার স্তরে নিয়ে গেছেন উচ্চারণ-মাধুর্যে। প্রেসিডেন্সিতে এম এ পড়তে পড়তেও সেই সুর কানে ভাসত।
কপালের নাম গোপাল। ইউনিভার্সিটিতেও এলিয়ট পড়ানোর জন্য পাওয়া হল পুরুষোত্তম থুড়ি পি লালকে। আর তিনি পড়ালেন তো পড়ালেন, এলিয়টের দুই অবিস্মরণীয় কাজ ‘দ্য লাভ সং অফ জে অ্যালফ্রেড প্রুফ্রক’ এবং ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তুলনাহীন কিন্তু দুরূপ আর ‘প্রুফ্রক’ কাব্যের তাবৎ লাস্যে ঢলঢল এক আধুনিক প্রেমকথা। প্রফেসর লাল সে দিন এসে প্রথমেই বললেন, “আমি তোমাদের টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ পড়াব; কঠিন, আশ্চর্য কবিতা। তার আগে ওঁরই এক প্রেমের কবিতা। একটু অন্যরকম প্রেম।” বলেই ধরে নিলেন—
Let us go then, you and I,
When he evening is spread out against the sky
Like a patient etherised upon a table;
Let us go, through certain half-deserted streets,
The muttering retreats
Of restless nights in one-night cheap hotels…
…In the room the women come and go
Talking of Michelangelo.
প্রেমের গানই তো কবিতা, তো প্রেম সারা হচ্ছে এক-রাতের থাকার মতন হোটেলে। আর সেখানে সারাক্ষণ মেয়েদের চলাচল। আর তাদের বকরবকরে উঠে আসছে একটিই নাম— মাইকেলাঞ্জেলো। মাই গড, মাইকেলাঞ্জেলো! ভীষণ মজা পেতাম এই দুটো পঙক্তিতে। কেন, কেন এত লোক থাকতে আমার প্রিয় শিল্পীর নামটাই ঘোরাফেরা করছে সেখানে? ধ্বনির মিলের জন্যই কি? ‘come and go’-এর সঙ্গে Michelangelo? সন্ধেবেলার রামসীতার মন্দিরের বাড়ির আড্ডায় আমার ঠোঁটে ঘুরেফিরে আসত এইসব লাইন। যা শুনে একদিন চন্দন মুখ থেকে বাংলার গ্লাস নামিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কী আগড়ম বাগড়ম বকিস বল তো? চুমুটুমু দিলি কাউকে? বুকেটুকে হাত বুলোলি? পারলে ওই সব গল্প শোনা। খোলা বুক ডেসক্রাইব কর, দেখবি সেইটাই কবিতা।”
আবার বলি, কপালের নাম গোপাল। ক’দিন পরই, ১৯৬৮-র ২৪ ডিসেম্বর, ক্রিসমাস ইভে খোলা বুক দেখা হল ট্রিংকাজ রেস্তোরাঁয়। শ্যামল, চন্দনের সঙ্গে নয়, আমার আরও দুই বন্ধু লালা ও ভোম্বলের সঙ্গে। লালা ছিল লখনউয়ের বিখ্যাত বাজপেয়ী পরিবারের ছেলে, তবে দু’পুরুষ ধরে মধ্য কলকাতার তালতলা পাড়ায় সেটেলড। সাবেক নিউ মার্কেটের ফার্নিশিং-এর বিখ্যাত দোকানের তরুণ মালিক। ওরই দোকানে আড্ডা বসত ভোম্বল আর আমার। দোকান বন্ধ হলে সামনেই গ্লোব সিনেমার বার-এ বসে ‘সান লাগার’ বা ‘গোল্ডেন ইগল’ বিয়ার পান। বছর আষ্টেক হল আমার এই প্রিয় বন্ধুটি প্রয়াত। আর ভোম্বল (ভাল নাম দুলাল) ১৯৭২ সাল থেকেই প্রবাসী। ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের কর্মী ভোম্বল প্রথমে জার্মানি গেল, সেখানে কিছুদিন কাজ করে এক রূপসী আইরিশ মেয়ে বিয়ে করে চলে গেল কানাডা। অনেক পরে বারকয়েক কানাডায় ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে, টরন্টোয়। আর দেখা হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই কথা ওঠে ’৬৮-র ক্রিসমাস ইভের।
তখনও সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি নিয়ে রাজ্যজোড়া হইচই বাঁধেনি। বড় বড় হোটেলের সান্ধ্য বিনোদনের মহার্ঘ্য উপকরণ ছিল ফ্লোর শো বা ক্যাবারে, যা তুঙ্গ মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়ে যেত স্ট্রিপ টিজ-এ, যা হল নাচের দোলায়, বিভঙ্গে, অপূর্ব মূর্চ্ছনায় বস্ত্রবর্জন। গ্র্যান্ডের প্রিন্সেস বা গ্রেট ইস্টার্নের ম্যাক্সিমজ়-এ এই ক্যাবারে চালু ছিল। পার্ক স্ট্রিটের ট্রিংকা’জ়, ব্লু ফক্স বা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোকাম্বো-এ প্যাম ক্রেন, ভেরোনিকা, ঊষা আইয়ারদের গান শুনেই খুশি থাকতে হত আমজনতাকে। লালা, ভোম্বল আর আমি যখন জীবনের ওই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় ট্রিংকা’জ়-এ ঢুকছি গান আর বিয়ারের খোঁজে, তখন থোড়াই জানি কপালে আমাদের কী ক্রিসমাস গিফট।
কী অপূর্ব গাইছিল ভেরোনিকা, সিক্সটিজ়ের সেরা পপ নাম্বার্স! গাইল ‘লিপস্টিক অন ইয়োর কলার টোল্ড আ টেল অন ইউ’। আর তখন ফ্লোরে সদ্য বাজারে আসা এক ঝাঁঝালো তরুণীর দুরন্ত কোমর ঝাঁকানো আর স্টেপিং। রেস্তোরাঁ আলো ক্রমশ কমে আসছে, আমাদের দ্বিতীয় বিয়ারও শেষ হল বলে। তৃতীয় বিয়ারের সঙ্গে লালা এবার ফুডও অর্ডার করল। ভেরোনিকার ব্যান্ডের ডন সেগাল এবার ধরে নিল এঙ্গেলবার্ট হাম্পারডিঙ্কের দুনিয়া মাতাল করা গান ‘প্লিজ রিলিজ মি, লেট মি গো ফর আই ডোন্ট লাভ ইউ এনিমোর’।
প্রেমের গানই তো কবিতা, তো প্রেম সারা হচ্ছে এক-রাতের থাকার মতন হোটেলে। আর সেখানে সারাক্ষণ মেয়েদের চলাচল। আর তাদের বকরবকরে উঠে আসছে একটিই নাম— মাইকেলাঞ্জেলো। মাই গড, মাইকেলাঞ্জেলো! ভীষণ মজা পেতাম এই দুটো পঙক্তিতে। কেন, কেন এত লোক থাকতে আমার প্রিয় শিল্পীর নামটাই ঘোরাফেরা করছে সেখানে? ধ্বনির মিলের জন্যই কি?
করুণ গানটার সঙ্গে মেয়েটার নাচও স্লো হয়ে এল। আর ও আস্তে আস্তে পোশাক খসাতে লাগল। আমাদের থার্ড বিয়ারও যখন শেষ হয়-হয়, চিকেন রোস্টও খতম, শুনলাম ভেরোনিকা বলছে মাইকে, “কাম অন গাইজ়, সাজেস্ট ইয়োর ফেভারিট ফাস্ট নাম্বার!” তখন কোথাও কোনও উচ্চবাচ্য নেই দেখে লালা আর ভোম্বল আমায় তাতানো শুরু করল, “বলো, বলো, ভালো হিড়িক মারা একটা গান বলো”। আমাকে আর তাতাবে কী, আমি তো ততক্ষণে দেদার তেতে আছি, দিব্যি চেঁচিয়ে দিলাম “নেভার অন আ সানডে”।
ভেরোনিকা কিছুটা অবাক হল এবং রীতিমতো খুশি হয়েই ধরে নিল গানটা। ফ্লোরের আলো কমল যেন। সেই নিবু-নিবু রঙিন আলোয় আমি দেখছি সদ্যযুবতী লোরেন সুইন্টন এই গানটাই রেডিওগ্র্যামে চালিয়ে ওর বসার ঘরে নাচছে আর আমি আমাদের বাড়ির চিলেকোঠার জানলা খুলে তাই দেখছি। পড়ছিলাম একটা ইংরেজি গল্প সঙ্কলনই, ড্যাফনে দ্যু মোরিয়ের-এর ‘কিস মি এগেন, স্ট্রেঞ্জার’, যখন লোরেনের বাড়ি থেকে ভেসে এল কনি ফ্রান্সিস-এর গলায় …
Oh, you can kiss me on a Monday, a Monday,
a Monday is very, very good,
or you can kiss me on a Tuesday, a Tuesday
a Tuesday in fact I wish you would.
Or you can kiss me on a Wednesday,
a Thursday a Friday,
and Saturday is best,
but never ever on a Sunday,
a Sunday, a Sunday,
Cause that’s my day of rest.
আমি মনের চোখে লোরেনকেই দেখছিলাম। ফ্লোরের মেয়েটা সরু বিকিনিসর্বস্বা হয়ে গেছে এবং ভেরোনিকার গাওয়া ‘স্যাটার্ডে ইজ বেস্ট’ কথাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ব্রা-টা খুলে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। ওর সুডৌল স্তনদুটো নগ্নিকা ভেনাসের স্তনের মতো ওই নিভন্ত আলোতেও উদ্ভাসিত। অতিথিদের মধ্যে থেকে দু’চারটে শিসও ছিটকে উঠছে, সঙ্গে মৃদু হাততালি নানা দিক থেকে। একটা ছোটখাটো উন্মাদনা রেস্তোরাঁ জুড়ে। সত্যিকারের ফ্লোর শো দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ল, কত বছর আগে লোরেনকে ‘ভেনাস রাইজিং ফ্রম দ্য ওয়াটার’ হিসেবে দেখা। বিশুদ্ধ, অবিস্মরণীয় নগ্নিকারূপে। আর আজ ভেরোনিকা যখন শোনাচ্ছে ‘নেভার অন আ সানডে’, ক্যাবারে গার্লটি শরীরের নিম্নাঙ্গের প্রায় অদৃশ্য পোশাকের রশিও আলগা করছে। সেরা উত্তেজনায় মানুষ স্তম্ভিত হয়, যে দশা সমস্ত গেস্টদের… তখন হঠাৎ সারা ঘরে অন্ধকার। অমনি ঘোর চেল্লামিল্লি ‘লাইট! লাইট!! লাইট!!!’ ক্ষণিকের মধ্যে আলো এল। কিন্তু ফ্লোরে মেয়েটি নেই। ভেরোনিকা গান শেষ করছে …
But never ever on a Sunday,
a Sunday, a Sunday,
Cause that’s my day of rest.
মনে আছে রাত একটায় আমি, লালা, ভোম্বল ট্রিংকা’জ-এর সামনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য। ট্যাক্সি দূরস্থান, একটাও লোক নেই আলো নেভা, অন্ধকার পার্ক স্ট্রিটে। আজকের দিনে একেবারে অকল্পনীয় একটা দৃশ্য, যখন আলোয় ভাসা পার্ক স্ট্রিটে রাতভর হাজার হাজার মানুষের স্রোত। অথচ কোথায় লুপ্ত সেই সাবেক বিলিতি মেজাজ। ওই ক্রিসমাস ইভ আর পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাব না জানি। জীবনানন্দ ভাঙিয়ে বলতে ইচ্ছে করে— ক্রিসমাস মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আর খুঁজিতে যাই না পৃথিবীর কাছে।
এই স্ট্রিপটিজ় দেখার বর্ণনা শুনিয়েছিলাম বান্ধবীকে প্রেসিডেন্সিতে, সে যেন আর এক ক্যাবারে। খেপে খেপে বলছি আর আর সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বলছে,
– সে কী, তুমি এসব দেখলে? একটা মেয়ে …
ওর চোখ বিস্ফারিত, কথা আর সরে না। থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস। ফর্সা মুখ রাঙিয়ে যাচ্ছে।
সেই সন্ধেয় মন্দির চত্বরে শ্যামল, চন্দন, খোকনকে বলে আর এক কেচ্ছা। চন্দন খেঁকিয়ে উঠল,
– ভটচাজ, যখন দেখলি মেয়েটা নার্ভাস ফিল করছে, তখন ওর হাত দুটো চেপে ধরে বলতে পারলি না, ‘নো ফিয়ার, দেখার এই তো শুরু, কত যে বাকি। ডোন্ট বি সো নার্ভাস।
পাশ থেকে খোকন কমেন্ট করল,
– তাতে কী হত?
ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ঝুলিয়ে চন্দন গ্রেগোরি পেক স্টাইলে বলল,
– দেখতেই পারত ভটচাজ। মেয়েটা কাঁপছে, মনে মনে নিজেকে ওই ক্যাবারে গার্লের চেহারায় দেখছে। আর আমাদের পণ্ডিতমশাই শুধু কপচে যাচ্ছেন। আরে পাগলা বুকে হাতটা দে! (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Pixels, Tribeca Care
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
One Response
Kono kotha noy…shudhu onubhob.