আগের দিনের কলেজ পাড়ার ধোঁয়াধুলো গুলিবারুদের কিসসা পরদিন সকালের কাগজে পড়াও এক অদ্ভুত শিহরণ। যা ঘটে আর কাগজে যা লিখে বেরোয়, তার মিল আর তফাত নিয়ে দিব্যি এক সমস্যায় পড়তে হয়। বাড়ির উৎকণ্ঠা বাড়ে, এই তাণ্ডবের মধ্যে ছেলের কলেজ করতে যাওয়া কতটা ঠিক, কতটা বেঠিক। মা বলে, কী দরকার এই গোলমালের মধ্যে যাওয়ার? মেজদি বলে, ক্লাসই যখন ভণ্ডুল হয়, তখন গিয়ে কী করবি? অথচ বুকটা কীরকম হু-হু করে ওই ধোঁয়া ধুলোর মধ্যে ফের গিয়ে পড়তে। ক্লাস হোক, না-হোক কী এক টান ইউনিভার্সিটি বা কলেজের ওই বেঞ্চগুলোয় গিয়ে বসার! একটা ইংরেজি বাক্য দিয়ে মনকে বোঝাই— Tomorrow is another day.
আগামী কালটা এক অন্যদিন, অনেকটা অন্যভাবেও। গতকালটাই তো অপূর্ব কেটেছে জ্যোতি ভট্টাচার্যের ‘লিয়র’ ক্লাসে, যা এডমন্ডের তির্যক ভাষণ দিয়েই শেষ হয়নি। ওই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা লেকচার শেষ করে স্যার বললেন, ‘‘যাক, আজকেই তোমাদের সঙ্গে শেষ ক্লাস আমার। কাল থেকে অন্য পাড়ায় কাজে বসব…’’ যা শুনে ক্লাস জুড়ে এক নীরব, সম্মেলক হাহাকার যেন। জ্যোতিবাবু আর ক্লাস নেবেন না!
ঘটনা হল, ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য হিসেবে ’৬৭-র নির্বাচনে জিতে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হলেন জ্যোতিবাবু। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ওঁকে শিক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করলেন। ক’দিন ধরেই সেই সম্ভাবনার কথা হাওয়ায় ভাসছিল, আমরা পাত্তা দিচ্ছিলাম না। সেদিন ওঁর শেষ বাক্যে দুর্ভাবনাটা বাস্তব হল। পরদিন খবর এল কাগজে। যদ্দূর মনে পড়ে, সঙ্গে ওঁর ছবিও। ক’দিন বাদে ওঁরই জায়গায় ‘কিং লিয়র’ পড়াতে এলেন প্রফেসর সুশীল মুখোপাধ্যায়। মোটাসোটা, গোলগাল, হাসিখুশি চেহারার মানুষ। এসেই বললেন, ‘‘এ হল অনুজের জুতোয় অগ্রজের পা গলানো। কলেজে জ্যোতি আমার ছাত্র ছিল। আর আজ ওর অসাধারণ ‘লিয়র’ পড়ানোর পর সেই ভার পড়ল আমার ওপর। তোমরা বাপু একটু মানিয়ে গুনিয়ে নিও।’’
অবশ্য আমরা যারা প্রেসিডেন্সি কলেজেও এমএ-র ক্লাস করি, তারা এক অন্য স্বস্তিতে ছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে জ্যোতিবাবুকে হারালেও সন্ধেবেলায় প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির পাশের ওই বিখ্যাত কিউবিকলে ‘লিয়র’ পড়তে পাচ্ছিলাম স্বয়ং তারক সেনের ক্লাসে! অন্য সব ক্লাস শেষ হলে ওই একটা ক্লাসের জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা আমাদের! স্যারের ট্যাক্সি করে ঘড়ি ধরে কলেজে ঢোকা আছে পাঁচটায়, কিন্তু বেরনোর কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সে ক্লাস চলতে পারে সাতটা, আটটা, ন’টা পর্যন্ত। বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, থেকে থেকে গর্জাচ্ছে আন্দোলনের বোমা কিংবা পুলিশের রাইফেল। বাইরের কোনও আওয়াজেই ভ্রুক্ষেপ নেই তারকবাবুর।
একবার তারকবাবু কিং লিয়রের একটা ট্র্যাজিক আস্ফালনের শেষে এসে পজ দিয়ে দাঁড়াতেই বাইরে ‘গদাম’ করে বেজে উঠল বিপ্লবী বোমা। মুহূর্তখানেকের মতো ভুরু কুঁচকে থামলেন তারকবাবু, যেন কবির বিখ্যাত শর্ট লাইনে দাঁড়িয়েছেন, তারপর ঢুকে পড়লেন ডায়ালগে। আজ সেই তারকবাবুর ক্লাসের জন্য প্রেসিডেন্সিতে আসা। কিন্তু বাজে মোটে আড়াইটে, যার মানে পাক্কা আড়াই ঘণ্টার অপেক্ষা। অথচ কফি হাউজে যাবার ভরসা নেই, পাছে কালকের মতো পুলিশ অ্যাকশনে পড়তে হয়। এই সব ভাবতে ভাবতে বন্দনা আর আমি ঢুকেই পড়েছি কফি হাউজে। শুভরঞ্জন আর কুমকুম কোথায় ছিটকে গেছে কে জানে। অন্য মেয়েরা কফি হাউজেই আসবে বলে ধারণা। কিন্তু ঢুকে পড়ে দু’ভাবে নিরাশ হতে হল। ক্লাসের মেয়েরা কেউ নেই। আর গোটা কফি হাউজে তিলধারণের জায়গা নেই।
গতকালের ওই বোমা-গুলি কাণ্ডের পর কফির আড্ডায় এই জমায়েত দেখে কে বলবে বাঙালি ছেলেমেয়ে জানের পরোয়া করে! অগত্যা সিট খোঁজা শুরু করলাম দু’জন। কিন্তু কোথায় সিট? তেতলার সরু বারান্দা হাউজফুল। সেখান থেকে নীচের হলের দিকে তাকালে লোকের মাথা আর কফির ধোঁয়া, চেয়ারের চেহারা নেই। হঠাৎ ওই ভিড়েই চোখে পড়ল কাকাকে। জনা তিনেক যুবক আর একটি সুন্দরী তরুণীকে কত কী বোঝাচ্ছে। বন্দনা বলল, ‘‘মেয়েটা লালী গুপ্ত। মৈত্রেয়ী দেবীর বোনের মেয়ে। ভাল ছাত্রী। মনে হয় কাকার কাছে বিপ্লবের পাঠ নেয়। জানি না ঠিক।’’
লালী বিপ্লবী হয়নি, তবে কালে কালে চমৎকার ওড়িশী নৃত্যশিল্পী হয়েছিল। তখন আমি সংবাদপত্রে, ওর নাচ রিভিউ করতে যাই। পরিচয়ও হল; ওর কথা শুনতে শুনতে ভাবতাম, এই কি সেই মেয়ে, যে কাকার দিকে চেয়ে মুগ্ধ নয়নে চরম বামপন্থার নীতি, যুক্তি, তত্ত্ব বিচার শুনত? কাকা ততদিনে লেজেন্ড হয়ে গেছে, জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ের ইতিহাস গড়েছে। জানি না কাকা তখনও কারাগারে, না মুক্ত। লালী পাশ করে অধ্যাপিকা হয়ে বিয়েও করল, কিন্তু বর হঠাৎ করে অসুখে মারা গেল। লালী গবেষণা করার জন্য কেমব্রিজ পাড়ি দিল।
সেদিন নেমে আসছি তেতলা থেকে, বন্দনা বলল,
– একবারটি দেখি চলো একটা-দুটো সিট জোগাড় হয় কিনা।
– যদি একটাই সিট মেলে?
– তাহলে তুমি বসবে আর আমি কলেজের বারান্দায় গিয়ে বসব।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘একা একাই?’’ ও দার্শনিক হয়ে গেল।
– একা একা তো এসেছি। আর একা একাই তো যেতে হবে। এই তো জগতের নিয়ম। তাই না?
কিন্তু কফি হাউজের নিয়মটা ঠিক জগতের মতো হল না। ভিড়াক্কার হলের একটা কোণ থেকে চোখে পড়ল একটা জুটি উঠে যাচ্ছে, যেন বা আমাদেরই জায়গা করে দেবার জন্য। আর অমনি বইখাতা বুকে চেপে ধরে বন্দনা মহিলা মিলখা সিং হয়ে এক ছুটে গিয়ে দখল নিল চেয়ার দুটোর। পাশ থেকে খুব মৃদু সুরে আওয়াজ এল, ‘‘এ মেয়ে ভাল নকশাল হবে।’’
বন্দনা নকশাল! এরকম নরমসরম মেয়ে দুনিয়ায় কম। কোনও অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গেলে মুখে এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, কিটসের লাইন। রেগে গেলে যার একমাত্র অভিব্যক্তি হল বিলকুল চুপ মেরে যাওয়া। চালু বাগধারায় স্পিকটি নট। আর তাকেই কিনা …
ভাবনাটা খুব দূর গড়াবার আগেই আর এক দৃশ্য। দেখি একমাথা উশকো খুশকো চুল, একমুখ কার্ল মার্কসীয় কালো দাড়ি, আধময়লা সাদা হাফশার্ট আর ধুতি লটকাচ্ছে ধুলোয়, আত্মভোলা মানুষটি বুকে খানকতক খাতা আগলে বিড়বিড় করতে করতে এসে পড়লেন আমার পাশেই। মুখটা উপরে তোলা, চোখে কী দেখছেন, ভগাই জানেন। বিড়বিড়িয়ে বললেন শুধু একটাই কথা,
– একটা ইনফিউশন হবে?
ইনফিউশন হল কফি হাউজের নিরেট কালো কফি। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
– আপনি আমার জায়গায় বসুন, বিনয়দা। আমি কফি অর্ডার করে দিচ্ছি।
বিনয়দা, কবি বিনয় মজুমদার, সেই ঠায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে চেয়ে চেয়ে বললেন,
– আমি ঠিক আছি। তুমি বসো। কফি এলে খেয়ে চলে যাব।
আমি নাম বলাতে টেবিলের অন্য দুটি ছেলে বুঝি বুঝতে পেরেছে লোকটি কে। অমনি উঠে দাঁড়িয়ে কবিকে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি আর বন্দনা তখন নিস্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছি কফির, আর ভক্তের চোখে দেখছি নীরব প্রেমিক পাগল কবিকে।
কফির অপেক্ষায় আমরা তিনজনই। নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্য বার দুয়েক গলা ঝাড়লাম। অথচ ‘ফিরে এসো চাকা’-র প্রাণ উতল করা কবি কীরকম লক্ষ্যহীন চাহনিতে কোথায় কী দেখছেন কিংবা কোথাও কিছু দেখছেন না। নাকি মনে মনে খুঁজে মরছেন ওঁর হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সী গায়ত্রী চক্রবর্তীকে, যে এখন বিদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত। ওঁদের কতটুকু কী পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কেউ জানেনি কখনও। শুধু জেনেছে কবি বিনয় তাঁর স্মৃতি আগলে আশ্চর্য, আশ্চর্য সব প্রেমের কথা লিখে যাচ্ছেন কবিতায় কবিতায়। মন ভেঙে যায়, বুক ভেঙে যায় জানলে, এই উন্মাদ কবি অসাধারণ ছাত্র ছিলেন অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যার সব কিছু হাওয়ায় ভাসিয়ে এখন শুধুই প্রেমিক, শুধুই কবি। কদিন আগেই গভীর রাতে হাতে ধরে পড়েছি এমন সব পঙক্তি—
‘আমি মুগ্ধ, উড়ে গেছো; ফিরে এসো, ফিরে এসো
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।’
আর এখন চোখের সামনে দেখছি সেই আশ্চর্য ব্যথাতুর মানুষটিকে আত্মভোলা হয়ে অপেক্ষায় শুধু এক কাপ ইনফিউশনের। একটু লজ্জাই হল কথা বলিয়ে ওঁর সোনালি মৌনতা ভাঙার কথা ভাবছি বলে। বন্দনাও দেখলাম মাথা নামিয়ে কোলে রাখা বই থেকে কিছু পড়ছে। এরকম চা কফির অপেক্ষা নিয়ে বিনয়দার কবিতাতেই তো আছে—
‘কারা যেন কথা বলে; আমি যা যা করি
সেই সব দেখে দেখে মুখেই তো বলে চলেছে।
এটুকু লেখার পরে শুনি তারা বলছে যে আমি কানে শুনি
চোখেও দেখি তা আমি নিজেও বুঝেছি।
এইভাবে কাব্যচর্চা করছি আমি তো।
সেইসব আগন্তুক যুবকেরা চলে গেছে বলে মনে হয়
এখন বিকালবেলা, চা খাওয়া তো প্রয়োজন খুব।’
অবশেষে কফি এল। ওঁর ইনফিউশন ঠোঁটে ঠেকিয়ে আপনমনে খেয়ে কার কথা ভেবেই যেন সামান্য হাসলেন। তারপর খাতাপত্তর গুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে একটা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে যেমন এসেছিলেন তেমনই খসখসে করে এলোমেলা পায়ে চলে গেলেন। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’-টা কার জন্য জানা গেল না।
বিনয়দা চলে যেতে ওঁকে আর গায়ত্রীকে নিয়ে যত গল্প বন্দনাকে শোনালাম। থোড়াই জানি তখন, এর বত্রিশ বছর পর, ২০০০ সালে, কলকাতা দূরদর্শনে আমার সাপ্তাহিক আলাপচারিতার আসর ‘কথায় কথায়’ অনুষ্ঠানে আমার অতিথি হয়ে আসবেন গায়ত্রী! ততদিনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না বুদ্ধিজীবী, লেখক, অনুবাদক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। সেই সন্ধ্যায় গায়ত্রী বললেন ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদার বিখ্যাত ‘অফ গ্র্যামাটোলজি’ বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। বললেন মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস অনুবাদের কথা। তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন ওঁর সাম্প্রতিকতম অনুবাদের কাজ। দেখলাম তা হল সাধক রামপ্রসাদের কবিতার সঙ্কলন। সেই অনুবাদের সঙ্গে শিল্পী নীরদ মজুমদারের অপূর্ব সব ড্রইংয়ে অপরূপা মা কালী।
আমাকে বলতেই হল সাধক কবির শ্যামাসঙ্গীত ফরাসি অনুবাদ ইতিপূর্বে করে রেখেছেন নীরদ মজুমদার। সঙ্গে সঙ্গে গায়ত্রীর উত্তর:
– ওই কবিতাগুলোই ইংরেজিতে করেছি, যা এখানে ওঁর ফরাসি তর্জমা আর ড্রইংয়ের সঙ্গে এক সঙ্কলনে বেরিয়েছে। ‘সং ফর কালী’।
তখন জিজ্ঞেস না করে পারিনি:
– এটা কি হঠাৎ একদিন করার ইচ্ছে হল?
গায়ত্রী বললেন,
– না। দেখুন, খুব সঙ্কীর্ণ অর্থে যাকে বিশ্বাসী মানুষ বলে, আমি তা নই। কিন্তু আমাদের পরিবারে শ্যামাসঙ্গীতের চল দেখে এসেছি যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে। সেই গান এখনও আমার মধ্যে ঘোরে ফেরে এবং আমাকে দেয় কবি কোলরিজ যাকে বলেছেন ‘poetic faith’ বা কাব্যিক বিশ্বাস। এই থেকেই রামপ্রসাদের গানের অনুবাদ।
তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম,
– আজ এখানে সেরকম একটা গান কি শুনতে পারি?
কথাটা শেষ করেছি কি করিনি গায়ত্রী বিন্দুমাত্র ভনিতা না করেই একেবারে নিখুঁত সুরে, ভাবে, আবেগে কী সুন্দর গেয়ে উঠলেন:
‘‘সকলি তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।
তোমার কর্ম তুমি করো মা,
লোকে বলে করি আমি।।
পঙ্কে বদ্ধ করো করী পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি।
কারে দাও মা ব্রহ্মপদ কারে করো অধোগামী।।
আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী।
আমি রথ তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি।।’’
কফি শেষ হতে কফি এসেছে, একসময় চিকেন কাটলেটও। কথার পর কথা উঠল বিনয়দাকে নিয়ে, গায়ত্রীকে নিয়ে। প্রেম আর কবিতা নিয়ে কথার শুরু থাকে, শেষ কোথায় কে জানে! কখন জানি একসময় কাকা ও ওর শ্রোতারা টেবিল ছেড়ে চলে গেছে। দূরে জানলার গায়ের টেবিলে এসে বসেছেন সত্যজিতের প্রিয় নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ওঁর বন্ধু নির্মাল্য আচার্য। ওঁরা দু’জন তখন একসঙ্গে আমাদের প্রিয় সাময়িকপত্র ‘এক্ষণ’ সম্পাদনা করেন। পত্রিকার অফিস একটা তো আছেই, তবে লেখাপত্তর নিয়ে আলাপ-আলোচনার অনেকটাই এই কফি হাউজেই সারেন।
সাধারণত এগারোটা-বারোটা নাগাদ আসেন। আজ একটু দেরিতেই দেখছি। পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে কমলা রঙের বুশ শার্টে নিদারুণ হ্যান্ডসাম নায়কটির মুখে। উল্টোদিকে বসা নির্মাল্যর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। সবাই আড়চোখে নায়ককে দেখছে, কিন্তু কাছে গিয়ে প্রশ্নট্রশ্ন করে বিরক্ত করছে না। দিনটা গড়িয়েই পড়ল যেন। হঠাৎ দল করে আমাদের ক্লাসের মেয়েরা এল তারকবাবুর ক্লাসের আগে কফিটা সেরে নিতে। এতক্ষণ কোথায় ছিল ওরা? উল্টে ওরাই জিজ্ঞেস করল,
– কোথায় ছিলে তোমরা?
বললাম,
– বা রে! এই কফি হাউজে। আর তোমরা?
কল্যাণী বলল,
– রিঙ্কির বয়ফ্রেন্ড এসেছিল, খাওয়াতে নিয়ে গেল। শনিবার ওর জাহাজে আমাদের সবার ইনভিটেশন। প্লিজ ডোন্ট মিস।
ওরা একটা কুইক কফির জন্য বসল। আর আমরা কলেজের দিকে হাঁটলাম। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: anagora.org, roar media
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
3 Responses
সেই সোনালী দিন গুলো কে আপনি আমাদের কাছে তুলে ধরলেন যা কোনো দিন ভুলবোনা।কি দারুন অস্থির অথচ সৃষ্টি শীল দিন গুলো ‘র সাক্ষী আপনি ! লোভ হয়, কেন আমি সেইসব দিনগুলো তে ছিলাম না। পড়ছি আর আবেগ তাড়িত হচ্ছি। এই ভেবে যে , কোথায় গেল ঐ মনিষীদের দের রাজত্ব টা ?
Khub chamotkar likhechen… mone hoi aaro pori kintu lekha hothat shesh hoye galo !
এমন চমৎকার কলম, এমন মস্ত রেঞ্জ, এমন ধরতাই,এমন অন্তরা র পর এমন সঞ্চারী!!!!!
আহা –আহা–আহা….
নিঃশব্দ কুর্ণিশ……………