রিঙ্কির বয়ফ্রেন্ডের ডাকা জাহাজের পার্টিতে যাবার জন্য আমরা বেশ ক’জন শনিবার দুপুরে জড়ো হলাম বসুশ্রী সিনেমার সামনে। জনা দশেক তো বটেই। ছেলে মোটে আমি, শুভ আর সত্যব্রত। অশোক সিনহা আসতে পারেনি, আর মেয়েদের মধ্যে বাদ পড়েছে বন্দনা। তাও তো দশ! কল্যাণী ওর বিলিতি মেমসায়েবি টোনে দিব্যি বলে দিল, “ওহ্! টেন ইজ আ পার্ফেক্ট নাম্বার ফর আর পার্টি।”
বসুশ্রী থেকে বাসে করে পার্ফেক্ট টেন আমরা পৌঁছেছিলাম খিদিরপুর ডকে। সেখানে রিঙ্কির বন্ধু আমাদের অপেক্ষায়। ও-ই সবাইকে নৌকোয় তুলে নিয়ে গেল প্রকাণ্ড এক মার্চেন্ট শিপে। নৌকো থেকে জাহাজের নামটার দিকে তাকিয়েছি যখন শুধু একটাই নাম মনের চোখে ভাসছে— এস. এস. ডাবলিন। যে জাহাজে ১৯৫৩ সালের এক শীতের সকালে বাবার সঙ্গে তুলে দিতে গিয়েছিলাম নিধুদাকে। ভাল নাম সুপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের বাড়া হ্যান্ডসাম যুবক। ফিরে এলে বিয়ের কথা বড়দির সঙ্গে। জামাইকে তৈরি করার জন্য সমস্ত খরচ দিয়ে বাবা পড়তে পাঠাচ্ছেন বিলেতে।
জাহাজে ওর কেবিনে নিধুদা বাবাকে প্রণাম করছে, আমায় জড়িয়ে আদর করছে, ওর বাবা চণ্ডীবাবু হাতজোড়া করে বলছেন,
– সবই তো সম্ভব হচ্ছে আপনার জন্য, বড়বাবু।
বাবা বলছেন,
– ওসব কথা থাক। ভালয় ভালয় ফিরে আসুক।
তারপর আমাকে গোটা জাহাজটা ঘুরে দেখাতে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ছেন বাবা। বলছেন,
– যে-কেবিনে ছিলাম আমরা ওটা ফার্স্ট ক্লাস কেবিন।
একসময় আমরা এসে দাঁড়ালাম ডেকে। বাবা বললেন,
– এর চেয়েও বড় জাহাজে তুমি ইংল্যান্ড যাবে অক্সফোর্ডে পড়তে। যেমন একটা জাহাজে আমি গিয়েছিলাম। আর প্রত্যেকটা পোর্ট থেকে তুমি আমাকে একটা করে চিঠি পাঠাবে। আর আমি মনে মনে সেখানে পৌঁছে যাব। ম্যাড্রাস, বম্বে, করাচি, এডেন, কায়রো, আলেকজান্ড্রিয়া, কেপ অফ গুড হোপ, জিব্রল্টার, সান সেবাস্তিয়ান, বর্দো, ক্যালে, ডোভার … ডোভার থেকে ট্রেনে করে তুমি যাবে লন্ডন। সেখান থেকে তুমি ট্রাঙ্ক কলে আমার সঙ্গে কথা বলবে। তারপর ওখান থেকে ফের ট্রেনে অক্সফোর্ড!
বাবা সারাক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন আর আমি বাবার সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে সব শুনছিলাম। যেন বাবা আমাকে ভূগোল পড়াচ্ছেন। শেষে জিজ্ঞেস করলাম,
– এভাবে কতদিন লাগে ইংল্যান্ড যেতে?
বাবা বললেন,
– সতেরো দিন।
তারপর আমার চুলে বিলি কেটে বললেন,
– তোমার সময়ে অবশ্য সব যাতায়াত প্লেনেই হবে। But I want you to make your first trip to England by boat. এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কত দেশ, কত মানুষ, ভাষা, সমুদ্র, আকাশ!
দু’বছর পর ব্রিস্টল থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছিল নিধুদা। তখন চেহারা, চালচালন, কথাবার্তা একেবারে সাহেবি। প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি আর দিদির সঙ্গে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর করত। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা সেরেব্রাল স্ট্রোকে চলে যেতে সেই আসাটা বন্ধ হল। সোনার হাঁস আর নেই জেনে চণ্ডীবাবু অন্য বড়লোক খোঁজা শুরু করলেন। কিন্তু সে সব অন্য গল্প।
বসুশ্রী থেকে বাসে করে পার্ফেক্ট টেন আমরা পৌঁছেছিলাম খিদিরপুর ডকে। সেখানে রিঙ্কির বন্ধু আমাদের অপেক্ষায়। ও-ই সবাইকে নৌকোয় তুলে নিয়ে গেল প্রকাণ্ড এক মার্চেন্ট শিপে। নৌকো থেকে জাহাজের নামটার দিকে তাকিয়েছি যখন শুধু একটাই নাম মনের চোখে ভাসছে— এস. এস. ডাবলিন। যে জাহাজে ১৯৫৩ সালের এক শীতের সকালে বাবার সঙ্গে তুলে দিতে গিয়েছিলাম নিধুদাকে। ভাল নাম সুপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের বাড়া হ্যান্ডসাম যুবক।
রিঙ্কির হবু বরের জাহাজে চড়তে চড়তে বাবার স্মৃতিতে ডুবেছিলাম কিছুক্ষণ। ঘোর কাটল ওর ক্যাপ্টেনস কেবিনে পা রেখে। ওহ মাই গড! কী দারুণ একটা ঘর আর পার্টির জন্য কী বিপুল বন্দোবস্ত! চার-পাঁচ রকমের স্কচ, দু’রকমের কনিয়াক, ফ্রিজ থেকে সদ্য বার করা কৌটো কৌটো অরেঞ্জ বুম বিয়ার, প্লেটে প্লেটে সাজানো হ্যাম স্যান্ডউইচ, পর্ক সালামি, ফ্রেঞ্চ ক্রোয়াসঁ, অমলেট আর চকোলেট। আর— যা দেখে আমাদের সব্বারই প্রাণ উড়ু উড়ু— কার্টন কার্টন বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট! কোত্থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে যে শেষ করব থৈ পাচ্ছি না। আমি আর কল্যাণী (কালে কালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারে মান্য সচিব হয়েছিল) প্রথমেই হামলে পড়লাম বেনসন অ্যান্ড হেজেসে। কয়েকটা বুকভরা টান দিতে না দিতেই রিঙ্কির বয়ফ্রেন্ড দেখি স্কচের পেগ সাজিয়ে আমাদের উস্কোচ্ছে,
– আরে জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল ছেড়ে কেন বেকার ধোঁয়া ফুঁকে সময় নষ্ট করছ? একটা পেগ নিয়ে ডেকে দাঁড়াও, নিজেকে লর্ড নেলসন মনে হবে।
হাতে স্কচ নিয়ে কেবিনের সামনে ডেকে যেতে ১৯৫৩ সালের সেই শীতের সকালটা ফিরে এল। কুয়াশায় মোড়া সকাল, খানিক দূরে আরও একটা বড় মার্চেন্ট শিপ, আর ডেকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বাবা আমার পিঠে হাত নদীর দিকে আবৃত্তি ওঁর প্রিয় বায়রনের কবিতার লাইন গ্রিসের সুনীল সমুদ্রের বর্ণনায়: Roll on, roll on, thou dark and deep blue ocean roll.
বাবার অকালপ্রয়াণে আমারও আর অক্সফোর্ড যাওয়া হয়নি। কিন্তু তাতে যত না খেদ তার চেয়ে বেশি মনখারাপ কোনও জাহাজে করে বাবার শোনানো বন্দর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ইংল্যান্ড পৌঁছতে না পারায়। শেষে ১৯৭৭-এর ৯ মে যখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের ৭৪৭ বিমানে করে লন্ডন পাড়ি দিলাম রবিশঙ্করের সঙ্গে ওঁর স্মৃতিকথা, ‘রাগ-অনুরাগ’-এর কাজে যোগ দিতে, আমার দমদম ছাড়ার মুহূর্তে এই দৃশ্যটাই মনে এসেছিল। হাতে স্কচ, ঠোঁটে বেনসন অ্যান্ড হেজেস আর চোখের সামনে নদী আর জাহাজ— সে যে কী সুখ আর আরাম তা আজ এতকাল পর লিখতে লিখতেও একটা ঘোরের মধ্যে পড়ছি। পাশে দাঁড়ানো শুভ একসময় বলল শুনছি,
– কী রে, কেমন বুঝছিস?
– কী আর বোঝার? এ তো স্বপ্ন!
শুভ বলল,
– যা বলেছিস। ইংরেজি সাহিত্য কপচে কি আর এই লাইফ পাওয়া যাবে?
তখন আমাদের গ্লাস রিফিল করতে করতে রিঙ্কির বয়ফ্রেন্ড বলল,
– আরে, এই স্কচ, বেনসন, নদী আর আকাশ বুঝতেও কবিতার প্রয়োজন। সবটাই তো মনের খেলা, বাপ। আমি তো কবিতার লোক নই, তবে মাঝে মাঝে সমুদ্রে সানসেট দেখতে দেখতে হেমন্তর গানটা গুনগুন করি— ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো’। তখন আর মনে হয় না বিদেশে পড়ে আছি।
এত ভাল লাগছিল পুরো ব্যাপারটা যে না বলে পারলাম না,
– কী আছে, আর কিছুদিন অপেক্ষা করো, তারপর তো রিঙ্কিকে নিয়ে ট্র্যাভেল করবে। তখন সূর্যাস্ত দেখতে দখতে মনে হবে পাশে সুচিত্রাও আছে।
তখন ওর হাসি দেখে কে? বলল,
– তার মানে আমি উত্তমকুমার?
শুভ বলল,
– আর ছাড়ো উত্তম। উত্তম কি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সুচিত্রাকে পায় নাকি?
রিঙ্কির বন্ধু বলল,
– আমিও কিন্তু কলকাতার পোর্টে এত সুন্দর সুন্দর একটা সন্ধ্যা অ্যাদ্দিনে পাইনি। ওকে, গেট রেডি ফর অ্যানাদার পেগ। বলেই ড্রিঙ্কস আনতে ছুটল। আমরা অতগুলো ব্ল্যাক লেবেল ঠুকে ডিনারে সবাই কত কী যে খেলাম কারও মাথাতেই রইল না। থেকে থেকে শুধু আওয়াজ উঠল, “মার্ভেলাস!”, “সুপার্ব!”, “অসাম!” আজকের দিনে কথায় কথায় যে শব্দটা লাফিয়ে ওঠে সেই “ওয়াও!” আওয়াজটা তখনও বাঙালির বুলিতে ঢোকেনি, তাই সেদিন শোনা হয়নি।
ঘোর কাটল ওর ক্যাপ্টেনস কেবিনে পা রেখে। ওহ মাই গড! কী দারুণ একটা ঘর আর পার্টির জন্য কী বিপুল বন্দোবস্ত! চার-পাঁচ রকমের স্কচ, দু’রকমের কনিয়াক, ফ্রিজ থেকে সদ্য বার করা কৌটো কৌটো অরেঞ্জ বুম বিয়ার, প্লেটে প্লেটে সাজানো হ্যাম স্যান্ডউইচ, পর্ক সালামি, ফ্রেঞ্চ ক্রোয়াসঁ, অমলেট আর চকোলেট। আর— যা দেখে আমাদের সব্বারই প্রাণ উড়ু উড়ু— কার্টন কার্টন বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট!
এরপরের ঘটনা ও স্মৃতি কোনওদিনই ভোলার নয়। পার্টি শেষ হতে আমাদের হোস্ট সব্বাইকে কার্টন ভেঙে ভেঙে বেনসন অ্যান্ড হেজেসের প্যাকেট দেওয়া শুরু করল। ওর টেবিলের ওপরে দেখলাম একটা দুর্দান্ত ইংরেজি নভেল পড়ে আছে যার অবলম্বনে অ্যালফ্রেড হিচককের তৈরি সিনেমাটা তখনও আমার মন ছেয়ে আছে। রবার্ট ব্লখ-এর ‘সাইকো’। আমি সেটা হাতে নিয়ে দেখছি দেখে বলল,
– তুমি চাইলেও ওটা তোমায় দিতে পারব না।
– এত কিছু বিলোচ্ছ, এটা পারবে না কেন?
– দুর্ধর্ষ সাসপেন্স। মাঝখানে এসে ফেঁসে আছি।
– ফিল্মটা আমার দু’বার দেখা। শেষটা বলে দেব?
ও প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
– নো! নো! প্লিজ না! এই নাও আরেকটা বেনসন।
বলে আরেকটা বেনসনের প্যাকেট গুঁজে দিল হাতে। তারপর সবাই যখন দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নৌকোয় নামছি, মাথায় জীবনের প্রথম ব্ল্যাক লেবেলের পাঁচ পেগ টলবল করছে, সত্যি মনে হল যেন এক জাহাজি সফর শেষ করে বন্দরে ফিরলাম।
সোমবার সকালে শেলির ‘প্রমেথিয়স আনবাউন্ড’ পড়াতে এলেন প্রফেসর মহীমোহন বোস। বার্ধ্যক্যে সদ্য পৌঁছনো বয়েস। খুব স্টাইলের ওপর ড্রেস করতেন সাদা সাইডকাট পাঞ্জাবি আর চোস্ত পাজামায়। বেশ সাহেবি ডেলিভারি ছিল স্যরের। আর খানিক পরপরই থুতনির নিচটায় হাত বুলোতেন। যে অংশটায় একটা গভীর পোড়ার ক্ষত, যারও একটা গল্প শোনা যেত। গল্পটা হল: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মহীমোহনবাবু এবং পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীর, দু’জনই ক্লাসের সহপাঠিনী লায়লার প্রেমে। দু’জনই তাঁকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেতে উদগ্রীব। লায়লারও পছন্দ দু’জনকেই। তাই রূপসী ও বিদূষী লায়লা একটা শর্ত দিলেন। পরীক্ষায় দু’জনের মধ্যে যিনি প্রথম হবেন তাঁরই গলায় মালা পরাবেন তিনি। এরপর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন কবীর এবং দ্বিতীয় হলেন মহীমোহন। লায়লা হুমায়ুনকে বিয়ে করে হলেন লায়লা কবীর এবং মর্মাহত মহীমোহন অ্যাসিড খেয়ে নিজের প্রাণ নেবার চেষ্টা করলেন। অ্যাসিডে মুখ পুড়ে গেল ঠিকই, কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেন। বাকি জীবন তিনি অবিবাহিত রইলেন এবং তা ব্যয় করলেন ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোয়।
মহীমোহনবাবু বড় ভালবেসে শেলি পড়াতেন। সেই সকালে যখন তিনি অপূর্ব মেজাজে ‘প্রমেথিয়াস আনবাউন্ড’ থেকে পড়ছেন— My soul is an enchanted boat,/which like a swan doth float/Upon the silver waves of thy sweet singing— আমরা, শনিবারে জাহাজের পার্টি করা বন্ধুরা নতুন করে ভাসছি নদীর নীলে… (চলবে)
অনিবার্য কারণে ‘জীবন থেকে জীবনে’ জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হতে পারেনি। পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি।
*ছবি সৌজন্য: Artist.com, ibsplc.com
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
2 Responses
Prothom theke ei lekhar roshey moje achhi. Ato saboleel lekha, pashe dnariye shonar moto, jeeboner pawa na pawar bedona keo koto norom bhabe chhunye dakhen tini ! Onobodyo.
আনন্দবাজার ছেড়ে যাওয়ার পর শঙ্করলালকে খুব মিস করি। এখন সংবাদ প্রতিদিনে নমাসে ছমাসে পাই কিন্তু তাতে মন ভরে না।