banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

শেষ খেলা

তৃষ্ণা বসাক

এপ্রিল ১৯, ২০২১

short story on Mahabharata
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register



অর্জুন বলেছেন– আজকে শকুনি আমার শরগুলিকেই তার পাশাখেলার উল্টো ডাক গ্লহ বলে বুঝতে পারবে। আর আমার গাণ্ডীবটি দেখলেই বুঝতে পারবে দুরোদর কাকে বলে।

দুরোদর- জুয়াড়ির কাছে মোট যত ঘুটি থাকে। সেগুলি যে পাত্রে রাখা হত তার নাম অক্ষাবাপন। আর দান ফেলার আগে জুয়াড়ি যে ডাকটি দিত, তার নাম গ্লহ যা পরবর্তীকালে হয় গ্রহ।


 

সন্ধ্যার দীপগুলি জ্বলে গেছে। তবু বড় অন্ধকার চারদিকে। পুরুমিত্র অবসন্ন শরীরে ফিরছিল। কিন্তু কোথায়? গৃহ তার আছে বটে একটা। সুগৃহিণী, দু’টি পুত্র, যা থাকে অন্যদের। কিন্তু এই নগরে নয়, একটু দূরের গ্রামে। খুব ইচ্ছে করছিল নগর ছেড়ে আজ রাতটা সেখানে গিয়ে কাটায় । কিন্তু না, আজ এখানেই থাকবে সে, কোকিলার কাছে। 

কোকিলার একটি গৃহ আছে, বস্তুত সেখানেই সন্ধ্যায় তাদের অক্ষক্রীড়া হয়। ক্রীড়া না বলে শিকার বলাই ভাল। দূরদূরান্ত থেকে আসা বণিক, যারা সন্ধ্যার পর বিনোদন খোঁজে কিংবা গ্রামের হাটুরে মানুষ, যারা নগরে এসে নাগরিকের জীবনযাপনের নকল করতে চায়, তাদের শিকার করে পুরমিত্র। তার মতো জুয়াড়ি আরও আছে, কিন্তু পুরমিত্র শঠতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেকোনও সাধারণ ক্রীড়াগৃহ নয়, তার আসর বসে কোকিলার বিলাসগৃহে। 

পুষ্প, সুগন্ধি, দীপে সজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করলেই আগন্তুকের স্নায়ু অবশ হয়ে আসে, তারপর সে যখন কোকিলাকে দেখে তার অবস্থা হয় মধুতে আটকানো মক্ষিকার মতো। আর কোকিলা আগাগোড়া  শিকারের গা ঘেঁষে বসে তাকে বিমোহিত করে রাখে। বারবার তার শূন্য পাত্র ভরে দেয় উৎকৃষ্ট মাধ্বীতে। সে যখন দান দিতে যায়, তখন তার পিঠে নিজের উত্তুঙ্গ স্তনযুগল ঠেকিয়ে তার কানে কানে উত্তেজক কথা বলে তাকে বিভ্রান্ত করে। তার সঙ্গে অবশ্যই যোগ হয় পুরমিত্রর অসামান্য ক্ষিপ্রতা। অক্ষের মূল কথা এটাই। প্রতিপক্ষ বোঝার আগেই কিছু ঘুঁটি সরিয়ে ফেলতে হবে অথবা কিছু ঘুঁটি যোগ করতে হবে। যত দান হাঁকবে, সেই অনুযায়ী এই ঘুঁটি কমানো বা বাড়ানোর কাজটা উত্তম অক্ষবিদ করে থাকেন । ঠিক যেভাবে একজন জাদুকর জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে হস্তলাঘব করেন।

কোকিলার গৃহের সামনে এসে পুরমিত্র একটু অবাক হয়ে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, নগরীর গৃহে গৃহে , বিপণিতে, প্রশাসনিক ভবনে, সর্বত্র দীপ জ্বলে গেছে, কিন্তু এ গৃহ এখনও অন্ধকার। এমনটা তো কখনও হয় না! প্রতি সন্ধ্যায় অতিথিদের জন্য দীপমালায় সেজে ওঠে এই গৃহ। ভবনদ্বারে ফুল ও সুগন্ধি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে কোকিলার দুই সহচরী। আজ সেসব কিছুই নেই। সমগ্র গৃহটি অন্ধকারে নিমজ্জিত। চমকে উঠল পুরমিত্র। তার কেমন ভয় করে উঠল। কোকিলার কিছু হয়েছে? কোকিলার কিছু হওয়া মানে তো তার অক্ষক্রীড়ার জীবিকাটি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া। দীর্ঘদিন অনেক নগরনটীর সঙ্গে মেলামেশা করেছে পুরমিত্র, তাদের শরীরের স্বাদ নিয়েছে, তাদের বাকচাতুরি, কামকলায় মুগ্ধ হয়েছে, কিন্তু কোকিলার মতো তীক্ষ্ণ মেধা কারও দেখেনি। শুধু তাই নয়, অক্ষক্রীড়া সম্পর্কে তার আগ্রহ আর জ্ঞান অতি বড় অক্ষবিদকেও হার মানায়। 

 

আরও পড়ুন: বুদ্ধদেব গুহর ছোটগল্প: বাঘের দুধ

 

মাঝে মাঝে পুরমিত্র অবাক হয়ে ভাবে, কোকিলাই তো স্বতন্ত্রভাবে একজন অক্ষবিদ হতে পারত। সে তো শুধু শিকারের পেছনে বসে তাকে প্রলুব্ধ করে, তাই নয়, সে ইশারায় পুরমিত্রকে দানও বলে দেয়। সেই কোকিলার কিছু হয়ে গেলে… কোকিলার বিকল্প সহজে দু’ একদিনে পাওয়া যাবে না, আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কটা মেয়েই বা নিজের গহনা আর প্রসাধন ছাড়া অন্য বিষয়ে চিন্তা করতে পারে? হঠাৎ বাতায়নের দিকে তাকিয়ে পুরমিত্রর অন্ধকার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এতক্ষণ অন্ধকারে বোঝা যায়নি, এখন দেখছে বাতায়নে বসে আছে কোকিলাউদাসীন তার মুখ চোখ, অঙ্গালেপন, প্রসাধন, রেশম বস্ত্র পরিধান– কোনওটাই সে করেনি। কী এমন হল, যে কোকিলা এভাবে বসে আছে?

 অন্যদিন পুরমিত্র এলে কোকিলা উঠে এগিয়ে আসে, পদপ্রক্ষালনের জল এগিয়ে দেয়, সুরা এগিয়ে দেয়, জিজ্ঞাসা করে সে ক্ষুধার্ত কিনা, রাতের আহারের আগে সামান্য মোদক বা ফল, কিছু খাবে কিনা। অর্থাৎ একজন স্ত্রী যা যা করে কোকিলা ঠিক তাই তাই করেতখন কোকিলাকে দেখলে কে বলবে সে একজন নগরনটী, তার মোহময় রূপ যৌবন কত পুরুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। বরঞ্চ স্ত্রীরা যা পারে না কোকিলা তাও করে। পুরমিত্রর মুখ দেখে সে তার মেজাজ বুঝে যায়। আর সেই অনুযায়ী বিনোদনের ব্যবস্থা করে। পুরমিত্র এ নগরে অনেক বছর আছে। অনেক বারাঙ্গনার সঙ্গলাভ করেছে সে। বস্তুত এদের একজন থেকে আর একজনের গৃহে ভাসতে ভাসতে নগর জীবনযাপনের জটিল কৌশল সে রপ্ত করেছে।

গ্রাম থেকে যখন আসে, তখন সে একেবারেই আনাড়ি এক যুবক। তার একটিমাত্র গুণ ছিল, নারীদের কেমন করে তৃপ্ত করতে হয় তা সে জানত। এর জোরেই সে ধীরে ধীরে অভিজাত সমাজে জায়গা করে নেয়। তাই সে শুধু যে অক্ষনিপুণ তাই নয়, বারাঙ্গনাদের মন বুঝতেও তার জুড়ি নেই। আর সেই কারণেই পুরমিত্র কোকিলার এই যত্নকে ভালবাসা বলে ভুল করে না। আসলে তার যেমন কোকিলাকে দরকার, কোকিলারও তাকে দরকার। কোকিলারই তাকে বেশি করে দরকার।

কোকিলার থেকেও কত সুন্দরী সুতনুকা বেশ্যা এই নগরে ছড়াছড়ি যাচ্ছে। চাইলে সে যেকোনও কাউকে তুলে আনতে পারে, তখন সেই নতুন শরীর হয়ে উঠবে তার জয়ের পারানি। কিন্তু কোকিলা ইচ্ছে করলেই আর একজন পুরমিত্র খুঁজে পাবে না। অক্ষ খেলে অনেকেই, কিন্তু পুরমিত্রের মতো অক্ষনিপুণ কজন? এই নগরীতে যে হাতে গোণা কয়েকজন অক্ষশৌণ্ড আছে, পুরমিত্র তাদের অন্যতম। বিবিংশতি, চিত্রসেন, সত্যব্রত, পুরুমিত্র। পাকা জুয়াড়ি বলতে যা বোঝায় এরা হচ্ছে তাই। আর সে কারণেই তো আজ রাজসভায় ডাক পড়েছিল তাদের চারজনের। 

চমকে উঠল পুরমিত্র। তার কেমন ভয় করে উঠল। কোকিলার কিছু হয়েছে? কোকিলার কিছু হওয়া মানে তো তার অক্ষক্রীড়ার জীবিকাটি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া। দীর্ঘদিন অনেক নগরনটীর সঙ্গে মেলামেশা করেছে পুরমিত্র, কিন্তু কোকিলার মতো তীক্ষ্ণ মেধা কারও দেখেনি। 

এত বছর পাশা খেলছে পুরমিত্র, দক্ষ অক্ষবিদ হিসেবে যথেষ্ট নামডাক তার, তবু রাজসভা থেকে ডাক আসেনি কখনও। তাই কাল যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে একজন পত্রবাহক এসে চুপিসাড়ে তার হাতে পত্রটি দিল, নীচে স্বাক্ষর দেখে চমকে উঠেছিল পুরমিত্র। সমগ্র দেশে অক্ষবিশারদ হিসেবে যে নামটি সমীহের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তিনি তাকে পত্র দিয়ে আগামীকাল রাজসভায় উপস্থিত থাকতে বলেছেন, নিজের ঘুঁটি-সহএবং এও বলেছেন এই বিষয়টি যেন কাকপক্ষীতেও টের না পায়। তাই কোকিলাকেও কিছু বলেনি পুরমিত্র। ভোরবেলা স্নান সেরে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। 

সাধারণত এত ভোরে কোকিলা নিদ্রামগ্ন থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ পুরমিত্রর পাশার আসর শেষ হয়ে গেলেও কোকিলার গৃহদ্বার রুদ্ধ হয় না। নৃত্য গীতের আসর চলতে থাকে সারা রাত্রি ধরে, যার শেষ হয় কোকিলার শয্যায় রতিক্রীড়ায়। কোকিলা নিজের একরাত্রির জন্যে যে পরিমাণ নিষ্ক হেঁকে রেখেছে, তাতে খুব ধনবান ছাড়া কেউ তাকে লাভ করতে পারে না। তাই কোকিলার কোনও কোনও রাত বিক্রয় হয় না। আর সেই রাতগুলি বরাদ্দ থাকে পুরমিত্রর জন্যে। এই ব্যবস্থায় কোনও অসুবিধে নেই পুরমিত্রর। এটা তো কোকিলার জীবিকা, সে তো পুরমিত্রর বিবাহিত স্ত্রী নয়। তবু, তবু কোকিলার রুদ্ধদ্বারের দিকে চাইলে তার বুকের মধ্যে জ্বালা জ্বালা করে কেন কে জানে!

আজও সকালে বেরোবার সময় কেমন ছটফটানি লাগছিল। পুরমিত্রর জীবনের এমন একটা স্মরণীয় মুহূর্ত, কোকিলাকে বলা হল না। কোকিলাকে বললে ও কাউকে বলত না, প্রখর বুদ্ধিমতী। যেতে যেতে অবশ্য ও আর কোকিলার কথা ভাবছিল না। কী এমন ব্যাপার ঘটল যে পুরমিত্রর ডাক পড়ল রাজসভায়? ফেরার সময় অবশ্য এর উত্তর তার কাছে ছিল। পুরমিত্ররা যে খেলা খেলে প্রতি সন্ধ্যায়, সে খেলায় হারলে তার আর্থিক লাভ কিছু কম হয়, সেই সন্ধ্যাটি বিষাদ্ঘন হয়ে ওঠে, কিন্তু মাধ্বী ও কোকিলার সঙ্গ সেই বিষাদ ভুলিয়ে দেয় এক প্রহরের মধ্যে। তাতে তার জীবনযাপনে কিছু কম পড়ে না। সে জানে খেলায় হার জিত আছেই, তার মতো জুয়াড়িরাও কখনও কখনও হেরে যায়, পরের সন্ধ্যার জয়ে সে দ্বিগুণ উশুল করে নেবে। 

কিন্তু আজ রাজসভায় যে খেলা হল, তার একটিই পরিণতির জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা ছিল। জয় এবং জয়। অন্য কোনও কিছুর অর্থ মৃত্যু, স্বপ্নের মৃত্যু। তাই তাকে পাঠানো পত্রে যাঁর স্বাক্ষর ছিল, তিনি কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। আর তাই নগরের শ্রেষ্ঠ জুয়াড়িদের তিনি ডেকে নিয়েছিলেন, যদি তাদের কখনও দরকার লাগে। না, দরকার পড়েনি। পুরমিত্রবিবিংশতি, চিত্রসেন, সত্যব্রত- এরা সব চিত্রবৎ বসেছিল।

 

আরও পড়ুন: রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প: ফুল্লরার চাঁদকথা

 

সারা জীবন অনেক অক্ষক্রীড়া করেছে, কিন্তু স্নায়ুর এমন চাপ কখনও অনুভব করেনি। চিত্রবৎ ছিল বটে, কিন্তু প্রতিটা দান সে মনে মনে লিখে নিচ্ছিল, তার মতো জুয়াড়ির কাছে এ তো শিক্ষার এক মহা সুযোগ! কিন্তু শুধু যে তার দৃষ্টি অক্ষক্রীড়ার ছক অর্থাৎ অধিদেবন বা ইরিণ কিংবা  অক্ষ রাখার পাত্র অক্ষবাপনেই ছিল, তাই নয়, সে সভাস্থলের সজ্জা, উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মুখমণ্ডল, শরীরভাষা- সব গভীর মনযোগে লক্ষ করছিল। এই গুণ সে পেয়েছে কোকিলার কাছ থেকে। 

কোকিলা মানুষের মুখ ও শরীরের ভাষা পড়তে পারেসে খেলতে আসা মানুষজন দেখেই বুঝে যায় কে কোন সামাজিক স্তর থেকে এসেছে, কার কত ধন আছে, কাকে কতটুকু দোহন করা যেতে পারে। তার কথা হল- এমনভাবে দোহন করবে, যাতে তার মনে না হয় সে প্রতারিত হয়েছে, বরং তাকে পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরে যেতে দাও, যাতে সে পুনর্বার আসে। সভাস্থলে বসে কোকিলার কথা মনে পড়ায় তার একটু বিবেকদংশন হল। কোকিলা যদি জানত, সে আজ কোথায় কাদের সঙ্গে বসে আছে, তাহলে নিশ্চয় সে গর্ব অনুভব করত। পরক্ষণেই তার মনে হল, কে কোকিলা? সামান্য এক বেশ্যা, শরীর বিক্রয় করে যাকে বেঁচে থাকতে হয়। আর সে পুরমিত্র, মেধা বিক্রয় করে। শুধুমাত্র মেধার জোরে সে কোন অজ গ্রাম থেকে উঠে এসে ইন্দ্রসভার তুল্য অত্যুজ্জ্বল সভাগৃহে বসে আছে। 

এইখানে আবার পুরমিত্রের কেমন খটকা লাগে। সে শুনেছে এই ক্রীড়া উপলক্ষেই এই সভাগৃহটি বিশেষ যত্নে নির্মাণ করা হয়েছে। এমন সভা সমগ্র জম্বুদ্বীপে আর আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু যেখানে ক্রীড়া হবে, সেই আংশটিতে যথেষ্ট আলো নেই। ঘুঁটিগুলি পুরমিত্রর মতো অভ্যস্ত চোখেও ভাল দেখা যাচ্ছে না। রাজস্থপতি কী করে এত বড় ভুল করলেন কে জানে! হঠাত বিদ্যুতচমকের মতো একটা কথা মাথায় আসতে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল পুরমিত্র।

পাশ থেকে বিবিংশতি তার কাঁধে হাত রেখে বলে ‘ শান্ত শান্ত। সভা দেখে চোখ কপালে ওঠার বয়স আমরা পেরিয়ে এসেছি বন্ধু, আসল খেলা দেখ। চুপচাপ। এমন সুযোগ আর পাবে না।’ পুরমিত্র তাকে বলতে পারল না, ক্রীড়াস্থলে কম আলোর রহস্যটা সে বুঝতে পেরেছে। কোকিলাও এমন করে যে। সারা গৃহে প্রচুর দীপ রাখলেও ঠিক খেলার জায়গাটায় সে অপ্রতুল আলো রাখে, যাতে বিপক্ষের দান ফেলতে অসুবিধে হয়। কিন্তু সেটা তো তাদের পেশা, এই চাতুরিটুকু তারা করে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য, এখানে রাজপরিবারের কেন তেমন করতে হবে?

তখনই এক সুবর্ণবরণ দীর্ঘদেহী পুরুষ করজোড়ে যা বললেন, তাতে পুরমিত্রর কাছে বিষয়টা অনেক পরিষ্কার হয়ে গেল। ‘মাতুল, তুমি যেন অন্যায় পথে শঠতা করে আমায় জিতে নেবার চেষ্টা কোরও না।’

শকুনি অল্প হেসে উত্তর দিলেন ‘যে মানুষ পাশার দান পড়ার আগেই সংখ্যাটি বুঝতে পারে, শঠতা বা অন্যায় হলে সে প্রতিকার করতে জানে, পাশার দান ফেলার ব্যাপারেও সে ওস্তাদ, সেই মানুষ অন্যায়ের শঠতাও সহ্য করতে পারে। এই তো এখানে এই নগরের শ্রেষ্ঠ অক্ষবিদরা আছেন। পুরমিত্রবিবিংশতি, চিত্রসেন, সত্যব্রত-তুমি চাইলে এদের মধ্যে যে কোনও একজনের সঙ্গে খেলতে পার, যদি আমাকে অবিশ্বাস কর। এখন বল তুমি কী করবে যুধিষ্ঠির।’

ইনিই তাহলে যুধিষ্ঠির! যদিও সে আদার ব্যাপারী, এত বড় বড় ব্যাপার সম্পর্কে তার খোঁজ রাখার স্পর্ধা বা অবসর কোনটাই নেই। কিন্তু নগরে থাকলে কিছু কিছু খবর তো কানে না এসে পারে না। যেমন এই যুধিষ্ঠির হচ্ছেন কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র। ইনি এবং এঁর পরের দুই ভাই কুন্তীর গর্ভজাত, আর বাকি দুই ভাই মাদ্রীর। কিন্তু এদের পিতা কে, কেউই জানে না। যদিও এদের পরিচয় পাণ্ডব, আর সেই অধিকার নিয়েই এই পাঁচটি বালককে নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন কুন্তী। পুত্র-সমেত রাজসভায় সটান হাজির হওয়া এই বংশে নতুন কিছু না।

কোকিলা মানুষের মুখ ও শরীরের ভাষা পড়তে পারে। সে খেলতে আসা মানুষজন দেখেই বুঝে যায় কে কোন সামাজিক স্তর থেকে এসেছে, কার কত ধন আছে, কাকে কতটুকু দোহন করা যেতে পারে। তার কথা হল- এমনভাবে দোহন করবে, যাতে তার মনে না হয় সে প্রতারিত হয়েছে, বরং তাকে পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরে যেতে দাও, যাতে সে পুনর্বার আসে। 

শকুন্তলা ভরতকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন দুষ্মন্তের সভায়। শকুন্তলার অবশ্য সন্তানের পিতৃত্ব প্রমাণের দায় ছিল। কুন্তী একটি নয়, পাঁচ পাঁচটি পুত্র নিয়ে এসে দাঁড়ালেন রাজসভায়, তাঁর মনে কিন্তু বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা আশঙ্কা ছিল না। যিনি অস্বীকার করবেন, সেই মানুষটিই তো নেই। সবাই মেনে নিল এই পাঁচটি বালক পাণ্ডুর ঔরসে না হোক, তাঁর সম্মতিতে ক্ষেত্র নিয়োগ ব্যবস্থায় জন্মেছে, এতে কেউ কিছু মনে করল না। বড় বড় ঘরে এমন আকছার ঘটে। কে কার ছেলে দেখতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে। 

পুরমিত্রদের মতো কারও ঘরে এমন ঘটলে নিন্দে হয়, আর ভেবে দেখলে তাদের ঘরে এমন হয় না। রাজারাজড়ারা এত ভোগ আর কুৎসিত যৌনাচার করে, যে তাদের অনেকেরই সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা থাকে না। তাই কখনো পুরোহিত, কখনো সুদূর গ্রাম থেকে ধরে আনা অজ্ঞাতপরিচয় লোক দিয়ে রানিদের গর্ভধারণ করানো হয়, আর রটিয়ে দেওয়া হয়,দেবতারা এসে সন্তান দিয়ে গেছেন। কুন্তীর বেলায় যেমন রটানো হল এই পাঁচ বালক আসলে পাঁচ দেবতার সন্তান। অর্থাৎ এরা ঈশ্বরপুত্র। যুধিষ্ঠির ধর্মের, ভীম পবনের, অর্জুন ইন্দ্রের আর নকুল-সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সন্তান। আর নগরবাসী যা জানে, পুরমিত্রও সেইটুকুই জানত। 

বিপণি, মধুশালা, কোকিলার গৃহে লোক মারফত অনেক কথাই কানে আসত। অন্ধরাজার একশো সন্তান আর এই পাঁচ ঈশ্বর সন্তানের মধ্যে নাকি অহিনকুল সম্পর্ক, এঁদের বারবার হত্যা করার চেষ্টা করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা, আর বারবার অলৌকিক উপায়ে তাঁরা আরও বলীয়ান হয়ে ফিরে এসেছেন। তাতে জনরব আরও গাঢ় হয়েছে যে এরা অবশ্যই দেবতাদের সন্তান, দেবতারাই এদের রক্ষা করেন। শেষ ঘটনাটি তো এই ধারণা আরও দৃঢ় করল। বারণবতে জতুগৃহে যারা পুড়ে মরেছে বলে সবাই জানে, যাদের অস্থি দাহ করা হল মহা সমারোহে, তারা মরা তো দূরের কথা, দ্রুপদের অমন আগুনের খাপরা মেয়েকে বিয়ে করে ড্যাং ড্যাং করতে করতে ফিরে এল! কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে কি তা সম্ভব?

যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে পুরমিত্রর মনে হল, না, ইনি কোনও সাধারণ মানুষ নন। অদ্ভুত এক সরল পবিত্রতার দীপ্তি এঁর মুখে চোখে। অক্ষক্রীড়ায় এঁকে মানায় না। শুধু যুধিষ্ঠির কেন, বাকি চারজনকেও এখানে বেমানান লাগছে।  বাঘ যেমন শিকারের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে, শকুনির চোখে তেমনি দৃষ্টি। সে দৃষ্টি দেখে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত খেলে গেল পুরমিত্রর। সে বুঝতে পারল, সম্ভবত অনেকগুলো ঘুঁটি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে শকুনির পাশা খেলা হবে এবং দান ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুঁটিগুলো গুনে ফেলার একটা তৎপরতা প্রয়োজন, যা যুধিষ্ঠিরের নেই।

ঘুঁটি গোনার সময়েই কে কত ধূর্ত প্রমাণ হয়ে যায়। ডাক দেওয়ার পর পাশার ঘুঁটি চেলে তুলতে হয় এবং গোনবার সময় চোখ বুলিয়েই অক্ষশৌণ্ড বুঝতে পারে, দানটি তার ডাকের সংখ্যা অনুযায়ী পড়েছে কিনা। না পড়লে তখনি নিপুণ জুয়াড়ির কেরামতি। নিজের ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে অসামান্য ক্ষিপ্রতায় ঘুঁটি সরিয়ে ফেলতে হবে অথবা জোগাতে হবে।

*** 

বৈদিক যুগে পাশার ঘুঁটি বানানো হত বিভীতক বা বয়ড়া দিয়ে। এই ফলের কোনওদিক সমান নয় বলে এর গায়ে একেকদিকে যে একেকটি সংখ্যা লেখা থাকবে তা সম্ভব নয়। তাই হয়তো এটা জোড় বিজোড় করে খেলা হত। আর এখন তো পাথর বা ধাতুর তৈরি ঘুঁটি, তার ওপর সবাই বলে শকুনির আছে মন্ত্রপূত পাশা, যা নাকি তার পিতা সুবলের হাড় দিয়ে তৈরি। তার সঙ্গে কীভাবে যুধিষ্ঠির পেরে উঠবেন? তবে কি এটা কোন বড় রাজনৈতিক চক্রান্ত?

‘আপনার আহার্য প্রস্তুত দেব। দেবী কোকিলা বলেছেন, আজ সান্ধ্য আসরে তিনি থাকতে পারছেন না।’ ভ্রমরার কথায় পুরমিত্রর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। কোকিলার এই দাসীটি কাজেকর্মে আবার কামক্রীড়ায় অতি নিপুণ। বেশ কয়েকবার এর শরীরের স্বাদ সে নিয়েছে। আজ তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করল পুরমিত্র। তার শরীরের অবসাদ কাটাতে পারে আজ ভ্রমরাই। তার শরীরে অনাবশ্যক মেধার প্রসাধন নেই কোকিলার মতো। কোকিলা নিজেকে কী মনে করছে আজকাল? পুরমিত্র ফিরলে সে উঠে আসারও প্রয়োজন মনে করে না! ভ্রমরার কটি বেষ্টন করে নিজের বুকে টানে সে। আর তখনি দ্বারে এসে দাঁড়ায় কোকিলা। বলে, ‘চমৎকার। রাজমহিষী আর দাসী যে সমান ভোগ্যা, তা তো আজ প্রমাণ হয়ে গেছে।’

 

আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের ছোটগল্প: অবরোহণ

 

বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় পুরমিত্র, তার হাত শিথিল হয়ে খুলে আসে ভ্রমরার কটি থেকে। সে হতবুদ্ধির মতো বলে ‘এর অর্থ?’ সে কথার উত্তর না দিয়ে কোকিলা ভ্রমরাকে বলে ‘ ভ্রমরা, আমার কক্ষে ওঁর খাদ্য পানীয় নিয়ে এস। আর যেসব অতিথি অক্ষক্রীড়ার জন্য আসবেন, তাঁদের সুমিষ্ট কথায় বুঝিয়ে দিও, এই গৃহে আর কোনওদিন অক্ষক্রীড়া হবে না। নৃত্যগীত ও অন্যান্য আমোদ প্রমোদ আগের মতোই চলবে।’

মাথায় বজ্রপাত হলেও এত বিস্মিত হত না পুরমিত্র। এ কথা ঠিক, তার আর কোকিলার মধ্যে কোনও চুক্তি হয়নি, যে সে আমৃত্যু এই গৃহে থেকে তার অক্ষশিকার চালিয়ে যাবে। কিন্তু কোনও চুক্তি কি প্রয়োজন ছিল? পুরমিত্র তো ভেবেছিল, কোকিলা তার প্রেমে পাগল, সে তাকে পূজা করে, আর সেও কোকিলাকে... না নাতার মতো ভদ্র বংশজাত পুরুষ কবে আবার কোন বেশ্যাকে ভালবেসেছে? কিন্তু থাকতে থাকতে তো পোষ্য পশুপক্ষীর ওপরেও মায়া জন্মায়। তাছাড়া সে সবে ভাবছিল কোকিলাকে আজকের সারাদিনের ঘটনা খুলে বলবে, রাজসভায় কাদের মাঝখানে সে বসেছিল, শুনলে কোকিলা সারাজীবন তার পায়ে পড়ে থাকবে।

এর মধ্যে কী এমন ঘটল যে কোকিলা এমন উন্মাদের মতো আচরণ করছে? সে কি জানে যে ইচ্ছা করলে সে এখনই এই নষ্ট নারীকে নগরী থেকে দূর করে দিতে পারে? অন্ধরাজা তো নামেই রাজা, রাজত্ব চালান বকলমে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন। তিনি অতি দক্ষ হাতে আইনশৃঙ্খলা সামলান। আর আজকের পর থেকে নিষ্কণ্টক রাজ্যে তিনি আরও ক্ষমতার অধিকারী হলেন সেই ক্ষমতার অলিন্দের চেহারা দেখে এসেছে পুরমিত্র। তাকে ভয় দেখাচ্ছে কোকিলা?

পরক্ষণেই তার মনে হয়, আসলে এ সমস্তই অর্থ দোহনের কৌশল। প্রথম প্রথম কোকিলাকে সে কিছু অর্থ দিত বটে, কিন্তু পরে কোকিলা তা নিতে চায়নি। সে বলত পুরমিত্রকে তো স্ত্রী ও পুত্রের ভরণপোষণ করতে হয়, এই গৃহের ব্যয়ভার সে একাই বহন করতে পারবে। বস্তুত পুরমিত্র বহু বছর হল কোকিলার অর্থেই খায়, কদাচিৎ দু’ একটি অলংকার বা সুগন্ধি ছাড়া তাকে আর কিছু দেয়নি। তার জন্যেই হয়তো এমন ক্ষেপে উঠেছে কোকিলা! সামান্য বেশ্যার এত সাহস! পুরমিত্র ক্রোধ সামলে নিল, কারণ সে ভেবে দেখল প্রায় বিনাব্যয়ে নগরীতে থাকার সুযোগ সে আর পাবে না, কারণ কোকিলা যে যুবক পুরমিত্রকে ভালবেসে নিজের গৃহে থাকতে দিয়েছিল, সেই যৌবন আজ অস্তমিত, অন্য রূপোপজীবিনীরা এমন করবে কি

সে তাড়াতাড়ি কোকিলার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে গাঢ় স্বরে বলল, ‘কেন প্রিয়ে? বৃদ্ধ পুরমিত্রকে আর মনে ধরছে না? তরুণ কোন অক্ষশৌণ্ডর প্রেমে পড়েছ বুঝি?’ কোকিলা এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় তার হাততীক্ষ্ণ স্বরে বলে ‘যে অক্ষের আসক্তিতে মানুষ নিজের স্ত্রীকে পণ রাখতে পারে, সেই অক্ষ আর কোনওদিন এই গৃহে খেলা হবে না পুরমিত্র। এটা তুমি জেনে রাখ। তুমি এই গৃহে থাকতে পার, তার জন্য কোনও অর্থ দিতে হবে না। কিন্তু সন্ধ্যার ক্রীড়ার আসরের জন্য অন্য কোনও গৃহ বা মধুশালা তোমাকে খুঁজে নিতে হবে। আর একটা কথা, আমার গৃহে থাকা মানে কিন্তু আমার শয্যায় থাকা নয়। সেটা নির্ভর করবে আমার ইচ্ছের ওপর।’

ভ্রমরার কথায় পুরমিত্রর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। কোকিলার এই দাসীটি কাজেকর্মে আবার কামক্রীড়ায় অতি নিপুণ। বেশ কয়েকবার এর শরীরের স্বাদ সে নিয়েছে। আজ তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করল পুরমিত্র। তার শরীরের অবসাদ কাটাতে পারে আজ ভ্রমরাই। 

কথাটা শুনে পুরমিত্র কোকিলার শয্যার ওপরেই বসে পড়ল ধপ করে, কারণ তার আর দাঁড়াবার শক্তি ছিল না। আজ দিনটাই তার হতচকিত হবার দিন। তার মনে পড়ছিল, কী ক্ষিপ্রতায় পাশার দান ফেলছিলেন শকুনি, আলোকের গতিকেও হার মানায় সেই ক্ষিপ্রতাআর দান ফেলার আগেই তিনি বলছিলেন- এই জিতলাম এই জিতলাম! আর তাঁর গলার পাশাপাশি আর একটি আশায় উদগ্রীব গলা শুনতে পাচ্ছিল পুরমিত্র। ‘আমাদের জয় হল তো? আমাদের জয় হল তো?’ পুরমিত্র ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছিল সিংহাসনে বসে অন্ধ রাজা উত্তেজনায় সিংহাসনের হাতল চেপে ধরছেনও তখনই বুঝতে পেরেছিল, এটা নিছক খেলা নয়ফলাফলের ওপর হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কিন্তু সেসব দেখার সময় ওর ছিল না। ও শুধু দেখছিল জাদুকরের মতো শকুনিকে। কিন্তু হতচকিত হবার তখনও বাকি ছিল। শকুনি ক্রমাগত জিতে চললেন, হারতে হারতে যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রৌপদী ছাড়া আর কিছু রইল না। আর যুধিষ্ঠির অগ্রপশ্চাত না ভেবে সেই নারীশ্রেষ্ঠা দ্রৌপদীকেই পণ রাখলেন আর চোখের পলক ফেলবার আগেই শকুনির উল্লাস শোনা গেল ‘এই জিতলাম।’

অত বড় সভায় কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল। কেউ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সত্যিই দ্রৌপদীকে দেখা যাবে ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল সবাই। পুরমিত্র টের পাচ্ছিল নাভির নীচের চাঞ্চল্য। বিবিংশতি উত্তেজনায় তার হাত চেপে ধরল। সভাস্থলের সবারই এক অবস্থা। কামনার সাতরং খেলে যাচ্ছে সবার মুখে চোখে। তারপর, তারপর যে কী ঘটল সব গুলিয়ে গেছে তার।

দ্রৌপদীকে নিয়ে আসতে যে প্রতিহারীকে পাঠান হল তাকে কী এক কূট প্রশ্ন করে পাঠালেন তিনি। যুধিষ্ঠির কি পরাজিত অবস্থায় তাঁকে পণ রেখেছেন? এর মাথামুণ্ডু অবশ্য কিছু বুঝল না পুরমিত্র, স্বামী হচ্ছেন স্বামী, যে কোনও অবস্থায় স্ত্রীর ওপর তাঁর অধিকার থাকবেপুরমিত্র তো পুরমিত্র, সভার এত বিজ্ঞজন, কেউ এ প্রশ্ন বুঝেছে বলে মনে হল নাতাঁরা একইরকম শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

তবে দ্রৌপদীর এই কথায় পুরমিত্র বুঝতে পারল, তিনি অন্দরে থেকেও এখানে কী হচ্ছে তার পুরো সংবাদ পাচ্ছেন। কর্ণ অসহিষ্ণু গলায় দুঃশাসনকে বললেন, ‘এ কোনও কাজের নয়, তুমি নিজে গিয়ে তাঁকে নিয়ে এস।’ সভায় একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল, দ্রৌপদী নাকি রজস্বলা, একবস্ত্রা। পুরমিত্ররও অস্বস্তি হচ্ছিলকিন্তু আর সবার মতোই দ্রৌপদীকে দেখার কৌতূহল বেশি বলবান ছিল। দুঃশাসন যখন সেই অগ্নিসম্ভূতাকে টানতে টানতে সভায় নিয়ে এলেন, তখন সে উত্তেজনায় প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এত রূপ কোন মানুষীর হতে পারে! পাশ থেকে সত্যব্রত জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট চেটে ওকে চাপা গলায় বলল ‘গ্রাম্যতা কোর না পুরমিত্র। ধৈর্য ধরলে ওই শরীর নগ্ন দেখতে পাবে। ওই দেখ দুঃশাসন বস্ত্র আকর্ষণ করছে। দুর্যোধন একে উরূতে বসতে বলে কী এমন অন্যায় করেছে? আমারই তো…’

পুরমিত্র সেসব যেন শুনতেই পাচ্ছিল না। দর্শক যেমন মঞ্চের যবনিকা ওঠার অপেক্ষায় থাকে, সে তেমনি রেশমবস্ত্রের নীচের লোভনীয় শরীর দেখার অপেক্ষা করছিল। দুঃশাসনের টান প্রবল হচ্ছিল। দ্রৌপদী আর্তনাদ করে উঠলেন ‘ হা কৃষ্ণ, সখা, রক্ষা কর।’ অমনি সভাস্থলে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। চোখের পলক ফেলার আগেই দ্রৌপদীর চারদিকে পীত, শ্বেত, রক্তিম, নানা রঙের বস্ত্রের ঢেউ খেলে গেলকারা যেন সেই বস্ত্রে তাঁকে পাকে পাকে জড়িয়ে দিচ্ছেদুঃশাসন টেনে টেনে ক্লান্ত, তবু বস্ত্র অফুরান। সভাস্থলের প্রায় সকলে চোখ বুজে করজোড়ে সেই অঘটনঘটনপটু কৃষ্ণকে স্মরণ করছিল। 

 

আরও পড়ুন: তিলোত্তমা মজুমদারের ছোটগল্প: গৃহবধূর যে কোনও তিনটি দিন

 

কিন্তু পুরমিত্র চোখ বোজেনিঅলোকসামান্যা নারীশরীর দেখার বাসনা তার স্নায়ুগুলি টানটান করে রেখেছিল। তাই সে দেখতে পেয়েছিল, কৃষ্ণ বা কোনও অলৌকিক পুরুষ নন, সামান্যা কয়েকজন নারী, যারা হয়তো অন্তঃপুরে রাজমহিষীর সহায়িকা, তাঁর বেশভূষা, অলংকার, কেশবিন্যাসে সাহায্য করে, সেই নারীরা এসে দাঁড়িয়েছে বস্ত্রসম্ভার নিয়ে, দুঃশাসন যত খুলে নেবার চেষ্টা করছে, তারা তার চেয়ে দ্রুত গতিতে ঢেকে দিচ্ছে দ্রুপদ কন্যাকে। সমস্ত ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটছে, তার সঙ্গে যুক্ত চোখ ঝলসানো অফুরান বস্ত্রসম্ভার, আর সভাস্থলের অপ্রতুল আলো– যে সমস্ত ঘটনাটি অলৌকিক বলে ভ্রম হচ্ছে, বস্ত্র সম্ভারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্ষীণতনু রমণীদের প্রায় দেখাই যাচ্ছে না।

কোথায় যেন শঙ্খধ্বনি হল, কারা যেন স্মরণ করল ‘জয় বাসুদেব।’ লজ্জা রক্ষা পাওয়া দ্রৌপদী স্বামীদের মুক্ত করে সভাগৃহ থেকে চলে গেলেন বিজয়িনীর পদক্ষেপে। কিন্তু তবু শেষরক্ষা তো হল না। আবার ডাকা হল পাণ্ডবদের। আবার হারানো হল, বাধ্য করা হল বনবাসে যেতে। ওঁরা কেমনভাবে চলে গেলেন, সেটা দেখার জন্যে অবশ্য অপেক্ষা করেনি পুরমিত্র। ক্লান্ত, ক্লান্ত সে বড়। ক্লান্তি অপনোদনের জন্যেই তো সে কোকিলার কাছে এসেছে। কিন্তু এই কুহকিনী আবার কী খেলা খেলছে তার সঙ্গে? এইজন্যেই নারীকে বিশ্বাস করতে নেই। এদের মতো বহুগামিনীদের তো নয়ই।

কোকিলা তার খুব নিকটে এসে দাঁড়াল। কাঁচুলির নিচে কী একটা বনজ সুগন্ধ লাগায় সে, তার গন্ধ পুরমিত্রর নাকে এসে লাগছিল। স্নায়ু অবশ হয়ে আসছিল, সে হাত বাড়িয়ে কোকিলাকে কাছে টানতে গেল, অমনি কোকিলা তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। হিসহিস করে বলল,

‘তুমি যেমন আমন্ত্রণ পেয়েছিলে শঠ শৌণ্ডিক শকুনির কাছ থেকে, তেমনি আমিও পেয়েছিলাম এক যুগপুরুষের কাছ থেকে। তিনি নিজে থাকতে পারবেন না বলে আমাদের সংবাদ দিয়েছিলেন। আমাদের মতো সমাজের বাইরের নষ্টা নারীদের। যারা প্রতিরাতে দু’মুষ্টি অন্নের জন্য নিজেদের লজ্জা বিক্রয় করে, দ্রৌপদীর সম্ভ্রমরক্ষার দায়িত্ব ছিল আজ তাদের। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? যে দেশে ক্রীতদাসেরও অধিকার থাকে স্ত্রীকে বিলিয়ে দেবার, সেই দেশের কী হবে বলতে পার পুরমিত্র? তুমি লিখে রাখ পুরমিত্র, যারা আজ রাজ্য ছেড়ে চলে গেল বনপথ দিয়ে, আর যারা ফিরে আসবে ১৩ বছর পর, তারা এক মানুষ নয়। সে বড় ভয়ংকর দিন আসছে। এই জম্বুদ্বীপে আর কোনও পুরুষ থাকবে না। শ্মশান! শ্মশান! নাহ এ খেলা আর কোনওদিন এই গৃহে হবে না। কে বলতে পারে…’

কথাটা শেষ করে না কোকিলা। আর তাই আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে পুরমিত্র। কোকিলা করুণা করেই তাকে আর শয্যা থেকে তোলে না, কিন্তু নিজে এই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়সে আজ ভ্রমরার কাছে শোবে। যাবার আগে সে ফুঁ দিয়ে দীপটি নিভিয়ে দিয়ে যায়। সেই অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে আরও আরও অন্ধকারের প্রতীক্ষা করে পুরমিত্র।

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com