banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: কেয়ারিং

সৌরভ হাওলাদার

সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩

Story Caring Sourav Haoladar
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

ম্যাকেঞ্জি রিপোর্টের প্রিন্টটা হাতে নেয় অর্ক। সেখানে আগামী দিনের ভবিষ্যতবাণী সম্বলিত নানাবিধ সমীক্ষার ফলাফল, গ্রাফের ওঠানামা। কোভিডোত্তর ঘুরে দাঁড়ানো। দাঁড়াতে দাঁড়াতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা! বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য-আকাশে আবার কালো ছায়া। তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী, টাকার দাম পড়ছে। অবশ্য ডলারের দাম বাড়ায় অর্কদের সাময়িক আনন্দ। একই পরিমাণ রফতানি করে প্রাপ্ত ডলার ভাঙিয়ে, এখন অনেক বেশি টাকা ঘরে তুলতে পারছে। কিন্তু এ সুখের ঘরে কাঁটা হয়ে আছে কাঁচামাল আমদানির খরচ।

বোর্ড মিটিং-এ জবাবদিহি করার জন্য পড়াশুনা দরকার। চিফ ফিনান্স অফিসারের সাথে বসতে হবে। আগামী দুই কোয়ার্টারের সম্ভাব্য বাণিজ্য নিয়ে সেলস হেড-এর দেখানো অংকগুলোতে অনেকটা জল মেশানো আছে। অর্কর বোঝা দরকার, ঠিক কতটা রোজগার ‘সত্যি’ হতে পারে? হাতে আর দু’দিন রয়েছে, তারপর কোম্পানির সমস্ত অংশীদারদের সম্মুখীন হতে হবে। সেখানে কেউ ওকে রেয়াত করে না। চেয়ারম্যান জেমস গ্রান্ট তেমন চাপ দেয় না। কিন্তু ভারতীয় ডিরেক্টর কৃষ্ণমূর্তি ছেড়ে কথা বলে না। সাড়ে সাত শতাংশ শেয়ার নিয়ে ওঁর চিমটি দিয়ে কথা, অর্কর বড্ড গায়ে লাগে। অল্প বয়সে ম্যনেজিং ডিরেক্টরের চেয়ারে বসতে, ঠিক কতটা ছ্যাঁকা সহ্য করতে হয়, বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না।

আরও পড়ুন- গল্প: হোটেল রজার্স স্টে

পিএ সুস্মিতা আগেই বেরিয়ে গেছে। আজ ওর স্বামী কলকাতায় ফিরছে। ল্যাপটপ সমেত প্রিন্ট আউটগুলো ব্যাগে ভরে অর্ক রিসেপশানে জানিয়ে দেয়, গাড়ি প্রস্তুত করতে। কিছুক্ষণ পরে গাড়ির চালক খলিল এসে ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। অর্ক লিফ্টে চড়ে নামতে থাকে। পাঁচতলায় ওদের পার্কিং। লিফ্ট থামতে লক্ষ করে একটি অল্পবয়সী মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে। মেয়েটির পরনে উজ্জ্বল হলুদ জামা, একটি পরিচিত খাবার পৌঁছানো কোম্পানির কর্মীদের ইউনিফর্ম। ওর কালো সুঠাম শরীরের ওপর যেন আগুনের মতো জ্বলছে। অর্ক সেদিকে তাকিয়ে বলে ফেলে, “কিছু বলবেন?”

মেয়েটি চমকে ওঠে, “না স্যার, সে কিছু না বটে।”

ঝাঁ চকচকে বহুতল কর্পোরেট কোম্পানির আবহে ধুলোমাখা মাটির পৃথিবীর বুনোফুলের ঘ্রাণ আসে। অর্ক বলে, “কিছু না তো, কী দেখছেন?”

মেয়েটি হেসে ফেলে, “মনহে হঁছে, তুমহার খিদা পাঁয়েছে।”

“মানে?”

মেয়েটি উত্তর করে না। শুধু হাসতে থাকে। কালো মুখের ওপর ঝকঝকে সাদা দাঁত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লিফ্ট বন্ধ হওয়ার জন্য বিপ বিপ করতে থাকে। নিজের পার্কিং ফ্লোরে নেমে পড়ে অর্ক। দরজা জোড়া লাগার আগে আরেকবার বুনোফুলকে দেখার চেষ্টা করে।

Image 1

খলিল এসি চালু করে রেখেছে। বিএমডব্লিউ-র রুপোলি এক্স ফোর, রাজহাঁসের মতো দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকে শরীর ছেড়ে দেয় অর্ক। হালকা পারফিউমের সঙ্গে ক্লিফ রিচার্ড, অন্য পৃথিবীতে নিয়ে যায়। গাড়ি গড়াতে শুরু করে। মসৃণ চলনে কোথাও কোনও হোঁচট নেই। গোধূলি আলোয় টান করা দিঘির জলে মরালের ভেসে চলার মতো। ফোন বাজতে থাকে। আবহ ছিঁড়ে আবার ফোনের জগতে প্রবেশ করতে ইচ্ছে করে না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, সেলস হেড অলোকেশ শেঠি। এতক্ষণে শয়তানটার ঘুম ভেঙেছে। ফোন কানে দিতেই, নরম গলায় এলিয়ে পড়া সুরে বলে, “বস, আমায় খুঁজছিলে?”

অর্ক ফিরে আসে— গানের সুর, সুগন্ধির প্রলেপ, বিএমডব্লিউ-এর সাঁতার থেকে ফিরে আসে, “শেঠি, তুমি যে প্রোজেকশানটা দিয়েছ, তার ভেতর কতটা মোস্ট লাইকলি? আর ফিগারগুলোর বেস অ্যানালিসিসটাও লাগবে। কোন রিজিয়নে কতটা, জানা দরকার।”

“তুমি চিন্তা কোরো না বস। আমি আছি তো। ওটার ওপরেই কাজ করছি। আর একটা দিন দাও, তোমায় সবটা ডিটেলে জানিয়ে দেব।”

“আমাকেও স্টাডি করার সময় দিও। একেবারে বোর্ড-এর ঘাড়ে ঘাড়ে দিলে মুশকিল।”

“বোর্ড তো দুদিন পরে। আমি কালই দিয়ে দেব। তুমি চিন্তাই কোরো না, কেমন?”

লোকটার এই অতি মিষ্টি মনোভাবটাই অর্কর অসহ্য লাগে। নিশ্চয়ই অন্য কোনও অভিসন্ধিতে অলোকেশ এতটা মাখন লাগিয়ে কথা বলছে! ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে।

Image 2

একটা এলোমেলো রাস্তা। অর্ক চিনতে চায়, অথচ একটুও বুঝতে পারে না। দোকানের সাইন বোর্ডগুলো অচেনা লাগে। আগে এই বোর্ডগুলোতে ঠিকানা লেখা থাকত। সেই ঠিকানা পড়ে বহু জায়গাতেই পৌঁছে যেত। এখনকার মতো গুগল ম্যাপ ছিল না। প্রতিটা জায়গার আলাদা চরিত্র ছিল, সাইন বোর্ডগুলো ছিল আলাদা। এখন সব একরকম লাগে, চিনতে পারে না। সামান্য দূরে একটা রেল স্টেশন। বেশ বড় স্টেশন, ইটালির মিলানের মতো। সেবার ক্লায়েন্ট মিটিং-এ মিলানে গিয়েছিল অর্ক। কিন্তু আজ কোনও ট্রেন ধরতে পারছে না সে। কাছাকাছি যেতেই ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। ট্রেন না ধরলে অর্ক পৌঁছবে কী করে? একবার এই প্ল্যাটফর্ম একবার অন্য প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে হচ্ছে। এত মানুষ চারিদিকে! প্রতিবার তাদের ঠেলে ঠেলে এগোতে হচ্ছে। তখনই খলিলের গলা শোনা যায়। যেন জলের উপর থেকে কথা বলছে, আর অর্ক রয়েছে সুইমিংপুলের অনেক নীচে।

“স্যার, বাড়ি এসে গেছে।” 

দু-তিনবারের ডাকে হুঁশ ফেরে অর্কর। তাকিয়ে দেখে, বোঝার চেষ্টা করে। আবাসনের ভেতর ওদের টাওয়ারের লিফট লবির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। অর্ক নেমে আসে, একটু যেন টলমলে অবস্থা।

নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে সোজা বাথরুমে চলে যায়। স্ত্রী মণিদীপা স্কুলের খাতা দেখছিল। একবার আলগোছে অর্ককে দেখে আবার নিজের কাজে মন দেয়। একটু পরেই খলিল আসে, গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গাতে পার্ক করে, চাবি আর অর্কর ব্যাগ দিয়ে যায়। মণিদীপাকে দেখে হেসে বলে, “স্যার বোধহয় খুব ক্লান্ত।”

মণিদীপা প্রত্যুত্তরে একটু হাসে, “হ্যাঁ, রাত তো কম হল না।”

Image 3

শহর কলকাতার দামি অঞ্চলের নামী আবাসনের উনিশ তলায় বাইরের কোলাহল স্পর্শ করে না। অর্কদের প্রায় চার হাজার স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট। বসার ঘরে মহার্ঘ্য আসবাবের সঙ্গে বইয়ের তাকে থরেথরে সাজানো বিশ্ব সাহিত্য। মণিদীপার সংগ্রহ। ঘরে ঢুকলেই রুচি আর আভিজাত্যের ছোঁয়া বোঝা যায়। বাথরুম থেকে স্নান সেরে, ঘরের পোশাক পরে বাইরে আসে অর্ক। হাতে সেই রিপোর্টের প্রিন্ট আউট। 

মণিদীপা হাতের কাজ গুটিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে, “খেতে দিই?”

অর্ক দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে কাঁটা দশটার কাছে, “একটা ড্রিংক নিই? তারপর।”

“ও বাবা! সে তো এক ঘণ্টা!”

“একটু খেতে ইচ্ছে করছে। তুমিও এসো না!”

“না আমার হবে না। এখনও খাতা দেখা বাকি। তুমি নাও। আমি একটু সালাড  করে দিচ্ছি।”

এই বলে মণিদীপা কিচেনের দিকে চলে যায়। অর্ক গ্লাস, বরফ আর স্কচের বোতল নিয়ে বসে, হাতে রিপোর্টের কাগজগুলো।

মণিদীপা প্লেট সাজিয়ে ফ্রোজেন চিকেন সালাড নিয়ে আসে। 

অর্কর চোখে কৃতজ্ঞতা।

সোফার একদিকে খাতা নিয়ে বসে মণিদীপা।

অর্কদের প্রায় চার হাজার স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট। বসার ঘরে মহার্ঘ্য আসবাবের সঙ্গে বইয়ের তাকে থরেথরে সাজানো বিশ্ব সাহিত্য। মণিদীপার সংগ্রহ। ঘরে ঢুকলেই রুচি আর আভিজাত্যের ছোঁয়া বোঝা যায়। বাথরুম থেকে স্নান সেরে, ঘরের পোশাক পরে বাইরে আসে অর্ক। হাতে সেই রিপোর্টের প্রিন্ট আউট। 

যত্ন করে গ্লাস বানিয়ে, আলতো চুমুক দেয় অর্ক। সারাদিনের চিন্তার পাথর যেন ধুয়ে যাচ্ছে। মণিদীপা বলে, “খলিল বলল, তোমায় নাকি আজ খুব ক্লান্ত লাগছে।”

অর্ক অবাক হয়ে বলে, “খলিল বলল?” তারপর একটু থেমে আরেক চুমুক দেয়, “আজ গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বেশ গভীর ঘুম। বাড়ি এসে গেছে, বুঝতেই পারিনি। বোধহয়, আমাকে কয়েকবার ডাকতে হয়েছে।” 

মণিদীপা বলে, “বোর্ড মিটিং কবে?”

অর্ক মণিদীপার দিকে তাকিয়ে থাকে। কীভাবে যেন ও সবসময় টের পেয়ে যায়।  “এই তো আর দু-দিন পরেই।”

“প্রিপারেশন হয়ে গেছে?”

“সব কী হয়? চলছে। আজ অফিস থেকে ফিরছি, লিফটে একজন বলল, আমায় নাকি ক্ষুধার্ত লাগছে। কী জানি?”

খাতা গুটিয়ে মণিদীপা বলে, “বেশ তো, ডিনার দিয়ে দিচ্ছি। চলে এস।”

Image 4

দুটো দিন পার হয়ে যায় ঝড়ের গতিতে। অর্ক প্রতিবারের মতো এবারেও বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের আস্থা অর্জন করতে পারে। যদিও এই বছরের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে নিজে যথেষ্ট সন্দিহান। আপাতত বোর্ড মিটিং-এর ধকল পার করে এখন সত্যি হালকা লাগছে। নিজের চেম্বারে এসে সুস্মিতাকে ডেকে পাঠায়। আজ যেন ওকে একটু বেশিই আকর্ষক লাগছে। অর্ক বলে, “আজ স্পেশাল নাকি?”

“কেন?”

“ইউ লুক স্টানিং টুডে।”

সুস্মিতা হেসে ফেলে, “এ কদিন দেখার সুযোগ পাননি।”

অর্ক সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলে, “শুক্রবারের ফিজিক্যাল মিটিংগুলো ক্যানসেল করে দিও।”

“কোথাও বেড়াতে যাবেন?” 

“হুঁ”

সুস্মিতা অবাক হয় না। ও জানে, কটা দিন অর্ক খুবই অশান্তিতে ছিল। মৃদু স্বরে বলে, “কোথায় যেতে চান?”

“খুব দূরে নয়, আবার ভিড়ে ঠাঁসা কোনও পপুলার ডেস্টিনেশনও নয়।”

“পুরুলিয়া যাবেন?”

“পুরুলিয়া? ভালো?”

“আমার হাজবেন্ডের কয়েকজন কলিগ ঘুরে এসেছেন। শুনেছি বেশ ভালো, মানে আপনি যেমন চাইছেন, নির্জন।”

“এখন গরম হবে না?”

“এখনও তো বর্ষা চলছে। মনে হয় না গরম হবে।”

“বেশ! তুমি হোটেল ঠিক করে, বুক করে দাও। শুক্রবার যাব আর রবিবার ফিরব।”

হাত পা ছড়িয়ে টান করে অর্ক। 

সুস্মিতা বলে “আমার কিন্তু হবে না।” 

অর্ক হতাশ হয়ে তাকায়, “সে কী! কেন?”

“বললাম না! সঞ্জয় এসেছে।”

“বৌকে আগলে রেখেছে?”

“কেন, আপনি রাখেন না?”

“জানি না।” অর্ক চুপ করে যায়, তারপর বলে, “মণিদীপার একাডেমিক চর্চা ওকে একটা সিউডো ইন্টেলেকচ্যুয়াল ওয়ার্ল্ডে কেজ করে রেখেছে। আমার ওয়ভলেংথের বাইরে।”

“ওটা আপনি ভাবেন। আপনি কি কোনও অংশে কম ইন্টেলেকচ্যুয়াল?”

“এটা কি প্রশংসা, না সমালোচনা?”

সুস্মিতা হাত তুলে চুলের গার্ডার ঠিক করতে করতে বলে, “আপনি যেভাবে নেবেন। চলুন এবার বেরোনো যাক।”

সুস্মিতার শরীরী ভাষায় অর্ক অবশ হতে থাকে, “বেশ উইকেন্ডে না যাও, আজ তো কিছুটা কোম্পানি দিতে পারো?”

Image 5

পাঁচতারা হোটেলের পুলসাইড-এর একটা টেবিলে দুজনে এসে বসে। ওয়েটারের আপ্যায়নের বহর দেখে বোঝাই যাচ্ছে এখানে ওরা পরিচিত মুখ। অর্ক স্কচ ডাবল অন দ্য রক, আর সুস্মিতা ফেবারিট রেড ওয়াইন নিয়ে, ল্যাপটপ খুলে বসে। যতই ঘনিষ্টতা দেখাক, সুস্মিতা জানে, দিনের শেষে অর্ক ওর বস।

অর্ক বলে, “কী ব্যাপার? আবার কাজ বার করলে?” 

সুস্মিতা হাসে, “বোর্ড মিটিং-এর এমওএম ড্রাফট করেছি, একবার দেখে দেবেন!”

“হ্যাঁ দেখেছি, ওটা আগে চেয়ারম্যান-এর পিএ অ্যাঞ্জেলাকে পাঠিও, যদি কিছু অলটার করতে হয়। তারপর সার্কুলেট করো।” 

“আপনার উইকেন্ড প্ল্যানও পাঠিয়ে দিলাম। ম্যাডামকে দেখিয়ে নেবেন।”

অর্ক স্কচ ডাবল অন দ্য রক, আর সুস্মিতা ফেবারিট রেড ওয়াইন নিয়ে, ল্যাপটপ খুলে বসে। যতই ঘনিষ্টতা দেখাক, সুস্মিতা জানে, দিনের শেষে অর্ক ওর বস।

কথা বলতে বলতে ওদের চোখ অন্যদিকে যায়। বাইরে হোটেলের বাগানে কোনও একটা সেমিনার হচ্ছে। কাচের ভিতর দিয়ে মণিদীপাকে দেখা যায়, সাদা দাড়ি সহ, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা একজন দীর্ঘদেহী মানুষের পাশে। সুস্মিতা লোকটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি চেনেন?”

“নাহ, কোনও সিনিয়র প্রফেসর হবেন। আই ডোন্ট বিলং টু দেয়ার সার্কল।”

“বেশ হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক, আর কেমন আগলে আগলে রেখেছেন!”

“আর আমি বুঝি আগলাই না?”

“অনেক মেয়েরা ফাদার্লি অ্যাফেকশন বেশি পছন্দ করে।”

“বাট আয়াম হার হাজব্যান্ড, নট ফাদার! ইজন্ট সো?”

সুস্মিতা হাসে, কোনও উত্তর করে না।

অর্ক দ্রুত গ্লাস শেষ করে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসে।

glasses-of-red-wine

মানভূম, এক ভিন্ন চরিত্রের ভূমি বৈচিত্র্য নিয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান। ঢেউ খেলানো প্রান্তরে দূরে দূরে তালগাছের সারি। আসন্ন ভাদ্রে প্রতিটি গাছ ফলবতী। মাটিতে পড়ে ফেটে গেছে অজস্র তাল। সে সব কুড়োনোর মতো কোনও জনমানুষ চোখে পড়ে না। জঙ্গল আছে ছাড়া ছাড়া। শাল, সেগুন, শিরিষ, পলাশ আরও অনেক। বিলম্বিত বর্ষার মেঘ রাস্তার ওপর সজল ছায়া টানিয়ে রেখেছে। হাইওয়ে থেকে নেমে, এখন গ্রামের রাস্তায় অর্কদের গাড়ি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আসনে বিয়ারের ক্যান হাতে অর্ক আর একটা খাতা কলম নিয়ে মণিদীপা। 

বহুদিন পর দুজনে একসঙ্গে। মণিদীপা ছোট মেয়ের মতো আবদার করে, “কত তাল! আমি নেব।”

খলিল গাড়ি দাঁড় করায়। অর্ক গাড়িতেই বসে থাকে। মণিদীপা রাস্তার থেকে নীচে নেমে পড়ে। কোনটা ভালো আছে, তুলে তুলে ফলগুলো দেখছে। খলিলকেও ডেকে নেয়। ম্যাডামের উৎসাহ দেখে খলিল বলে, “একগাছি দড়ি পেলে আমি গাছে উঠে তাল পেড়ে দিতে পারব।”

মণিদীপা হাসে, “থাক, আমার জন্য তোমার কোমর ভাঙতে হবে না। মাটিতে পড়ে থাকা তালগুলোও ভালো, একটু বেছে নিলেই হয়।”

দুজন মিলে ঝটপট পাঁচ ছটা পাকা তাল নিয়ে ডিকিতে ভরে।

খলিল গাড়ি দাঁড় করায়। অর্ক গাড়িতেই বসে থাকে। মণিদীপা রাস্তার থেকে নীচে নেমে পড়ে। কোনটা ভালো আছে, তুলে তুলে ফলগুলো দেখছে।

অর্ক বলে, “এতগুলো নিয়ে কী করবে? বাড়িতে লোক বলতে তো আমরা দুজন। ছেলেটা আসতে এখনও দুমাস বাকি।”

“কেন? বিলিয়ে দেব। ওরা সবাই কত কত দাম দিয়ে কেনে! এখানে কেউ নেওয়ারই নেই! আর ক্ষীর জ্বাল দিয়ে ফ্রিজে রেখে দেব, গোরা পুজোয় এসে খাবে।”

অন্য সময় হলে, অর্ক হয়তো প্রতিবাদ করত। আভিজাত্য ডিঙিয়ে, হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট তুলে ড্রাইভারের সাথে ছুটোছুটি করে, বহুজাতিক কোম্পানির এমডি-র বউকে তাল কুড়োতে দেখে কতটা সম্মানহানি হত, তার হিসেব করত। কিন্তু পাণ্ডববর্জিত প্রান্তরে, অকৃপণ প্রকৃতির মাঝখানে এসে, অনায়াসে পাগল হওয়া যায়! অর্ক বিয়ারে লম্বা চুমুক দেয়। 

রিসর্টে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

Image 6

পরদিন, সদ্য ভোর হয়েছে। ছোট ছোট টিলা গড়িয়ে জল নেমেছে, এক বিশাল জলাধার। মুরাডি বাঁধ। একরাশ রাঁজহাস আর মুরগিদের নিয়ে ছোট রিসর্ট। খুব বেশি বাহুল্য নেই, তবে যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু আছে। মণিদীপা রাজহাঁসের দলের কাছে চলে যায়। পাখিগুলো পালকের মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে এক পা গুটিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মণিদীপাকে দেখে গলা বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। একসাথে শাঁখ বাজানোর মতো ডাকে। একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। 

“ভয় পাবেন না, ম্যাডাম। ওরা ভাবছে আপনি খাবার দিতে এসেছেন।” 

কথা শুনে মণিদীপা ফিরে তাকায়। খলিল দাঁড়িয়ে।

“তুমি এত সকালে?”

“মোরগগুলো এমন ডাকছে, ঘুম ভেঙে গেল।”

“ওই জলের ধারে খুব সুন্দর। ঢোলকলমির ফুলে আলো হয়ে আছে।”

“স্যার ওঠেননি?”

“না, কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল।”

“বিশ্রামের জন্য এসেছেন, বিশ্রাম করুন।”

পাখিগুলো পালকের মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে এক পা গুটিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মণিদীপাকে দেখে গলা বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। একসাথে শাঁখ বাজানোর মতো ডাকে। একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। 

মণিদীপা একা একাই এগিয়ে যায়। এলিয়ে পড়া পলাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকালে, চোখ ঢেকে যায় শাল পিয়ালের পাতায়। ছোট ছোট পাহাড়ের চূড়ায় বর্ষার মেঘ জড়িয়ে আছে, যেন জলরঙে আঁকা পট। একটা দিকে কয়েকটা তাঁবু রয়েছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক তাঁবু, প্রতিটিতে ডিশ টিভির অ্যান্টেনা লাগানো। পলাশ গাছের গা বেয়ে মোটা মোটা লাল পিঁপড়ের লাইন। খলিল লক্ষ করে ছুটে আসে, “ম্যাডাম, সরে আসুন।”

পিঁপড়ে দেখে ছিটকে আসে মণিদীপা। 

খলিল একমনে ফোন ঘাঁটছে। মণিদীপা ধন্যবাদ জানায়, “ভাগ্যিস, তুমি দেখতে পেলে!”

খলিল কিছু বলে না, ব্যস্ত থাকে ফোন নিয়ে। মণিদীপা জিজ্ঞেস করে, “কী দেখছ?”

“ফেসবুক। কতগুলো ছবি পোস্ট করলাম। একটাও লাইক এল না।”

“এখন ক’টা বাজে দেখেছ?”

“ছটা বাজতে পাঁচ।”

“তুমি ভোর চারটেতে ছবি পোস্ট করবে, অত সকালে কে ছবি দেখবে?”

খলিল হাসে। যেন ভীষণ একটা সমস্যার সমাধান হল।

Image

অর্কর ঘুম ভাঙে সুস্মিতার ফোনে, “গুড মর্নিং বস। প্রপার্টিটা ভালো?”

“খারাপ নয়। তবে কাল রাত হয়ে গিয়েছিল, কিছু দেখার সুযোগ পাইনি।”

“ঠিক আছে, আপনি রিল্যাক্স করুন। কোনও অসুবিধা হলে জানাবেন।”

***

মুখ ধুয়ে স্নান সেরে রেস্তোঁরায় নেমে আসে সবাই। প্রাতরাশ শেষে অর্ক জিজ্ঞেস করে, “আজ কোথাও যাব?”

রিসর্ট ম্যানেজার তার বিশেষ কর্পোরেট অতিথির সেবা করতে সব সময়ই তৈরি। পরপর একগাদা নাম শুনিয়ে দেয়। অর্ক বলে, “অত সব নামে কাজ নেই। অফবিট কী আছে? যেখানে খুব কম মানুষই যায়।”

“আপনারা তেলকুপি যেতে পারেন।”

“তেলকুপি? কী আছে সেখানে?”

“প্রাচীন রাজাদের তৈরি মন্দির। আনুমানিক এগারোশো শতকে তৈরি। দামোদরের ওপর পাঞ্চেত বাঁধ দেওয়ার পর বহু অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এই মন্দিরগুলো তাদের মধ্যে আছে।”

“সে কী! সংরক্ষণ নেই?”

“না, সে সব কোথায়?”

অর্ক বেশ উৎসাহী হয়ে খলিলকে বলে, “তেলকুপি চল।” 

রিসর্ট ম্যানেজার তার বিশেষ কর্পোরেট অতিথির সেবা করতে সব সময়ই তৈরি। পরপর একগাদা নাম শুনিয়ে দেয়। অর্ক বলে, “অত সব নামে কাজ নেই। অফবিট কী আছে?

গুগলম্যাপ দেখে ওরা তেলকুপির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ডিভিসি-র বিদ্যুৎকেন্দ্র পার হয়ে গাড়ি গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়ে। রাস্তা ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে, এমন মানুষও চোখে পড়ে না। শেষমেশ একজনকে পাওয়া গেল, সে বলল ওরা ঠিকই এসেছে। এবার রাস্তা থেকে নেমে যেতে হবে। “ইটো আসলে নদীটোই বটে। তবে এখন জল নাই বলেই, মন্দির তক্কঅ যাঁতে পাঁইরবে।” 

শুনে খলিল আঁতকে ওঠে, “স্যার, এত ভারী গাড়ি নিয়ে নরম মাটিতে নামা ঠিক হবে না।”

গ্রামের লোকটি প্রবোধ দেয়, “ই পাথইরা মাটি। কাদা নাই। অল্প আগেই গাড়ি গেইলছে।” 

অর্ক এবার গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা রাস্তা সরজমিনে দেখে আসে। রাস্তা বলে কিছু নেই, তবে গাড়ির চাকার দাগে ঘাসপাতা গজায়নি। একটু আগে গাড়ি যাওয়ার চিহ্নও রয়েছে। খলিলকে বলে, “গাড়ির দাগ রয়েছে। তুমি আস্তে আস্তে নামতে পারো।”

মণিদীপা জিজ্ঞেস করে, “এখান থেকে কতটা? হেঁটে যাওয়া যাবে না?”

লোকটি তখনও দাঁড়িয়েছিল, “উটা পারবে নাই। দমে দূর। অখন জল নাই। নাইতো আমরাই লৌকা লিয়ে পঁউছাইন দি। এতটা আসেছো, মন্দির ট দেখে আসো।”

Panchet_Dam_(DVC)
ডিভিসি-র বিদ্যুৎকেন্দ্র পার হয়ে গাড়ি গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়ে

খলিল ধীরে ধীরে গাড়ি নামায়। চারিদিকে মানুষ সমান ঘাসজঙ্গল ভেদ করে, একটু একটু করে এগোতে থাকে।

কিলোমিটার খানেক এইভাবে এগিয়ে, থেমে যেতে হয়। এক দঙ্গল মোষ সেখানে দাঁড়িয়ে। অর্ক নেমে পড়ে। নীচে বেশ কাদা। 

খলিল এবার হতোদ্যম হয়, “আমি আর গাড়ি এগোতে চাই না। চাকা ফেঁসে গেলে বের করতে পারব না।”

অর্ক মণিদীপার দিকে তাকায়, “তুমি?”

“না গো, মোষগুলো দেখে ভয় লাগছে।”

অর্ক আর কথা বাড়ায় না। মোষদের পাশ দিয়ে এগোতে থাকে। কাদামাটি হলেও পা আটকে যায় না। গ্রামের ছেলেটি ঠিকই বলেছিল, এখানে পাথুরে মাটি। একটু যে ভয় করছে না, তা নয়। বড় বড় ঘাসের ওপাশে ঠিক কী আছে বুঝতে পারছে না। যতটা সম্ভব পা জোরে জোরে মাটিতে ফেলছে, পায়ের তলাতেও সাপখোপ কী রয়েছে, জানে না।

এভাবে কিছুটা চলার পর হঠাৎই ঘাসের জঙ্গল শেষ হয়ে যায়। আর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে খোলা প্রান্তর। সেই প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে জলস্রোত বয়ে চলেছে— দামোদর। আর তার মাঝখানে জলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক নির্জন একাকী রেখদেউল। অর্ক অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কে বা কারা কত যত্ন করে একসময় এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। দেবতা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার পুজো হত নিয়মিত। আজ সময়ের খেলায় মন্দির প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত। জলের জন্য আর কাছে পৌঁছতে পারে না। একটু দূর থেকে দুচোখ ভরে দেখে আর মোবাইলে ছবি তুলতে থাকে। ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল। এক ছুটে কোথাও গিয়ে যে লুকোবে তেমন কোনও আশ্রয় ধারেকাছে নেই। ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেরার পথ ধরতে চায় অর্ক। তাকিয়ে দেখে। ঠিক কোনদিক থেকে এসেছিল, বুঝতে পারছে না। আন্দাজে ঘাস জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ে। খুঁজতে থাকে নিজের ফেলে আসা পায়ের ছাপ। কিন্তু চেনা যায় না। ঘাসে কাদায় আর বৃষ্টিতে সেসব মিলেমিশে গেছে। অর্ক একবার ফোন বের করে খলিলকে কল করতে চায়, দেখে এখানে ফোনের টাওয়ার নেই। থাকবেই বা কী করে! ও তো নদীখাতের মাঝামাঝি রয়েছে। চারিদিকে প্রকৃতি ছাড়া আর কোনও প্রাণস্পন্দন নেই। অর্ক যেন নিজেকেও এই ঘাস, কাদা, জল, মাটি আর পুরনো হয়ে যাওয়া পাথুরে মন্দিরের একজন ভাবতে থাকে। আদি নেই, অন্ত নেই। ভবিষ্যৎ বা অতীত কিছুই নেই। এক অবসম্ভাবী বর্তমানের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ কাউকে খুঁজে না পেলেও কিছু এসে যায় না। অর্কর হঠাৎই ভীষণ ভালো লাগে।

সেই প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে জলস্রোত বয়ে চলেছে— দামোদর। আর তার মাঝখানে জলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক নির্জন একাকী রেখদেউল। অর্ক অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কে বা কারা কত যত্ন করে একসময় এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। দেবতা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার পুজো হত নিয়মিত। আজ সময়ের খেলায় মন্দির প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত।

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে, মনে নেই। অর্ক মোষেদের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। এবারে ফেরার দিক চিনতে পারে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গাড়িটা দেখতে পায়। একটা ছাতা নিয়ে মণিদীপা বাইরে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। ভেজা অবস্থা দেখে তখুনি জামা ছাড়িয়ে দেয়। অর্ক খালি গায়ে গাড়িতে এসে বসে। খলিল গাড়ি স্টার্ট দেয়। 

পথে রঘুনাথপুরে একটা দোকানে ঢুকে মণিদীপা নতুন জামা কিনে দেয়।

Image 7

ফেরার পথে বৃষ্টি ধরে এসেছে, রাস্তার অনেক জায়গায় বেশ জল জমে আছে। আঁকাবাঁকা জলজঙ্গল পার হয়ে গাড়ি চলেছে। একটু দূরে রাস্তার ওপর অনেকটা জল জমে রয়েছে। একটা বাইক চড়ে দুজন আসছে, তারা অর্কদের গাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফাঁকা রাস্তায় খলিল মনের সুখে গাড়ি ছোটাচ্ছিল। জলের কাছে এসে গাড়ি ধীরে করতে পারে না। চাকা থেকে ফোয়ারার মতো জল ছিটকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাইক আরোহীদের সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায়। মণিদীপা “ইসসস” করে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাইকটা ওদের গাড়িটাকে ধরার জন্য ফিরে আসছে। মণিদীপা খলিলকে বলে, “গাড়ি সাইড করো। ওরা এলে ক্ষমা চেয়ে নেবে।”

খলিল রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাইকটা এসে যায়। লোকটি দৃশ্যত পুরো ভিজে গিয়েছে। ওরা আসতে খলিল হাত জড়ো করে বলে, “স্পিডে ছিলাম বলে থামাতে পারিনি।”  পিছনের সিট থেকে মণিদীপা বলে, “অনিচ্ছাকৃত ভুল, মাফ করে দিন। ইচ্ছা করে হলে, দাঁড়িয়ে থাকতাম না।”

মণিদীপার কথায় লোকটির রাগ অনেকটাই প্রশমিত হয়। অর্ক কোনও কথা বলে না। চুপ করে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ওর মনের মধ্যে সেই নির্জন মন্দিরটার ঘোর লেগে আছে। কেমন অভিমান নিয়ে একবুক নদীজলে দাঁড়িয়ে আছে, যেন অপেক্ষায় আছে, কবে সময় তাকে সম্পূর্ণভাবে কালের অতলে নিয়ে যাবে।

Submerged_Deul_of_Telkupi
অভিমান নিয়ে একবুক নদীজলে দাঁড়িয়ে আছে

রিসর্টে ফিরে আসতে না আসতেই অর্কর ফোন বেজে ওঠে, ওদিকে সুস্মিতার গলা, “সরি স্যার, এই সময় বিরক্ত করতে হল। চেয়ারম্যান একটা খবর পাঠিয়েছেন। এমওএম-এ একটা ইনপুট চেয়েছেন। ম্যকেঞ্জি রিপোর্টে, অয়েল এন গ্যাস ইন্ডাস্ট্রির ওপর এম্ফাসিস আছে। উনি জানতে চেয়েছেন, আমরা কীভাবে অ্যালাইন করব বলে ভেবেছি?”

“হুঁ, আমি করে দেব। আর কিছু?”

“না সে রকম নয়। হোটেল থেকে বলল, আপনারা বেরিয়েছিলেন। হাউ ডু ইউ এনজয়?”

“অ্যায়াম হ্যাপি! থ্যাঙ্কস।”

“হোয়াট অ্যাবাউট ম্যাম?”

“মাস্ট বি। মাঠে নেমে তাল কুড়োচ্ছে!”

“হোয়াট? তাল!”

“হ্যাঁ, এখানে প্রচুর তালগাছ। কেউ নেওয়ার নেই। মাস্ট বি ওয়াইল্ড তাল।”

“ওইরকম খালি জায়গায় আপনারা নেমেছেন?”

“আমি নামিনি। খলিল ছিল, ওর সাথে।”

“খলিল! কাম অন স্যর। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, ইফ আই সিম ক্রসিং লিমিট। ইউ মাস্ট কেয়ার দিস লেডি। সি ইজ জাস্ট ওয়ান্ডারফুল!”

“হু সেস, অ্যায়াম নট কেয়ারিং?”

“এনি ওয়েজ, এনজয় স্যার। কোনও অসুবিধা হলে জানাবেন।”

***

জলজঙ্গলে সন্ধে নামছে। অর্ক আবার ওর পছন্দের ড্রিংক নিয়ে বসেছে। মণিদীপা অনেকদিন পর আজ শাড়ি পরেছে। অর্কর ওকে আজ খুব ভালো লাগছে। মনের মধ্যে সুস্মিতার কথাটা ঘুরছে “ইউ মাস্ট কেয়ার দিস লেডি…” কেন বলল? ও কি কেয়ার নেয় না? কেয়ার না নিলে এইখানে বেড়াতে আসত? অর্ক রিসর্ট ম্যানেজারকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, “কাছাকাছি জুয়েলরি শপ আছে?”

ম্যানেজার লোকটি একটু অবাক হয়ে গেল, “জুয়েলরি! মানে গয়নার দোকান?”

“তানিষ্ক, পিসি, টিবিজি এই সব?”

“না স্যার! এই গ্রামের ভেতর এসব কোথায় পাবেন?

অর্ক আবার ওর পছন্দের ড্রিংক নিয়ে বসেছে। মণিদীপা অনেকদিন পর আজ শাড়ি পরেছে। অর্কর ওকে আজ খুব ভালো লাগছে। মনের মধ্যে সুস্মিতার কথাটা ঘুরছে “ইউ মাস্ট কেয়ার দিস লেডি…”

রিসর্টের ভেতর সুন্দর লন আছে। মণিদীপা সেখানে ঘুরছে। সন্ধের পরে পশ্চিম আকাশে এখনও আলোর চিহ্ন লেগে আছে। আর সেই আলো প্রতিফলিত হচ্ছে বাঁধের জলে। সব মিলিয়ে ভীষণ মন কেমন লাগে। মণিদীপা খেয়াল করে, একটু আড়ালে খলিল কার সঙ্গে ভিডিও কলে বেশ জোরে জোরে কথা বলছে। খলিল মণিদীপাকে দেখে একগাল হেসে ফেলে। ফোন ঘুরিয়ে দেখায়, “আমার ছেলে।” 

মণিদীপা দেখে, একটা নিষ্পাপ শিশু বাবার সাথে কথা বলে চলেছে।

“ও তাই বুঝি! বাঃ খুব সুন্দর। স্কুলে যাচ্ছে তো?”          

“এবারে যাবে। এই ক’দিন হল ওর মুসলমানী হয়েছে। এর পরেই যাবে।”

মণিদীপা ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বলে, “ঠিক আছে। পড়াশুনা যেন ঠিক হয়।” 

পিতা-পুত্রকে আলাপ করতে দিয়ে এগিয়ে যায় সে।

Woman with saree
মণিদীপা অনেকদিন পর আজ শাড়ি পরেছে

গয়নার দোকান পাওয়া যাবে না জেনে একটু হতাশ হয় অর্ক। খুব ইচ্ছে করছিল মণিদীপাকে কিছু একটা কিনে দেয়। কেয়ারিং প্রমাণ করা জরুরি হয়ে গেছে। 

ম্যানেজার ছেলেটি বলে, “আজ রাতে ক্যাম্প ফায়ার হবে। সঙ্গে আদিবাসী নাচ।”

“ছৌ নাচ?”

“সে নাচ নয়। এমনি নাচ। সেই যে সত্যজিতের ছবিতে আদিবাসীরা নাচল, তেমন।”

“ও বাবা! সত্যজিত রায়ের ছবির নাচ।”

“ওই রকম আর কী! আসলে শহরের গেস্টরা আদিবাসীদের সাথে নিজেরা নাচতে চায়, ছবি তোলে। ওই সিনেমাটার মতো। ছৌ নাচতে গেলে অনেক পরিশ্রম! সেটা পারবে না।”

অর্ক এসবে তেমন উৎসাহ পায় না। নিজের পানীয়তে মন দেয়।

কিছুক্ষণ পর, লনের এক পাশে অগ্নিকুণ্ড তৈরি হল। গেস্টরা তার চারধারে ঘিরে ঘিরে বসেছে। পাঁচজন মেয়ে আর তিনজন ছেলের একটা দল চলে এল। মেয়েগুলো সকলে লাল শাড়ি, মাথায় গোছা গোছা ফুল, আর একটা ঘটিতে কিছু ফুলপাতা দিয়ে মাথার ওপর রেখেছে। ছেলেগুলো কেউ মাদল কেউ ধামসা নিয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ওরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নাচ শুরু করল। দলের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা গান ধরল। মাদল আর ধামসার তালে জায়গাটা যেন দুলে উঠেছে। রিসর্টের বেয়ারারা অতিথিদের হাতে হাতে পানীয় পৌঁছে দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটায় অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে পড়ল। অর্ক লক্ষ করে মণিদীপা এসে নাচের দলের মেয়েদের সাথে দাঁড়ালো। চেষ্টা করছে পায়ে পা মেলাতে। মাদল ক্রমে দ্রুত লয়ে বাজছে, সেই সঙ্গে দুলছে মেয়েদের শরীরগুলো। আগুনের তাপে উষ্ণতা বাড়ছে। আশেপাশে অনেকের হাতেই গ্লাস ধরা রয়েছে। অর্ক একটু দূর থেকে তাকিয়ে আছে। একটা মেয়েকে যেন চেনা লাগল। সেই লিফটে দেখা মেয়েটির মতো, যে বলেছিল ‘ক্ষুধার্ত’ লাগছে। পরক্ষণেই ভাবে, সেই মেয়ে এখানে কী করে আসবে!

হঠাৎ অর্কর মনে হল একটা লোক একটু বেশি উৎসাহী হয়ে মণিদীপার কাছে এসে নাচবার চেষ্টা করছে। হাত ধরে পা মেলাতে চাইছে। মণিদীপা একটু আড়ষ্ট। এক পাশ থেকে সরে নাচের দলের অন্যদিকে চলে যায় সে। লোকটিকে দেখে মনে হয় আসক্ত হয়ে আছে। সেও এই দিক থেকে সরে আবার নাচের দলের অন্যদিকে যেতে চায়।

কিছুক্ষণ পর, লনের এক পাশে অগ্নিকুণ্ড তৈরি হল। গেস্টরা তার চারধারে ঘিরে ঘিরে বসেছে। পাঁচজন মেয়ে আর তিনজন ছেলের একটা দল চলে এল। মেয়েগুলো সকলে লাল শাড়ি, মাথায় গোছা গোছা ফুল, আর একটা ঘটিতে কিছু ফুলপাতা দিয়ে মাথার ওপর রেখেছে। ছেলেগুলো কেউ মাদল কেউ ধামসা নিয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ওরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নাচ শুরু করল। দলের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা গান ধরল। মাদল আর ধামসার তালে জায়গাটা যেন দুলে উঠেছে। 

অর্ক চোখ দিয়ে খলিলকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু কোথাও খলিলকে দেখতে পায় না। খলিল অন্য ড্রাইভারদের সঙ্গে নিয়ে মহুয়ার স্বাদ নিতে ব্যস্ত। 

ওদিকে লোকটি আবার অন্য পাশে দাঁড়িয়েছে। মাদল-বাজিয়ে একটি ছেলে এগিয়ে এসে মণিদীপাকে বলে, “উনি কি আপনার সাথে?”

মণিদীপা হাত নেড়ে জবাব দেয়, “একে চিনিই না।”

মাদল বাজাতে বাজাতে ছেলেটি লোকটির কাছে ঘেঁসে যায়। হিস হিস করে বলে, “কাইটে বাঁধের জলে ভাঁসাইন্দিব। মাছে খাঁইয়ে লিবেক।” 

হাতের গ্লাসটা রেখে অর্ক এগিয়ে আসে। লোকটার কলার টেনে ধরে। মণিদীপা গভীর চোখে অর্ক-র দিকে তাকিয়ে থাকে।  

ততক্ষণে রিসর্টের নিরাপত্তা রক্ষীরাও চলে এসেছে, লোকটিকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

মাদলের শব্দ, শাল সেগুন পলাশের পাতা পার করে পৌঁছে যায় বাঁধের জলের ওপারে, পাহাড়ের গায়ে। সেখানে আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ মেঘেদের আড়াল থেকে মুখ বার করেছে। জলের ওপর তার রুপোলি ঝলক যেন কোনও এক মায়াবি শহরের মায়া নিয়ে পথ চেয়ে আছে। অর্ক নিজের গ্লাসটা খুঁজে নিয়ে ‘অন দ্য রকস’-এ চুমুক দেয়। নতুন খুশিতে মণিদীপা পায়ে পা মিলিয়ে নেচেই চলেছে। দ্রিম দ্রিম দ্রিম। অর্কর সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে, সত্যিই ওর খুব খিদে পেয়েছে, ভালোবাসার খিদে। অর্ক যেন ওর হারিয়ে যাওয়া স্টেশনে পৌঁছতে পারে। এবারে আর ট্রেন ওকে ছেড়ে যাবে না। অপেক্ষা করছে কখন অর্ক সেই ট্রেনে উঠবে। মণিদীপাকে দুই বাহুর মধ্যে নেবে, দেখিয়ে দেবে কেমন করে কেয়ার করতে হয়, কেমন করে ভালবাসতে হয়, সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর মতো। 

*অলঙ্করণ: শুভ্রনীল ঘোষ

*ছবি সৌজন্য:  Wikipedia

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

6 Responses

  1. বেশ ভালো লেখা। আজকের জেট যুগে কেয়ারিং খেতাব টা আদায় করা যে কত কঠিন পরিশ্রমের ব্যাপার তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ব্যাপারটা ওর দেখে, তার দেখে পরিমাপ করে বলার মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com