আমাদের ছোটবেলায় পল্লির পূজা প্যান্ডেলের পাশে একটা লোক নানা রকম খেলনা নিয়ে দাঁড়াত। কাগজের চাকতি, হাওয়া পেলেই বনবন করে ঘোরে। তির-ধনুক, গদা, প্লাস্টিকের রোদচশমা আর মুখোশ। হনুমান-সিংহ-রাক্ষস-ভূত-কঙ্কাল আর একটা হাসি-হাসি মুখ। সেই প্রথম আলাপ মুখোশের সঙ্গে। মুখে পরে নিলেই আমি অন্য কেউ, হনুমান পরলেই ভেতর থেকে কে যেন হুপ হুপ করে ডেকে ওঠে, সিংহ পরলে অদৃশ্য কেশরে মাথা ঝাঁকানো। আর রাক্ষসে যেত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে। তখন চারপাশে দুটোই সম্পর্ক: খাদ্য ও খাদক। হাসি-হাসি মুখটা কোনও দিন পরে দেখিনি, ছোটবেলায় আবার আলাদা করে হাসিমুখের প্রয়োজন পড়ে নাকি?
৪০ বছর পেরিয়েছে, তবুও পথে বেরোলে আজও সেই লোকটাকে খুঁজি। সেই তো প্রথম আমার সাঁকো নাড়িয়ে দিয়েছিল। যুক্তি বলে, উনি তো মহান কেউ নন যে প্রচণ্ড ভরসায় দেওয়ালে লিখব “ফিরে আসবেন”, কালের নিয়মে ওঁর বয়স আজ ১০৫/১১০ হওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তির বাইরে যে একটা ভাবের জগত আছে, সেখানে কিন্তু লোকটার খোঁজ চলে। পুজোর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার পাশাপাশি তাঁকেও খুঁজি, হয়তো তিনি পাড়া বদলেছেন, হয়তো তিনি কোনও থিম প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, হয়তো সিনেমায় যেমন হয় তেমনই ঠিক তাঁর মতোই দেখতে তাঁর বড় কিংবা ছোট ছেলে…
আবার ফিরে আসি সেই মুখোশের গল্পে। একদম ছোটবেলায় দেখা মুখোশ আর তার মধ্যেকার গল্পগুলো ভেতরে বসে গেল। রপ্ত হল অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার খেলা। আর ক’বছর পরেই, ওই তেরো-চোদ্দোর আশেপাশে, সিগারেট তখন অন্য এক হাতছানি। মেয়ে দেখলে কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। তখন একটাই মন্ত্র, “আমি ভাল ছেলে।” আর একটাই অস্ত্র ‘মুখোশ’। সিগারেট খেয়ে বাড়ি ঢুকে ‘অবাক পৃথিবী’ মুখোশ পরে গুরুজনের সামনে শিশুসুলভ হয়ে থাকা। মামা যদিও বলেছে, “হ্যাঁ রে, লুকিয়ে ওসব ফুঁকিস টুকিস না তো?” শুনে এমন একটা লুক দিতাম যাতে বাকিরা কিছু না বললেও বুঝত, আমি এমন বখাটে নই, আমার মধ্যে শিশু ভোলানাথ আজও বাস করে। ওদিকে ভার্জিনিয়া চার্মস তখন উৎসবের সঙ্গী। তার পর হাত ধরাধরি করে এল দুজন। বিয়ারে চুমুক আর রিয়াকে চুমু। আবারও কেউ ধরতে পারে না। সৌজন্যে ‘ভাল ছেলে’ মুখোশ। দুর্গাপূজার মুখোশ কিন্তু লেপ্টে গেল।
বয়স আরও খানিক বাড়লে, দুর্গাপুজোর জের সামলাতেই আবার মুখোশ। কথায় আছে, “খানেকা ঠিকানা নহি, ন’ বজে নহানা।” বাড়িতে বাবার মুখ শুকনো, চাঁদা কিছুতেই বাড়ানো তো দূর, আগেরটাই দিতে পারবে কি না সন্দেহ, এ হেন বাড়ির ছেলে আমি বিকেলে বের হতাম গুলশন গ্রোভারের মুখোশ পরে, বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতে গিয়ে অদ্ভুত গলায় বলতাম, খোঁজ নিন দ্রব্যমূল্য কী হারে বেড়েছে, এক বছরে ( তখন বাম জমানায় দেওয়ালে দেওয়ালে এটাই লেখা থাকত )। বাড়তি টাকা ঠিক আদায় করে ফিরতাম। আবার, পুজো চলে এলে সেই আমি প্যান্ডেলে বসতাম ‘কেয়ামত সে’-র আমির মার্কা মুখোশ পরে, যদিও আমার মত শরীরময় আকালের সন্ধান আমিরের নয়, তাতে কী, মুখোশ তো শুধু মুখের, তাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ঝুপঝাপ প্রেমে পড়তাম। এক হাতে তালি বাজানোর ওই বিশ্বরেকর্ড আজও অক্ষত, সুখেন দাস-তাপস পাল-প্রসেনজিৎ থেকে লোকেশ ঘোষ সব মুখোশেই নিজের মুখ রেখেছি। ঠাকুর আসে ঠাকুর যায়, আবার আসে, তবু প্রেম আর আসে না। পাড়ায় ঠাকুর চলে গেলে “কবে যে কোথায় কী যে হল ভুল জীবন জুয়ায় হেরে গেলাম” গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরতাম, আবার পরের বছর “হয়তো আমাকে কারও মনে নেই আমি যে ছিলাম” গাইতে গাইতে আবার সে এসেছে ফিরিয়া।
ওই কোন এক মনীষী বিবাহ নিয়ে বলেছিলেন না, পৃথিবীতে বোকারা আছে বলেই বাজারে ফুটো কলসি বিক্রি হয়ে যায়… কালের নিয়মে সেই তথ্য মেনে আমার বাড়িও এক দিন তত্ত্ব এল, ক্যাসেটে বিসমিল্লা সাবধান করে দুঃখে কাঁদলেন। সেটা ছিল আগস্ট মাস, আর তার পর মাস গড়াতেই তুলো মেঘ। উপহার দেওয়ার তালিকায় জুড়ল নতুন কিছু নাম। তখন আমি ক্ষুদিরামের মুখোশে। জানি ফাঁসি হবে, কিন্তু হাসতে হাসতে দড়ি গলায় নেব। হার মানা হার যেন। অঙ্কে কোনও দিন ভাল নাম্বার পাইনি বলে কি অল্প আয়ে সংসার চালাতে পারি না? তেমনই যত কম নাম্বার পাই না কেন, জীবন বিজ্ঞানের সিলেবাস মেনে ঘরে অতিথিও এল। পুজোয় তাকে নানা রঙে সাজাতে মন চাইল।
এ-দিক ও-দিক থেকে বাঁচিয়ে সব জোগাড় করে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে ম্যাডক্স-এর ভিড়ে শত রাজা আর পরিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরাও ঘুগনি খাই। পরিবেশ-পরিস্থিতি তখন পিঠ চাপড়ে কবির মুখোশ পরায়, “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক।”
এখন দুর্গাপুজো মানে আমি সেই ‘আতঙ্ক’ ছবির মাস্টারমশাইয়ের মুখোশ পরি মনে মনে, আপনি কিছুই দেখেননি। নব্য প্রজন্ম এসে বেশি চাঁদা চায়, পরিবার-পরিজনও বেড়েছে। বিভিন্ন সিরিয়াল আর আমাজন মার্কা বেচু-বাবুদের কল্যাণে বউ এসে চাহিদা জানায়, গিচা শাড়ি চাই। আমি ভালমানুষ সন্তোষ দত্তের মুখোশ পরে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে দিই, মনে ঝড়। পুজোর পরের মাসের ইলেক্ট্রিক বিল? ইএমআই ? কাজের লোকজনকেও দ্বিগুণ মাইনে দিতে হয়। সব করি বেশ হাসি- হাসি মুখেই। না করেই বা উপায় কী… এই দুর্গাপূজাই তো শিখিয়েছে মুখোশের ব্যবহার।
তবু এত কিছুর পরেও এক সন্ধ্যায় মুখ আর মুখোশ একাকার হয়ে যায়। প্রায় দেউলিয়া আমিও, পাড়ার ঠাকুর যখন লরি চেপে বিসর্জনের জন্য বাড়ির গলি পেরিয়ে যায়, দুই হাত কপালে দিয়ে প্রণাম করে নিজের অজান্তেই বলে ফেলি, “আবার এসো মা।”…এখানেই হেরে যায় মুখোশ, এখানেই জিতে যায় শারদোৎসব।
" data-author-type="
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 18
" data-author-archived="
Warning: Undefined array key "archived" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 19
">
Warning: Undefined array key "id" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 39
-"
Warning: Undefined array key "archive" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 40
itemscope itemid="" itemtype="https://schema.org/Person" >
Warning: Undefined array key "img" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-avatar.php on line 4
Warning: Undefined array key "show_social_web" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-socialmedia.php on line 6
Warning: Undefined array key "show_social_mail" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-socialmedia.php on line 7
Warning: Undefined array key "show_social_phone" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-socialmedia.php on line 8
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 17
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 19
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 21
Warning: Undefined array key "archive" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 37
Warning: Undefined array key "name" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 41
Warning: Undefined array key "job" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 10
Warning: Undefined array key "job" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 15
Warning: Undefined array key "company" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 17
Warning: Undefined array key "phone" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 26
Warning: Undefined array key "mail" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 36
Warning: Undefined array key "web" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 46
Warning: Undefined array key "bio" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-bio.php on line 8