একদিন তাঁর কণ্ঠে জেগে উঠেছিল এই গান: ‘আমি আছি তোমার সভার দুয়ার-দেশে, / সময় হলেই বিদায় নেব কেঁদে হেসে.. ‘
১৯ সেপ্টেম্বরের সকালে সত্যিই তিনি বিদায় নিয়ে গেলেন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে।
পূর্বা দাম।
আর আশ্চর্য সমাপতন, সেদিনই তাঁর সংগীতগুরু সুচিত্রা মিত্রের জন্মদিন।
সুচিত্রা মিত্রের কাছেই পূর্বা শিখেছেন রবীন্দ্রনাথের গান সুদীর্ঘকাল। রবীন্দ্রসংগীত পূর্বার কাছে মনের আরাম, প্রাণের শান্তি।
অধুনা বাংলাদেশের পাবনায়, মামার বাড়িতে জন্ম পূর্বার। অবিশ্যি ওঁদের বাড়ি ছিল গারো পাহাড় অঞ্চলে। বাবা ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, মা প্রতিভা দেবী। পূর্বার এক মামা ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সুপরিচিত শিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, যিনি বটুকদা নামেই বিখ্যাত ছিলেন। বটুকদার ‘নবজীবনের গান ‘ স্মরণীয়। মায়ের রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা ছিল। ফলে বাড়িতে সংগীতের আবহেই মানুষ। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রসংগীত শুনেই বড়ো হয়েছেন পূর্বা। স্বাধীনতার আগে ওঁরা কলকাতায় চলে আসেন।
[the_ad id=”266918″]
পূর্বার কাকা, বিশিষ্ট মনোবিদ ডঃ তরুণচন্দ্র সিংহ রবীন্দ্রসংগীত খুব ভালোবাসতেন। তিনি পূর্বার গান শেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে তাঁকে নিয়ে যান সুচিত্রা মিত্রের কাছে। সুচিত্রাদি তখন থাকতেন সার্দান এভিনিউতে, বাড়িতে ছিল সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘গীতাঞ্জলি।’ আর দেশপ্রিয় পার্কের কাছে দ্বিজেন চৌধুরীর বাড়িতে ছিল ‘রবিতীর্থ।’ সেখানে সাগর সেন, সুশীল দে ভৌমিকরা গান শিখতেন। এই দুটি সংস্থা মিলে গেল কিছুদিন বাদে, নাম রইল ‘রবিতীর্থ।’ এস আর দাস রোডে একটি বাড়িতে ‘রবিতীর্থ ‘-র ক্লাস শুরু হয়। পূর্বা সেখানেই ছাত্রী হিসেবে যোগ দিলেন, তখন তাঁর কিশোরীবেলা।
তারপর দীর্ঘকাল সুচিত্রাদির নিবিড় তালিম পেয়েছেন। সুচিত্রাদির শিক্ষণ পদ্ধতি খুব ভালো লেগেছিল পূর্বার। পূর্বা নিজেই বলছেন এ সম্পর্কে: প্রথমেই বলতেন গানটা ভালো করে বারবার পড়তে। মুখস্ত করে ফেলতে হত গান। খাতা দেখে গান করা পছন্দ করতেন না সুচিত্রাদি। গানের মানে বুঝিয়ে দিতেন, বুঝিয়ে দিতেন ছন্দ। দেখিয়ে দিতেন কোথায় কী ভাবে দম নিতে হবে। গান অনুযায়ী লয় এবং স্কেল নির্বাচন — সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
[the_ad id=”266919″]
সুচিত্রাদি পূর্বাকে বলতেন, “দ্যাখ, কাউকে নকল করবি না। যে কোনও শিল্পীর একটা স্বাতন্ত্র্য জরুরি।” পূর্বা আজীবন সুচিত্রাদির এইসব নির্দেশ, অভিমতকে মান্যতা দিয়েছেন। ফলে সুচিত্রাদির গায়নের সার্থক উত্তরসূরি হয়েও একটা স্বকীয় গায়নশৈলী গড়ে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। সুচিত্রাদির গায়নের আমেজ থাকলেও তাঁর গান আলাদা। স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, পূর্বা গাইছেন।
এখানেই একজন শিল্পী পৃথক হয়ে যান। পূর্বার কন্ঠ সুরময়, উচ্চারণ স্পষ্ট, আবেগ সীমায়িত। পূর্বা গত শতকের ছয়ের দশকে রেকর্ড জগতে প্রবেশ করেন। তখন পূর্বা সিংহ নামে রেকর্ড বেরোয়। প্রথম দিককার এমনই একটি রেকর্ড: ‘ শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা।’ বিচিত্র পর্যায়ের এই গানে বুনে দেওয়া আছে জীবনের কিছু নিবিড় অনুভব। তাকে যথাযথ রূপ দেন পূর্বা। পরে অরুণ দামের সঙ্গে বিবাহের পর তাঁর অজস্র রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বেরোয় পূর্বা দাম নামে। সবকটির পরিচালনায় সুচিত্রা মিত্র। ছয়ের দশকে সন্তোষ সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যের এলপি রেকর্ডে অংশ নেন।
[the_ad id=”270084″]
পূর্বা রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান বেশি পছন্দ করতেন, বিভিন্ন রেকর্ডে তারই পরিচয়। তাঁর দীপ্র কণ্ঠে ও গায়নে উল্লেখযোগ্য: ‘হেথা যে গান গাইতে আসা’, ‘তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ’, ‘তোমায় যতনে রাখিব হে’, ‘তোমার কাছে শান্তি চাব না’, তোরা শুনিসনি কি শুনিসনি তার পায়ের ধ্বনি’ ইত্যাদি। পাশাপাশি প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র পর্যায়ের গানেও তিনি আকর্ষণীয়। বিশেষ করে মনে পড়ে ‘ আসা যাওয়ার পথের ধারে’, ‘আমার শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো’ বা ‘মম দুঃখের সাধন’ — বেশ আন্তরিক গায়ন।
প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর গানে যেভাবে ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাকে ছবির মতোই ফুটিয়ে তুলেছেন পূর্বা। ‘শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে’, ‘আজ শ্রাবনের পূর্ণিমাতে’, ‘আমারে যদি জাগালে আজি নাথ’ বা ‘ গহনরাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে’ প্রভৃতি বর্ষার গান তাঁর উজ্জ্বল কণ্ঠে, বোধে ছবি হয়েই ফোটে।
টপ্পাঙ্গের গান ততটা পছন্দ না করলেও করতেন না তা নয়। একবার এক অনুষ্ঠানে পূর্বার কণ্ঠে টপ্পাঙ্গের একটি গান শুনে এক প্রতিবেদক লিখলেন, টপ্পার অলংকরণ আর একটু বেশি হলে গানটি আরও খুলত। পরে আর এক অনুষ্ঠানে সেই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা পূর্বার, তাঁকে বললেন, “রবীন্দ্রনাথের গান নিধুবাবুর টপ্পা নয়, এখানে দানার ব্যবহারে খুব সংযত হওয়া দরকার। রবীন্দ্রনাথ এমনটাই চেয়েছিলেন।” প্রতিবেদক একদম চুপ! সত্যি কথা, গানের উপস্থাপনায় খুবই সংযম প্রয়োজন, দরকার ভারসাম্যের। এটাই অনেকে বোঝেন না। ফলে অতিরিক্ত অলংকরণে আবৃত করেন গানকে, গানের মূল মেজাজ, কথা যায় হারিয়ে। পূর্বা দামের মতো হাতেগোনা কিছু শিল্পীই এই ভারসাম্যের ব্যাপারটি বোঝেন, বুঝতেন।
রবীন্দ্রসদনে এবং অন্য নানা মঞ্চে পূর্বাদির অনেক অনুষ্ঠান শোনার অভিজ্ঞতা আছে। সবসময় তাঁকে অনন্য মনে হয়েছে। অনেক সময় দেখেছি, অনুষ্ঠানে নবীন শিল্পীরা কেমন গাইছেন তা মন দিয়ে শুনছেন। ভালো লাগলে বলছেন, আবার কোথাও ঠিক না লাগলে তাও বলছেন। এটা বিশেষ করে হত রবীন্দ্র সদনের রবীন্দ্র জন্মোৎসবের অনুষ্ঠানে।
[the_ad id=”270085″]
তাঁর স্নেহের পরশ পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পরিচয় হয়েছিল মায়া সেনের বাড়িতে। একবার মায়াদি লন্ডন গেলে মাস তিনেক মায়াদির ক্লাস নিয়েছিলেন পূর্বাদি। তখনই পরিচয়। তারপর দেশ পত্রিকার আলোচক রূপে আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। খুবই ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। শেষ দিকে শরীর নিয়ে খুবই কষ্ট পেলেন। কয়েকটা বছর একেবারে শয্যাশায়ী ছিলেন। অবশেষে ৮৫ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। রেখে গেলেন অজস্র মনে রাখার মতো গান। রবীন্দ্রনাথের গান।
এই গানের মধ্যে দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন, এখানেই একজন প্রকৃত শিল্পীর সার্থকতা। মৃত্যুতেই তাঁর পথ চলার শেষ নয়। শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!
স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l
5 Responses
সুসঙ্গ রাজকন্যা বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পূর্বা দামকে নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী এ লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি ।
যোগ্য কলমে এই তর্পণ হল। স্বপনদার মত এমন স্বচ্ছন্দ ও শ্রদ্ধাবনত বিনয়ী গবেষক, বিশেষত গানের ক্ষেত্রে আর কেউ নেই। সবিনয়ে মনে করিয়ে দি, পূর্বা দাম ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মহাশয়ের সেই বিরল যুগল বন্দীটির কথা – কন্ঠস্বর ও সরোদ একযোগে মিলে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ধ্যানে।
মন্দারদি একদম ঠিক বলেছ৷ আমি সব্বাইকে সেটাই বললাম ৷ আমার ভীষণ প্রিয় পূর্বাদির তর্পণ স্বপনদার কলমে ছুঁয়ে গেছে।
খুব ভালো লাগল এই নিবেদন।
স্বপন দা, আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানা হল। আমার প্রণাম নেবেন দাদা 🙏