banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

এলোমেলো বেড়ানো: ৭

অমিতাভ রায়

ডিসেম্বর ২১, ২০২২

Amitav roy Okha Dwarka
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] []

মিঠাপুর-দ্বারকা-ওখা

মিঠাপুর। নামের সঙ্গে কোনওরকম সঙ্গতি না রেখেই এই শহরে রয়েছে দেশের বৃহত্তর লবণ তৈরির কারখানা। ঘুরিয়ে বলা উচিত, লবণ কারখানা ঘিরে গড়ে উঠেছে মিঠাপুর। বিশ্বাস না হলে টাটা সল্টের প্যাকেটের উপর একবার নজর দিলেই সন্দেহের নিরসন হবে।

গুজরাটের উত্তর পশ্চিম প্রান্তের এক ছোট্ট শহর মিঠাপুর। সাগরপারের প্রাচীন বন্দর ওখা-র পাশে পড়ে থাকা এই জনশূন্য  বিস্তীর্ণ পতিত জমির নাম এককালে ছিল ‘ওখামণ্ডল’। ব্রিটিশ সরকারের আমলে ওখামণ্ডল ছিল দেশিয় রাজ্য বরোদা-র অংশ। উনিশশো তিরিশের দশকে তখনকার বরোদা সরকারের কাছ থেকে এই অনুন্নত পতিত জমির প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর একলপ্তে কিনে নেয় টাটা কেমিক্যালস্। তখন অবশ্যি খাতায়-কলমে টাটা কেমিক্যালস্-এর জন্মই হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ১৯৩৯-এ এখানে লবণ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করে টাটা কেমিক্যালস্। তখন থেকেই জায়গাটির নাম হয় মিঠাপুর। শুধুমাত্র লবণ উৎপাদন ঘিরে গড়ে তোলা একটা পরিকল্পিত শহরের নাম যিনি মিঠাপুর দিয়েছিলেন তাঁর রসবোধ নিয়ে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই।

Mithapur salt factory
১৯৩৯-এ এখানে লবণ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করে টাটা কেমিক্যালস্

মিঠাপুর টাটা কেমিক্যালসের জন্মস্থান। ভারতের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের মিঠাপুর একটি ছোট ও বিচ্ছিন্ন শহর হলেও লবণ কারখানার কর্মী এবং আশেপাশের গ্রামের প্রায় এক লক্ষ মানুষ তাদের জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে টাটা কেমিক্যালস্-এর উপর নির্ভরশীল। এখন মিঠাপুরের কারখানায় বছরে দশ লক্ষ টন লবণ উৎপাদিত হয়। সেইজন্যেই হয়তো দেশের সমস্ত শহর-গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত জনপদে পাওয়া যায় টাটা সল্ট।

মিঠাপুরের কারখানায় প্রতি বছর নয় লক্ষ টন সোডা অ্যাশও তৈরি হয়। আরও আছে একটি সিমেন্ট কারখানা, যেখানে বছরে পাঁচ লক্ষ টনের বেশি সিমেন্ট উৎপাদন করা যায়। অনুসারী শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে কস্টিক সোডা, সালফিউরিক অ্যাসিড এবং তরল ক্লোরিন তৈরির কারখানা।

শুধুমাত্র একটা লবণের কারখানা এবং সংলগ্ন সুপরিকল্পিত শহর দেখতে নিশ্চয়ই আপনি-আমি তো বটেই কোনও পর্যটকই এত দূরে আসবেন না। একটু আধটু নয়, হাওড়া থেকে রেলপথে আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। শালিমার-ওখা সাপ্তাহিক সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে ট্রেনের টাইমটেবল অনুযায়ী সময় লাগে ৪৩ ঘণ্টা। বিশ্বাস করতে অসুবিধা হলে একবার সফর করে পরখ করতে পারেন। এত দীর্ঘ সফর হলে কী হবে, ট্রেনে ঠাসাঠাসি ভিড়। সংরক্ষিত আসনের টিকিট পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তাহলে কোন আকর্ষণে প্রতিদিন দলে দলে লোক শালিমার-ওখা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে সফর করতে উৎসাহী?

সাগরপারের প্রাচীন বন্দর ওখা

ধর্মীয় পর্যটন পৃথিবীর সব দেশে সবসময়েই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রান্তিক স্টেশন ওখা পৌঁছনোর একটু আগেই রয়েছে ‘দোয়ারকা’। বাঙালি অবিশ্যি দ্বারকা বলতেই অভ্যস্ত। বানান কিন্তু সব ভাষাতেই দ্বারকা। ট্রেনের ভিড় বুঝিয়ে দেয় আজও ধর্মের নামে মানুষের কী অমোঘ আকর্ষণ!

দ্বারকা নামের আক্ষরিক অর্থ হল ‘প্রবেশপথ’। ইতিহাসের পাতায়  দ্বারকাকে ‘মোক্ষপুরী’, ‘তী’দ্বারকামতী এবং ‘দ্বারকাবতী’ নামেও উল্লেখ করা হয়। চিরায়ত মহাকাব্য মহাভারতেও দ্বারকার উল্লেখ রয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস, মথুরায় মামা কংসকে পরাজিত ও হত্যা করার পর শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে আসেন। মথুরা থেকে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের অভিবাসনের এই পৌরাণিক বিবরণ গুজরাটের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লোকশ্রুতি, দ্বারকা গড়ে তোলার জন্য শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্র থেকে প্রায় ৯৬ বর্গ কিলোমিটার বা ৩৭ বর্গ মাইল জমি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে পৃথিবীর বৃহত্তম ও ব্যস্ততম বন্দর সাংহাই তো এইভাবেই গড়ে উঠেছিল। তাহলে কি দ্বারকার অনুপ্রেরণায় সাংহাই তৈরি হয়েছে? হবেও বা! এখন তো অনুপ্রেরণা ছাড়া কোনও কিছুই হয় না।

কথিত আছে যে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে প্রশাসন পরিচালনা করতেন। ৭২টি থামের উপর প্রায় ৮০ মিটার উঁচু পাঁচতলার দ্বারকাধীশ মন্দির শহরের প্রধান আকর্ষণ। লোকশ্রুতি, এই মন্দির আসলে শ্রীকৃষ্ণের প্রশাসনিক ভবন। শহরের পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্র আছে, সেই কারণেই বোধ হয় মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। প্রশাসনে মুক্ত বাতাসের আনাগোনা স্বচ্ছন্দ রাখার প্রয়াস!

প্রচলিত বিশ্বাস, মথুরায় মামা কংসকে পরাজিত ও হত্যা করার পর শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে আসেন। মথুরা থেকে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের অভিবাসনের এই পৌরাণিক বিবরণ গুজরাটের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লোকশ্রুতি, দ্বারকা গড়ে তোলার জন্য শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্র থেকে প্রায় ৯৬ বর্গ কিলোমিটার বা ৩৭ বর্গ মাইল জমি পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

অনেককাল আগে নির্মিত হয়েছিল বলা হলেও এখনকার মন্দিরটি দেখে তা মনে হয় না। ইতিহাসের নথি অনুযায়ী ১৮৬১ সাল নাগাদ বর্তমান মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছিল। ১৯৬০ থেকে দ্বারকাধীশ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করছে ভারত সরকার। স্বভাবতই পুনর্গঠিত ও সুসংস্কৃত মন্দিরে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মন্দিরের আঙিনায় সারা বছরই দর্শনার্থীদের থিকথিকে ভিড়। কলকাতার দুর্গাপূজা-মণ্ডপ পরিক্রমার অভিজ্ঞতা থাকলে অবিশ্যি জনসমুদ্রকে উপেক্ষা করে কৃষ্ণবর্ণের মর্মর মূর্তি দর্শনে অসুবিধা হবে না।

শহরের প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলা গোমতী নদী আরব সাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মোহনার কাছাকাছি নদীর তীরে রয়েছে সমুদ্র দেবতা, সরস্বতী ও লক্ষ্মী মন্দির। এখানেই রয়েছে একটি লাইটহাউস, যার আলো পনেরো-ষোলো কিলোমিটার দূর থেকেই দেখা যায়।

এছাড়াও দেবভূমি দ্বারকা জেলার সদর শহর দ্বারকায় রয়েছে আরও অসংখ্য ছোট-বড় মন্দির। কোথাও দর্শনার্থীর অভাব নেই। শহরের জনসংখ্যা কিন্তু এখনও পঞ্চাশ হাজারের থেকে অনেক কম। 

Sundown at Dwarkadhish_Temple
প্রচলিত বিশ্বাস, মথুরায় শ্রীকৃষ্ণ মামা কংসকে পরাজিত ও হত্যা করার পর দ্বারকায় চলে আসেন

“…’বেরিয়ে যখন পড়েছি ভাই থামলে তো আর চলবে না।…’ কবিকথিত এহেন আপ্তবাক্য মাথায় রেখে সক্কাল সকাল গান্ধীধাম থেকে সফর শুরু হয়েছিল। পাঁচ ঘণ্টায় সোয়া দু’শো কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে জামনগর। সেখানে মধ্যাহ্নভোজ সেরে রাস্তার বাঁ পাশে রিল্যায়েন্স পেট্রোকেমিক্যালস্ আর ডান হাতে এসার কোম্পানির শিল্পনগরী দেখতে দেখতে আরও একশো কিলোমিটারেরও বেশি গাড়ি গড়িয়ে যাওয়ার পর দ্বারকা। সেখানে তো আর বিশ্রাম হয়নি। তারপর আরও চল্লিশ কিলোমিটার পেরিয়ে মিঠাপুর হয়ে আপাততঃ অন্তিম গন্তব্য ওখা।

এতক্ষণ যে রাস্তায় গাড়ি ছুটছিল, হঠাৎ করেই সেই সড়ক যেন সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। আর ঠিক সেখানেই নীল রঙের ছোট্ট বোর্ডের উপর সাদা কালিতে লেখা রয়েছে— ‘ওখা’।

সাগর নয়, আসলে আরব সাগরের খাঁড়ি। হোক না খাঁড়ি, রীতিমতো বালুকাবেলা রয়েছে। এপ্রিলের প্রখর রবিরশ্মিতে চতুর্দিক ঝলমল করছে। বালুকাবেলায় যেন গলানো সোনা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গরম অনুভূত হচ্ছে না। আসলে সাগর অথবা খাঁড়ি থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় রৌদ্রের তীক্ষ্ণতা কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। তটভূমি জুড়ে গড়ে উঠেছে চমৎকার রাস্তা। রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য বাড়ি। রাস্তা অবিশ্যি জনশূন্য। জোয়ার-ভাঁটায় খাঁড়িতে জল বাড়ে-কমে। তবে খাঁড়ি প্রশস্ত নয়। ওপারের বাড়ি-ঘরদোর দিব্যি দেখা যায়। লঞ্চে করে পারাপার করতে হয়, এবং লঞ্চে জমজমাট ভিড়। দূরদূরান্তের ভক্তরা দ্বারকা-দর্শন সেরে শ্রীকৃষ্ণের বাসস্থান পরিদর্শনের জন্য খাঁড়ি পেরিয়ে বেট-দ্বারকায় চলে আসেন। ওখা পেরিয়ে সাগরের ওপারে বেট-দ্বারকা দ্বীপে শ্রীকৃষ্ণ সপরিবারে বসবাস করতেন বলেই লোকশ্রুতি।

Dwaraka
৭২টি থামের উপর প্রায় ৮০ মিটার উঁচু পাঁচ তলার দ্বারকাধীশ মন্দির শহরের প্রধান আকর্ষণ

সারাদিনের সড়ক সফরের ধকল সামলিয়ে শরীর যখন একটু বিশ্রামের খোঁজ করছে ঠিক তখনই গাড়ির চালকের অনুরোধ রক্ষা করতে লঞ্চে সাগর অথবা খাঁড়ি পেরিয়ে বেট-দ্বারকায় পদার্পণ। মূল মন্দির দ্বারকাধীশের হলেও অন্যান্য মন্দিরও রয়েছে। এমনকি একটি গুরুদোয়ারাও বেট-দ্বারকায় অবস্থিত। তবে নজরে আসবে দ্বারকাধীশের মন্দিরকে কেন্দ্র করে ভক্তদের ক্লান্তিহীন পরিক্রমা।

দ্বারকাধীশের মন্দির দেখে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে যদি প্রধান পুরোহিত হঠাৎ করে আপনার হাত জড়িয়ে ধরে কপালে একটি টিকা এঁকে দেন মোটেও বিস্মিত হবেন না। সকলের জন্য এই আপ্যায়ন নয়। তাঁর বিচারে দিনের সেরা দর্শনার্থীর কপালে তিনি স্বহস্তে টিকা এঁকে দেন। তারপরই মাথায় পরিয়ে দেবেন একটা পাগড়ি। এই সাদামাটা বস্ত্রখণ্ডকে মোটেও হেলাফেলা করা যাবে না। আগের দিন এই কাপড় মন্দিরের চূড়ায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ধ্বজা হিসেবে পতপত করে উড়েছে। সূর্যাস্তের লগ্নে সেই ধ্বজা নামিয়ে এনে যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়। পরের দিন ভোরবেলায় আবার ধ্বজা হিসেবে মন্দিরের চূড়ায় টাঙিয়ে দেওয়া হয় নতুন এক বস্ত্রখণ্ড। আর আগের দিনের ধ্বজা পরের দিনের সেরা দর্শনার্থীর প্রাপ্য। পুরোহিতের বিচার সবসময় ঠিক হয় কিনা তা বলা মুশকিল।

গুজরাটের ৪৪টা ছোট বন্দরের (minor port) অন্যতম ওখা। ১৯৮২তে গুজরাট সরকার স্থাপিত গুজরাট মেরিটাইম বোর্ড রাজ্যের ৪৪টি ছোটো বন্দরের নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই ওখা বন্দরও গুজরাট মেরিটাইম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন। এখন তেমন ব্যস্ততা না থাকলেও এককালে ওখা বন্দরের কিন্তু যথেষ্ট নামডাক ছিল। ইতিহাসের নথি অনুযায়ী আরব দুনিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সূচনাপর্বে ওখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত। এখন অবিশ্যি মিঠাপুরে উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ছাড়া অন্য কোনও দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই। বিধি মোতাবেক ভারতীয় নৌসেনা, কাস্টমস্ ও গুজরাট মেরিটাইম বোর্ডের পুলিশের একটা করে বাহিনী ওখায় মোতায়েন করা আছে। তবে দিনমানে তাদের দর্শন না পেলেও বিস্মিত হওয়ার কী দরকার?

Bet Dwarka
দূরদুরান্তের ভক্তরা দ্বারকা-দর্শন সেরে শ্রীকৃষ্ণের বাসস্থান পরিদর্শনের জন্য খাঁড়ি পেরিয়ে বেট দ্বারকায় চলে আসেন

পর্যটকরা কোনওরকমে বেট-দ্বারকা ঘুরে এসে আবার দ্বারকা অথবা মিঠাপুরে চলে যান। ওখায় তো কোনও পান্থনিবাস-ধর্মশালা বা হোটেল-হোমস্টে নেই। তবে আগাম বন্দোবস্ত করে রাখলে ওখা বন্দরের অতিথিনিবাসে ঠাঁই মিলতে পারে।

সাগরতটের হাতেগোনা কয়েকটি সুদৃশ্য বাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওখা বন্দরের অতিথিনিবাস। দোতলা বাড়ি। প্রথম দর্শনে হানাবাড়ি বলে মনে হতেই পারে। ঘটা করে আবার বাড়িটির সদরের প্রস্তরফলকে কোনও এককালে যত্ন করে খচিত হয়েছিল, ‘ইয়োরোপিয়ান গেস্ট হাউস, ওখা পোর্ট’। সত্যি সত্যিই ব্রিটিশ স্থাপত্য। সদর পেরিয়ে সুনসান বাড়ির ভেতরে পা রাখলেই বোঝা যায় যে বহুকাল ঝাড়পোঁচ হয়নি।

একতলার চারটি ঘরেই তালা। চালকের হাঁকডাক শুনেও কোনও সাড়া নেই। লোকজন আছে কিনা বলা মুশকিল। চালক ছাড়বার পাত্র নয়। একের পর এক ফোন করে কার সঙ্গে বেশ দাপটের সঙ্গে কথা বলছেন জানা নেই। অস্বস্তি এড়াতে বাইরে বেড়িয়ে সাগরের সৌন্দর্য অবলোকন করাই সময়োপযোগী কাজ। সে এক অপরূপ দৃশ্য। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছে। ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে রবিরশ্মির তেজ। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে সাগরের ঢেউয়ের রং। পাল্টে যাচ্ছে বালুকাময় তটভূমির চেহারা। হাওয়ার গতি বাড়ছে, এবং গরম উধাও।

এমতাবস্থায় যদি পুলিশের আগমন ঘটে তা হলে বিস্ময়ের বদলে চিন্তার উদ্রেক হয়। আর সেই পুলিশ যদি কর্তব্যের ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন তা হলে সত্যি সত্যিই বিস্মিত হতেই হবে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও এক অচেনা ব্যক্তি যদি অকস্মাৎ দোতলায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান তা হলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায়?

‘পড়েছি মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে’— পুরোনো প্রবাদকে স্মরণ করে গুটিগুটি পায়ে দোতলায় উঠে যাওয়াই সমীচীন। সঙ্গে চালক আছেন। কাজেই চরৈবতি।

Okha Tourism
গুজরাটের ৪৪টা ছোটো বন্দরের অন্যতম ওখা

দোতলার একটি ঘরে রাত কাটানোর বন্দোবস্ত। সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো চমৎকার ব্যবস্থা। জানালা খুলে দিলেই হু হু করে সাগরের হাওয়া ঘরের পরিবেশকে মনোরম করে তুলছে। এবং তখনই জানা গেল দুটো তলায় আটটি ঘর থাকলেও মাত্র এই একটি ঘরই ব্যবহারপোযোগী। ঠিক সেই মুহূর্তে চালক জানিয়ে দিলেন তিনি এই খন্ডহরে থাকবেন না।

অতিথিনিবাসের পরিচারক একই সময়ে সুদৃশ্য পেয়ালায় সুগন্ধি চা পরিবেশন করলে এতবড় হানাবাড়িতে একাকী রাত কাটানোর দুশ্চিন্তা মাথায় আসবে না। তিনি আরও জানালেন যে রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। 

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা বিছানা। জানালার সামনের টেবিলের উপর ফুলদানিতে তাজা ফুল। এই মরুর দেশে কোত্থেকে সুগন্ধি ফুল এল কে জানে! সবকিছু জানারই বা কী দরকার! সিলিং ফ্যানের হাওয়ার সঙ্গে সাগরের বাতাস মিলে এক মনোরম পরিবেশ। গিজারে জল গরম হয়। এসি চলে। আর কী চাই!

সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো চমৎকার ব্যবস্থা। জানালা খুলে দিলেই হু হু করে সাগরের হাওয়া ঘরের পরিবেশকে মনোরম করে তুলছে। এবং তখনই জানা গেল দুটো তলায় আটটি ঘর থাকলেও মাত্র এই একটি ঘরই ব্যবহারপোযোগী।

সূর্য ডুবতে ডুবতে প্রায় রাত সাড়ে সাতটা। আটটাও হতে পারে। হঠাৎ করে সাগরের জলের স্তর বেড়ে চলেছে। সাগরের বুকে ডুব দেওয়ার লগ্নে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে রক্তিম রবিরশ্মি। সেই মুহূর্তে মনে হতেই পারে পৃথিবীর এমন সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ ক’জন পায়!

চায়ের খালি কাপ-প্লেট নিতে এসে পরিচারক জানিয়ে গেলেন রাত ন’টা বাজতে চলেছে। স্নান করার ইচ্ছে থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে নিতে হবে। সাড়ে ন’টায় নৈশভোজ শুরু হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের দেওয়াল ঘড়ি ন’বার বেজে বুঝিয়ে দিল আঁধার ভালো করে ঘনিয়ে না এলেও রাত হয়েছে।

স্নানাদি সেরে ঘরের বাইরে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশটা পাল্টিয়ে হয়ে গেল একেবারেই অন্যরকম। একটু আগে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় যে পৃথিবীকে এত ঝকঝকে লাগছিল তা আবার এক লহমায় ঘন অন্ধকারে ডুবে থাকা এক প্রাচীন পার্থিব ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়ে গেছে। প্রশস্ত করিডরে একটা বাতি জ্বললেও তা নিষ্প্রভ। কোনওরকমে ইয়োরোপিয়ান সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমেও একই অবস্থা। নিষ্প্রভ আলো। সবমিলিয়ে পুরো বাড়িটায় ছড়িয়ে পড়েছে মনখারাপের যাবতীয় উপাদান।

সেই মুহূর্তে যদি কানে আসে মানুষের কণ্ঠস্বর, তখন ভয় না পেলেও চমকে উঠতেই হয়। বাড়ির উঠোনে বেশ কিছু মানুষের সমাগম।  আলো-আঁধারিতে তাঁদের মুখ-চোখ-চেহারা স্পষ্ট না হলেও নিশ্চিতভাবেই তারা মানুষ। বাতাসে রান্নার বাস। অর্থাৎ এঁরা নৈশভোজ সারতে এসেছেন। বেশ কয়েকজন বহিরাগত অতিথির সঙ্গে আলাপ করতে এসে জানতে পারলাম তাঁরা ভারতীয় নৌসেনা, কাস্টমস্ ও গুজরাট মেরিটাইম বোর্ড ও স্থানীয় ব্যাঙ্কের কর্মী। দফতরের ক্যান্টিনে মধ্যাহ্নভোজের বন্দোবস্ত থাকলেও রাতেরবেলায় কিছুই পাওয়া যায় না। অনন্যোপায় হয়ে এই হানাবাড়িতেই চালু করতে হয়েছে যৌথ পাকশাল। হানাবাড়িতে নতুন অতিথির একাকী রাত কাটানোর কথা শুনে তাঁরা রীতিমতো বিস্মিত ও চিন্তিত। একই সঙ্গে বিধিবদ্ধ সতর্কবার্তা— রাতে যেন ভুল করেও ঘরের দরজা খোলা না হয়। 

নৈশভোজ সেরে নিশ্চিন্ত নিদ্রা। নিয়ম মেনে পরের দিন সকালে সাগরের উপর ছড়িয়ে পড়েছে ঊষালগ্নের সোনালি রোদ, এবং দরজায় চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গতরাতের সেই পরিচিত পরিচারক।

ছবি সৌজন্য:  Wikimedia Commons, Tata.com

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com