এন্টালির আনন্দ পালিত বাস স্টপে নেমে আনন্দ পালিত রোড ধরে কিছুটা হাঁটলেই দুনম্বর ব্রিজের ঠিক আগে ডান হাতে একটা সরু গলি, দেব লেন। সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি বাড়ি। সরু গলি, গাড়ি ঢোকে না বলে প্রোমাটারেরও উৎসাহ নেই, তাই মোটামুটি সব বাড়িই পুরনো। গলির শেষ প্রান্তে মহেশ দত্তের দোতলা বাড়ি। তিন পুরুষের ভিটে। নিজেরাই থাকেন, ভাড়াটে নেই। পরিবার বলতে একমাত্র ছেলে প্রানেশ, বৌমা পৃথা আর আদরের নাতি টুরুন, ক্লাস ফোরে পড়ে। গত কার্ত্তিকে মহেশবাবুর স্ত্রী প্রতিভাদেবী হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। বাড়িটা মহেশবাবুর দাদু হেমচন্দ্র দত্ত বানিয়েছিলেন। শখ করে সদর দরজার পাশে শ্বেত পাথরের ফলকে খোদাই করে নাম লিখেছিলেন “দত্তভিলা”।
গলির উপরেই সদর দরজা। তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকলে প্রথমেই বসবার ঘর। আর সদর দরজার উল্টো দিকে ঠিক মুখোমুখি দেওয়ালে দুটো অয়েল পেন্টিং, হেমচন্দ্র আর তার ছেলে নরেশচন্দ্রের। ঘরটা অন্ধকার হলেও পেন্টিংয়ে আঁকা চেহারাগুলো বেশ ভালই বোঝা যায়। বসার ঘরের দক্ষিণের দিকের ঘরে মহেশবাবু থাকেন। গলির দিকে জানালা থাকলেও বসার ঘরটা বেশ স্যাঁৎস্যাতে। ঘরে আসবাব বলতে একটা কাপড়ে মোড়া বড় সোফা, পুরনো দিনের কালচে হয়ে যাওয়া মেহগনি কাঠের কয়েকটা হাতল দেওয়া চেয়ার, একটা রেক্সিনে মোড়া আরামকেদারা আর একটা শ্বেত পাথর বসানো বড় কাঠের গোল টেবিল। বসার ঘরে সারাদিনই মোটামুটি আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয় এতটাই অন্ধকার সে ঘর। পশ্চিমে একটা উঁচু চৌকাঠ দেওয়া দরজা। দরজার পরেই একটা বারান্দা। বারান্দা থেকে নামলেই উঠোন। উঠোনের মধ্যিখানে তুলসীতলা আর উত্তরপশ্চিম কোনায় গঙ্গা জলের কল, একটা চৌবাচ্চা আর তার পাশেই বাড়ির পেছনের দরজা। বারান্দার দক্ষিণ দিকে কাঠের হাতল দেওয়া দোতলায় ওঠার সিঁড়ি।
দোতলায় বাবা মা’র সাঙ্গে থাকে টুরুন। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেও একতলায় নামাটা টুরুন সিড়িঁর কাঠের হাতলে বসে স্লিপ খেয়ে সাঁ-আ-আ করে নামতেই পছন্দ করে।
দত্ত পরিবারের এই চার সদস্যের বাইরে আরও চারজন আছেন যারা দিনের অনেকটা সময়ই এবাড়িতে কাটান। বাড়ির পিছনের বস্তির আবু তার স্ত্রী রুবেলা আর দুই ছেলে আলী আর মুজিব। আবু টানা রিক্সা চালায় আর দত্তবাড়ির ফাইফরমাস খাটে। রুবেলা আবার পৃথার ছায়া সঙ্গী। আলী মোটামুটি টুরুনের বয়সী, মুজিব একটু ছোট হলেও ওরা তিনজনে অভিন্ন হৃদয়।
আবুদের দিন শুরু হয় কাকভোরে টুরুনদের বাড়ির পেছনের গঙ্গা জলের কলে স্নান দিয়ে। রুবেলা মোটামুটি দুটো সংসার চালায়, নিজের আর পৃথার। পৃথা যেহেতু স্কুলে পড়ায় তাই ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। রাতের রান্না সেরে, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে তবে রুবেলার ছুটি। স্কুল থেকে ফিরে টুরুন আলী আর মুজিবের সঙ্গে বিকেলটা কাটায়।
মহেশবাবুর জীবন জুড়ে শুধু এই নাতি আর দুই বন্ধু, সুশীল বোস আর রসময় সান্যাল। সুশীলবাবুর কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মাথাভরা কালো ঘন চুল, বয়সের নিয়মে দুএকটা পাকা চুল থাকলেও বোঝা যায় না। সাধারণত গাঢ় রঙের পোষাক পরেন। একটু গম্ভীর, কথা কম বলেন। আর রসময়বাবুর সারা গায়ে শ্বেতী, ধবধবে সাদা আদ্দি কাপড়ের পায়জামা পাঞ্জাবি ছাড়া পরেন না, সবসময় পান খান বলে ঠোঁট দুটো টকটকে লাল। মাথায় চুল নেই বললেই চলে। লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে সুশীলবাবুকে প্রায় দ্যাখা যায় না বলে টুরুন নাম দিয়েছে ভ্যানিশ দাদু। আর রসময়বাবুকে টুরুন রসদাদু বলেই ডাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নীচের বসার ঘরে মহেশবাবু, সুশীলবাবু আর রসময়বাবুর আড্ডা চলে। ভ্যানিশদাদু আর রসদাদুর ভীষণ দাবার নেশা। কখনও আবার দুজনের মধ্যে দাবার চাল নিয়ে মন কষাকষিও হয়। সন্ধ্যের পড়াশুনা সেরে টুরুন নীচে নেমে প্রায় প্রতিদিনই দ্যাখে টেবিলে বসে ভ্যানিশ দাদু আর রসদাদু দাবা খেলছেন আর দাদু আরামকেদারায় বসে সেটা উপভোগ করছেন। টুরুন এসে রসদাদুর চেয়ারে পাশ দিয়ে বসে আর বোঝার চেষ্টা করে খেলাটা। রসদাদুই টুরুনের বেস্ট ফ্রেন্ড। অনেক অনেক গল্প জানেন আর সেটাই টুরুনের অ্যাট্র্যাকশন। সেই গল্পগুলোই টুরুন একটু রং বদলে সকালে স্কুলের বন্ধুদের আর বিকালে আলীদের শোনায়।
এমনিভাবেই চলছিল। গতমাসে হঠাৎ ভ্যানিশ দাদু কিরকম ভ্যানিশ হয়ে গেল। কদিন ধরে আসছে না দেখে দাদু আবুকাকাকে পাঠিয়েছিলেন খবর নিতে। আবুকাকা মা’কে বলল তারপর মা দাদুকে জানাল। দাদু কিন্তু দুটো দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই বললেন না। আজকাল দাদু আর রসদাদুই দাবা খেলেন। পৃথা টুরুনকে বলেছে তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক সেরে দাদুদের সঙ্গে গল্প করতে, তাতে দাদুদের একটু ভাল লাগবে। এতে টুরুনেরও ভালো হয়েছে। পড়ার সময় কমে গিয়ে দাদুদের সঙ্গে আড্ডার সময়টা বেড়ে গেছে। আজকাল মহেশবাবু আর সান্যালবাবুর দাবার বোর্ড ছাড়াও টেবিলে একটা ফাঁকা বোর্ড রাখা থাকে। টুরুনের কাজ যখনই কোনও ঘুঁটি খাওয়া যায় সেটাকে নিয়ে ফাঁকা বোর্ডে ঠিক জায়গায় সাজানো। এইভাবে টুরুনও আস্তে আস্তে দাবা খেলাটা শিখতে থাকে। দাবার ঘুঁটি সাজাতে টুরুন যে একদম ভুল করেনা তা নয়। রসদাদু সবসময় উৎসাহ দেন। দাদুদের চোখের জোর কম হলেও টুরুনের অল্প আলোতে কোনও অসুবিধা হয় না। টুরুনের দাদুর থেকে রসদাদু দাবাটা বেশি ভাল খেলেন। রসদাদুর পাশে থেকে টুরুন যখন মোটামুটি দাবাটা খেলতে শিখে নিল, তখন দাদুদের পাশেই ঘুঁটি সাজানো একটা আলাদা বোর্ড বসানো হলো। একপাশে টুরুন আর অন্যদিকে রসদাদু। রসদাদু একসঙ্গে টুরুনের দাদু আর টুরুনের সঙ্গে খেলতে লাগলেন। মাঝেমধ্যে টুরুনকে চাল দিয়ে একটু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। টুরুন মাথা নিচু করে মন দিয়ে খেলে আর রসদাদু মাঝে মধ্যে খেয়াল হলে একটা চাল দেন। এইভাবে আস্তে আস্তে টুরুন দাবা খেলাটা মোটামুটি শিখে ফেলেছে।
ইদানীং রসদাদু দাবা খেলা নিয়ে টুরুনের প্রশংসা করলেও টুরুন কিন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা কোন চালটা কেন দিচ্ছে। সবসময় মনে হয় ওর হয় অন্য কেউ বোধহয় চালটা দিয়ে দিচ্ছে।
পরশু দিনই তো টুরুন শুনেছে রসদাদু দাদুকে বলছে “টুরুনটা কিন্তু সত্যিই খুব ইন্টেলিজেন্ট। যেরকম তাড়াতাড়ি দাবা খেলাটা আয়ত্তে এনে ফেলেছে, ভাবাই যায় না। ওর একেকটা চাল তো আমায় বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। ওর খেলার মধ্যে সুশীলের একটা ছাপ আছে। মাঝে মাঝে বেশ চমক লাগিয়ে দেয়।” দাদু আবার এসব কথায় কান দেন না। দাদুর বক্তব্য এইটুকু ছেলে আবার অত পারে নাকি, ও সব আন্দাজে করে। এইরকম করে যত দিন যায় রসদাদুর চোখে টুরুন আরও তুখোড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। আজকাল রসদাদু দাদুর চেয়ে টুরুনের চাল সামলাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।
এরই মধ্যে প্রানেশ আর পৃথা ঠিক করল এবারের পুজোয় কোথাও বেড়াতে যাবে। এমন জায়গায় যাবে যেখানে মহেশবাবুও যেতে পারেন আর জায়গাটা হবে বেশ একটু নিরিবিলি। প্রানেশের অফিসের জুনিয়ার সমীর বলল ঝাড়খন্ডের জয়দাতে যেতে। জামসেদপুরের কাছে, জামশেদপুর-রাঁচি হাইওয়ের উপরেই। দলমা পাহাড়ের কোলে সুবর্ণরেখা নদীর কাছেই সমীরদের একটা বাড়ি আছে। হোমস্টে করে ভাড়াও দেয়। সেইমতই সব ঠিক হল। আবুকে বলা হল এই কটাদিন রাত্রে নীচের বসার ঘরে শুতে। ষষ্ঠীর দিন রাত্রিবেলা হাওড়া থেকে চক্রধরপুর স্পেশাল ধরে পরদিন ভোরবেলা চান্ডিল পৌঁছল টুরুনরা। স্টেশন থেকে অটো নিয়ে সোজা সমীরদের বাড়ি। মিনিট চল্লিশের পথ। ভারী সুন্দর জায়গা। একতলা বাড়ি, ছাদে উঠলেই একটু দুরে সুবর্ণরেখা নদী দেখা যায়। নদীর অন্য পারে কিছুটা ক্ষেত, তারপরেই দলমা পাহাড়। বাড়ির কেয়ারটেকার লুধু মাহাতো। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। শুধু একটাই সমস্যা ধারেকাছে কোনও মোবাইলের টাওয়ার নেই, ফলে ফোনও নেই। দাদু না বেরোলেও মা বাবার সঙ্গে টুরুনের বেড়ানো বেশ ভালই হল। সুবর্ণরেখা নদী, দলমা পাহাড়, জয়দা ড্যাম সব দেখে ওরা দশমীর দিন রাতের ট্রেনে চেপে পরেরদিন সকালে বাড়ি পৌঁছল।
ইদানীং রসদাদু দাবা খেলা নিয়ে টুরুনের প্রশংসা করলেও টুরুন কিন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা কোন চালটা কেন দিচ্ছে। সবসময় মনে হয় ওর হয় অন্য কেউ বোধহয় চালটা দিয়ে দিচ্ছে। পরশু দিনই তো টুরুন শুনেছে রসদাদু দাদুকে বলছে “টুরুনটা কিন্তু সত্যিই খুব ইন্টেলিজেন্ট। যেরকম তাড়াতাড়ি দাবা খেলাটা আয়ত্তে এনে ফেলেছে, ভাবাই যায় না। ওর একেকটা চাল তো আমায় বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়।
বাড়িতে ঢুকেই পৃথা বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। ঘরদোর বেশ এলোমেলো। রুবেলা কখনই এরকমভাবে অগোছালো করে রাখে না। তাছাড়া বেলা তখন বারোটা অথচ রুবেলা নেই, খাবারের কোনও বন্দোবস্তও নেই। পৃথা টুরুনকে ডেকে বললো “যা তো, রুবেলা মাসিকে ডেকে নিয়ে আয় তো!” একটু পরে টুরুন ঘুরে এসে বলল “আবুকাকার খুব জ্বর, রুবেলা মাসি বলেছে এখন আসতে পারবে না।” ব্যাপারটা পৃথার ভাল ঠেকল না। নিজেই চলে গেল রুবেলার বাড়ি কী হয়েছে জানতে। আবুকে দেখে, রুবেলার সঙ্গে কথা বলে পৃথা থ। দুজনেই ভয়ে কুঁকড়ে আছে। দুদিন আগে রাত্রিবেলায় আবু নাকি ভূত দেখেছে টুরুনদের নীচের বসবার ঘরে। এত ভয় পেয়েছে যে ওরা টুরুনদের বাড়িতে আসতে ভয় পাচ্ছে। পৃথার আসতে দেরি হ’চ্ছে দেখে মহেশবাবু, প্রানেশ আর টুরুন সবাই চলে এসেছে আবুদের ঘরে। প্রানেশ আবুর গায়ে হাত দিয়ে বুঝল একশোর মতো জ্বর। কী হয়েছে জানতে চাইলে প্রথমটায় আবু ভয়ে কিছুই খুলে বলতে পারল না। শুধুই বলতে লাগল “বাবু আপনার বাড়িতে জরুর ভূত আছে! আমি পারব না। আমার বউ ছেলেদের নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবো! হায় আল্লা আমি কী গুনহা করলাম!” অনেক বোঝানোর পর মহেশবাবুর কথায় শেষমেশ আবু উঠে বসে কাঁপতে কাঁপতে ঘটনাটা খুলে বলল। “আপনারা বেড়াতে যাওয়ার দিন রাত থেকে কথামতো আমি বসবার ঘরে শুতে শুরু করি। প্রথমদিন মাঝরাতে একটু খুটখাট আওয়াজ পেলেও আমি ভাবলাম ইঁদুর টিদুর হবে। অত মাথা না ঘামিয়ে তাই আবার ঘুমিয়ে পড়ি। তারপরে তিনদিন কোনও আওয়াজ নেই আর আমিও ক্লান্ত ছিলাম, ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু কাল রাতে যা দেখলাম, বাবু আপনার বাড়িতে নির্ঘাত ভূত আছে!” জানা গেল কাল মাঝরাতে খুটখাট আওয়াজ পেয়ে আবুর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে ঘরের আলো জ্বলছে আর টেবিলের ওপরে দাবার ঘুঁটিগুলো নিজের থেকেই এক ঘর থেকে সরে অন্য ঘরে যাচ্ছে। যেন কেউ বসে বসে দাবা খেলছে। এইসব দেখে আবু তৎক্ষনাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। সকালে আবুর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে রূবেলা গিয়ে দেখে এই অবস্থা। তখন পাশের বাড়ির খোকনকে নিয়ে গিয়ে রুবেলা আর খোকন দুজনে ধরাধরি করে আবুকে ঘরে এনে শুইয়ে দেয়। সেই থেকে আবুর গায়ে জ্বর।
এসব শুনে টুরুন একটুও ভয় না পেলেও প্রানেশ আর পৃথা কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই জানে আবুর কোনওরকম নেশার দোষ নেই তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় রইল না।। পৃথার প্রস্তাব বাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়ন পুজো করা হোক। আপাদমস্তক নাস্তিক মহেশবাবু বেশ জোর দিয়ে বললেন “না না! ওসব কিছু করতে হবে না। আমি তো নীচেই থাকি, দেখি কে ভূত!“ এই বলে মহেশবাবু টুরুনকে বললেন “কি দাদুভাই! ভূত দেখবে নাকি আজ রাত্রে!” পৃথার অনিচ্ছা সত্ত্বেও টুরুন এক পায়ে খাড়া। সেদিন মায়ের সঙ্গে অনেক ঝামেলা করে টুরুন নীচে দাদুর কাছে শুলো। বেশ কিছুক্ষন দুজনে জেগে গল্প করার পর ক্লান্ত টুরুন ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে মহেশবাবু বসবার ঘরে এসে আরামকেদারায় বসলেন ভূত দেখবার আশায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মহেশবাবুও ঘুমিয়ে পড়লেন। ভূত দেখার আশায় অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর দাদু আর নাতি তখন গভীর ঘুমে। হঠাৎ একটা চেয়ার টানার আওয়াজে টুরুনের ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল আওয়াজটা বসবার ঘরের দিক থেকে এসেছে। চারদিক বেশ অন্ধকার। সবকিছুই একটু আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। টুরুন বিছানা ছেড়ে বসবার ঘরের চৌকাঠের সামনে এসে উঁকি মেরে দেখে দাদু আরাম কেদারায় শুয়ে মুখ হা করে ঘুমোচ্ছেন আর টেবিলে বসে ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা রসদাদু দাবা খেলছেন। অন্যদিকে আরেকজন বসে আছেন কিন্তু অন্ধকারে তাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। তবে টুরুনের মনে হল অবয়বটা খানিকটা ভ্যানিশদাদুর মতোই। টুরুন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চৌকাঠেই বসে পড়ল। রসদাদুর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, একমনে দাবা খেলে চলেছেন।
সকাল হতেই পৃথা তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এসে দেখে আরামকেদারায় বসে ঘুমোচ্ছেন মহেশবাবু আর পাশের শোবার ঘরের চৌকাঠে বসে দরজায় হেলান দিয়ে টুরুন ঘুমোচ্ছে।
টুরুনকে তুলে মহেশবাবুকে জাগিয়ে পৃথা জিজ্ঞেস করলো “তোরা এরকমভাবে ঘুমোচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?” কারুর কোনও উত্তর নেই। পৃথা রাগে গজগজ করতে করতে দোতলায় চলে গেলে, মহেশবাবু টুরুনকে জিজ্ঞাসা করলেন “কি দাদুভাই কিছু দেখেছ নাকি? আমি তো দেখার আশায় বসে বসে ঘুমিয়েই পড়লাম।” টুরুন বললো “হ্যাঁ দাদু, দেখলাম তো! রসদাদু টেবিলে বসে দাবা খেলছে , মনে হ’লো সঙ্গে ভ্যানিশদাদুও আছে।” মহেশবাবু বুঝতেই পারলেন এটা টুরুনের স্বপ্ন। জলজ্যান্ত সান্যালবাবু ভূত হবেন কি করে। যাইহোক ঠিক হল আজ রাত্রে দাদু নাতি একসঙ্গে আবার ভূত দেখার চেষ্টা করবে।
সকাল নটা নাগাদ হঠাৎ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন দেখে মহেশবাবু কৌতূহলবশত ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর “দত্তজেঠু! আমি অনীক বলছি, রসময় সান্যালের ছেলে। কদিন ধরে অনেকবার চেষ্টা করে আজ লাইনটা পেলাম। একটা খবর দেবার ছিল আপনাকে। বাবা আর নেই! নবমীর দিন রাত্রে ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।” এটুকু শুনেই মহেশবাবুর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। আস্তে আস্তে কেদারায় বসে পড়লেন। রসময় সান্যাল নেই একথাটা বিশ্বাস করতেই পারছিলেন না মহেশবাবু। বাড়ির কাউকে ডেকে যে খবরটা দেবেন সেটুকুও পেরে উঠলেন না। আরামকেদারাতেই বসে রইলেন চুপ করে অনেকক্ষণ। সব যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল। একদিকে এতদিনের বন্ধুকে হারানোর শোক, অন্যদিকে মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা – আবুর ভূত দেখা, টুরুনের মাঝরাতে রসদাদু আর ভ্যানিশদাদুকে দাবা খেলতে দেখা আর তারপরে এই ফোন – তাহলে কি সত্যিই ভূত বলে কিছু আছে!
পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।