banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: সংকেত রাগ: পর্ব ১

স্নিগ্ধা সেন

জানুয়ারি ৪, ২০২২

The Sitar musical instrument
সেতারটা একপাশে শোয়ানো, ম্রিয়মাণ যেন
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

ফোন এসেছিল এই পত্রিকা অফিসের নম্বরে, সম্পাদকের ঘরে। সম্পাদক ভবানীপ্রসাদের হাতে ফোন ধরিয়ে বললেন, ‘সেলেব্রিটির ফোন। দেখুন কোথায় কী লিখে ফেলেছেন রিভিউয়ে।’ সেলেব্রিটি? মানে কোনও শিল্পী? ভবানীপ্রসাদ কলকাতার একটি সুপরিচিত সংবাদপত্রের শিল্পসংস্কৃতি বিভাগের সিনিয়র রিপোর্টার,সঙ্গীত সমালোচক– অভিজ্ঞতায় ভারী, বয়েসেও নেহাত ছেলেছোকরা নন। তাই গানবাজনার আসরে ওঁকে চেনে অনেকেই। শিল্পীরা ওঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন কারণ খবরের কাগজের ভালো রিভিউ প্রচার আর পরিচিতি বাড়ায়।

ফোন করেছিলেন সেলিব্রিটি সেতারী শান্তিমোহন রায়। দেশবিদেশ ঘুরে আসা শান্তিমোহনকে সেতারীমহলে গুরু বলে মানে সবাই। ‘রায়’ পদবী দেখে প্রথম প্রথম কলকাতায় অনেকে বাঙালি ভেবে স্বজাতিগৌরবে আহ্লাদিত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু এখন সকলেই জানেন শান্তিমোহন উত্তর ভারতের মানুষ। জলসা সম্মেলন সুবাদে কলকাতায় যাওয়া-আসা প্রায়ই। তাই বাংলা বলেন ঝরঝরে। সামান্য একটু অবাঙালি টান আছে যেটা ওঁর সেতারের মিঠে ঝঙ্কারের মতোই মনোহারী।

হালে শান্তিমোহন কলকাতায় এসেছেন শোনা যাচ্ছিল। কোনও অনুষ্ঠান এখনও পর্যন্ত ঘোষিত হয়নি, তবে রসিকমহলে উদ্যোগ চলছে। গত বছরে এমন একটি অনুষ্ঠানেই শান্তিমোহনের সঙ্গে ভবানীপ্রসাদের পরিচয়— প্রচারউন্মুখ শিল্পী আর নামী পত্রিকার সাংবাদিকের যেমন হয়।

ভবানীপ্রসাদ ইংরেজি লেখেন চমৎকার। বিশেষ করে অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন লেখার সময় এমন সব বর্ণিল এবং সুরেলা উপমা ব্যবহার করেন, যে সেটি নিজেই হয়ে ওঠে সাহিত্যকর্ম বিশেষ। আর একটি বিশেষত্ব ওঁর রিভিউয়ে পাওয়া যায়, তা হল শিল্পীর সমঝদারি। ভবানীপ্রসাদ নিজেও সেতার বাজান। বাইরে বাজাতে ওঁকে শোনা যায়নি, কিন্তু নিজের ঘরে রেওয়াজে বসেন নিয়মিত। অন্তত দু’ঘণ্টা উনি মেট্রোনোম আর সুরপেটি নিয়ে অভ্যেস করেন তালিম পাওয়া নানা কায়দা কৌশলের। লয়জ্ঞান ওঁর ভালো, হাতও যথেষ্ট তৈরি।

ভবানীপ্রসাদের সেতারে তালিম হয়েছে ওঁর দাদু অনাদিপ্রসাদের কাছে। অনাদিপ্রসাদ গোস্বামী ছিলেন জমিদার। অবশ্য সে জমিদারী কবেই ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, এলাকা হিসেবে সেটি এখন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। অনাদিপ্রসাদ যখন যুবক ছিলেন, এই জমিদারীর আয়ে ওঁর শখবিলাস ভালোই মিটত। শখ তো ছিল একটিই, কিন্তু একান্ত প্রাণের শখ বলতে যা বোঝায়, তা ছিল সেইরকম। মার্গসঙ্গীতে ছিল রুচি,ভারতবর্ষের নানা জায়গা থেকে ওস্তাদদের আমন্ত্রণ করে আনতেন, বিশেষ করে যন্ত্রশিল্পীদের। অনেক অর্থব্যয় করে তালিম নিতেন, সংগ্রহ ছিল অনেক রাগরাগিণীর। আর ছিল সৃজনশীল কল্পনার অসীম বিস্তার। উনি নতুন রাগ তৈরি করতে ভালোবাসতেন। বাজনার ছোটছোট কায়দা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। চাইতেন ওঁর নিজের বাজনায় যেন একটা স্পষ্ট স্বকীয়তা থাকে। ছাত্র ছিল জনাকয়েক। তাদের মধ্যে আদরের নাতি ভবানীপ্রসাদকে বসাতেন এবং চমৎকৃত হতেন দেখে, যে ছাত্রদের চাইতে নাতি তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে। সে বয়সে ছোট বটে, কিন্তু মাথা তার পরিষ্কার এবং শেখে খুব মন দিয়ে। সত্যিই স্কুলের গণ্ডী পার হবার আগেই সেতারে তার হাত বেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

Pixels Sitar Player
অনাদিপ্রসাদ সেতারে নতুন রাগ তৈরি করতে ভালোবাসতেন।

কিন্তু অনাদিপ্রসাদ এটা বুঝেছিলেন, যে জমিদারীর আয়ের আনুকূল্য না থাকলে, শুধু সঙ্গীতচর্চা করলে নাতির জীবনে সচ্ছলতা আসবে না। অতএব দাদুর কড়া নজরদারিতে লেখাপড়া আর সেতারচর্চার জোড়া চাপের মধ্যে ভবানীপ্রসাদ বড়ো হয়ে উঠছিলেন। অনাদিপ্রসাদের মৃত্যু, দেশভাগ, জমিদারীর অনিশ্চিত অবস্থা এবং শরিকী বিবাদবিসংবাদ ভবানীপ্রসাদকে ঠাঁইনাড়া করল। তিনি এসে পড়লেন কলকাতায়।

কলকাতায় ভবানীপ্রসাদকে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন অনাদিপ্রসাদের পরিচিত কয়েকজন। কিন্তু সঙ্গীতচর্চার ব্যাপারটা আপাতত পাশে সরানো রইল। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করে যখন বেরলেন ভবানীপ্রসাদ- সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। ইংরেজি ভালো লিখতেন বলে লেখালেখির কাজ করতেন। ছোটখাটো আর্টের ম্যাগাজিনে লিখতেন ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস সম্বন্ধে। রাগরাগিণীর সূত্র যে দেশীয় সঙ্গীতেই, দরবারী পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতিতে সঙ্গীতের উপযুক্ত বিকাশের জন্য প্রকৃত সমঝদার শ্রোতার কতখানি প্রয়োজন, সে সম্বন্ধে কিছু যুক্তিসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

সে সব লেখা একটি সুপরিচিত বড় কাগজের, এখন যেখানে তিনি কাজ করেন, সেখানকার সম্পাদকের চোখে পড়ে। এই পত্রিকায় ডেকে এনে ভবানীপ্রসাদকে চাকরী দেন তিনিই। কলকাতার ছোটবড়ো অনুষ্ঠানে ভবানীপ্রসাদ এখন পরিচিত মুখ। কয়েকজন প্রবীণ সেতারী ওঁকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। মতামতের মূল্য দেন। এতটাই, যে নিজেরা ছাত্রদের যখন শেখান, ভবানীপ্রসাদ এসে বসলে আপত্তি করেন না। বাজনা এবং রাগবিজ্ঞান বিষয়ে নানারকম আলোচনা করতে পছন্দ করেন দু’তরফই। তাতে ভবানীপ্রসাদের লাভ হয়েছিল। বাড়িতে গোপনে রেওয়াজ এবং সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে ওঠাবসা করার ফলে দাদুর শিক্ষার বাঁধন আলগা হতে পারেনি।

শান্তিমোহন রায় ফোনে যখন বললেন, ‘আমি কি ভবানীপ্রসাদ গোস্বামীর সঙ্গে কথা বলছি?’ ভবানীপ্রসাদ এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলেন শান্তিমোহন বোধহয় ভুল করে ওঁকে এই কাগজের কর্তাদের কেউ বলে ধরে নিয়েছেন। কোনও উত্তর দেবার আগেই আবার প্রশ্ন। ‘আপনি কি ভবানীপ্রসাদ গোস্বামী?’ জবাবে ‘হ্যাঁ’ শুনে ওদিকের কণ্ঠ বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই আপনার বাড়িতে। বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন দয়া করে?’ একটু থমকিয়ে গেলেন ভবানীপ্রসাদ। বাড়ি কেন আসতে চাইছেন?
– আমার বাড়িটা এমন জায়গায় যে খুঁজতে অসুবিধে হবে আপনার।
– আমার এখানে যে ড্রাইভার, সে কলকাতার রাস্তাঘাট খুব ভাল চেনে। আমার অসুবিধে হবে না। 
সম্পাদকমশাই একদিকের কথা শুনে আন্দাজ করেছেন ব্যাপারটা। ইশারা করে বললেন বাড়ির ঠিকানা বলে দিতে। দেখা করার একটা সময় ঠিক করা হল, সামনের রবিবার, সকাল দশটা নাগাদ। ভবানীপ্রসাদ ফোন ছেড়ে দেবার পর সম্পাদকমশাই বললেন,
– বড় আর্টিস্ট, নিজের সম্পর্কে ভাল কিছু লেখাতে চাইছেন নিশ্চয়, কিন্তু কিন্তু করবেন না।

সেই বিশেষ রবিবারের সকাল বেলায় ভবানীবাবু ভারি বিপন্ন বোধ করতে লাগলেন। শান্তিমোহন এলে তাঁকে কীভাবে আপ্যায়ন করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। একা মানুষ, থাকেন বাগবাজারের ভেতর দিকে একটা গলিতে, ছোট্ট টু রুম ফ্ল্যাটে। একটি বয়স্কা মহিলা দু’বেলা এসে ঘর পরিষ্কার, কাপড়কাচা ইত্যাদি করেন। খাবার দিয়ে যায় পাড়ার হোটেল। ইলেক্ট্রিক হিটার কিনেছিলেন এক প্রতিবেশীর পীড়াপীড়িতে। খাবার গরম করতে কিম্বা কফি-চায়ের জল গরম করবার সুবিধে হয়। হিটারে চাপানোর মতো বড়ো দু’তিনটি মগ আর বাটি আছে। ছাঁকনিতে চা ভিজিয়ে,গুঁড়ো দুধ, সুগার কিউব মিশিয়ে খাওয়া,ব্যস। তবে এরকম অগোছালোভাবে আজ কি শান্তিমোহনের সঙ্গে ভদ্রতা রক্ষা করা যাবে? অনেক ভেবেচিন্তে ভালো বিস্কুট আর কফির শিশি কিনে আনলেন। স্বেচ্ছায় অভিভাবক বনে যাওয়া সহৃদয় প্রতিবেশীটির কাছ থেকে ধার করে আনলেন ভালো কাপডিশ।

অনাদিপ্রসাদ গোস্বামী ছিলেন জমিদার। অবশ্য সে জমিদারী কবেই ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, এলাকা হিসেবে সেটি এখন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। অনাদিপ্রসাদ যখন যুবক ছিলেন, এই জমিদারীর আয়ে ওঁর শখবিলাস ভালোই মিটত। শখ তো ছিল একটিই, কিন্তু একান্ত প্রাণের শখ বলতে যা বোঝায়, তা ছিল সেইরকম। মার্গসঙ্গীতে ছিল রুচি,ভারতবর্ষের নানা জায়গা থেকে ওস্তাদদের আমন্ত্রণ করে আনতেন, বিশেষ করে যন্ত্রশিল্পীদের। অনেক অর্থব্যয় করে তালিম নিতেন, সংগ্রহ ছিল অনেক রাগরাগিণীর। আর ছিল সৃজনশীল কল্পনার অসীম বিস্তার। উনি নতুন রাগ তৈরি করতে ভালোবাসতেন। 

শান্তিমোহন এলেন সওয়া দশটা নাগাদ। বাড়িটা খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছে। ভবানীপ্রসাদ অতিথিকে নিয়ে বসলেন ওঁর কাজের ঘরে। কাজের কথাই হবে মনে হচ্ছে। তবে প্রথমে একটু আতিথেয়তা হোক। নিজেই কফি করে বিস্কুট সাজিয়ে রাখলেন টেবিলে।
– বেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট তো মশাই আপনি। জমিদার ফ্যামিলির লোক হয়ে এমন? বাঃ বেশ।
– আপনি সে কথা কী করে জানলেন?
– আপনার দাদু জমিদার অনাদিপ্রসাদ একজন ভালো মিউজিকোলজিস্ট ছিলেন আমি খবর পেয়েছি। উনি কিছু রাগ তৈরি করেছিলেন যা খুব বেশি কাউকে শোনান নি। ওই রাগগুলির হদিশ আপনার কাছে পাব বলেই দেখা করতে চেয়েছি।
– আপনাকে কে বলেছে এ সমস্ত?
– আপনার দাদুর কাছে কিছুদিন শিখেছিলেন মহীন সরকার। এখন দিল্লিতে থাকেন। আমার সঙ্গে পরিচয় আছে। তিনিই আমাকে বলেছেন, যে একমাত্র আপনার কাছেই এই রাগগুলির সন্ধান পাওয়া যাবে।
– আমার কাছে? আমি কতটুকু শিখেছি? দাদু মারা যাবার পর আমি তো কলকাতায় চলে এলাম আর এখন এ সব চাকরি…
– শুনেছি আপনি খুব মেধাবী ছিলেন এবং অনাদিপ্রসাদ যা শেখাতেন চটপট তুলে নিতেন, মহীনবাবুই বলেছেন। উনি আমাকে আপনার দাদুর করা দুটো রাগের কথা বলেছেন। ‘স্রোতধ্বনি’ আর… আর ‘অক্ষর’ না ‘বর্ণ’ এরকম নাম তাদের।

 

আরও পড়ুন: স্নিগ্ধা সেনের বড়গল্প: বৃত্তান্তর

 

ভবানীপ্রসাদের মুখে হালকা হাসির রেখা।
– হ্যাঁ,দাদু ভালবাসতেন নতুন কিছু করতে। ‘স্রোতধ্বনি!’ সে এক অদ্ভুত রাগ তৈরি করেছিলেন বটে। সম্পূর্ণ জাতি, সোজা চলনের রাগ। কিন্তু বিস্তার অংশে স্বর এগতো ঘসিটের কায়দায়, একটা স্রোত বয়ে যাওয়ার মতো। আর মীড়তান লাগিয়ে স্রোতের বাঁকগুলো, ঢেউ এ সব বোঝানো যাবে, এমন বলতেন দাদু। শেষের দিকে ঝালা বাজাবার সময় নদীর কুলুকুলু আওয়াজ যাতে মনে হয়, সেভাবে কন্ট্রোল করে তারে স্ট্রোক দেওয়া হত।
– অসাধারণ কনসেপ্ট। আর অক্ষরমালা না কী যেন অন্যটা– সেটা কি অলগ্‌ কিসিমের?
শান্তিমোহনের গলায় যেন কী রকম একটা সুর। মুগ্ধতার নয় অবশ্যই। প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশঙ্কা? তিনি বাঙালিদের খুব একটা পাত্তা দিতে চান না বলেই শোনা যায়। ভবানীপ্রসাদ বললেন,
– এটা ঠিক মনে নেই। পুরোনো খাতায় খুঁজে দেখব।
শান্তিমোহন বললেন,
– পুরনো খাতায় আরো কিছু পেলে মুঝে বাতাইয়েগা। আপ খুদ নেহি বাজাতে হো?
খুব সিরিয়াস হলে শান্তিমোহনের কথায় যে হিন্দি এসে জড়ো হয় বুঝেছেন ভবানীপ্রসাদ। বললেন,
– নিজের মনে বাজাই। দাদু খুব ভালোবেসে শিখিয়েছিলেন।
– রাগগুলো আমাকে যেদিন দেবেন, বাজিয়ে শোনাবেন। আপনার দাদুর স্টাইল নিশ্চয় আপনার বাজনায় পাব।
অনুরোধ আর আদেশের একটা মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কথাগুলো।

Sitarist
নিজের মনে বাজাই। দাদু খুব ভালোবেসে শিখিয়েছিলেন।

শান্তিমোহন চলে যাবার পর ভবানীপ্রসাদ নিজের প্যাঁটরা খুললেন। প্যাঁটরা মানে এক সুটকেস ভর্তি দাদুর গানের খাতাপত্র। স্রোতধ্বনি পাওয়া গেল অল্প খুঁজেই। কিন্তু অক্ষর? না বোধহয়, ‘বর্ণ’ শুনেছিলেন নামটা। কই এমন কোনও রাগ তো মনে পড়ছে না। রাগরাগিণীর কারবার স্বর নিয়ে, ওই স্বরকে রাগের বর্ণমালা ভেবেছিলেন দাদু? স্বরের পর স্বর সাজিয়ে একটা স্টেটমেন্ট? বা রঙ মিলিয়ে একটা ছবি? ভবানীপ্রসাদের চিন্তায় জট পড়ে গেল।

হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎচমক। দাদুর অনেক উদ্ভাবনী কল্পনার মধ্যে একটা ছিল সঙ্কেত রাগ। ওই ভাবনার পেছনে তিনি লম্বা সময় ব্যয় করেছেন। ভবানীপ্রসাদ তখন সবে কৈশোর পার করেছেন, তবু দাদু ওঁকে ধরেই বোঝাতেন ওই শব্দটা দিয়ে ঠিক কী বলতে চাইছিলেন। উনি ভেবেছিলেন, বিভিন্ন রাগের বিশেষ স্বরবন্ধ আলাদা আলাদা নিয়ে যদি আলাদা আলাদা ভাবনার ইমেজ তৈরি করা যায় এবং বাজনার নানা কায়দায় যদি সেই ইমেজ স্রোতার মনে জাগিয়ে তোলা যায় তা হলে সার্থক কম্যুনিকেশন তৈরি হবে শিল্পী আর শ্রোতার মধ্যে। উদাহরণ দিতেন পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার। আর হাতে সময় ছিল না এত কিছু ভাববার। বিকেলে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। রবিবারের প্রাইভেট জলসা, কিন্তু ভালো শ্রোতার ভিড় হবে।

শান্তিমোহন ফোন করলেন দু’দিন পর। কবে বসা যাবে আবার? রবিবার ছাড়া ভবানীপ্রসাদ ফুরসত পান না। সুতরাং ঠিক এক সপ্তাহ পরে ফের দিন স্থির করা হল। এবার আর চা নয়, ভালো কোনও জায়গায় নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ খাওয়াবেন শান্তিমোহনকে, এমন প্ল্যান ভবানীপ্রসাদের। সকালটা সেতার নিয়ে নির্বিঘ্নে কাটবে। একটা গোপন উত্তেজনা হচ্ছিল, বড়ো সেতারীর সামনে বাজাবেন বলে।

এবারে বসা হল ফরাস পেতে। সেতার শোওয়ানো রয়েছে একধারে। দাদুর তড়পদার সেতারটা নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায় চলে আসবার সময়। খুব সাবধানে, ধাক্কা বাঁচিয়ে। সেই সেতারই বাজান। দাদুর খাতা থেকে স্রোতধ্বনির পাতা ক’টি জেরক্স করে রেখেছেন, তুলে দেবেন শান্তিমোহনের হাতে। দাদুর সৃষ্টি করা রাগ শিখতে চাইছেন, কত আনন্দের কথা। তাকে পারিবারিক সম্পত্তি মনে করে গুপ্তবিদ্যা করে রাখার কথা ভবানীপ্রসাদের মাথায় আসেইনি।  

একা মানুষ, থাকেন বাগবাজারের ভেতর দিকে একটা গলিতে, ছোট্ট টু রুম ফ্ল্যাটে। একটি বয়স্কা মহিলা দু’বেলা এসে ঘর পরিষ্কার, কাপড়কাচা ইত্যাদি করেন। খাবার দিয়ে যায় পাড়ার হোটেল। ইলেক্ট্রিক হিটার কিনেছিলেন এক প্রতিবেশীর পীড়াপীড়িতে। খাবার গরম করতে কিম্বা কফি-চায়ের জল গরম করবার সুবিধে হয়। হিটারে চাপানোর মতো বড়ো দু’তিনটি মগ আর বাটি আছে। ছাঁকনিতে চা ভিজিয়ে,গুঁড়ো দুধ, সুগার কিউব মিশিয়ে খাওয়া,ব্যস। তবে এরকম অগোছালোভাবে আজ কি শান্তিমোহনের সঙ্গে ভদ্রতা রক্ষা করা যাবে? অনেক ভেবেচিন্তে ভালো বিস্কুট আর কফির শিশি কিনে আনলেন। 

স্রোতধ্বনি নিয়ে এ ক’দিন বসেছেন বলে শান্তিমোহনের সামনে হাত ভালোই চলল। ভদ্রলোক চোখ বুজে তারিফ করছিলেন। স্রোতের কলধ্বনি কৃন্তনের কোন কৌশলে বাজানো হল, সেটি তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন,
– আমাকে সেতারটা দিন, আমি চেষ্টা করি।
হাতে সেতার নিয়ে মাথা নোয়ালেন একবার।
– গুণী মানুষের যন্ত্রের মর্যাদা দিতে শিখেছি। বুঝতে পারছি এটি আপনার দাদুর।
কথায় দরবারী কারুকাজ একেবারে। শান্তিমোহন ওস্তাদ মানুষ,ভবানীপ্রসাদের বাজনা থেকে কায়দা ধরে নিতে ওঁর বেশি সময় লাগেনি। তবে ভবানীপ্রসাদ জানেন এবং শান্তিমোহন ও মনে মনে মানলেন, রেওয়াজ ছাড়া এ জিনিস চট করে হাতে পাকা হয়ে উঠবে না।  

কিন্তু অন্য রাগটা? তার তো নির্দিষ্ট কোন নামই নেই! সঙ্কেতরাগ একটা ভাবনামাত্র। দাদু ভাবনাটাকে বাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শান্তিমোহন কি বুঝবেন কোন প্রেরণা ছিল দাদুর চেষ্টার পেছনে? স্বর দিয়ে ছবির পর ছবি এঁকে একটা বৃহৎ কিছুর ধারণা দেওয়া এবং তার জন্য ছক ভেঙে রাগ অঙ্গের মুক্ত ব্যবহার, এ এমন প্রয়াস, যা শাস্ত্রের মাপা গন্ডিতে বিশ্বাসী শিল্পী বা শ্রোতার বোধের বাইরে। তবু এই সম্বন্ধে দু’ এক কথা বললেন দাদুর সম্মান রাখবেন বলে। শান্তিমোহন খুব মন দিয়ে শুনছিলেন ভবানীপ্রসাদের ব্যাখ্যা। বললেন, ‘আপনার দাদু কি ছবি আঁকতেন?’ ঠিকই। অনাদিপ্রসাদ ছবির প্রদর্শনী দেখতে পছন্দ করতেন, বলতেন ছবি, নৃত্য আর সঙ্গীতের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকতেই হবে। সৃষ্টি হবে পরস্পরকে অবলম্বন করে। তবে এ সব কথা ভবানীপ্রসাদ আর বললেন না। ওঁর মনে হল শান্তিমোহনের আগ্রহ ছিল রাগসংগ্রহে, রাগের সৃষ্টি তত্ত্বে নয়। কথায় কথায় অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভবানীপ্রসাদ অতিথিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রেস্তরাঁর দিকে।      (চলবে)

 

ছবি সৌজন্য: Fineartamerica, facebook

স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।

One Response

  1. স্নিগ্ধাদি, সকালে উঠেই আপনার এই অসাধারণ লেখাটি পড়ে মনটা এক অন্য জগতে চলে গেল। আগেকার দিনে শারদীয়া পত্রিকাতে যে ধরনের গল্প পড়তাম সেগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com