banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

নন্দিনী আসছে…: পর্ব ৩

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

A psychological novel

*আগের পর্বের লিংক: [] [
*পরের পর্বের লিংক []

নন্দিনী বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। উপরের ঠোঁট নিচের সহোদরাটিকে জড়িয়ে নিবিড়। একেবারে পরিপাটি। মাথার তলায় বালিশ। কোমর অবধি হালকা চাদর। সুখী নিঃশ্বাসে ভরে আছে সারাটা ঘর। সকালবেলায় এমন দৃশ্য দেখলে পুণ্য হয়। চল্লিশ সেকেন্ড ভালো করে নন্দিনীকে দেখল রঞ্জন। তারপর ওর দিকে এগিয়ে গেল। বাঁ হাতে পিঠে চাপড় দিয়ে সুর করে বলল,
– এই যে নন্দিনী ম্যাডাম, উঠে পড়ুন…।
ডান হাতে ধরা চায়ের কাপটা বিছানার শিয়রে টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেল নিজের কাপটা আনতে। দুটো কাপ একসঙ্গে আনতে গেলেই চলকে পড়ে। সে হাতেই আনো বা ট্রে-তে বসিয়েই আনো, চলকাবেই।
কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকেই, যা ভেবেছিল রঞ্জন, নন্দিনী ওঠেনি। কাপটা টেবিলে রেখে আবার ডাকল
– এই যে এনআরসি, ওঠো, উঠে পড়…

এই যুগটাই সংকোচনের। সহকর্মীরা নন্দিনী রায়চৌধুরীকে সংক্ষেপে ডাকে এনআরসি। রঞ্জন মজুমদারও তাই আরএম। এইবার আওয়াজ এল,
– উঁ… উম… উহ..আর একটু…
– না না ওঠ… দেরি করে গেলে কচুরি জিলিপি কিছুই পাবি না…।
নন্দিনীর কপালে মাথায় আঙুল বুলিয়ে দিল রঞ্জন। ডানদিকের গালে আলতো চুমু খেল।
– উঠে পড় লক্ষ্মী মেয়ে…
পিঠে হাত রেখে আস্তে-আস্তে ওকে বসিয়ে দিয়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল।
– এই নে চা খা…
চোখ খুলল নন্দিনী। কাপে হালকা চুমুক দিল,
– বাহ্‌!
রঞ্জনের সকালটা ভরে গেল।
– ভালো?
নন্দিনী দু’বার মাথা দোলাল।
– এই একটা কাজ তুই ভালোই পারিস…
– পারিই তো… তাছাড়া আজ বিশ্ব চা দিবস, ভালো করতেই হবে। একেবারে সত্যজি রায়ের বিজ্ঞাপন মেনে চা বানিয়েছি…
নন্দিনী হাসল। ঘুম জড়ানো হাসি।
– অমনি একটা বলে দিলি… সত্যজি রায়ের–
– আরে! সত্যি… ওঁর করা চায়ের বিজ্ঞাপনের অনেক ডিজাইন আছে। এখন যেটার কথা বলছি তা চা বানাবার পদ্ধতি নিয়ে। ফলো দ্য রুল অফ ফাইভ টু মেক আ পারফেক্ট কাপ অফ টি…

 

আরও পড়ুন: অমর মিত্রের ধারাবাহিক উপন্যাস: কাকলি গানের বাড়ি


নন্দিনীর চোখ এইবার পুরো খুলে গেছে,
– এত সুন্দর গল্প বলিস যে, বোঝা মুস্কিল ঢপ দিচ্ছিস কিনা…
– আচ্ছা তোকে দেখাচ্ছি– 
রঞ্জন মোবাইল খুলে বিজ্ঞাপনটি উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু দু’তিন মিনিট চেষ্টার পরেও পাওয়া গেল না।
– এইখানে সিগন্যালটা ঠিক আসছে না।
– হুম… আর আসবেও না। নন্দিনী দুষ্টু-দুষ্টু হাসল। রঞ্জনের কথা বিশ্বাস করেনি।
– তোকে ঠিক দেখাব। দু’জন মহিলা গোল টেবিলে বসে… একজন টি-পট থেকে চা ঢালছেন, অন্যজন টেবিলে দু’কনুই ভর করে বসে, চা ঢালা দেখছেন। আসলে সেই সময় সেন্ট্রাল টি বোর্ড চা জনপ্রিয় করতে এমন অনেক বিজ্ঞাপন করেছিল। সত্যজি রায়, অন্নদা মুনশি এঁরা দু’জনেই ডিজাইন করেছেন–
– ও তাই বুঝি? খুঁজে পেলে দেখাস তো… ভালো ফিচার হয়
– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছ’বছর পরের বিজ্ঞাপনের হেডিং– ‘সুখে ও দুঃখে চা-ই একমাত্র নির্ভর… । ওই বিজ্ঞাপনের কপি-র শেষ লাইন– ‘আজ পৃথিবীকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবার অভিযানেও চা-ই আপনার সহায় হোক…’
বলতে-বলতে নিজের কাপটাও নাটুকে ভঙ্গিতে এগিয়ে ধরল রঞ্জন। এইবার নন্দিনী মেনেছে।
– এইটা জোগাড় কর, লিখব…
– হ্যাঁ, লেখ। ভালো হবে। চল এইবার উঠে তৈরি হয়ে নে, ঘুরে আসি…। আমিও মুখে-চোখে একটু জল দিয়ে নিচ্ছি…

অন্যদিনের থেকে রবিবারটা এই কারণেই আলাদা যে, একমাত্র এইদিনই চারপাশের গাছগুলোকে ভালো করে লক্ষ করা যায়। যেমন, সকালে হেঁটে ফেরবার সময় রঞ্জন দেখেছে কাঠবাদাম গাছের পাতায় কত ধুলো জমেছে। এ অঞ্চলে ধোঁয়াধুলো কম। তবু এত ধুলো! মধ্য কলকাতার গাছগুলোর তাহলে কী অবস্থা! তখনই দেখেছে, পেয়ারা গাছের পাতার আড়ালে টিয়াপাখি ঠোঁটের আরামে পেয়ারায় ঠোক্কর দিচ্ছে। বুলবুলি আকারের, কুচকুচে কালো কিন্তু পেটের কিছু অংশ সাদা, সেই অচেনা পাখিটার ছবিও তুলেছে রঞ্জন সকালে।

মোবাইলে তোলা ছবিটা দেখেই নন্দিনী বলল,
– এটা তো দোয়েল…
ও ইতিমধ্যে সালোয়ার কামিজ পরে তৈরি। রঞ্জন তো রেডি ছিলই। ওরা টু-হুইলার চেপে চলে গেল চিপুর। জোড়াসাঁকোর কাছে একটা দোকান খুব প্রিয়। বাইক দাঁড় করিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসতেই দোকানের ছেলেটা বলল,
– নমস্তে জি…গুড মর্নিং…

ছেলেটার বাবা থাকলে এসব কিছু বলে না। গম্ভীর মুখে রুটিনমাফিক চারটে করে কচুরি দেয় দু’জনকে। সঙ্গে আলুর তরকারি। আলুর পিঠে খোসা লেগে থাকে। কচুরি শেষ হলে চারটে করে জিলিপি। অতগুলো জিলিপি খেতে না চাইলে কোনও কোনওদিন নন্দিনী আগাম বলে দেয় দু’টো দেবার জন্য। কচুরি জিলিপি খাবার পর ইচ্ছে হলে ওরা সোজা গঙ্গার ঘাটে যায়। অথবা অন্য কোনও দিকে। কখনও এয়ারপোর্ট ধাবায় চলে যায়। কখনও চিড়িয়াখানায়। দক্ষিণেশ্বর-বেলুড়ও ঘুরে এসেছে। 

তোকে ঠিক দেখাব। দু’জন মহিলা গোল টেবিলে বসে… একজন টি-পট থেকে চা ঢালছেন, অন্যজন টেবিলে দু’কনুই ভর করে বসে, চা ঢালা দেখছেন। আসলে সেই সময় সেন্ট্রাল টি বোর্ড চা জনপ্রিয় করতে এমন অনেক বিজ্ঞাপন করেছিল। সত্যজি রায়, অন্নদা মুনশি এঁরা দু’জনেই ডিজাইন করেছেন…

একবার তো সোজা কোলাঘাট চলে গিয়েছিল। ক’দিন আগে চন্দননগর। রাস্তার ধাবায় খাওয়া সেরেছিল সেবার। মোটমাট বেশি বেলা হয়ে গেলে ওরা খেয়েই ফেরে। কোনও-কোনও রবিবার এরই মধ্যে সিনেমা দেখাও ঢুকে পড়ে। কখনও-সখনও নাটকও। আজকাল জেলার নাটক খুব উন্নতি করেছে। কল্যাণী আর বালুরঘাটের দল দু’টি তো দারুণ।

নন্দিনী চারটে জিলিপিই খেল। চায়ে প্রথম চুমুকটা দিতেই যেন মনে পড়ে গেল…
– এই আরএম শোন, চল আমরা গড়ের মাঠে যাই, একটু গড়াগড়ি খেয়ে যাব বিধান সরণির সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে। একটা অনুষ্ঠান আছে। গান হবে… কিছুক্ষণ শুনে খেতে যাব। আজ চাইনিজ খেতে ইচ্ছে… নতুন কোনও জায়গা ভেবে নে– নন্দিনী বাঁধা গতের বাইরে চলতে ভালোবাসে। এইজন্যেই তো ওকে এত ভালো লাগে। ওর কথা শেষ হতে-না-হতেই রঞ্জন বলল,
– ভাবতে হবে না, যাব এলিয়ট রোড। এক চিনে পরিবার তাদের বাড়িতে খাওয়ায়। এটা কোনও দোকান নয়। চাউ মিয়েনটা ফাটাফাটি…

দুপুরের খাওয়া শেষ হতে-হতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। ফেরবার সময়, নন্দিনী মনে করে কবিতা দত্ত বনিকের জন্য এক প্যাকেট চাউ মিয়েন নিয়ে নিল। ওর সঙ্গে ভদ্রমহিলার খুব ভাব। রঞ্জন একটু দূরত্ব রাখে। নন্দিনীর মতো মাসিমা-ফাসিমা ডাকতে পারে না। বলে, ম্যাডাম বা মিসেস বনিক। বাড়ি ফিরতে সোওয়া পাঁচটা। তারপর একটু গড়িয়ে নিল দুজনেই। রাত্তিরে আর রান্না করতে ইচ্ছে করল না কারোরই। রঞ্জন বলল,
– এনআরসি চল বিরিয়ানি খেয়ে আসি…
নন্দিনী নাক কোঁচকাল।
– ইচ্ছে করছে না রে…
– কেন? পেট ভার? আমার তো কখন সব হজম…
– না ঠিক ভার নয়, তবে বিরিয়ানি খাবার মতো চনমনেও নয়
– তাহলে মাংসের ঝোল রুটি?
নন্দিনীর চোখ চকচক করে উঠল!
– কোথায় পাবি?
– আছে, আছে জায়গা আছে। তুই থাক, আমি নিয়ে আসছি…
– ওলে ওলে কী ভালো ছেলে… নন্দিনী চুমু ছুড়ে দিল।

 

আরও পড়ুন: অনুভা নাথের গল্প: ক্লোমা

 

রাত্তিরেও জমিয়ে খাওয়া। খাওয়ার পরে বাসন ধোওয়া, রান্নাঘরের টুকিটাকি গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব নন্দিনীর। ঘর দু’টিতে বিছানা করা, মশারি খাটাবার কাজ রঞ্জনের। কখনও-কখনও একটা ঘরেই বিছানা হয়। মশারিও। তবে তা সাধারণত শনিবার। তখন একটা খাট পুরো লাগে না, অর্ধেক খাটেই দু’জনে ধরে যায়। খাটের কোণায়, ঘরের দেওয়ালে ওদের পূর্ণস্বর, অর্ধস্বর, চন্দ্রবিন্দু সব ধাক্কা খেতে-খেতে নেচে বেড়ায়। বাতাসের প্রতিটি অণু-পরমাণু আনন্দ নামের বায়বীয় বস্তুর ঔরসে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এই সময়েই রঞ্জনের মনে হয়, সে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট ঘুরে আসতে পারে। নন্দিনীর মনে হয়, উত্তরবঙ্গের চা-বাগান শ্রমিক আর নারী পাচার চক্র নিয়ে একটা বড় বই লিখে ফেলা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। রঞ্জন বলল,
– গুড নাইট।
ওর হাতে শহিদুল জহিরের নির্বাচিত উপন্যাস। রাত্তিরে ওদের দু’জনেরই অভ্যাস বই পড়া। পড়তে পড়তে ঘুমনো। নন্দিনী হাসল,
– তাই? গুড নাইট? চা খাবি না?
এর মানে যে চা খাওয়া নয়, রঞ্জন ভালোই জানে। ও হাসল–
– এই চা-টাও আমি ভালোই বানাতে পারি, কী বল?
তারপর দু’টো ঘরই অন্ধকার।

ওদের রবিবার এমনই নিয়মছাড়া কাটে। এই একটা দিনকে ওরা তারিয়ে-তারিয়ে, চেঁচে-পুঁছে উপভোগ করতে চায়। প্রতি রবিবারে নতুন মজা। সোম থেকে শনি ওদের দেখলে বোঝাই যাবে না, এত আনন্দ পাবার ক্ষমতা দু’জনের।

অন্য দিনে সকালে হাঁটবার সময়েই রঞ্জনের মাথায় ঘুরতে থাকে রিটেল আউটলেটের চেহারা। যে দোকানগুলোর বিক্রি কমছে তার নামগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। সাহু ট্রেডিং, শম্পা ইলেকট্রনিকস– দু’টোই সুজয়ের এরিয়া; বিধান মোবাইল সার্ভিস, মৃদুলের; গণপতি সেলস আর মোবাইল সলুশনস– অনন্য। অফিসে গিয়েই সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। রঞ্জনের হাঁটার গতি বেড়ে যায়।

ঘরে ফিরেই দ্রুত চা বানিয়ে নন্দিনীকে ডাকে। এক ডাকেই উঠে পড়ে মেয়েটা। হুস-হুস করে চা শেষ করে ঘর-লাগোয়া টয়লেটে ঢুকে পড়ে। রঞ্জনও তিন চুমুকে চা শেষ করে ভ্যানগার্ডের পাতা উল্টে নেয়। নন্দিনীর কোনও লেখা বের হলে ওপর ওপর চোখ বোলায় একবার। রাত্তিরে ভালো করে পড়বে বলে সরিয়ে রাখে। নন্দিনী হাঁক দেয়,
– ব্রেক ফাস্ট…
খাবার টেবিলে দুধ-কর্নফ্লেক্স, কলা, ডিমসেদ্ধ। মাখন পাঁউরুটি। টেবিলের কোণায় বড় পাত্রে কলা, আপেল, নাসপাতি রাখা থাকে। ওরা দু’জনেই জেলা থেকে এসেছে বলে ফল খেতে ভালোবাসে। শহরের ছেলেমেয়েরা তেমন একটা ফল খায় না আজকাল। 

খেয়েই তৈরি হয়ে নেয় রঞ্জন। যেদিন সকাল-সকাল যাবার থাকে নন্দিনীর, রঞ্জন ওকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যায়। সোমবার যেতেই হয়। কারণ ওইদিন ফিচার নিয়ে আলোচনা হয় এডিট মিটিংয়ে। মিটিং শুরু হয় তাড়াতাড়ি। অন্যদিন সাড়ে এগারোটা-বারোটাতেও অফিস গেলে চলে। যাবার আগে বাড়িতে বসেই ল্যাপটপ ঘেঁটে প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। দেশ-বিদেশের ই-পেপারগুলো পড়ে। 

রাত্তিরেও জমিয়ে খাওয়া। খাওয়ার পরে বাসন ধোওয়া, রান্নাঘরের টুকিটাকি গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব নন্দিনীর। ঘর দু’টিতে বিছানা করা, মশারি খাটাবার কাজ রঞ্জনের। কখনও-কখনও একটা ঘরেই বিছানা হয়। মশারিও। তবে তা সাধারণত শনিবার। তখন একটা খাট পুরো লাগে না, অর্ধেক খাটেই দু’জনে ধরে যায়। খাটের কোণায়, ঘরের দেওয়ালে ওদের পূর্ণস্বর, অর্ধস্বর, চন্দ্রবিন্দু সব ধাক্কা খেতে-খেতে নেচে বেড়ায়।

রঞ্জন অফিসে গিয়েই টিমকে নিয়ে বসে। দুর্বলতাগুলো ধরে–
– দেখ আমাদের প্রোডাক্ট হল সার্ভিস। আমরা মোবাইল যন্ত্রটা বেচছি না, বিক্রি করছি কানেকশন। আজকাল সবাই দাম কমাতে-কমাতে এমন জায়গায় গেছে যে, সবারই অফার হরে-দরে এক। আমাদের সেলস বাড়াতে গেলে কাস্টমারদের বুঝতে হবে… রিটেলগুলোকে বোঝাতে হবে প্রোডাক্ট ভালো করে বোঝাও… মিথ্যে আশ্বাস দিও না… আর লোকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর…। যারা কর্পোরেট অ্যাকাউন্ট দেখছ, তাদের দায়িত্ব নিয়মিত কোম্পানিগুলো ভিজিট করা। সে তোমায় ডাকুক বা না ডাকুক তবু ঘুরে আসতে হবে। এইভাবেই রিলেশনশিপ গড়ে ওঠে…
এরপরে দলবল রাস্তায় নামে। রঞ্জনও যায়, তবে আগে থেকে টিমকে জানায় না কোথায় যাবে। সবাই সতর্ক থাকে এজন্য।

যেদিন বেলা করে বেরোয় নন্দিনী, কাজের মাসির সঙ্গে দেখা হয়। কী কী রান্না হবে বলে যায়। অন্যদিন মাসি নিজের মতো বাজার করে এনে রান্না করে, ঘর মুছে, থালাবাসন ধুয়ে, ফ্রিজে খাবার ভরে রাখে। চাবি রাখা থাকে দোতলার মাসিমার কাছে। অবশ্য চাবিওয়ালাকে দিয়ে আরও একজোড়া চাবি করানো হয়েছে, যার একটা নন্দিনীর ব্যাগে, অন্যটা রঞ্জনের পকেটে থাকে। রাত্তির করে ফিরলে মাসিমাকে আর বিরক্ত করতে হয় না।

কোনও-কোনও দিন অবশ্য সবকিছু এমন মসৃণ ঘটে না। একটু খরখরে হয়ে যায়। রাত্তিরে ফিরতেই নন্দিনী বলল,
– নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখবি…
রঞ্জন তাকিয়ে রইল।
– কতবার বলেছি চান করবার পর তোয়ালে শুকোতে দিয়ে যাবি, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখবি…তা না বিছানায় ভেজা তোয়ালে, ঘরের কোনে নোংরা জাঙিয়া লটপট করছে…
রঞ্জনেরও দিনটা ভালো যায়নি। বিকেলবেলায় ন্যাশনাল সেলস হেড মুম্বই থেকে ফোন করে ঝাড় দিয়েছে, আরও ভালো করতে হবে পারফরম্যান্স। মাথাটা গরমই ছিল, তবু শান্ত গলা‌য় বলবার চেষ্টা করল,
– একদিন হয়ে গেছে…এমন করছিস–
– একদিন? একদিন?
দু’বার দু’রকম ঝোঁক দিয়ে উচ্চারণ করল নন্দিনী।
– অন্তত দু-তিন মাস এই চালাচ্ছিস… আমি কিছু বলি না বলে–
এইবার রঞ্জনও খেপে গেল,
– তোকে তুলতে হবে না, আমারটা আমি বুঝে নেব…
– কী বললি!
নন্দিনীর চোখমুখ লাল।
– এখন তো বলবিই… প্রোমোশন পাবার পর থেকে তোর রোয়াব বেড়ে গেছে। যা-যা, ওইসব মস্তানি অফিসের জুনিয়রদের দেখাস। গাড়ি কেনার পর থেকে ভাবছিস কী একটা হলাম। আরে ওইরকম গাড়ি কলকাতায় হাজার একটা লোক রোজ কিনছে…

 

আরও পড়ুন: সৌরভ হাওলাদারের বড়গল্প: বিপ্রতীপ

 

প্রোমোশনের কথা তুলে খোঁটা দিচ্ছে! একবারও ভাবল না, গাড়িটা যেদিন কিনেছে, ওকে নিয়ে কতটা চক্কর মেরেছে সেদিন। কী সব কথা– রোয়াব বেড়ে গেছে! টু-হুইলারটা বিক্রি করে পেল তিরিশ হাজার। নন্দিনীর কুড়ি ছিল। দু’টো যোগ করে যা হল তাই দিয়ে নন্দিনীর জন্য কেনা হল স্কুটি। এইগুলো কেমন বেমালুম ভুলে গেল! অহংকার আমার হয়নি, হয়েছে তোর। এইসব কথা মনে-মনে বলল রঞ্জন। মুখ দিয়ে ছিটকে বের হল–
– তুইও তো বেড়ে গেছিস প্রেস ক্লাবের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে ঢোকবার পর থেকে! এখানে যাচ্ছিস, ওখানে যাচ্ছিস, টিভি-তে মুখ দেখাচ্ছিস! সব ব্যাপারে পণ্ডিত। এখন আবার দিল্লিতে উইমেন্স প্রেস ক্লাবের মেম্বার হবার চেষ্টা… ভাবছিস কী হলাম!
বলেই খারাপ লাগল। রাগ ব্যাপারটা আদতে নিজেকেই পোড়ায়। নন্দিনী তেড়েফুঁড়ে আরও অনেক কিছু বলছিল। কানে না তুলে, চুপচাপ জামাকাপড় বদলিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল রঞ্জন। ঘুমের ঘোরে মনে হল কেউ যেন ডাকছে। খাবার কথা বলছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। চোখে আবার ঘুম এসে গেল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখল নন্দিনী চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে।
– গুড মর্নিং…
ওর ঠোঁটে গরম চায়ের ধোঁয়া ওঠা হাসি। গতরাতের মন কষাকষির কোনও লেশ নেই কোথাও। তখন এইভাবেই তো মিটে যেত সব। একদিন কোনও কারণে কাজের মাসি আসেনি। নন্দিনী বাড়ি ফিরে, ফোন করে বলেছিল রাতের খাবার নিয়ে আসবার কথা–
– বাড়িতে কিচ্ছু নেই। চাইনিজ, তড়কা-রুটি যা পাবি নিয়ে আসবি।
সেদিন রঞ্জনেরও কাজের চাপ। একাজে-ওকাজে খাবারের কথা বেমালুম ভুলে গেল। বাড়ি ঢুকতে-ঢুকতে সাড়ে দশটা।
– কি রে, কী আনলি?
– কী আনব বল তো?
নন্দিনী শান্ত চোখে তাকিয়ে। তখনই মনে পড়ল…
– এহহে, একদম ভুলে গেছি… এই রে! এখন কী হবে?
এইবার নন্দিনী গম্ভীর।
– কোনও দায়িত্ববোধ নেই তোর…আজকাল আর ভরসা করা যায় না তোকে।

ধাক্কা খাবার মতো কথা। এবং এর কোনও জবাব হয় না। মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে গেল রঞ্জন। কী করে যে ভুলে গেল সব! আজকাল কেন যে এমন ভুল হচ্ছে! অথচ আজকে একটা দেবার মতো খবর রঞ্জনের পকেটে। টুইটার মোবাইলের অফার লেটারটা আজই পাওয়া গেছে। জোনাল হেড, মাইনেও সব মিলিয়ে প্রায় থার্টি পারসেন্ট বাড়বে। ভেবেছিল ঘটা করে, নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করবে খবরটা, বলবে-
– এইবার আমরা বিয়ে করতে পারি।
কিন্তু সব ঘুলিয়ে গেল।
– খেতে আসা হোক। নন্দিনীর গলা। গম্ভীরভাব কাটেনি।
খাবার টেবিলে গিয়ে রঞ্জন অবাক। প্লেটে সাজানো আট-দশটা স্যান্ডউইচ! দু’জনের পক্ষে যথেষ্ট। এক কামড় দিয়েই বোঝা গেল টুনা স্যান্ডউইচ।
– তুই বানালি?
– ভেবেছিলাম রোববার ব্রেকফাস্ট করব। এক কৌটো টুনা আজই কিনেছিলাম। তোর অপূর্ব মেমারির জন্য আজই খুলে ফেলতে হল…
রঞ্জন উচ্ছ্বসিত।
– সত্যি দারুণ বানিয়েছিস। তুই আমার দুর্ভিক্ষের ধর্মগোলা…
– কী বললি? ধ..ধ…ধর্মগোলা?… হা-হা-হা
ফুসফুস খালি করে হেসে উঠল নন্দিনী।
– হ্যাঁ…। অপ্রস্তুত মুখে, মৃদু গলায় দু-তিনবার ধর্মগোলা উচ্চারণ করল রঞ্জন।

 

***

– কী ধর্ম-ধর্ম বিড়বিড় করছ বলতো? 
ওই কবিতা দত্ত বণিক-মার্কা মুখের ভদ্রমহিলা আশ্চর্য রকমের শান্ত।
– যদি আমায় রাখলে তোমার কোনও অধর্ম হয়, রেখ না। নাহয় থানাতেই জমা করে দাও আমায়…।
যেন থানাতে জমা করলেই ওর সব সমস্যার সমাধান।
– না-না। আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। আপনি অত উতলা হবেন না, কোথাও না হলে আমি যেখানে থাকি, নিয়ে যাব…
ভদ্রমহিলাকে নিয়ে অত কিছু ভাববার নেই। অন্য সমস্যা রঞ্জনের। এই তিনটে ঝুরি নামানো বটগাছের তলায় সে যে দাঁড়িয়ে আছে, তা ঠিক। সামনে দিয়ে বাস-ট্রাম-অটো-ট্যাক্সি এবং জনতা যে নিজের নিয়মে চলে যাচ্ছে, তাও ঠিক। ওর গাড়িটা যে সুইস পার্ক নার্সিংহোমের সামনে রাখা, বেশ মনে আছে। কিন্তু এখন যে কী করবার, মাথায় আসছে না। অথচ, কিছু একটা কাজ নিশ্চয় আছে।

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com