চাকরি করতে বাঙালি বরাবরই ভালোবাসে। বিভিন্ন রাজার দরবারে, সদাগরি আপিসে, জুটমিলে, যাবতীয় বড়বাবু, গোমস্তা, নায়েব, ম্যানেজারের পদ আলো করে থেকেছে বাঙালি। সেই মুঘল আমল থেকেই। আর এই দীর্ঘ কলম-পেষার যাত্রায় তার সঙ্গী হয়ে পায়ে কোমরে জড়িয়ে থেকেছে ধুতি। পদমর্যাদা অনুযায়ী এই ধুতির ধরন ধারন বদলে বদলে গেছে। কিন্তু গত শতাব্দির নব্বইয়ের দশক অবধিও পুরুষদের ‘ফর্মাল’ পোষাকের তালিকা থেকে একেবারে মুছে যায়নি ধুতি।
ঠাকুরদা ছিলেন জুটমিলের বড়বাবু। সাহেবসুবোদের সঙ্গে ওঠবোস। শুনেছি কারুর ওপর রেগে গেলে রীতিমতো ‘ব্লাডি সোয়াইন’ বলে গাল পাড়তেন। কিন্তু কাজে যাওয়ার পোষাক ছিল সে সময়ের বাকি পাঁচটা বাঙালির মতোই – ধুতির ওপর ফুল শার্ট (গোঁজা), পায়ে চকচকে পাম্প শু, মোজা, পকেটে চেন লাগানো পেতলের ঘড়ি। ধুতি পরার কায়দা ছিল কুঁচি দিয়ে আর সেই কুঁচি পকেটে না গুঁজে সামনে ঝোলানো থাকত। শীতকালে শার্ট-এর ওপর গরম কোট পরার চল ছিল। যদিও ১৯৭১ সালের ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে দেখানো হয় ছবির নায়ক ধুতি পরে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ায় তার বিলিতি কোম্পানিতে চাকরি হয়না। কিন্তু আশির দশক অবধি ডালহৌসি চত্বরেও হাতেগোনা কিছু ধুতি পরা ক্লার্ক দেখতে পাওয়া যেত। এমনকি নব্বইয়ের দশক অবধি স্কুলের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ ধুতি পাঞ্জাবি পরে স্কুলে আসতেন। তাঁদের পায়ে থাকত চামড়ার চটি অথবা বেল্ট দেওয়া কাবলি শু। আর পালাপার্বণের জন্য তোলা থাকত ধাক্কা পাড় বা জরি পাড় ফরাসডাঙার ধুতি কিংবা মিহি শান্তিপুরি ধুতি।
বিশ্বের দরবারে ভারতের বাজারের দ্বার খুলে যেতেই এই ছবিগুলো খুব দ্রুত পাল্টে যেতে থাকল। একগাদা নামী এবং দামী ব্র্যান্ড তাদের হালফ্য়াশনের পোষাকের সম্ভার নিয়ে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগল ভারতের উপকূলে। আর আমরাও আমাদের চামড়ার তলায় লুকিয়ে থাকা উপমহাসাগরীয় হীনম্মন্যতার তাড়নায় ঘাড় মুখ গুঁজে সেজে উঠতে থাকি কোট প্যান্ট টাই-এ। রোজকার পরিধেয় ধুতি ক্রমে, বিয়ের, পুজোর পোষাক হয়ে উঠল। ক্রমে এই ট্রেন্ড শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলে ধুতি পরতেই জানেনা। সেইজন্যই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধুতি পরে নোবেল নিতে দেখে ঢি ঢি পড়ে যায়।
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় আকারে স্থূল, প্রকারে কুল এবং জোকার-এ মশগুল। ভালোবাসেন মার্ভেল, ডিসি, আর যা কিছু ফিশি। পূর্বজন্মে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে বাংলার নেশায় বুঁদ। পরজন্মে গল-দের গ্রামে খোলা আকাশের নীচে গোল টেবিলে নৈশভোজের আসরে বসে বুনো শূকরের রোস্ট খেতে চান।