বাংলা কবিতাজগতে দশকের হিসেব খুব প্রচলিত, মানে দশ বছর। আর বাঙালির হিসেবে এখনও টিকে আছে যুগের হিসেব, এক যুগ মানে বারো বছর। ‘শুধু বিঘে দুই’ পত্রিকা বারো বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। ভাবলে অবাক লাগে। কীভাবে যে শুরু হল, কীভাবে যে অতিক্রান্ত হল পথ, পিছনে ফিরে তাকালে… ছবির মতো নয়, বরং স্বচ্ছ অনচ্ছ কত কীই যে…
প্রথমেই মনে পড়ছে মাঝের এক কঠিন সময়ের কথা। পত্রিকা আর বোধহয় বের করা যাবে না। ‘শুধু বিঘে দুই’ কোনও আঙ্গিকেই বাণিজ্যিক লিট্ল ম্যাগাজিন নয়। ফলে অর্থকরী সীমাবদ্ধতা প্রথম থেকেই প্রকট। সেবার তার সঙ্গে জুড়ে গেল আরও কিছু জরুরি উপাদান। মনস্থির করে পত্রিকা আর যে বেরোবে না সেকথা পাঁচজনের মাঝে ঘোষণা করে দিলাম। পরের মাস দুয়েক আমি অনুরোধ উপরোধ তো পেলামই, এমনকী হুমকিও— পত্রিকা বন্ধ করা চলবে না। হতবাক, অবাক, নির্বাক— আমার সে-সময়ের অবস্থা এসব কোনও শব্দেই বোঝানোর নয়। স্যার আর্থার কন্যান ডয়েল তাঁর সৃষ্ট চরিত্র জনাব শার্লক হোমসের পুনর্জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, পাঠকের বিপুল দাবিতে। সে তো এক কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। আর বাংলা কবিতাজগতে আবার প্রকাশিত হল কালি কাগজ অক্ষর বাঁধাই নিয়ে আমাদের ‘শুধু বিঘে দুই’। যা নিছক কল্পনা নয়, যাকে ছোঁয়া যায়!
পত্রিকা সম্পাদনার জন্য লেখকদের সঙ্গে ব্যক্তি পরিচিতি ‘শুধু বিঘে দুই’ আদপে আবশ্যিক মনে করে না। ফলত এই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখকদের সংখ্যাগরিষ্ঠই কেবল লেখার মাধ্যমে আমার পরিচিত, কখনোই দেখাসাক্ষাৎ হয়নি অথচ নিয়মিত লেখা পাঠান এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ব্যক্তিগত চেনাজানা এড়িয়ে যাওয়া ‘শুধু বিঘে দুই’-এর নিজস্ব ঘরানা বলা যায়। আর তাই, এই পত্রিকা ঘিরে আজও কোনও গোষ্ঠী তৈরি হয়নি। এ এক সচেতন প্রয়াস বই কী। সত্যি কথাটা হল, শুভানুধ্যায়ীদের রচিত কবিতাসকল ও কবিতাবিষয়ক গদ্যসমূহই পত্রিকার একমাত্র পৃষ্ঠপোষক। বর্ষীয়ানদের নিরন্তর শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ আমাদের পাথেয়, শুরুর দিন থেকে, আজও।
প্রাসঙ্গিক আরও কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমরা পত্রিকার পাশাপাশি পুস্তক প্রকাশনা শুরু করেছিলাম। তখনও ব্যাপারটা পরিকল্পনার পর্যায়ে, পেলাম বিপুল সাড়া। একথা তো জানাই যে আমরা প্রকাশিতব্য বইগুলির প্রচার বা প্রসার বা বিক্রি— কিছুই তেমন জমিয়ে করতে পারব না। জেনেশুনেই যে কতজন নিজেদের বিশেষ পছন্দের লেখাগুলি বই হবার জন্য তুলে দিলেন আমার হাতে, ‘শুধু বিঘে দুই’-কে ভালোবেসে।
অবিশ্যি কিছু অন্যরকম ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, কারও কিছু লেখা বই আকারে প্রকাশ করলাম, আধা কি এক বছরেই তাঁর নতুন বই অন্য প্রকাশনা থেকে বেরোল, সে বইয়ে ‘শুধু বিঘে দুই’ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সব লেখাগুলি জুড়ে দেওয়া হল। এতে ‘শুধু বিঘে দুই’-এর বইটির বিক্রি, যেটুকু হাঁটি হাঁটি পা পা হচ্ছিল, গেল স্তব্ধ হয়ে। আবার বই প্রকাশিত হল কি হল-না, কেউ কেউ রয়্যালটি তখুনি দিতে হবে এমন দাবি তুলেছেন। এহেন দাবির সামনে বিড়ম্বিত হওয়া ছাড়া করার কিছুই থাকে না।
আবার উলটোদিকে আছে আলো। সেই যে কথায় বলে না, তোমার ঘরে কেউ এলে তাকে থালা সাজিয়ে অনেক কিছু দেবার চেয়ে ভালোবেসে আর যত্নে একটা বাতাসা একটু জল দেওয়া হৃদয়স্পর্শী। ‘শুধু বিঘে দুই’ সেকথায় বিশ্বাসী। তাই যৎসামান্য সাম্মানিক, আক্ষরিক অর্থে তা ওই বাতাসারই সমতুল, দিতে সনিষ্ঠ থেকেছি। সে দিতে গিয়ে দেখেছি কতজন আছেন, কিছুতেই নেবেন না, পত্রিকাকে ভালোবেসে নেবেন না। আবারও লিখি, এতটাই যৎকিঞ্চিত সেই সাম্মানিক যে ওই দেওয়া বা নেওয়ায় কোনও পক্ষই লাভ বা ক্ষতির হিসেব কষতে পারবে না।
তবে? হাতে রয়ে গেল ভালোবাসা। ‘শুধু বিঘে দুই’ আর বাংলা কবিতা। তার সামনে নত হতে যে কী আনন্দ…
—সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদক, শুধু বিঘে দুই
*ছবি সৌজন্য: ‘শুধু বিঘে দুই’ পত্রিকার ফেসবুক পেজ
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।