প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]
(৩১)
‘গান যে কীভাবে দেশ থেকে দেশে ট্র্যাভেল করে তার একটা ফ্যাসিনেটিং ইতিহাস আছে৷ সেই ইতিহাসটা রঙিন ধরার চেষ্টা করত৷ লোকসংগীতের সংগ্রাহক হিসেবে ওর অভাব আমি প্রতিদিন নতুন করে অনুভব করি৷’ এই শেষ বাক্যটা লিখে ই-মেলটা শেষ করল ইউজিন৷ নতুন করে ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে আলো সেনের৷ বেশ কয়েক বছর পর৷ ইদানীং ইউজিন একটা এন.জি.ও-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে৷ যেটা চালান ক্যালিফোর্নিয়ায় বেস্ড্ এক ভদ্রমহিলা আর তাঁর মেয়ে৷ ভারতবর্ষের প্রান্তিক মানুষদের জন্য অনেক অর্থ প্রতিবছর খরচ করেন ভদ্রমহিলা৷ তবে সেসবের জন্য আলাদা ট্রাস্ট আছে৷ যে এন.জি.ও-টার সঙ্গে ইউজিন যুক্ত, সেটা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া বীরভূম জেলায় কয়েকটা গ্রামে কাজ করে৷
স্কুল রয়েছে অনাথ বাচ্চাগুলোর জন্য৷ গ্রামের মহিলাদের জন্য স্বনির্ভর হওয়ার প্রকল্প৷ বাংলাদেশে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মাইক্রো-ফাইনান্সিং-এর মডেলটাই অনুসরণ করে এরা৷ বেশ ছড়ানো কর্মকাণ্ড। ইউজিন আগে এই ধরণের কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল না৷ ও নিজেই ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেশের লোকসংগীত সংগ্রহ করত৷ সেভাবেই ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রঙিন আর আলোলিকার৷ রঙিনেরও নেশা ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের গান, বিশেষত লোকসংগীত সংগ্রহের৷ ইউজিনের সঙ্গে রঙিনের প্রথম আলাপ শান্তিনিকেতনের ট্রেনে৷ ইউজিনের গায়ের চামড়া, চুলের রং সবকিছুই কৌতূহল বাড়াচ্ছিল সহযাত্রীদের৷ জানলার ধারের একটা সিটে বসেছিল ও৷ আনরিজার্ভড কামরায় সেই সকালবেলাতেও বেশ ভিড়৷ একটু পরে বর্ধমান বা ওর কাছাকাছি স্টেশনে যাত্রীরা অনেকে নেমে গেল৷ ট্রেন একটু ফাঁকা হয়ে গেল৷ ইউজিন দেখতে পেল ওর উল্টোদিকে জানলার শার্সিতে হেলান দিয়ে একজন যাত্রী ঘুমোতে ঘুমোতে যাচ্ছে৷ মুখটা একটু হাঁ হয়ে আছে৷ লোকটাকে বেশ কাতর দেখাচ্ছে৷ ওর কাঁধের শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ছোট্ট টেপরেকর্ডার, অনেক কাগজপত্রের বান্ডিল আর কতগুলো বই৷ বইগুলো বাংলা ভাষায়, আন্দাজে বুঝেছিল ইউজিন, কেন না বইগুলো ইংরেজি ভাষায় হলে ও বুঝতে পারত৷ ইউজিন উঠেছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা সস্তার হোটেলে৷ ট্যাক্সি বলে রেখেছিল, সেটাই সুবিধে হয়েছে৷ যখন ভোরের আলো ফুটব ফুটব করছে, তখন ট্যাক্সি এসে ওর মালপত্র সহ ওকে পৌঁছে দিয়েছে হাওড়া স্টেশনে৷ নিজেও খুব ক্লান্ত ছিল ইউজিন৷ জেট ল্যাগ ওকে পেড়ে ফেলেছিল সেবারে কেন যেন৷ তার আগে বেশ কয়েকবার রাজস্থানে গেছে ও৷ কেরালা আর কন্যাকুমারীও ঘোরা হয়ে গেছে৷ হিমালয়ের কয়েকটা জায়গাতেও যাওয়া হয়েছে৷ কিন্তু পূর্ব ভারতে সেই প্রথম আসা৷

কিছুক্ষণ পর লোকটা ধরমর করে চমকে উঠে বসেছিল৷ মাথার উপরে লাগেজ রাখার জায়গায় দেখে নিয়েছিল ওর লাগেজ ঠিকঠাক আছে কি না৷ তখনই ওর চোখ পড়েছিল ইউজিনের দিকে৷ আর তারপরই যেটার জন্য ইউজিন আদপেই তৈরি ছিল না, ঠিক সেটাই করেছিল ও৷ ইউজিনের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসেছিল৷ আনন্দময় একটি মানুষের উষ্ণ হৃদয়ের স্পর্শ যেন সংক্রামিত হয়েছিল ইউজিনের মধ্যে৷ ও এতবার ভারতবর্ষে এসেছে, মানুষকে অমন হাসতে দেখেনি কখনও অচেনা মানুষের দিকে তাকিয়ে৷ ভারতীয়রা অচেনা মানুষ দেখলে একটু গুটিয়ে যায়, বিশেষ করে তার মতো সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে৷ সেদিনও ট্রেনে মানুষজন অত ভিড়ের মধ্যেও ফিসফিস করছিল তাকে দেখে৷ ইউজিন জানত তারই কথা বলছে ওরা৷ সাদা চামড়ার মানুষ মানেই সায়েব৷ সেই প্রথম লোকটির অদ্ভুত সহজ হাসার ভঙ্গি ওকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ওর দিকে একটু অ্যাপোলোজেটিকালি বলেছিল— ‘আই স্লেপ্ট৷ আই অ্যাম রঙিন৷ রঙিন মুর্মু৷’
‘ওয়্যার আর ইউ গোয়িং?’ আবার ওকে শুধিয়েছিল সদ্য ঘুম ভাঙা লোকটা৷
অদ্ভুত একটা এগজিস্টেনশিয়াল প্রশ্ন বলে মনে হয়েছিল প্রশ্নটা ইউজিনের কানে৷ ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি’ এই প্রশ্নটা ঠিক অমন সরল ভঙ্গিতে আর কেউ কখনও জিজ্ঞাসা করেনি ইউজিনকে৷
হাসির উত্তরে ইউজিনও হেসেছিল৷ ‘গোয়িং টু শান্তিনিকেতন’ বলেছিল ও৷
‘আর ইউ আ স্টুডেন্ট? ওয়াই আর ইউ গোয়িং দেয়ার? টু মিট এনিবডি? প্রশ্নবাণ ছুটে এসেছিল আবার৷
ইউজিন এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেলেছিল৷ অচেনা মানুষকে কতটা প্রশ্ন এবং কী প্রশ্ন করা যায়, সে সম্পর্কে এর কোনও ইনহিবিশন নেই৷ মুখের ভাষা যেন আয়নার মতো ওর মনের ভিতরের সবটুকু ধরে দেয়৷
ও এতবার ভারতবর্ষে এসেছে, মানুষকে অমন হাসতে দেখেনি কখনও অচেনা মানুষের দিকে তাকিয়ে৷ ভারতীয়রা অচেনা মানুষ দেখলে একটু গুটিয়ে যায়, বিশেষ করে তার মতো সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে৷ সেদিনও ট্রেনে মানুষজন অত ভিড়ের মধ্যেও ফিসফিস করছিল তাকে দেখে৷ ইউজিন জানত তারই কথা বলছে ওরা৷ সাদা চামড়ার মানুষ মানেই সায়েব৷
‘নোবডি ইন পার্টিকুলার৷ আই অ্যাম গোয়িং টু কালেক্ট সাম ফোক মিউজিক অ্যারাউন্ড দ্য রিজিয়ন৷’ ইউজিন জানিয়েছিল৷
‘ও, ইউ আর গোয়িং টু ফাইন্ড দ্য মিউজিক ইউ আর সার্চিং ফর৷’ রঙিনকে যেন সেদিন প্রফেসি ভর করেছিল৷
সেই শুরু৷ বোলপুর স্টেশনে পা রাখার মধ্যেই রীতিমত আলাপ জমে গেছিল রঙিনের সঙ্গে৷ রঙিন একটু থেমে থেমে ইংরেজি বলত৷ ওর নিজের ভাষা থেকে আক্ষরিক অনুবাদ করত ইংরেজি বাক্যগুলো৷ কিন্তু নিজের মনের ভাবকে প্রকাশ করতে ইউজিনের কাছে কনভে করতে কখনই অসুবিধে হত না রঙিনের৷
বোলপুর স্টেশনে নেমে বোঝা গেছিল রঙিনের ধড়ফড় করে জেগে ওঠার কারণ৷ উপরে লাগেজের জায়গা থেকে একটা ল্যাপটপের প্যাকেজ নামিয়েছিল ও৷ একই রিক্সা ধরে ওরা শান্তিনিকেতন গেছিল৷ রঙিন ওর চেনা একটা হোটেলে নামিয়ে দিয়েছিল ওকে৷ ‘ইউ স্টে হিয়ার৷ দিস ইজ গুড বাট চিপ৷’ রঙিন ধরেই নিয়েছিল বেশ কয়েক দিনের জন্য শান্তিনিকেতন এসেছে বলে, স্থানীয় মানুষ হিসেবে একটা সস্তা দেখে হোটেল খুঁজে দেওয়া ওর কর্তব্য৷

ইউজিনের অবশ্য খুব একটা সুবিধের মনে হয়নি হোটেলটা৷ বেশ ডাউন মার্কেট আর বিছানার গদিটা পাথরের মতো শক্ত৷ অগত্যা রঙিনেরই শরণাপন্ন হতে হয়েছিল৷ ফোন নম্বর বিনিময় হয়ে গেছিল ট্রেনেই৷ রঙিন আলো সেনের সাহায্যে পূর্বপল্লি গেস্টহাউসে সপ্তাহ তিনেকের একটা বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল৷ সেই সূত্রেই আলাপ আলো সেনের সঙ্গে৷ এক সন্ধ্যায় ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিল রঙিন৷ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আলোর সঙ্গে— ‘দিস ইজ মাই ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড শ্রীমতি আলোলিকা সেন৷ অ্যাজ শি ওয়াজ মাই টিচার ইন কলেজ, আই কল হার আলোদি৷’ আবার একগাল হেসেছিল রঙিন৷ আলোকে দুহাত জোড় করে নমস্কার করেছিল ইউজিন৷ আলো প্রতিনমস্কার করেছিলেন৷
‘ইউ ক্যান কল মি আলো৷’ খুব শান্ত, কিন্তু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন চেহারা ওঁর৷ খুব ডিগনিফায়েড৷ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েদের দেখেছে ইউজিন কাজের সূত্রে৷ সংগ্রহ করেছে মেয়েদের কথ্য ভাষার গান বিভিন্ন অঞ্চল থেকে৷ কিন্তু শান্তিনিকেতনের মেয়েরা যেন সব দিক থেকেই আলাদা৷ প্রায় সবাই একটু টেগোরের ছায়ায় আচ্ছন্ন বলে মনে হয়েছিল ইউজিনের, অন্তত ও যাদের মিট করেছিল সেই একমাসে৷ আলোও টেগোর সম্পর্কে খুব শ্রদ্ধাশীল৷ কথায় কথায় সে কথা ও বলেওছিল আলোলিকাকে৷
‘ইউ সি, আই ক্যানট হেল্প ইট৷’ উনি হেসে বলেছিলেন— ‘আমি ষাট সাল থেকে এখানে পড়েছি৷ তারপর থেকে এই পঞ্চান্ন বছর ধরে এখানেই বসবাস করেছি৷ শান্তিনিকেতনে এত বছর ধরে থাকার সুবাদে বলতে পারি এই জায়গাটা তোমার মধ্যে চারিয়ে যায় তুমি না চাইলেও৷ ইট গ্রোজ অন ইউ৷ টেগোর ইজ নট হিয়ার ফিজিক্যলি৷ বাট হি ইজ টিল নাও আ ভেরি ইমপর্টেন্ট পার্ট অব মাই লাইফ৷’
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েদের দেখেছে ইউজিন কাজের সূত্রে৷ সংগ্রহ করেছে মেয়েদের কথ্য ভাষার গান বিভিন্ন অঞ্চল থেকে৷ কিন্তু শান্তিনিকেতনের মেয়েরা যেন সব দিক থেকেই আলাদা৷ প্রায় সবাই একটু টেগোরের ছায়ায় আচ্ছন্ন বলে মনে হয়েছিল ইউজিনের, অন্তত ও যাদের মিট করেছিল সেই একমাসে৷ আলোও টেগোর সম্পর্কে খুব শ্রদ্ধাশীল৷
ইউজিন ভাবছিল টেগোরের কথা প্রথম কবে জেনেছে৷ হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেছিল ওদের বাড়িতে পটারি বার্নের একটা ক্যাটালগের সুদৃশ্য ছবির মধ্যে ও প্রথম টেগোরের ছবি দেখেছিল৷ পটারি বার্নের ক্যাটালগে অনেক বাড়ির চমৎকার সব গৃহসজ্জার ছবি থাকত৷ সেইরকম একটা বাড়ির সুদৃশ্য লিভিংরুমের দেওয়ালে দাড়িওয়ালা একজন মানুষের অপরূপ এক ছবিতে কিশোর ইউজিনের দৃষ্টি আটকে গেছিল৷ তখনই খোঁজ করে জেনেছিল ছবিটা ভারতবর্ষের একজন কবির ছবি, ১৯৪১ পর্যন্ত যিনি বেঁচেছিলেন৷ ‘হি অ্যাপিয়ারড্ লাইক আ সেন্ট টু মি’ ইউজিন বলেছিল আলোকে৷
‘রবীন্দ্রনাথের কোনও বই অনুবাদে পড়েছ তুমি?’
‘গীতাঞ্জলি’ পড়েছে ইউজিন কলেজে পড়ার সময়৷ ততদিনে ওর আবিষ্কার করা হয়ে গেছে বার্ণস অ্যান্ড নোব্লের বইয়ের দোকানের কফিশপে বিরাট এমুড়ো থেকে ওমুড়ো অবধি যে হোর্ডিং আছে, সেখানে শেক্সপিয়র, ভিক্টর হুগোর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথও আছেন৷
‘ইন ফ্যাক্ট আমার স্টুডেন্ট লাইফে বার্ণস অ্যান্ড নোব্লের কাফের যে বিশেষ কর্নারটাতে আমি বসতাম, সেখানে টেগোর যেন ছবি থেকে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন৷ আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগত৷’ ইউজিন বলেছিল৷
শুনে রঙিন হেসে উঠেছিল হো হো করে৷ ‘সো হি ওয়াজ কলিং ইউ টু কাম টু শান্তিনিকেতন৷’
‘ইয়েস, ইট ওয়াজ আ কলিং ইন আ ওয়ে’ ইউজিন বলেছিল৷
কিন্তু তুমি তো সংগ্রহ কর লোকসংগীত, শান্তিনিকেতনের মধ্যে শুধু ঘুরলে চলবে না, তোমাকে আশপাশের গ্রামে যেতে হবে৷ লোকজীবন, জনজাতির সঙ্গে মিশে তারপর তো তুমি তাদের গান সংগ্রহ করতে পারবে, সেগুলোর প্রেক্ষিত পাবে— রঙিন বলেছিল৷ তিন সপ্তাহ ধরে রঙিনই ভার নিয়েছিল ইউজিনকে গাইড করার৷ দুজনের মধ্যে কত যে আলোচনা হয়েছে গান নিয়ে, গানের চলমানতা নিয়ে৷
ইউজিন রঙিনের থেকে বেশ খানিকটা ছোট৷ বছর কুড়ির তফাত থাকা সত্ত্বেও এক অদ্ভুত অসমবয়সী বন্ধুত্ব হয়েছিল দুজনের মধ্যে৷ রঙিনের কাছে বাংলা শিখতে শুরু করেছিল ইউজিন৷ রঙিন বোলপুরের দিকে একটা স্কুলে পড়াত, আর গান নিয়ে মেতে থাকত৷ শান্তিনিকেতনের একটা উঁচু বাঁধের উপরে টিলায় গিয়ে বসে থাকত ওরা৷ পরস্পরের গানের সংগ্রহ শুনত৷

ইউজিনের ভালো লাগত রঙিনের সঙ্গে মাঠে ঘাটে বাঁধের উপর ঘুরে বেড়াতে৷ এমন অনেক অনেক বিকেলে ওরা দুজনে কথা বলেছে গান নিয়ে৷ সেরকম এক সন্ধের কথা স্মৃতিতে ঝলসে উঠল ইউজিনের৷ একটি, নাকি অনেক সন্ধ্যা?
ওরা বলছিল টমাস আলভা এডিসনের ১৮৭৭-এ ‘ফনোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কারের কথা৷ ওরা যখন কথা বলছিল তার কিছুদিন আগেই জানা গেছে এডিসন নয়, এডওয়ার্ড লিয়ঁ স্কট নামে একজন ফরাসি প্রথম আবিষ্কার করেন শব্দধারণের যন্ত্র ‘ফনোগ্রাফ’, যাতে রেকর্ড করা হয় প্রথম মানবকণ্ঠ৷ ওরা তখন এই তথ্য জানত না৷ রঙিন ইউজিনকে বলেছিল ‘ফনোগ্রাফ’ যন্ত্র কীভাবে বছর কয়েকের মধ্যেই ভারতে পাড়ি দেয় ‘গ্রামোফোন’ হয়ে৷ জগদীশ বসু ১৮৯১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে একটি ফনোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের একটি গানও রেকর্ড করেন৷ বিবেকানন্দও আমেরিকা সফরের সময় একটি ফনোগ্রাফ উপহার পান৷ এসব গল্প করেছিল রঙিন৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘আমি একটু অদ্ভুত৷ আলোদিকে ভালবেসে ফেললাম, ও দশ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও৷ তুমি আমার চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট৷ তাও তোমাকে এত ভালো লাগছে আমার৷ অসমবয়সীদের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয়৷
*****
‘বাঃ, তোমার বাড়ি কী যত্ন করে সাজানো’ প্রচন্ড অ্যাডমিরেশন নিয়ে বলছে জিনিয়া৷ এই ক’মাসে ওর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ইউজিনের৷ পাহাড়ি একটা ছোট্ট শহরে একটা বাড়িতে থাকে ইউজিন৷ সেখানে আসার জন্য ও বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিল জিনিয়াকে৷ জিনিয়ারই সময় হচ্ছিল না৷ এবার একটা ফাঁক পেয়ে জিনিয়া দুদিনের জন্য চলে এসেছে এখানে৷ এখানে একটা পাবলিকেশন হাউসের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট আপ করেছিল৷ কখন কী কাজে লেগে যায় বলা যায় না৷ কিন্তু ইউজিনের বাড়ি আসাটাও আরেকটা উদ্দেশ্য৷ ইউজিনের সঙ্গে গল্প করে বেশ আরাম পাওয়া যায়৷
জিনিয়া কিছুদিন ধরে একটা ক্লান্তি অনুভব করছে৷ রুণকে নিয়ে ক্রুজে যাওয়াটা এখনও পেন্ডিং৷ সাতদিন ছুটি হয়ত ও নিতে পারে৷ কিন্তু তারপর? বিয়াট্রিস আর রুণের সঙ্গ তো ও বাড়িতেও পায়৷ তবে ক্রুজে গিয়ে ওই একই মুখগুলো দেখে ভালো লাগবে কি যথেষ্ট? জিনিয়া একজন সঙ্গী খোঁজে, যে ওর সত্যিকারের বন্ধু হবে। তেমন আর এ বয়সে হয় না চট করে৷ এ বয়সে সবাই পরিচিত, অ্যাকোয়েন্টেন্স৷ পরিচিতি বাড়ে, বন্ধু বাড়ে না৷
এসবই ভাবতে ভাবতে দুঘণ্টা ড্রাইভিং দূরত্বে এল এ-তে পৌঁছে গেছিল ও৷ পাবলিশিং হাউসটার সঙ্গে মিটিং বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে৷ এই পাবলিশিং বিজনেসের কর্ণধার একজন মহিলা৷ সুসানের বয়স হয়েছে ভালোই, কিন্তু সাজপোশাক, কথার ভঙ্গি এবং সর্বোপরি অ্যাটিচুডে কোনও বয়সের ছাপ নেই৷ বরং বেশ ছটফটে আর ফূর্তিবাজও৷ সুসান ব্ল্যাক মহিলা৷ ব্ল্যাক এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে একটা বই নিজে এডিটও করেছে ও৷ সুসান জিনিয়াকে একটা ওপেন অফার দিয়েছে৷ বলেছে ‘ইফ ইউ আর টায়ার্ড উইথ লাইফ, অ্যাট সাম পয়েন্ট, ইফ ইউ ফিল ইউ ডিজার্ভ আ নিউ স্টার্ট, জাস্ট লেট মি নো৷ আই উইল বি হিয়ার, ইন দ্য সেম প্লেস৷’ কী করে বুঝল সুসান, ওর জীবনে একটা ক্লান্তি আছে? সুসান বহুদর্শী নিশ্চয়ই৷ অনেক কষ্ট করে ও ওর পরিবারের ছোট্ট বইয়ের দোকানটা থেকে একটা ছিমছাম, মানসম্পন্ন ছোটখাটো পাবলিশিং হাউস গড়ে তুলতে পেরেছে৷
পাহাড়ি একটা ছোট্ট শহরে একটা বাড়িতে থাকে ইউজিন৷ সেখানে আসার জন্য ও বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিল জিনিয়াকে৷ জিনিয়ারই সময় হচ্ছিল না৷ এবার একটা ফাঁক পেয়ে জিনিয়া দুদিনের জন্য চলে এসেছে এখানে৷ এখানে একটা পাবলিকেশন হাউসের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট আপ করেছিল৷ কখন কী কাজে লেগে যায় বলা যায় না৷ কিন্তু ইউজিনের বাড়ি আসাটাও আরেকটা উদ্দেশ্য৷ ইউজিনের সঙ্গে গল্প করে বেশ আরাম পাওয়া যায়৷
সুসানের সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছিল জিনিয়ার৷ কখনও হঠাৎ খেয়াল হলে সুসানকে জানাবে, বলেছিল জিনিয়া৷ অফারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইউজিনের বাড়ি পৌঁছে গেছিল ও৷ ইউজিনের মুখটা সবসময়ই হাসি হাসি, কিন্তু চোখ দুটোয় যেন কীসের এক বিষাদ লেগে আছে৷ ইউজিন ওরই অপেক্ষায় ছিল৷ পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট বাড়ি৷ দরজা খুলে একগাল হেসে ও বলল, ‘এস, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷’ ছোট্ট কথা— কিন্তু কথাটুকু মনের কোনও একটা তন্ত্রীকে স্পর্শ করল জিনিয়ার৷ সন্তান হিসেবে রুণের এক ধরনের ভালবাসার দাবি রয়েছে জিনিয়ার প্রতি৷ নাকি নির্ভরতাবোধ? বিয়াট্রিসেরও এই এত বছরে এক ধরণের অধিকারবোধ জন্মেছে জিনিয়ার উপর৷ বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে অ্যালেক্সের জীবনটা আলাদা হয়ে গেছে৷ ওর নতুন জীবনযাত্রা, নতুন প্রাত্যহিক রুটিন মেরি জানে৷ অ্যালেক্সের স্ত্রী৷ বহুদিন ধরে জিনিয়ার চলার পথ আলাদা৷ সেজন্য জিনিয়ার কোনও দুঃখবোধ নেই৷ আফটার অল ওর নিজেরই সিদ্ধান্ত ছিল বিচ্ছেদটা৷ জিনিয়া দায়িত্ব নিয়ে নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়েছে নিজের জীবনটাকে। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়— দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকলে ভালো হত৷ ইউজিন সে অর্থে ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়৷ তবে মাঝে মাঝেই ওয়াট্স্অ্যাপে চ্যাট হয় ওর সঙ্গে৷ দু-একবার স্কাইপ কলও হয়। কেউ কেউ থাকে ইউজিনের মতো, খুব কেয়ারিং টাইপ, জিনিয়ার মনে হয়৷ যখন কথা হয়, একটা আন্তরিকতা, একধরণের কনসার্ন মিশে থাকে ওর কথায়৷ এই জিনিসটা একমাত্র, মা বা দাদার মতো ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কারুর কাছে পায়নি জিনিয়া৷ সেজন্যই ‘এস তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম’ এই ছোট্ট কথাটা এমন গভীরভাবে স্পর্শ করল জিনিয়াকে৷
সুসানের সঙ্গে কথা বলে এল এ-র ট্র্যাফিকের মধ্যে দিয়ে ইউজিনের এখানে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে৷ ওহাই বলে এই ছোট্ট শহরটা এল এ থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে৷ আধ ঘণ্টার পথ৷ জিপিএসে ইউজিনের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে খুব সহজেই জিনিয়া পৌঁছে গেছে গন্তব্যে৷
সত্যিই ওর জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল ইউজিন৷ চায়ের সরঞ্জাম রেডি করে৷ নীলগিরির চা৷ এবার ভারতবর্ষ থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছে ও৷ ‘চিনি দুধ ছাড়া তো তোমার? আমার যতদূর মনে আছে…’ ইউজিন শুধলো৷
জিনিয়ার আরেকবার চমকাবার পালা৷ তিন-চার মাস আগে সান ডিয়েগোতে একবার দেখা হয়েছিল৷ কিন্তু ওর চা খাবার ব্যাপারে পছন্দ অপছন্দ ইউজিন মনে রেখে দিয়েছে!

‘মিটিং ক্যামন হল?’
‘খুব ভালো৷ সুসান, মানে যিনি পাবলিশিং কোম্পানিটা হেড করেন, তিনি একটা ওপেন অফারও দিয়েছেন আমাকে৷ যদি আমার কখনও ক্লান্ত লাগে, তাহলে ওঁদের ওখানে আমি ট্রাই করতে পারি৷’
‘কী ভাবছ? নেবে অফারটা?’ ইউজিন গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করছে৷
‘ভাবছি৷’ বলতে বলতে হেসে ফেলেছে জিনিয়া, —‘নাঃ, সিরিয়াসলি এখনই ভাবার সময় আসেনি৷ তবে…’
‘তবে কী?’ ইউজিন শুধোল৷
‘আমি ঠিক জানি না!’ জিনিয়া একটু ক্লিষ্টস্বরে বলে— ‘একসময় জীবনে এগিয়ে যাওয়া সম্পর্কে যতটা নিশ্চিত ছিলাম, এখন আর সেরকম নই৷ এখন মাঝে মাঝে বুঝতে পারি বয়েস হচ্ছে আমার৷ একটা মিডল এজ ক্রাইসিস রয়েছে হয়ত ভিতরে ভিতরে৷’
ইউজিন ভাবছে— ‘আমি বুঝতে পারছি৷’ ও বলে— ‘আমারও এরকম হয় মাঝে মাঝে জানো?’
‘তোমার জীবন কেমন চলছে ইউজিন?’ জিনিয়া জানতে চায়৷
‘চলছে জিনিয়া৷ একটা নতুন সংস্থার হয়ে কাজ করতে শুরু করেছি আমি৷’ ইউজিন বলে৷
‘কাজ পাল্টেছ তুমি? ওয়াও, আগে ইউনেস্কোর একটা প্রজেক্টে ছিলে না? জিনিয়া উচ্ছ্বসিতভাবে জানতে চায়৷
‘আমি যেটা করতাম সেটাকে তো ঠিক চাকরি বলা চলে না৷ ইউনেস্কোর একটা প্রজেক্ট আছে তৃতীয় বিশ্বের অনাথ বাচ্চাদের আর্ট শেখাবার৷ সেই প্রজেক্টের পার্ট হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত আমাকে৷’ ইউজিন বলছে, আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চাদের খেলার ছলে আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট শিখিয়ে বেড়িয়েছে ও৷ ছবি আঁকা, স্যান্ড-আর্ট, বিভিন্ন মালমশলা দিয়ে ভাস্কর্য বা মূর্তি গড়ার কাজ— এসব বাচ্চাদের শেখানোর সূত্রে নিজেও অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছে ও৷ সেখান থেকেই ওর প্রধান ভালবাসাটা গড়ে উঠেছে সংগীত সংগ্রহের৷
‘গান যে পৃথিবীতে কতরকম হতে পারে, অঞ্চলভেদে কীভাবে পাল্টে যায় তার চলনভঙ্গি, আবার কত সুর যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল করে, এসব কিছুই আমি আগে জানতাম না৷ বাচ্চাদের ‘টিচার উইদাউট বর্ডার’ থেকে আমি আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম— আমায় খুঁজতে হবে অনেক দেশে, অনেক সমাজে ছড়িয়ে থাকা গান, বিশেষত লোকসংগীতকে— যা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম৷ আবার হয়তো একই সুর যা বিশ্বজনীন৷’
‘আই রিয়েলাইজ্ড্ দ্যাট মিউজিক ইজ ট্রুলি দ্য থিং উইদাউট আ বাউন্ডারি৷’ ইউজিন হাসল৷
‘গান যে পৃথিবীতে কতরকম হতে পারে, অঞ্চলভেদে কীভাবে পাল্টে যায় তার চলনভঙ্গি, আবার কত সুর যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল করে, এসব কিছুই আমি আগে জানতাম না৷ বাচ্চাদের ‘টিচার উইদাউট বর্ডার’ থেকে আমি আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম— আমায় খুঁজতে হবে অনেক দেশে, অনেক সমাজে ছড়িয়ে থাকা গান, বিশেষত লোকসংগীতকে— যা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম৷ আবার হয়তো একই সুর যা বিশ্বজনীন৷’
‘এখন কি সেই মিউজিক খোঁজার জন্যই অন্য কোথাও কাজ নিচ্ছ তুমি?’ জিনিয়া জিজেস করেছিল৷
‘খানিকটা তাই, তবে পুরোটা নয়৷’ ইউজিন বলল— ‘আসলে অনেক দেশে তো ঘুরেছি আমি৷ ইউনেস্কোর টিমের সঙ্গে৷ বাচ্চাদের আর্ট শেখাবার কাজটা খুব এনজয় করতাম৷ কিন্তু সেখানে আমার ততটা স্বাধীনতা ছিল না৷ আমি বারবার ঘুরেফিরে কয়েকটা জায়গায় যেতে চাইতাম যে সব জায়গায় আত্মা আমাকে টানত৷ কিন্তু ইউনেস্কো আমার সেসব পছন্দের জায়গায় আমাকে পাঠাত না, হয়তো অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিত৷ তাই ভাবলাম অনেক হয়েছে৷ আমারও বয়েস হচ্ছে৷ এবার নিজের ইচ্ছেমত ঘুরব৷ তাই এই সংস্থাটার সঙ্গে যোগ দিলাম৷
‘এই সংস্থাটা কি তোমার পছন্দের জায়গাগুলোতে পাঠাবে?’
‘হ্যাঁ, আশা করি তাই৷’ ইউজিন বলে— ‘এত সব জিজ্ঞেস করছ, আমার পছন্দের জায়গা বা দেশ কোন্টা জিজ্ঞেস করছ না তো?’
সত্যি তো, একদম খেয়াল হয়নি জিনিয়ার৷ এটাই তো অবভিয়াস প্রশ্ন৷ ‘পছন্দের দেশ কোনটা তোমার?’ এবার যন্ত্রচালিতের মত জিনিয়া প্রশ্ন করে৷
‘সেটা মনে হয় তোমারও দেশ৷ ইন্ডিয়া৷’
জিনিয়া একটু চুপ করে থাকে৷ তারপর বলে— ‘ইউ সি, আই ডোন্ট কনসিডার মাইসেল্ফ ইন্ডিয়ান৷’
ইউজিন তাকিয়ে আছে জিনিয়ার ব্যাখ্যার অপেক্ষায়৷
‘আমি জন্মেছিলাম ইংল্যান্ডে৷ আমার মা বাবা ইংল্যান্ডে চলে আসেন৷ আমার জন্মের বছর দুয়েক পরে আমরা চলে আসি আমেরিকায়৷ ফিলাডেলফিয়াতে আমার ছোটবেলা কেটেছে৷ কলাম্বিয়াতে কলেজ শেষ করে বিয়ে করি৷ তারপর থেকে ওয়েস্ট কোস্টে৷ মোট কথা ইংল্যান্ডে জীবনের দুবছর বাদ দিয়ে বাকি গোটা জীবনটাই কেটেছে এদেশে৷ ইন্ডিয়া গেছি মোট দুবার কি তিনবার৷ তার মধ্যে একবার যখন আমার চার বছর বয়স, যার কোনও স্মৃতি নেই আমার৷ বড় হয়ে ইন্ডিয়া যাওয়ার তাগিদ কখনও অনুভব করিনি পারিবারিক অকেশন ছাড়া৷ এবার আমাকে বল, ইন্ডিয়াকে আমার নিজের দেশ ভাবার কী কারণ বা যুক্তি থাকতে পারে?’ এতটা একচোটে বলে জিনিয়া প্রায় হাঁপাতে থাকে৷
‘নাও ইউ নিড সাম ওয়াইন৷’ বলে উঠে গিয়ে ইউজিন দুজনের জন্য ওয়াইন নিয়ে এসেছে৷ গোলাচে পাত্রে স্বচ্ছ পানীয়৷
‘এটা কি শার্ডনে?’ জিনিয়া জিজ্ঞাসা করছে৷
‘এটা স্যাভিয়ো ব্লাঁ৷ যেটাকে আমার দেশ বলে ভাবার কথা ছিল, কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি, এটা সেই দেশের৷’ ইউজিন মজার হাসে৷

‘তোমার গল্পটা শেষ হল না৷ বলছিলে, ইন্ডিয়া তোমার পছন্দের দেশ৷ হুইচ পার্ট অব ইন্ডিয়া?’
‘ইন্ডিয়াতে বেশ কয়েকবার গেছি আমি৷ অনেক জায়গাই ভালো লেগেছে খুব৷ জয়সলমীরের এক সন্ধ্যা যেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, স্যিলুয়েটে উটের সারি, আর কয়েকজন নারী পুরুষ আগুন ঘিরে বসে গান ধরেছে তাদের ভাষায়— সেই স্মৃতি আমার বারবার ঘুরে দেখতে ভালো লাগে৷ ভালো লাগে হিমালয়ের কিছু কিছু জায়গা৷’
‘হিমালয়ে গেছ তুমি? কোথায় গেছ? রানিখেত, কৌশানী, পিথোরাগড়, উখিমঠ, আরও সব জায়গার নাম বলে ইউজিন৷ তারপর বলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি ওখানকার মানুষজনের সঙ্গলাভের জন্য৷ কত যে নতুন বন্ধু পেয়েছি আমি ইন্ডিয়া ঘুরতে ঘুরতে৷ খুব অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক সেসব দেখা হওয়া৷’
এখনও যোগাযোগ হয় তোমার ভারতের বন্ধুদের সঙ্গে?’ জিনিয়া জানতে চায়৷
‘সব সময় হয় না৷ পথে বেরিয়ে যে দেখা, পথেই শেষ হয় অনেকসময়৷ জীবনের সেই পর্বে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা৷ তারপর তা সময়ের সঙ্গে ফিকে হতে থাকে৷ কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে যায়, জানো?’
অনেক জায়গাই ভালো লেগেছে খুব৷ জয়সলমীরের এক সন্ধ্যা যেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, স্যিলুয়েটে উটের সারি, আর কয়েকজন নারী পুরুষ আগুন ঘিরে বসে গান ধরেছে তাদের ভাষায়— সেই স্মৃতি আমার বারবার ঘুরে দেখতে ভালো লাগে৷ ভালো লাগে হিমালয়ের কিছু কিছু জায়গা৷
‘তোমার কি শুধু ভারতবর্ষকে এইরকম মনে হয়? ভারতবর্ষ কী সিম্বলাইজ করে তোমার কাছে?’ জিনিয়া বলে— ‘আমি জানতে চাইছি কারণ সেই দেশটা সম্পূর্ণ অচেনা আমার৷ তাই জানতে চাইছি— তুমি ঠিক কী পেয়েছ ভারতে গিয়ে?’
ইউজিন একটু ভাবে, তারপর বলে— ‘শুধু ভারত বলাটা হয়তো ভুল হবে৷ তুমি তো জানো আমি রোমাণি৷ চলমানতা আমার রক্তে, আমার শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে৷ অনেক দেশে ঘুরতে ঘুরতেই আমার এক একটা মুহূর্তে মনে হয়েছে— এই, ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই এতকাল বেঁচে ছিলাম আমি৷ কিন্তু ভারতবর্ষে সেই মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। হিমালয়ের এক ছোট্ট শহরের কথা মনে পড়ে৷ একজন সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ চারদিকে পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি… তেমন লেয়ারস্ অব মাউন্টেন এখানে নেই। সেই পাহাড়ের ওপাশে খুব আস্তে আস্তে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল— আকাশটা রং ধরছিল৷ সূর্যোদয় হচ্ছিল৷ সেই সাধু, মোহন মহারাজ বলত তাঁকে সকলে— তিনি সূর্যের দিকে মুখ করে বসে একটা বাঁশি বাজাচ্ছিলেন৷ গেরুয়া পরা প্রবীণ এক সন্ন্যাসী তাঁর আশ্রমের কোর্টইয়ার্ডে বসে আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছেন৷ ভাবতে পারো! কোনও প্রার্থনা নয়, মন্ত্র উচ্চারণ নয়, শুধু একটা একলা বাঁশির সুর প্রকৃতির মধ্যে নিবেদন করছিলেন উনি!’
ইউজিন যেন একটু শিউরে উঠল অনেকদিন আগের সেই সাধুর বিরাট বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে আত্মনিবেদনের মুহূর্তটি স্মরণ করে৷ তারপর বলল— ‘সারা জীবন ধরে অমন একটা সুরকে খুঁজে পেতে চাইছি আমি জিনিয়া৷ যে সুর এই পৃথিবীর সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিয়ে নতুন এক জন্মের দিকে নিয়ে যাবে৷’
জিনিয়া ঠিক বুঝতে পারছিল না ইউজিনের সব কথাগুলো৷ কিন্তু ওর মধ্যে যে একটা অন্বেষণ রয়েছে সেটা বুঝতে পারছিল৷
হঠাৎ ইউজিন যেন ঘুমঘোর থেকে জেগে উঠল৷ একটু লজ্জিতভাবে বলল— ‘দ্যাখো, কথায় কথায় বলতে ভুলেই গেছি যে আজ কিন্তু আমরা একটা তুরস্কের রেস্তোঁরায় খেতে যাব৷ এটা আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা৷ তোমার গাড়িটাতেই যাই, কী বল?’
ইউজিনের নিজের গাড়িটা ছোট্ট একটা টু-সিটার৷ সেটা ওর বাড়ির সামনে পার্ক করা আছে৷ রেস্টুরেন্টটা ওর বাড়ি থেকে কুড়ি মিনিটেরও কম ড্রাইভিং দূরত্বে৷ বেশ আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা৷ খেতে খেতে জিনিয়া বলল— ‘এই নতুন সংস্থায়, যেখানে তুমি কাজে যোগ দিচ্ছ, সেখানে কী করতে হবে তোমায়?’
‘এটা চালাতেন আদতে এক ভদ্রলোক৷ এখন ভদ্রলোক মারা গেছেন৷ কিন্তু ওঁর স্ত্রী আর মেয়ে খুব যত্ন নিয়ে চালান সংস্থাটা৷ ভারতের অনেক ধরণের কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমি যেখানে যাব, সেখানে গ্রামের বাচ্চাদের জন্য স্কুল আর দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র করেছেন ওঁরা৷ সেই ছেলেমেয়েগুলোর শিক্ষার কিছুটা ভার আমার উপর৷
‘কোথায় স্কুলটা?
‘ওয়েস্ট বেঙ্গলের বীরভূমে৷ খুব কাছেই শান্তিনিকেতন৷ বেঙ্গলের খুব ফেমাস জায়গা৷ তুমি নিশ্চয়ই জানো!’

‘কী আশ্চর্য৷ শান্তিনিকেতন আমার মায়ের বেড়ে ওঠার জায়গা৷ একবার গেছিলাম ছোটবেলায়৷’ বলার সঙ্গে সঙ্গে জিনিয়ার মনে পড়ে কী একটা ঘটনা উপলক্ষ্যে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যেতে হয়েছিল তাদের৷ পরে একবার দাদা বলেছিল জিনিকে৷ দুর্ঘটনা ঘটেছিল একটা৷ কেউ মারা গিয়েছিল অকস্মাৎ৷ কে যে, সেটা জিনিয়ার কিছুতেই মনে পড়ে না৷ নিজের উপর খুব রাগ হয় ওর৷ শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জায়গা— এইটুকুই জানে জিনিয়া৷ ওর মা অরুণলেখা কোনওদিন নিজের ছোটবেলার গল্প বলতেন না৷ অনেক জিজ্ঞেস করলে একটা দুটো কথা বের করা যেত তাঁর মুখ থেকে৷
ভাবতে ভাবতে জিনিয়া একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল৷ ইউজিন তা দেখে বলল— ‘জিনিয়া, আর ইউ অলরাইট? তুমি বোধহয় কিছু ভাবছ?’
একটু বিব্রত বোধ করল জিনিয়া৷ সত্যিই তো, শান্তিনিকেতন সম্পর্কে ইউজিনের সঙ্গে কথা বলার মতো মূলধনও তার নেই৷ ও কথা ঘুরিয়ে বলল— ‘আমি আমার মায়ের কথা ভাবছিলাম৷ তোমার সঙ্গে তিনি শান্তিনিকেতন নিয়ে অনেক আলোচনা করতে পারতেন৷’
জিনিয়ার মা কোথায় থাকেন, কত বয়েস হয়েছে এসব নিয়ে কথার পর ইউজিন বলল— ‘তোমার যখন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তখন তোমার একবার গেলে ভালোই লাগবে জায়গাটা৷ দেয়ার আর স্টিল সাম অ্যামেজিং পিপল দেয়ার৷ বাট সাম আর গন৷’
খেতে খেতে ইউজিন বলছে প্রথমবার শান্তিনিকেতন যাবার পথে ওর সঙ্গে কী আশ্চর্যভাবে আলাপ হয়েছিল রঙিন বলে একটি মানুষের৷ ‘রঙিন মিন্স্ কালারফুল অ্যান্ড দিস পার্সন ওয়াজ কালারফুল ইন এভরি সেন্স অফ দ্য টার্ম৷ ৷’ ইউজিন বর্ণনা করছিল কীভাবে শান্তিনিকেতন থাকার সময়ে রঙিন ওর গাইড হয়ে চষে বেড়িয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম৷ ভূমিপুত্র হবার দরুণ গ্রামের লোকেদের জীবনযাত্রা আর তাদের গান সম্পর্কে অনেক জানত রঙিন, যে জ্ঞান ছিল তার সহজাত৷ জন্মসূত্রে পাওয়া সেই সহজিয়া জ্ঞানের ভাণ্ডার ইউজিনের সঙ্গে সে ভাগ করে নিয়েছিল অনায়াসে৷ হি ব্রিদ্ড মিউজিক৷ আমার শান্তিনিকেতনের দিনগুলো ওরকম হত না রঙিন না থাকলে৷’
‘ওয়াই আর ইউ টকিং অ্যাবাউট দিস গাই ইন পাস্ট টেন্স? ওয়্যার ইজ হি নাও?’ জিনিয়া জানতে চেয়েছিল।
একটু চুপ করে আছে ইউজিন৷
‘এবার গোল্ডস্টাইন ফাউন্ডেশন, মানে যে সংস্থায় আমি নতুন প্রজেক্টে যোগ দিচ্ছি, তাদের সঙ্গে যখন কথা হল— আমি শান্তিনিকেতনের পাশে ওই গ্রামে গিয়ে কাজ করব, তখন আমার সবচেয়ে আগে মনে পড়ল রঙিনের কথা৷ রঙিনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল আমার৷ অনেকদিন দেখা হয়নি তো, সেইজন্য৷ হয়তো আমি যথেষ্ট চেষ্টা করিনি যোগাযোগ রাখার৷ আসলে আমার মানসিকতাটাই এইরকম৷ আমি জোর করে সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করি না৷ আই নো হাউ টু লেট ইট গো৷’
‘এবার শান্তিনিকেতন যাওয়া ঠিক হতে কী করলে? রঙিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আবার?’
‘সেই কথাই বলছি৷ তোমাকে বললাম না, শান্তিনিকেতনে যাবার ট্রেনে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল রঙিনের সঙ্গে! ও তখন একটা বড় বাক্স নিয়ে ফিরছিল৷ একটা কম্পিউটারের বাক্স৷’
জিনিয়া খুব সন্দিগ্ধভাবে তাকাচ্ছে ওর দিকে— ‘সো ওয়াট! হোয়াই ইজ দ্যাট ইম্পর্ট্যন্ট হিয়র!’
‘ভেরি ইম্পর্ট্যন্ট ইনডিড৷ সেই ল্যপটপটা ও নিয়ে যাচ্ছিল ওর জীবনের এক বিশেষ মহিলার জন্য৷ ওর লাইফ-পার্টনার আলোর জন্য৷ ভদ্রমহিলা ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর ছিলেন৷ রঙিন ছিল ওর ছাত্র৷ ভদ্রমহিলা উচ্চবর্ণের৷ রঙিন ছিল সাঁওতাল, শান্তিনিকেতনের দেশজ জনজাতির অংশ৷ তাছাড়া ও দশ বছরের ছোট ছিল আলোদির চেয়ে৷ ওর দেখাদেখি আমিও আলোদি বলতাম মহিলাকে৷ যাইহোক, আমি থাকাকালীনই ও ল্যাপটপে ই-মেল করা, ওয়ার্ড প্রসেসিং এসব শিখিয়েছিল ওই ভদ্রমহিলাকে৷ ওর ই-মেলটা লিখেও দিয়েছিল আমাকে৷ —যখন তুমি আমাদের থেকে দূরে থাকবে, তখন ই-মেলে খোঁজখবর কোরো আমাদের৷ ভুলে যেও না… রঙিন বলেছিল আমার চলে আসার সময়৷ প্রায় আট বছর আগের কথা৷’

‘এই নতুন কাজটা পাওয়ার পর আমার বীরভূমে যাবার পরিকল্পনা এবং থাকার খবর জানিয়ে মেল করেছিলাম আলোদির ঠিকানায়, রঙিনের নামে। তার উত্তরও এসেছে কয়েকদিন আগে৷ রঙিন নয়, আলোদির কাছ থেকে৷ উনি লিখেছেন— আমি মেলে যেমন লিখেছিলাম, সেভাবে আর কখনও রঙিন আমার গ্রামে-গঞ্জে ঘোরার গাইড হতে পারবে না৷ তিন বছর আগে কলকাতায় এক পথ দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে৷’
খাওয়ার পর অন্ধকার আঁকাবাঁকা একটা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ইউজিনের আস্তানায় ফিরল ওরা৷ জিনিয়াই চালাচ্ছে, যেহেতু ওর গাড়িতেই গেছিল ওরা৷ ‘নীলের কী খবর?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল জিনিয়া৷ ইউজিন বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে৷ আজ আকাশে অনেক তারা৷ হঠাৎ হেডলাইটের আলো নেভালে বোঝা যায় এ জায়গাটা অ্যাস্ট্রোনমির লোকেরা তারা দেখার জায়গা হিসেবে বেছে নেয় কেন!
‘নীল ভালো আছে মনে হয়৷ ওর নিজের জায়গায় সুস্থিত৷ আমরা এখনও একসঙ্গে আছি কিনা আমি ঠিক জানি না৷’
‘তোমাকে যদি অজান্তে ব্যথা দিয়ে থাকি, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত’— জিনিয়া বলে উঠল নীল আর ইউজিনের সম্পর্কের ভাঙন আঁচ করে৷
‘দেয়ার ইজ নাথিং টু বি সরি অ্যাবাউট৷ এখন যেরকম অবস্থাতেই থাকুক না কেন, একদিন তো আমাদের এই পারস্পরিক সম্পর্ক সত্য ছিল৷ ওই তারার মত ধ্রুব৷ কিন্তু জানো তো জিনিয়া, তারাগুলোরও মৃত্যু হয়৷ এই তারা যাদের রাতের আকাশে দেখছ, তারা অনেকেই হয়তো আসলে এখন আর নেই৷ সম্পর্কও ওরকমই৷ তুমি জানো না, ভাবছ আছে৷ আসলে হয়তো ফুরিয়ে গেছে৷ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ তুমিও তো জানো এই সম্পর্কের জন্ম-মৃত্যুর গল্প, তাই না?’
হ্যাঁ, জিনিয়াও জানে সম্পর্কের ফুটে ওঠা আর ঝরে যাবার গল্প৷ ফিরে এসে পার্কে বসেছে ওরা৷ ইউজিন গিয়ে লিকিওর নিয়ে এসেছে দুটো ছোট্ট গ্লাসে৷ বেইলিজ আইরিশ ক্রিম৷ এক আকাশ তারা নিয়ে পাশাপাশি বসে আছে জিনিয়া আর ইউজিন৷ ওরা দুজনে দেখছে আকাশে মণিরত্নের মত খচিত তারাগুলোকে৷
কিন্তু জানো তো জিনিয়া, তারাগুলোরও মৃত্যু হয়৷ এই তারা যাদের রাতের আকাশে দেখছ, তারা অনেকেই হয়তো আসলে এখন আর নেই৷ সম্পর্কও ওরকমই৷ তুমি জানো না, ভাবছ আছে৷ আসলে হয়তো ফুরিয়ে গেছে৷ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷
চোখ জড়িয়ে আসছে জিনিয়ার। সারাদিন খুব হেকটিক কেটেছে, সেই সকালে সান-ডিয়েগো থেকে রওনা হবার পর থেকে৷ আইরিশ ক্রিমের প্রভাবে বেশ বুঁদ লাগছে ওর, চিন্তা জড়িয়ে যাাচ্ছে৷ কী যেন একটা বলছিল ইউজিন সন্ধেবেলা— সুর, নাকি গান নিয়ে? এক দেশ থেকে কীভাবে লোকমুখে বাহিত হয় সুর, গান চলাচল করে এক জনগোষ্ঠী থেকে আরেক জনগোষ্ঠীর ভিতর দিয়ে, সময় থেকে সময়ান্তরে নয় কি?
একই সময়ে ইউজিন বসে ভাবছিল সেদিনের কথা, যখন প্রথম ইউনেস্কোর মিউজিক নিয়ে কনফারেন্সে নীলের সঙ্গে ওর দেখা৷ ওর মনে হয়েছিল— এক সঙ্গে একটা নতুন সুর ও সৃষ্টি করবে নীলের সঙ্গে, যে সুর আগে কেউ কখনও স্পর্শ করতে পারেনি৷ ইউজিনের মনে পড়ছিল রঙিনের কথা৷ ভুবনডাঙার মাঠে বসে রঙিনই তাকে শুনিয়েছিল ‘বানাত ইস্কান্দারিয়া’ মানে ‘আলেকজান্দ্রিয়ার মেয়ে৷’ তুরস্ক থেকে লেভান্ত, টোকিয়ো থেকে টেক্সাস সর্বত্র আঁকা ছিল সুরের যাত্রাপথ৷ বলকান অঞ্চল, ম্যাসিডোনিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, ইটালির বন্দর এমনকি স্পেনের ‘সেফার্দি’ ইহুদিরা অবধি দাবি করেছিল, এ সুর এ গান তাদের নিজস্ব৷ রঙিন বলেছিল ১৯২৬ সালে কলকাতার অ্যালফ্রেড থিয়েটারে অনুষ্ঠান করে গেছিলেন মিশরের নৃত্যশিল্পী ফরিদা৷ কে জানে সেই অনুষ্ঠানেই হয়তো আলেকজান্দ্রিয়ার মেয়ের সুর প্রথম শোনেন বাঙালি এক কবি৷ তাঁর কলমে জন্ম নেয় ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে’ নামে একটি গান, যার সুর পৃথিবীর দেশে দেশান্তরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে৷
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৮ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Flickr, Amazon, Needpix
অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।