Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: শেষ পর্ব

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৩

Novel Akashpradip Part-24
Novel Akashpradip Part-24
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২] [২৩]

(৪১)

রাতে জেগে থাকার ফলে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেল সীমন্তিনীর৷ এ সময় অরুণাভ সাধারণত হসপিটালে রওনা দিয়ে দেয়৷ কিন্তু আজ ও বেরোয়নি৷

‘তুমি আজ যাবে না হসপিটাল?’ সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল৷

‘নাঃ, আজ আগে থেকেই ছুটি নেওয়া আছে৷ আজ তোমার জন্মদিন না?’ অরুণাভ হেসে বলছে৷

‘আমার জন্মদিনে সন্ধেবেলা বাইরে ডিনারে গেলেই হত৷ পুরো দিন ছুটি নেওয়ার কী দরকার ছিল?’

‘দরকার ছিল৷ আজ আমরা খুব অন্যরকমভাবে সেলিব্রেট করব৷ স্পেশাল সেলিব্রেশন ফর দ্য স্পেশাল লেডি ইন মাই লাইফ৷’ অরুণাভর কথাতে একটা রহস্যের সুর খেলা করছে৷ দোতলার স্টাডিতে বসে চা খাচ্ছে ওরা৷ এটা পূর্ব দিক৷ চমৎকার রোদ উঠেছে আজ৷ দেওয়ালজোড়া বে উইন্ডো দিয়ে সকালের সূর্য এসে পড়েছে অরুণাভ আর সীমন্তিনীর মুখে মাথায়৷ আলো লুটোপুটি খাচ্ছে অরুণাভর সল্ট অ্যান্ড পেপার চুলে৷ সীমন্তিনীর পরনে একটা আকাশ-নীল রঙের হাউসকোট৷ একঢাল খোলা চুল পিঠ ছাপিয়ে নেমেছে কোমর অবধি৷ দূরায়ত এক দেবীপ্রতিমার মতো দেখাচ্ছে ওকে৷ একটু বিষাদমাখা আয়ত দুটি চোখ৷

‘স্পেশাল সেলিব্রেশন? রিয়েলি? লাইক ওয়াট?’ সীমন্তিনী হাসিমুখেই বলছে৷ কিন্তু বহু বছর ধরে দেখার ফলে অরুণাভ জানে এখন মনে মনে ও ব্রুড করছে রণোর ফোন না করা নিয়ে৷ ওর মনটাকে ডিসট্র্যাক্ট করার জন্য অরুণাভ বলল— ‘আজ আমরা একটা স্পেশাল খেলা খেলি এস৷ লেট্‌স্‌ ওপেন আওয়ার হার্টস৷ আমরা যা ভাবছি তা সোজাসুজি একে অন্যকে বলি?’

সীমন্তিনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণাভর দিকে৷ —‘তুমি বলবে প্রথমে?’

দোতলার স্টাডিতে বসে চা খাচ্ছে ওরা৷ এটা পূর্ব দিক৷ চমৎকার রোদ উঠেছে আজ৷ দেওয়ালজোড়া বে উইন্ডো দিয়ে সকালের সূর্য এসে পড়েছে অরুণাভ আর সীমন্তিনীর মুখে মাথায়৷ আলো লুটোপুটি খাচ্ছে অরুণাভর সল্ট অ্যান্ড পেপার চুলে৷ সীমন্তিনীর পরনে একটা আকাশ-নীল রঙের হাউসকোট৷ একঢাল খোলা চুল পিঠ ছাপিয়ে নেমেছে কোমর অবধি৷ দূরায়ত এক দেবীপ্রতিমার মতো দেখাচ্ছে ওকে৷ একটু বিষাদমাখা আয়ত দুটি চোখ৷

‘ইটস্‌ ইওর বার্থ ডে৷ তুমিই আগে বল কী ভাবছ?’ অরুণাভ মোটামুটি নিশ্চিত রণোরা যে ওর জন্মদিন মনে রাখেনি, সে সম্পর্কে ক্ষোভ উগরে দেবে সীমন্তিনী৷ কিন্তু অরুণাভকে সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি করে দিয়ে ও প্রশ্ন করল —‘অরুণাভ, হাউ ডিড মাই ফাদার ডাই? তুমি গিয়ে পৌঁছবার পর কী দেখেছিলে? ওয়াজ ইট অ্যা হার্ট অ্যাটাক?’ আগে অনেকবার সীমন্তিনী এই প্রশ্নই করেছে৷ প্রতিবারই উত্তর এড়িয়ে গেছে অরুণাভ৷ কিন্তু আজ মন খুলে কথা বলার দিন৷ রণো অরুণাভকে ফোন করেছিল দুদিন আগেই৷ ও বলেছে বৃন্দাদের সঙ্গে ওদের দেখা হওয়ার কথা৷ তারপরই ওর মনে হয়েছে মাম্মার মনের অন্ধকার দূর করা দরকার৷ রণোর সঙ্গে কথা বলার পর অরুণাভও অনেক ভেবেছে৷ ও নিজেও এই ত্রিশ বছর ধরে আরেকটা সিক্রেট, একটা গোপন কথা থেকে প্রোটেক্ট করছে সীমনকে৷ বৃন্দার প্রতি যে অরুণাভর একটা আকর্ষণ ছিল, তা অরুণাভ গোপন করার চেষ্টা করেনি৷ সীমন্তিনীই বরং কোনও আগ্রহ দেখায়নি সেই আকর্ষণের বৃত্তান্ত শুনতে৷ কিন্তু ওর বাবার শেষ সময়টা নিয়ে বার বার প্রশ্ন করেছে সীমন্তিনী৷ অরুণাভই নিজেকে জড়ো করতে পারেনি সীমন্তিনীকে সবটা খুলে বলার জন্য৷ অরুণাভ ঠিকই করেছিল ও গিয়ে কী কী করেছিল, সবটা খুলে বলবে এবার সীমন্তিনীকে৷ আশ্চর্য, ঠিক সেই জিনিসটাই ও জানতে চাইছে অরুণাভর কাছ থেকে, এত বছর পর৷

face to face morning tea
দোতলার স্টাডিতে বসে চা খাচ্ছে ওরা

অরুণাভ নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল৷ রণোদের ফ্লাইট নেমে গেছে৷ মাঝের এই সময়টায় অরুণাভকে বলতেই হবে সত্যি কথাটা৷ ওই শুরু করেছে এই মন খুলে কথা বলার খেলাটা৷

খুব আস্তে আস্তে অরুণাভ বলল— ‘সীমন, ইট অ্যাপিয়ার্ড টু বি আ কেস অব ড্রাগ ওভারডোজ৷ একটা ঘুমের ওষুধ সেদিন একটু বেশি খেয়েছিলেন উনি৷ আমি খালি স্ট্রিপ পেয়েছিলাম ড্রয়ারে৷ যে ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ ইট মাইট বি দ্যাট, বাট দ্য অ্যাটাক ওয়াজ ইনডিউস্‌ড্‌ বাই স্লিপিং পিল্‌স্‌৷ লাল্টুদারা পিস হাভেনে রেখেছিল ওঁকে, আমি আসা অবধি৷ দুদিন বরফে থাকার পর চেনা যাচ্ছিল না ওঁকে৷’

সীমন্তিনী চুপ করে আছে৷ হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছে তথ্যটাকে৷

‘হয়তো ড্রাগ ওভারডোজটা আমার অ্যাসাম্পশন৷ আই অ্যাম নট অ্যাবসোলুটলি সিওর৷ এতদিন অন্য কাউকেই বলিনি৷ কিন্তু ভিতরে ভিতরে আই হ্যাড মাই ডাউট্‌স্‌৷ তুমি জিজ্ঞেস করলে তাই বললাম৷ বাট আই হ্যাভ সামথিং টু গিভ ইউ৷’

একটু থামল অরুণাভ৷ স্টাডি টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে আনছে৷

‘সীমন, আই হ্যাভ নট হিডেন এনিথিং ফ্রম ইউ ইন মাই হোল লাইফ৷ এক্সসেপ্ট দিস৷ এটা তোমাকে লেখা একটা চিঠি৷ তোমার বাবার৷ ইট্‌স্‌ আ সিল্‌ড্‌ এনভেলপ৷ আমি জানি না ভিতরে কী লেখা আছে৷ আমি শুধু এই চিঠিটা এত বছর ধরে রেখে দিয়েছিলাম৷’

সীমন্তিনী হাত বুলোচ্ছে খামের গায়ে৷ উপরে তার নাম৷ মুক্তোর মতো অক্ষরে লেখা সীমন্তিনী সেন৷ কেয়ার অফ অরুণাভ সেন৷ বাবা তাঁর আদরের মেয়েকে অরুণাভর কেয়ারে রেখেছিল৷ কিছুই বলছে না সীমন্তিনী৷ এই চিঠিটা এখন পড়ে কী হবে? ত্রিশ বছর আগে পড়লে হয়তো প্রাসঙ্গিক হত৷ এখন এটা সম্পূর্ণ ইরেলেভ্যান্ট, অপ্রাসঙ্গিক৷ সীমন্তিনীর কি এখন আর এই অপ্রাসঙ্গিক চিঠিটা পড়া উচিত? সীমন্তিনী ঠিক বুঝতে পারছে না৷ ও জানে যে এত বছর চিঠিটা এখানে ছিল না ৷ এই ড্রয়ার বহুবার ক্লিন করেছে ও৷ তখন ওটা থাকলে ও দেখতে পেত৷

old sealed letter
এই চিঠিটা এখন পড়ে কী হবে?

‘এই চিঠি কোথায় ছিল?’ শুধু এইটুকুই জিজ্ঞেস করে ও৷

অরুণাভ সব বলছে৷ ওর হসপিটালে ওর নিজস্ব ঘরের টেবিলের ড্রয়ারে ও রেখে দিয়েছিল চিঠিটা, কলকাতায় আলমারির লকারে এটা পাবার পর সঙ্গে নিয়ে এসে৷ ‘বিশ্বাস কর, আই কুডন’ট গ্যাদার মাইসেল্ফ টু গিভ ইউ দ্য লেটার দেন৷ তুমি বাবার খবরটা শোনার পর থেকে অনেকবার ফেইন্ট করে গেছিলে৷ আমি ফেরার পরও তুমি এত আপসেট ছিলে যে যেকোনও সময় তোমার মিসক্যারেজ হতে পারত৷ রণো আর তোমাকে বাঁচানো যেত না৷ আমি যে কোনওভাবে তোমাদের বাঁচাতে চেয়েছিলাম৷’

সীমন্তিনীর ভালনারেবল মন যাতে শরীরে প্রভাব না ফেলে, সেজন্যই অরুণাভ প্রোটেক্ট করতে চেয়েছিল ওর স্ত্রী সন্তানকে৷ ‘হয়তো চিঠিটায় অনেক উত্তর ছিল তোমার প্রশ্নের। কিন্তু তখন চিঠিটা তোমার হাতে দেবার চেয়ে আরও বড় কনসার্ন ছিল আমার টু প্রোটেক্ট মাই ফ্যামিলি৷ আমাদের পরিবারের ইউনিটটাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম আমি৷’

অরুণাভ সারাজীবন বড় ছাতার মতো রক্ষা করেছে ওকে আর রণোকে, সীমন্তিনী ভাবে৷ তবে রণো কি আর ওদের ফ্যামিলি বলে ভাবে? তবে তো অন্তত একটা ফোন করার কথা মনে হত ওর মাম্মার জন্মদিনে৷ ভাবতে ভাবতেই দরজায় একটা বেল বাজে৷ শুক্রবার সকাল নটার সময় কে বেল বাজাচ্ছে? সীমন্তিনী একটু অবাক, ঈষৎ বিরক্ত হয়ে উঠতে যায় দেখার জন্য কে এসেছে৷ কিন্তু তার আগেই অরুণাভ খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে নীচে নেমে যায় কে এল দেখতে৷ সিঁড়ি দিয়ে অনেক জোড়া পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ অস্ফুটে দু-একটা কথা৷ পুরুষ এবং মহিলা কণ্ঠ৷ গলাগুলো চেনা লাগছে না? সীমন্তিনী কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে৷ নীচে লিভিংরুমে না বসিয়ে অরুণাভ সবাইকে উপরে নিয়ে আসছে কেন? পরক্ষণেই চেনা গলার শব্দে সীমন্তিনী চমকে ফিরে তাকায়৷ স্টাডির দরজা দিয়ে ও কে? রণো না? পিছন পিছন রোহিণী উঠে আসছে হাসিমুখে। ওদের পিছনে অরুণাভ, মুখে একটা মিচকে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

অরুণাভ সারাজীবন বড় ছাতার মতো রক্ষা করেছে ওকে আর রণোকে, সীমন্তিনী ভাবে৷ তবে রণো কি আর ওদের ফ্যামিলি বলে ভাবে? তবে তো অন্তত একটা ফোন করার কথা মনে হত ওর মাম্মার জন্মদিনে৷ ভাবতে ভাবতেই দরজায় একটা বেল বাজে৷ শুক্রবার সকাল নটার সময় কে বেল বাজাচ্ছে?

সীমন্তিনী কি স্বপ্ন দেখছে? এই সময় তো রণোর আসার কথা নয়৷ ওর তো অনেক কাজ অফিসে৷ রণোর কি কোনও বিপদ হয়েছে? স্বপ্নটার কথা চকিতে হানা দেয় মনে৷ নাহ, রণো একগাল হাসছে৷ উস্কোখুস্কো চুল, রেড আই, ফ্লাইটে রাত্রি জাগরণে চোখ দুটো একটু লাল হয়ে আছে। মাম্মার গায়ে লেপ্টে থাকত যে কিশোর ছেলেটা এক যুগ আগে, অবিকল তার মতো দেখায় এই পূর্ণ যুবককে৷ দু-হাত বাড়িয়ে ঠিক ছোটবেলার মতো জড়িয়ে ধরে সীমন্তিনী৷ সেই কোমল কঠিন বাহুবন্ধনে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মুহূর্তে সীমন্তিনী বুঝতে পারে আজকের এই মুহূর্তটুকুর জন্যই ও এতকাল বেঁচেছিল৷ ‘হ্যাপি বার্থডে মাম্মা’, সীমন্তিনীর কানের কাছে রণো ফিসফিস করে বলে —‘আই হ্যাভ সো মাচ টু টেল ইউ৷’

***

‘‘Let me take to down/’cause I am going to Strawberry Fields
Nothing is real
And nothing to get hung about
Strawberry Fields for ever
Living is easy with eyes closed
Misundrstanding all you see
It’s getting hard to be someone
But it all works out
It doesn’t matter much to me..’’

young man holding his Mother
দু-হাত বাড়িয়ে ঠিক ছোটবেলার মতো জড়িয়ে ধরে সীমন্তিনী

অনেক অনেকদিন বাদে রণো অ্যাটিক থেকে ওর গিটারটা বার করেছে৷ আজ সারা সন্ধে ধরে গিটারটা টিউন করে নিয়ে গান গাইছে ও৷ যেতে আসতে ঘুরে ফিরে সীমন্তিনীর কানে আসছে গানগুলো৷ এখন এই গানটা গাইছে৷ সীমন্তিনীর এক সময়ের বড় প্রিয় গান৷ সদ্য বিয়ের পর পর বস্টনের দুকামরার অ্যাপার্টমেন্টে মাঝে মাঝে একটা গিটার নিয়ে গান করত অরুণাভ৷ স্ট্রবেরি ফিল্ডস্‌ গানটার সবচেয়ে স্পষ্ট স্মৃতি ওটাই৷ তখন অরুণাভর ঝুঁটি বাঁধা একটা পনিটেল ছিল৷ গালে স্টাবল, মুখটা একটু লম্বাটে৷ অরুণাভ তখন জিন্‌স্‌ আর টি শার্ট পরত বেশিরভাগ সময়৷ গিটার হাতে খুব মানিয়ে যেত ওর সেই সময়কার চেহারায়৷ এই পরিবারের প্রায় সকলেরই মিউজিকের সেন্স সহজাত৷ রণো প্রথাগতভাবে পিয়ানো লেসন নিয়েছিল, কিন্তু মাউথ অর্গ্যান, গিটার— এসব ও শিখেছিল খেয়ালে৷ হাইস্কুলে ওকে খুব দামি এই গিটারটা উপহার দেওয়া হয়েছিল ম্যাথ অলিম্পিয়াডে চান্স পাবার পর৷ ইদানীং বহু বছর পড়েই ছিল গিটারটা৷ রণোর পড়াশোনা আর তারপর কাজের চাপে গিটার বাজিয়ে গানের ইচ্ছেটাই চলে গেছিল৷ কী ভেবে কয়েক মাস আগে সীমন্তিনী দোকান থেকে আবার সারিয়ে এনেছে গিটারটা৷ স্ট্রিংগুলো নতুন করে পরিয়েছে৷ যদি রণোর কখনও বাজাবার ইচ্ছে হয়৷ এখন ওকে গিটারটা নিয়ে গান করতে দেখে খুব ভালো লাগছে সীমন্তিনীর৷ এবারের জন্মদিনটা সত্যি অদ্ভুত একটা বাঁকের মুখে দাঁড় করিয়েছে৷

সকালে ও ত্রিশ বছর আগে লেখা বাবার চিঠিটা হাতে পাওয়ার পরই বেল বেজেছিল৷ রণোরা দুদিনের মধ্যে প্ল্যান করে সারপ্রাইজ দিতে চলে এসেছে৷ অনেক কথা বলার ছিল ওর৷ সীমন্তিনীর দুবছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া মায়ের পরবর্তী জীবনে কী হয়েছিল, সে নিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনি বলছিল রণো৷ মায়ের অন্য এক মেয়ে সিমোন আর সীমন্তিনীর মাসি বৃন্দার সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের৷ একটা বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়িতে সমুদ্রের ধারে সূর্যাস্ত আর চাঁদ ওঠা দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে রণোর কাছে উন্মোচিত হয়েছে ওর অচেনা দিদিমার গল্পটা৷ নাঃ মাকে মনে নেই সীমন্তিনীর৷ শুধু অনেক বছর আগে তৈরি হওয়া একটা ক্ষত, একটা গোপন অভিমান, একটা ফাঁপা শূন্যতার বোধ রয়ে গেছে৷ বাবা ওকে একা হাতে বড় করেছিলেন৷ বড় অসময়ে অম্বিকা চলে গেলেন৷ সীমন্তিনীর আরও কিছুকাল দরকার ছিল বাবাকে৷ এই ত্রিশ বছর ধরে অনেক লড়াই করতে হয়েছে সীমন্তিনীকে— ওর বাবার হঠাৎ মৃত্যুর সঙ্গে, মার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে৷ রণোকে বড় করতে গিয়ে ও ভুলেই গেছিল সব৷ সব ক্ষত আবার বড় হয়ে ফিরে আসে রণো আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়ার সময় থেকে৷ অরুণাভ ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে৷ হঠাৎ খুব একা হয়ে গেছিল সীমন্তিনী৷ ‘ক’দিনের জন্য এবার এলি রণো?’ সীমন্তিনী আলগোছে জিজ্ঞেস করেছিল, সব গল্প যখন বলা হয়ে গেছে৷

সীমন্তিনীর দুবছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া মায়ের পরবর্তী জীবনে কী হয়েছিল, সে নিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনি বলছিল রণো৷ মায়ের অন্য এক মেয়ে সিমোন আর সীমন্তিনীর মাসি বৃন্দার সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের৷ একটা বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়িতে সমুদ্রের ধারে সূর্যাস্ত আর চাঁদ ওঠা দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে রণোর কাছে উন্মোচিত হয়েছে ওর অচেনা দিদিমার গল্পটা৷ নাঃ মাকে মনে নেই সীমন্তিনীর৷ শুধু অনেক বছর আগে তৈরি হওয়া একটা ক্ষত, একটা গোপন অভিমান, একটা ফাঁপা শূন্যতার বোধ রয়ে গেছে৷ বাবা ওকে একা হাতে বড় করেছিলেন৷ বড় অসময়ে অম্বিকা চলে গেলেন৷ সীমন্তিনীর আরও কিছুকাল দরকার ছিল বাবাকে৷  

‘এবার নিজের বাড়ি ফিরেছি অনেকদিন বাদে, থাকব এখন’— রণো একগাল হেসেছিল, বর্ষাশেষে শরতের আকাশের মতো হাসি৷ সীমন্তিনী দেখছিল, হাসলে এখনও রণোর বাঁ গালে টোল পড়ে, সেই আগের মতো৷ আগের মতোই রয়ে গেছে সব৷ হারিয়ে যায়নি কোনও কিছুই৷ বৃন্দা আর সিমোন উপহার পাঠিয়েছে বেশ কিছু জিনিস৷ বৃন্দা পাঠিয়েছে একটা লাল বেনারসি শাড়ি৷ খুব চেনা ঠেকছে সীমন্তিনীর শাড়িটা৷ ঠাকুমার মুখে অনেক গল্প শুনেছে ও শাড়িটার৷ চুয়ান্ন বছর আগে এই শাড়িটা পরেই সীমন্তিনীর মা রাধিকা অম্বিকাচরণ রায়দের ভবানীপুরের বাড়ির খোলা চাতালে বউ হয়ে নেমেছিল৷ রাধিকার ব্যবহৃত সব জিনিস যত্নে রাখা আছে বৃন্দার কাছে৷ ‘আমি এতদিন দিদির শাড়ি গয়না সব আগলে বসেছিলাম তোমার মাকে দেব বলে’— বৃন্দা বলেছিল রণোকে৷ সর্বাঙ্গে মহার্ঘ্য সোনার জরির কাজ করা শাড়িটায় খুব আলতো করে হাত বুলোচ্ছিল সীমন্তিনী৷ এই শাড়িটা তার কাছে শুধু একটা শাড়ি নয়৷ এই শাড়িতে তার মায়ের স্পর্শ লেগে আছে৷ একটা হালকা সুগন্ধ এখনও লেগে আছে শাড়ির পরতে পরতে৷ হয়ত তার মাসি খুব যত্ন করে কীটদ্রষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা করেছে শাড়িটা৷ হয়ত কোনও বিশেষ পারফিউম দেওয়া আছে ওতে৷ তবু কী ভেবে সীমন্তিনী চোখ বুজে শাড়িটার ঘ্রাণ নিল একবার৷ অন্য কোনও জন্মের সুগন্ধ এসে দখল নিচ্ছে সেন্সের৷ আগে কখনও যেন পেয়েছে এই গন্ধটা৷ এটা কি মায়ের গায়ের গন্ধ ছিল? ওর বোন হয়ত বলতে পারত৷ সিমন, ওর না দেখা বোন৷ মার অন্ধকার গর্ভ থেকে সীমন্তিনীর মতোই তারও জন্ম৷ ওর বড় নিজের সেই বোনের ছবি তুলে এনেছে রণো আর রোহিণী ওদের ফোন ক্যামেরায়৷ বারবার দেখেও আশ মিটছিল না সীমন্তিনীর৷ ওর মাসির ছবি আগে এ বাড়ির ফ্যামিলি অ্যালবামে ও আগেও দেখেছে৷ কিন্তু সেই ছবির সঙ্গে রুপোলি ক্রু কাট চুলের এখনকার বৃন্দার অনেক তফাত৷ মৃত্যু একবার জানান দিয়ে গেছে শরীরে৷ মুখে সময়ের বলিরেখা৷ একটু যেন ক্লান্ত৷ তবু যেন অসীম আত্মপ্রত্যয় বৃন্দার চোখে ৷ রোহিণী বলছিল অদ্ভুত ইন্সপায়ারিং মনে হয়েছে ওর ভদ্রমহিলাকে৷ যিনি হেসে বলতে পারেন —‘‘আর কতদিনই বা হাতে আছে ভেবে হা হুতাশ করা আমার ধাতে নেই৷ আমার অনেক কাজ বাকি এখনও৷ বিশেষ করে বীরভূমে আমার স্কুলের ছেলেপিলেগুলো অপেক্ষা করে থাকে আমার জন্য৷ আমি গিয়ে দাঁড়ালে হাসিতে ওদের মুখগুলো ভরে যায়৷ ওদের ভালবাসা, ওদের ওই সহজ সরল মুখগুলোর জন্য আমাকে বাঁচতে হবে আরও অনেক দিন৷’

সিমোন দুটো আশ্চর্য জিনিস পাঠিয়েছে ওর জন্য৷ একটা পশমিনা শাল, যেটা গায়ে জড়িয়ে শেষ দিনগুলো কেটেছে ওদের মায়ের৷ ‘হোমে মা সবসময় এই শালটা গায়ে জড়িয়ে থাকত৷ এটা আমাদের দিদিমার জিনিস৷ কী জানি হয়তো মা তার মায়ের স্পর্শ অনুভব করত এই শালটা জড়ালে! আই ডোন্ট নো, বাট ইট ইজ ভেরি ডিয়ার টু মাই হার্ট’ সিমোন বলেছিল —‘সি ওয়াজ ওয়্যারিং ইট ওয়েন সি ডায়েড৷’

Young man playing acoustic guitar
সারা সন্ধে ধরে গিটারটা টিউন করে নিয়ে গান গাইছে ও

রণো বলেছিল —‘আর ইউ সিওর ইউ ওয়ান্ট টু পার্ট উইথ ইট, বিকজ ইট ইজ আ মেমোরেবলিয়া টু ইউ টু?’

সিমোন ঝরণার মত হেসেছিল —‘কাম অন রণো৷ আমি তো অন্তত কুড়ি বছর পেয়েছি মাকে। আর যাকে দিচ্ছি এটা, সি ইজ মাই ওন সিস্টার৷ ও তো মাকে পায়নি দুবছরের বেশি৷ তাই এটা ওরই থাক৷’ রণো কোনও কথা বলতে পারেনি৷ সত্যিই খুব বড় মনের মানুষ ওরা৷ অকাতরে কেউ যে কাউকে এই স্মৃতিগুলোর অংশভাগ দিচ্ছে, সেটা গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল ওকে৷ পশমিনা শালটার সঙ্গে সিমোন আর একটা জিনিস পাঠিয়েছে সীমন্তিনীর জন্য৷ একটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি৷ ছবিতে এক সুখী দম্পতির মাঝখানে একটি ছোট্ট মেয়ে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে৷ রণো সন্তর্পণে ওর সঙ্গের একটা ফোল্ডার থেকে বার করে এনেছিল ছবিটা৷ সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে দেখেছিল কাঁপছে মাম্মার হাতখানা৷ ছবির বাচ্চা মেয়েটা হাসি মাখা মুখে ঢলে পড়েছে মা’র কোলে৷ মা আর বাবা দুজনেই হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটার দিকে।

আরও পড়ুন- গল্প: চাঁদ আঘাতের দিন

রণো টের পেল মাম্মা ভিতরের আবেগে থর থর কাঁপছে৷ উঠে এসে ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল সীমন্তিনীকে৷ ‘এই ছবিটা পরে তোমার মা’র বিলংগিংস থেকে খুঁজে পেয়েছিল তোমার বোন৷ বাকি আরও অনেক ছবি তোমার মাসির কাছে রয়েছে মাম্মা৷ শুধু এই ছবিটা তোমার মা নিয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে যাবার সময়৷ অ্যান্ড সি ডিড নট পার্ট উইথ দ্য পিকচার টিল হার ডেথ৷’ রোহিণী ওপাশ থেকে বলছিল৷ মাম্মার জন্য ওরও চোখে জল এসেছে৷ সীমন্তিনীর জন্য একটা বার্থডে কার্ডও পাঠাতে ভোলেনি ওরা৷ সেখানে একটা শুঁয়োপোকার প্রজাপতি হয়ে যাওয়ার ধাপগুলো মজা করে আঁকা৷ তলায় লেখা— Your birthday is everyday, because in each new day you metamorphose into something new.

ভিতরে দুলাইন করে চিঠিও লিখেছে ওরা সীমন্তিনীর জন্য৷ সিমোন ইংরেজিতে লিখেছে— ‘দিদি (if I may), waiting for you. Together we will resume a long pending old relationship towards a new beginning. Your sister Simone

বৃন্দার লেখাটা বাংলায় —‘পঞ্চাশ বছর আগে অন্য এক পৃথিবীতে শেষবার দেখা হয়েছিল তোমার সঙ্গে৷ যদি চাও, তবে চল আমরা আবার একটা সাঁকো তৈরি করি৷ সেই অসম্পূর্ণ সাঁকোটা আমাদের ডাকছে, অপেক্ষায় আছে তাকে সম্পূর্ণ করার৷ বেটার লেট দ্যান নেভার৷ কোনওকিছুই দেরি হয়ে যায়নি৷ তোমার মাসি বৃন্দা৷  

সীমন্তিনীর চোখ দিয়ে জল পড়ছে ধারাস্রোতে৷ ওর বুকের ভিতরের সব জমাট অন্ধকার, বরফ-জমা শীতলতা গলে গিয়ে কুল কুল করে আস্তে আস্তে নদীর আকার নিচ্ছে৷

Sad woman reading a letter

এবার বাকি কাজটুকুও করার জন্য উঠে দাঁড়ায় সীমন্তিনী৷ বাবার সঙ্গে কথা বলা এখনও বাকি৷ ওদের দোতলার কিছুটা অংশ লেকের দিকে প্রোজেক্টেড৷ উপরটাও টাফেন্‌ড্‌ গ্লাসে তৈরি৷ আলো নিভিয়ে বসলে মাথার উপরের পুরো আকাশটা ভিতর দিয়ে দেখা যায়৷ সেইখানে বসে বন্ধ খামটা খুলে ফেলে ও ভিতরের থেকে অম্বিকার লেখা চিঠি বার করে৷ ভিতরে গোটাগোটা অক্ষরে অম্বিকা লিখেছেন

 পরম কল্যাণীয়া মা সীমন্তিনী,

তোমার প্রান্তে এখনও রাত বারটা বাজে নি৷ তাই তোমার জন্মদিন শুরু হয় নি৷ পৃথিবীর যে প্রান্তে আমি রয়েছি সেখানে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে ঠিক বারটা বাজে৷ আমাদের বসার ঘরে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক ঢং ঢং করে করে বলল টেকনিকালি তোমার জন্মের শুভ দিনটি এসে পড়ল বছর ঘুরে৷ তাই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম আমার মনের একটুকরো তোমার জন্য সাজিয়ে রেখে যাব বলে৷ এই চিঠিটাই হয়ত আমার উপহার তোমার জন্মদিনে৷

তুমি যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলে সেই দিনটি আমার কাছে ছিল আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের মুহূর্ত৷ শুধু আমার নয়, বোধহয় তোমার মারও৷ তোমার মার হয়ে কথা বলা আমার সাজে না৷ সে আমার উপর অর্পণ করে যায় নি সে দায়িত্ব৷ তবু বলছি একটা বিশেষ কারণে, যা একটু পরে বলছি৷ আগে বলি – তুমি যেদিন জন্মেছিলে, সেদিন সকাল থেকে রাধিকার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল৷ দশ ঘন্টা সে আলিপুরের নার্সিংহোমের ঘরে শুয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিল৷ পাশের ঘরে আমি ছটফট করছিলাম৷ কিন্তু আমাদের এখানে সন্তানজন্মের সময় স্বামীদের প্রসব যন্ত্রণাক্লিষ্ট স্ত্রীর শয্যার পাশে থাকার অধিকার নেই৷ আমি নিজে ডাক্তার হলেও সেই অধিকার ছিল না৷ ডাক্তারনী এলেন, ঠিক সন্ধ্যে ছটার সময় তুমি পৃথিবীর আলো দেখলে৷ তোমাকে ধুইয়ে মুছিয়ে পরিষ্কার করে দেখান হল আমাকে৷ সেই মুহূর্তে আমারও নবজন্ম হচ্ছিল বাবা হিসেবে৷ আমি দেখলাম একমাথা চুল, ফুটফুটে সুন্দর একটি মানবিকা টলটলে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে৷ ডাক্তার হিসেবে জানি ওই সময়ে শিশুর দৃষ্টি ফোকাস হয় না৷ পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে শিশুরা দৃষ্টি দিয়ে জগতকে চিনতে শেখে৷ কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আছ, যেমন ভাবে গত বাইশ বছর ধরে অনেকবার তাকিয়ে ভরসা খুঁজবে, আমার কাছ থেকে৷ তোমাকে দেখে আমার ভিতরে কুলকুল করে সুখের একটা চোরা স্রোত বইতে শুরু করল৷ আমি টের পেলাম, একেই বলে পিতৃস্নেহ৷

এবার ভিতরে স্ত্রীর কাছে যাবার অনুমতি মিলল৷ সেই মুহূর্তে ডাক্তার শোভা ঘোষ রাধিকাকে দেখালেন তোমাকে৷ তারপর ওর কোলের পাশে শুইয়ে দিয়ে বললেন – ‘এই নাও তোমার নিজের মেয়ে৷ এই যে এতক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করলে, জেনো, পৃথিবীতে কেউ কখনও তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না ওকে৷ রাধিকা একটু হেসেছিল৷ সেই হাসিতে অনেক কষ্ট সওয়ার পর শরীরে যে ক্লান্তি নামে, সেই ক্লান্তির সঙ্গে প্রথম মা হওয়ার আনন্দ মাখামাখি হয়ে ছিল৷ পরে, তোমাকে ছেড়ে সে যখন চলে যায়, তার বহু পরে সেই হাসির ছবিটা, আমার মনের মধ্যে হানা দিয়ে গেছে বহুবার৷ তোমার জন্মের বহু পরে একবার কথা প্রসঙ্গে রাধিকা বলেছিল আমাকে – সেদিন মনের কোণে একটু অভিমানও হয়েছিল সেই তেইশ বছরের মেয়েটার৷ নার্সরা বাইরে অপেক্ষমাণ আমাকে আর অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে আগে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল সদ্য হওয়া মেয়েকে৷ সে তো তার ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া ছোট্ট চারাগাছটাকে সবচেয়ে আগে দেখতে পায় নি৷

এর পরের গল্প যেভাবে এগোল, সে সবই তোমার জানা৷ জানি একবছর আগে যখন জীবনের নিষ্ঠুর সত্যটির মুখোমুখি হলে, তখন তোমার কি অপরিসীম কষ্ট হচ্ছিল, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম অসহ্য বেদনায় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছ তুমি৷ তোমাকে বলতে গিয়ে আমার ভিতরটাও ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিল৷ তাই জীবনের বাকি কিছু সত্য সেদিন হয়তো বলা হয়ে ওঠেনি৷ সেসবই আজ লিখতে বসেছি৷

পরবর্তী জীবনে যা-ই হোক্‌, একথায় আমার কোন সংশয় নেই যে প্রথমে আমরাও একটি সুখী আনন্দময় পরিবারই ছিলাম৷ তোমার মায়ের কোনও স্মৃতি রাখব না স্থির করে রাধিকার সব শাড়ি, গয়না, এবং আমাদের একসঙ্গে তোলা ছবি আমি বৃন্দাকে দিয়ে দিই৷ সেসব ছবিতে আমাদের আনন্দময় জীবনের কোনও কোনও মুহূর্তের সাক্ষ্য ছিল৷ সেগুলিকে হাতছাড়া করায় পরে আর কখনও সেসব আনন্দের মুহূর্তগুলি তোমার কাছে তুলে ধরতে পারি নি৷

তুমি প্রায় এক বছর হল সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে নতুন দেশে চলে গেছ৷ শৈশবে যে রূপকথার রাজ্যের আকাঙ্খা-যেখানে সবাই সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করে চিরকাল – জাগত তোমার মনে, আমি জানি অরুণাভর হাত ধরে সেই রূপকথার রাজ্যের সন্ধান পেয়েছ তুমি৷ শুধু সহমর্মী  স্বামী পেয়েছ তাই নয়, অতি স্নেহশীল শ্বশুর শাশুড়ি এসেছেন তোমার জীবনে নতুন মা-বাবা হয়ে৷ অচিরেই তোমারও প্রথম সন্তানের জন্ম হবে, যে মাতৃত্বের অমর্ত্য স্বাদে পরিপূর্ণ করে দেবে তোমাকে৷ আমি জানি এই নতুন জীবনে, এই পরিপূর্ণ সংসার একরকম ওষধির কাজ করবে তোমার, সন্তানের দিকে তাকিয়ে, তাকে লালন পালন করে একদিন তোমার দুঃখও অসীম পাথার পেরিয়ে যাবে৷

তোমার এই নতুন করে বাঁচা, নিজেকে নতুন পৃথিবীতে নতুন করে সাজিয়ে নেবার প্রক্রিয়ার মধ্যে আমি গিয়ে আর পুরনো আনন্দহীন স্মৃতিভারে ভারাক্রান্ত করতে চাই না তোমাকে৷ শুধু একটা কথা৷ আমার অনুরোধ বলতে পার৷ কয়েকদিন আগে তোমার মাসী ফোন করেছিল আমাকে৷ কুড়ি বছর পর৷ বৃন্দার আমাকে এতদিন বাদে ফোন করার কারণ রাধিকার বর্তমান অবস্থা৷ রাধিকাকে ভিড়ে ভিড়াক্কার কিংস ক্রস স্টেশনে যেদিন নামিয়ে দিয়ে হিথরো ফিরে গেছিলাম ক্যাব নিয়ে, সেদিনই তাকে শেষ দেখি আমি৷ ভেবেছিলাম নতুন জীবনে, নতুন স্বামী সন্তানকে নিয়ে সে সুখী হতে পারবে৷ কিন্তু বৃন্দার সঙ্গে কথা হবার পর মন বড় ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আমার৷ রাধিকার তার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে বহু বছর হয়ে গেল৷ তার আরেকটি কন্যা সন্তান রয়েছে যার এখন কুড়ি বছর বয়স৷ রাধিকার অমনোযোগ এবং অসহিষ্ণুতার ফলে সে মেয়েটি বিপথগামী হয়ে গেছিল৷ তাকে মাদকাসক্তি থেকে দূরে সরাতে বৃন্দা একটি নিরাময় কেন্দ্রে রেখেছিল তাকে৷ এখন সে অনেকটাই সুস্থ৷ কিন্তু ইতিমধ্যে রাধিকার স্নায়ুজনিত রোগ এত বৃদ্ধি পেয়েছে, যে তাকে মানসিক রোগীদের কেয়ার গিভিং হোমে রাখার প্রয়োজন হয়েছে৷ সেখানেও সে অপ্রকৃতিস্থ আচরণ করছে৷ শুধু মাঝে মাঝে তোমার নাম ধরে ডাকছে৷ বৃন্দা এই অবস্থা তোমার বোনকে নিজের কাছে নিয়ে গেছে৷ ইনভারনেসে তোমার মার সংসারের পাট গুটিয়ে তাকে চিকিৎসার দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে৷ কিন্তু এখন সব মিলিয়ে খুব বিপর্যস্ত অবস্থা ওর৷ রাধিকার এই অবস্থা জেনে আমার উৎফুল্ল্ হওয়াই উচিত ছিল হয়তো, যে অবস্থায় সে আমাকে রেখে গেছিল, তার সমুচিত শাস্তি হয়েছে ভেবে৷ কিন্তু আশ্চর্য মানুষের মন৷ কুড়ি বছর আগে আমাকে জীবন্মৃত অবস্থায় রেখে যে আমার জীবন থেকে চলে গেছিল, তার এখন এই অবস্থা শুনে আমার মন বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ এই ক’দিন সমানে ভাবছি৷ কথা বলছি নিজের সঙ্গে৷ আমার কি তবে ভুল রয়ে গেল কোনও? পঁচিশ বছর আগে যে রাধিকাকে দেখে আমি ভালবেসেছিলাম, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে এনে তার সারা জীবনের ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম, এবং স্থির করেছিলাম, যাই ঘটুক না কেন সারা জীবনে কখনও তাকে অসুখী হতে দেব না, নিজের কাছে নিজের করা সেই প্রতিজ্ঞাই ভিতরে ভিতরে বিপর্যস্ত করছে আমাকে৷ কটা দিন খুব অসহায় লাগছে তাই৷ নিজে গিয়ে তো আর দাঁড়াতে পারব না তোমার মা’র শেষের দিনগুলোতে, আর সেই জোর নেই আমার ভিতরে৷ বহু দুরে চলে গেছে সে আমার কাছ থেকে, দুজনের পথ বাঁক নিয়েছে দুরকম ভাবে৷ তবু তার এই অবস্থা শুনে মনে হচ্ছে, সেদিন যদি ক্ষমা করতে পারতাম তাকে, তোমার অধিকার নিঃশর্তভাবে দিয়ে দিতে পারতাম তাকে, তবে হয়ত আজকে তার জীবনটা এমন ভাবে শেষ হতো না৷ ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে, ক্ষম হে মম দীনতা, পাপী জনশরণ প্রভু৷’ সারাজীবন দগ্ধেছি জীবনের এই পরিণতিতে৷ তবু তাকে ভুলতে পারলাম কই?

ভালবাসা হয়তো থাকে না, শুধু ভালবাসার স্মৃতি থাকে৷ সারা জীবন প্রেমহীনতার যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষকে তাড়া করতে থাকে একদা প্রেমের স্মৃতি৷ বৃন্দা বলেছিল তোমাকে সবটা জানাতে৷ ও না বললেও হয়তো তোমাকে জানাতামই আমি৷ আমি নিজে তো পারিনি৷ হেরে গেছি বার বার৷ তুমি কি পারবে মাগো তোমার বড় অভাগী মাকে ক্ষমা করে দিতে? একবার যদি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াও, এথিকসের প্রশ্ন না তুলে, মরালিটির প্রশ্নে কে ঠিক, কে ভুল, সে বিচারে না গিয়ে, শুধুমাত্র শুদ্ধ চৈতন্যের আলোতে স্বামী, সন্তানকে নিয়ে কখনও যদি গিয়ে দাঁড়াও তার কাছে, আমার বিশ্বাস মৃত্যুর খাদের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতেও আবার সে নতুন প্রাণ ফিরে পাবে৷ পারবে না মা তোমার বৃদ্ধ বাবার এই ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে?

এই চিঠি বন্ধ করে আলমারির লকারে রেখে দেব আমি৷ ভোর হয়ে এল৷ তোমার পৃথিবীর প্রান্তে জন্মদিনের উৎসবের সূচনা হবে আর কিছুক্ষণ পর৷ সারা দিনটা নানা টুকি টাকি বকেয়া কাজ সারব আমি৷ তোমার জন্মদিনের সকালে আমার প্রান্তে আঁধার ঘনাবে৷ তখন নিশ্চয়ই কথা হবে আমাদের৷ তারপর ঘুমোতে যাব আমি৷ শান্ত গভীর একটি ঘুম, বহুকাঙ্খিত ঘুম, এখন বড় প্রয়োজন আমার৷

এই চিঠি কখন কি অবস্থায়, কিভাবে তোমার হাতে পৌঁছবে জানি না আমি৷ তবে জানি কখনও না কখনও এই চিঠি তোমায় খুঁজে নেবে৷ ভাল থেকো মা আমার৷ নিজে শিখে নিও, সন্তানকে শিখিও ভাল থাকার, ভাল রাখার করণ-কৌশল৷ সত্যদ্রষ্টা কবি জানতেন সেসব৷ নাহলে কেন লিখবেন – ‘জীবনে জীবন যোগ করা,

নাহলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা৷’

ভাঙতে লাগে এক মিনিট৷ তৈরি করতে অনেকক্ষণ৷ সেতু গড়ার কাজে থেমে যেও না কখনও৷ সেই সেতু ধরে কখনও হয়তো পৌছে যাবে স্বপ্নসম্ভব পৃথিবীতে৷ মনে রেখো শেষ পর্যন্ত ভালবাসাই থেকে যায়৷

ইতি তোমার বাবা

অম্বিকাচরণ রায়৷

রাত গভীর হয়েছে৷ কাচঘরে এসে বসেছে সীমন্তিনী৷ কোলে অম্বিকার লেখা চিঠিটা৷ রণোর ঘরে গিটার থেমে গেছে অনেকক্ষণ৷ ঘুমিয়ে পড়েছে পরিশ্রান্ত ছেলেটা৷ থেমে যাওয়া সুর তবু অনুরণন তুলছে সীমন্তিনীর মনে৷ চেশায়ার ক্যাটের হাসি যেমন নিরালম্ব শূন্যে ঝুলে থাকে৷ ঘুমঘোরের গহনে যেমন পথ হাঁটে মানুষ, তেমনি বিছিয়ে থাকা গভীর গহন স্ট্রবেরি-ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে সীমন্তিনী৷ স্ট্রবেরির গন্ধে ভরে উঠছে বাতাস৷ ম ম করছে চারিদিক৷ স্ট্রবেরি ঝোপের পাশ দিয়ে হেঁটে সোজা বিছানো রাস্তা দিয়ে অনেকদূর চলে যেতে থাকে  সীমন্তিনী৷ তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে ও৷ অনেক পথ বাকি আছে৷ ভোর হয়ে আসছে৷ আকাশে ছড়িয়ে থাকা তারারা ভোরের আলোয় ম্লান হয়ে যায়৷ শুধু ভোরের শুকতারাটি মিটমিট করছে৷

(সমাপ্ত)

ছবি সৌজন্য: PixaHive, Abode stock, Pexels, Istock,

Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।
Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com