banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

সেই প্রভাতে নেই আমি (প্রবন্ধ)

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

pankaj mallik

রবীন্দ্রনাথেরচয়নিকানিয়ে বসেছে বছর সতেরোর গানপাগল ছেলে বই খুলতেই চোখে পড়ল একটা নাপড়া কবিতাচির আমি পড়তে পড়তে আনমনা হয়ে গেল সে মনে শুধুই বাজছে, ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি/ সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি কী অপূর্ব ভাবঐশ্বর্য, কী রোমাঞ্চকর চৈতন্যের পরিব্যাপ্তি! ভাবতে ভাবতে কখন যেন সুরের দোলা জাগল মনে গুনগুন করে সেই কবিতা সুর দিয়ে গাইতে থাকল ছেলেটা যেমনটা হয়, গানপাগলদের যাই পড়ে, যাই দেখে, সবেতেই সুর পায় এরও তেমনই অবস্থা শেষে মনটা বেশ তৃপ্তিতে ভরে উঠল রবীন্দ্রনাথের কবিতাতেও সুর দিতে পেরেছেএ কি কম প্রাপ্তি! আনন্দের চোটে অর্গান বাজিয়ে বাজিয়ে নতুন করা সুরে কবিতাটি গাওয়াও শুরু হল আর গুনগুন করে নয়, জোরে জোরেই! হঠাৎ পিছন থেকে কার গলা – ”উঁহু, উঁহু, একটু যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।’সে কী কথা! আমারই দেওয়া সুর আমিই অন্য রকম গাইছি? উত্তর এল – ”এটা তো রবিবাবুর একটা গান, ওঁর নিজেরই সুর দেওয়া আছে আরে, তুমি তো তা গাইছ, মাঝে মাঝে সামান্য তফাৎ হচ্ছে।’

তারপর কী হল?

সেদিনের বছর সতেরোর যুবক, পরবর্তীকালের কিংবদন্তী গায়কসুরকার পঙ্কজকুমার মল্লিকের বয়ানে শোনা যাক – ”সেই মুহূর্তে আমার সমস্ত চৈতন্য প্রথমে বিস্ময়ে পরক্ষণেই এক অপার্থিব পুলকে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলএ কী বিস্ময় এলো আমার জীবনে! আমি কেবল সুর দিতেই পারি না, কবির নিজের দেওয়া সুরের সঙ্গে আমার সুর কিনা প্রায় মিলে যায়!”

অতি অল্প বয়সে ঘটে যাওয়া এমনই কিছু ঘটনার ফলে, কখনও কখনও যে মানুষটি রোমাঞ্চিত হতেন এই ভেবে, যে পূর্বজন্মে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রগানের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল, সে মানুষটি সঙ্গীতচর্চার সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত পরিবারে কিন্তু জন্মগ্রহণ করেননি ১৯০৫ সালের ১০ মে, উত্তর কলকাতার চালতাবাগান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন পঙ্কজকুমার মল্লিক পিতা মণিমোহন মল্লিক, মা মনমোহিনী দেবী ভক্ত বৈষ্ণব মণিমোহনের আয়োজনে বাড়িতে কুলদেবতা জগন্নাথদেবের পূজা হত রথযাত্রায় মল্লিক পরিবারে সঙ্গীতচর্চার ধারাবাহিকতা না থাকলেও, পূজা উপলক্ষে বাড়িতে আটদিন ধরে যে উৎসব হত, তার অঙ্গ হিসাবে প্রতি বছর বসত গানের আসর সেখানেই পঙ্কজকুমার মুগ্ধ হয়ে শুনতেন কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, টপ্পা, প্রভৃতি নানা ধারার গান তেরো বছর বয়সে, এই আসরেই একবার তাঁর সুযোগ হয়েছিল গান করার সেদিন সন্ধ্যায় মল্লিকবাড়ির উৎসবে সেকালের বিখ্যাত সঙ্গীতগুরু বিশ্বনাথ রাওয়ের শিষ্য দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও গান গেয়েছিলেন, আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে পঙ্কজকুমারের গান শুনে তিনি বুঝলেন, এমন সহজাত প্রতিভা যার, তার গান শিখে সে প্রতিভার যথাযথ বিকাশ ঘটানো উচিৎ

প্রাথমিকভাবে ছেলেকে গানের বিষয়ে উৎসাহ না দিলেও, গান শেখার এই সুবর্ণ সুযোগটি গ্রহণ করতে বাধা দেননি মণিমোহন বৌবাজারে, গুরু দুর্গাদাসের বাড়ি গিয়ে পঙ্কজকুমার শুরু করেন শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে তালিম নেওয়া আর বিশেষভাবে শেখেন বাংলা টপ্পা নিধুবাবুর যুগ পেরিয়ে গেলেও, টপ্পার চাহিদা কমেনি তখনও রেকর্ডেও তখন বিখ্যাত শিল্পীদের কন্ঠে টপ্পার রমরমা কিন্তু পঙ্কজকুমারের মন পড়ে থাকত ভবসিন্ধু দত্তের কন্ঠে ব্রহ্মসঙ্গীতে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে তখন প্রতি শনিবার যান তিনি, গান শুনতে৷ শুনে শুনেই শেখা হয়ে যেতএই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে‘, ‘আমি কান পেতে রই‘, ‘পদপ্রান্তে রাখো সেবকে‘, ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে‘- মত গান ভবসিন্ধু দত্তের কন্ঠে যাঁর গান শুনে মোহিত হতেন পঙ্কজ, সতেরো বছর বয়সে সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরচয়নিকাতিনি খুঁজে পেয়েছিলেন গুরু দুর্গাদাসের বাড়িতেই রবীন্দ্রগানের সুরের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল তাঁর দেওয়া সুর৷ সেই বিস্মিত, রোমাঞ্চিত পঙ্কজের জীবনে এর কিছুকাল পরেই ঘটে গেল আর এক বিস্ময়কর ঘটনা

পঙ্কজকুমার তখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র মনের আনন্দে একদিন সুর দিয়ে ফেললেন রবীন্দ্রনাথেরশেষ খেয়াকবিতায় সুরই শুধু দিলেন না, উৎসাহী হয়ে সে সুর বন্ধুবান্ধবদের গেয়ে শুনিয়েও দিলেন যৌবনের সারল্য এখানেই থামল না স্বরচিত সুরে সে কবিতা ছোটবড় কিছু অনুষ্ঠানেও গেয়ে ফেললেন পঙ্কজ এরপরেই ঘটল যা ঘটার এক অপরিচিত ভদ্রলোক বাড়ির কড়া নেড়ে বলে গেলেন, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন বিস্ময়, সংশয়, অজানা ভয়ে তখন অসহায় অবস্থা পঙ্কজকুমারের মনে সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন – ‘আমার কথা কেমন করে জানলেন রথীন্দ্রবাবু? আমি কি না জেনে তাঁর পিতৃদেবের চরণে কোনও অপরাধ করে ফেলেছি?’ নির্দিষ্ট দিনে যে যাত্রা তাঁর দুর্গানাম স্মরণ দিয়ে শুরু হল, তা ছিল, পঙ্কজকুমার মল্লিকেরই ভাষায়, ”জীবনের সব চাইতে ভীতিপ্রদ যাত্রা।” সে যাত্রার গন্তব্য জোড়াসাঁকো রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাচ্ছেন সে যুগের এক কলেজছাত্র জানেন না তাঁর সেখানে ডাক পড়ার কারণ কী জানেন না, অজ্ঞাতেই কোনও গুরু অপরাধ করে তিনি স্বয়ং কবিগুরুর অসন্তোষের কারণ হয়েছেন কিনা

অবস্থায় সেদিনের অখ্যাতনামা পঙ্কজকুমারের মনের অবস্থা কেমন হয়ে থাকতে পারে, তা বোধহয় আজকের পাঠকও সহজেই অনুমান করতে পারবেন দর্শন পাওয়া গেল সৌম্যদর্শন রথী ঠাকুরেরশেষ খেয়া‘- প্রসঙ্গ উঠল প্রশ্ন করলেন, ”কবিতা বা গানটি আপনি কোথায় পেলেন বলুন তো?” ভয়ে, সংকোচে সেদিন সত্য বলতে পারেননি পঙ্কজ বলেছিলেন, কবিগুরুর গানের বই থেকেই তিনি পেয়েছেন ওই রচনা এও বলেছিলেন, সে গানের স্বরলিপিও প্রকাশিত কাহিনি কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি মাসখানেকের মধ্যেই আবার জোড়াসাঁকোয় যেতে হল তাঁকে এবার আর রথীন্দ্রনাথ নন, ডাকলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পঙ্কজকুমারের অনুভূতি? তাঁরই বয়ানে – ” কী গভীর বাণী এলো ঘন মেঘের আড়াল ধরে।” ততদিনে রথীন্দ্রনাথও জেনে গিয়েছেন, কবিতায় সুরারোপ করেছেন যুবক পঙ্কজই কবিপুত্র বললেন, ”গানটা বাবামশাই আপনার মুখেই শুনতে চান৷ চলুন তাঁর কাছে।’সেদিন কবিকে অর্গান বাজিয়ে গান শোনানোর পর, বাড়তি একটি মুহূর্তও ঠাকুরবাড়িতে কাটানোর সাহস পাননি পঙ্কজ

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে বলেছিলেন, ” গানটি তো আমায় শুনিয়েই পালিয়ে গিয়েছিলে৷ অমন সুন্দর গলা তোমার, পালালে কেন?” পঙ্কজকুমারের সুরেশেষ খেয়াগাইবার অনুমতি কবি দিয়েছিলেন কবিতার সুরকারকেদিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়াগানটি জনসমক্ষে গাইতে আর কোনওদিন দ্বিধা বোধ করেননি পঙ্কজ মল্লিক ১৯৩৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নিউ থিয়েটার্সেরমুক্তিছায়াছবিতেদিনের শেষেগানটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তার আগেই অবশ্য কবিগুরুরগানের ভাণ্ডারীদিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে অনেক রবীন্দ্রগান শেখা হয়ে গিয়েছে পঙ্কজকুমারের উপলব্ধি করা হয়েছে কাব্যগীতির প্রকৃতিরবিঠাকুরের গান যদি শিখতে চাও তো মনে রেখো আগে গানের বাণী ভাবটিকে আয়ত্ত করতে হবে বারবার পাঠ করে বাণীবাহিত ভাবটুকুকে কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করাতে হবেতারপর পড়া শেষ হলে যখন সুর তুলবে, তখন দেখবে ভাবের সঙ্গে সুরের কী আশ্চর্য মিলন…” – পঙ্কজকে বলেছিলেন আচার্য দিনেন্দ্রনাথ

পিছিয়ে যাওয়া যাক দশটি বছর৷ ১৯২৭ সাল এক বৃষ্টিভেজা দিনে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কাছাকাছি কোনও একটি বাড়ির গাড়িবারান্দার নীচে এক ডিসপেনসারির রোয়াকে দাঁড়িয়ে কোনওরকমে বৃষ্টির দাপট থেকে নিজেকে বাঁচাচ্ছেন পঙ্কজকুমার, আর গুনগুন করে গেয়ে চলেছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায় হঠাৎ পিঠে টোকা ফিরে দেখেন এক স্যুট পরা ভদ্রলোক সেই ডিসপেনসারির মালিক ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে পঙ্কজকুমারের কাছে স্বাভাবিক স্বরে গানটি শুনতে চাইলেন তিনি গান শেষ হতেই প্রশ্ন – ”উড ইউ লাইক টু ব্রডকাস্ট? কলকাতায় নতুন রেডিও স্টেশন হয়েছেইণ্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি৷ আমার জানাশোনা আছে, যদি গাইতে চান তো বলুন।’সেই বর্ষার দিনে পঙ্কজকুমারের জীবনে বিধাতার কৃপাবর্ষণ হয়ে গেল মিঃ আয়েঙ্গারের যোগাযোগস্থাপনে প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের সহযোগিতায় কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হলেন তিনি ১৯২৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বরএমন দিনে তারে বলা যায়আরএকদা তুমি প্রিয়ে আমারি তরুমূলেগানদুটি ব্রডকাস্ট করে বেতারের যাত্রা আরম্ভ হল পঙ্কজ মল্লিকের কলকাতা বেতারের সঙ্গে ওঁর এই অপূর্ব যোগাযোগের ফলশ্রুতি হিসাবে, ১৯২৯ সালে আরম্ভ হলসঙ্গীতশিক্ষার আসর‘, যার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকলেন গায়ক পঙ্কজকুমার, এবং সেই সূত্রে জন্ম হল শিক্ষক পঙ্কজকুমারের

সঙ্গীতশিক্ষার আসরে নানাবিধ গান শেখালেও, যে গান শেখানোর প্রতি পঙ্কজকুমারের বিশেষ আগ্রহ ছিল, তা রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁরই কথায়, “সংগীত শিক্ষার আসরএর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের গানকে আপামর সাধারণের মধ্যে আমি বছরের পর বছর ছড়িয়ে দিতে থাকি কেউ কেউ অস্বীকার করলেও এই ইতিহাসের অপহ্নব ঘটবে না, যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্ত রসমাধুরী থেকে সাধারণ বাঙালি তখনও বঞ্চিত ছিলেন এই পটভূমিতেই, সাধারণ মানুষের মুখে, সেই আলোকসামান্য মহাগীতিকারের দাসানুদাস আমি, তাঁর গান একটি একটি করে তুলে দিয়েছিলাম এটাই ছিল আমার সংগীত শিক্ষার আসরের একটি প্রধান কাজযে গানের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতকে ভালোবেসেছিলেন কিশোর পঙ্কজকুমার, ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর‘-এর মতো মঞ্চে, সেই রবীন্দ্রগানের মধ্যে দিয়েই বহু মানুষকে একসূত্রে বাঁধতে চাইবেন, তো স্বাভাবিক! এই অনুষ্ঠানের কারণে শুধু যে সাধারণের মধ্যে গান শেখার প্রেরণা জেগেছিল তা-ই নয়, মিলেছিল উপায়ও

রবীন্দ্রগানের সঙ্গতে সেকালে তালবাদ্যের ব্যবহার প্রচলিত ছিল না রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে, সে গানের সঙ্গে মৃদু নিয়ন্ত্রিতভাবে তবলা ও পাখোয়াজ সঙ্গতের প্রচলনের পিছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল সঙ্গীতশিক্ষার আসর এর পরে, পঙ্কজকুমারের পরিচালনায় ১৯৩২ সালে কলকাতায় আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে, একমাত্র কনক বিশ্বাস ব্যতীত সমস্ত শিল্পীই তবলা ও পাখোয়াজ সঙ্গতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন ১৯৩২ সালেরই সেপ্টেম্বর মাসে, ‘হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্টস্কোম্পানি থেকে পঙ্কজ মল্লিকের কন্ঠে প্রথমবার রেকর্ড হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত অসম্ভব জনপ্রিয় সেই রেকর্ডটির দু’টি গান – ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলেতোমার আসন শূন্য আজি‘-তে তালবাদ্যের সঙ্গত ব্যবহার করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক অবশ্য এর আগেই, স্বল্পস্থায়ী ভিয়েলোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ওঁর প্রথম রেকর্ড তখনও বৈদ্যুতিক রেকর্ডিং প্রচলিত না হওয়ায়, পুরনো পদ্ধতিতে, চোঙার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে শিল্পী রেকর্ড করেছিলেন বাণীকুমার রচিত বর্ষার দু’টি গান তবে রেকর্ডসঙ্গীতের শিল্পী হিসাবে সাফল্য অর্জনের জন্য ১৯৩২ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল পঙ্কজকুমারকে

চলচ্চিত্রের সঙ্গে পঙ্কজ মল্লিকের যোগাযোগের সূত্রপাত ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে তখন নির্বাক ছবির যুগ সিনেমার পর্দায় ছবি চলাকালীন, ‘অর্কেস্ট্রা পিট‘- বসে নানা দৃশ্যের ভাব অনুযায়ী অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করাই তখন সঙ্গীত পরিচালকের কাজ৷ ১৯৩১ সালের এপ্রিলে মুক্তিপ্রাপ্ত, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফ্ট’ প্রযোজিত, চারু রায়েরচোরকাঁটাছায়াচিত্রের নেপথ্যে প্রথম অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেন পঙ্কজকুমার, রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে যৌথভাবে আকাশবাণীর সুদক্ষ যন্ত্রীরাই ছিলেন শিল্পী ১৯৩১ সালে সবাক যুগ আরম্ভ হলে, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফ্ট’ সংস্থাটিইনিউ থিয়েটার্স’ নামে পরিচিত হয়ে প্রযোজনা করেদেনাপাওনা ছবিতেও সুর রচনা অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেন পঙ্কজ মল্লিক রাইচাঁদ বড়াল এর কিছুকাল পরেই, কলম্বিয়া গ্রাফোফোন কোম্পানিও অর্কেস্ট্রা পরিচালনার জন্য আহ্বান জানান সুদক্ষ পঙ্কজকুমারকে ততদিনে কন্ঠশিল্পী হিসাবেও কলম্বিয়াতে তিনি রেকর্ড করে ফেলেছেনএসো মুক্তির নামে‘, ‘নমো নমো হে রুদ্র সন্ন্যাসী‘, ‘মায়ের মন্দির যে নবীন যুগের‘ (গীতিকারবাণীকুমার), প্রভৃতি গান

সেকালের অধিকাংশ শিল্পীর মতো পঙ্কজকুমার কোনও বিশেষ সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ না হওয়ায়, এই সময় হিন্দুস্থান কলম্বিয়া, দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই ওঁর নিয়মিত রেকর্ড প্রকাশ করা সম্ভব হয় ত্রিশের দশকের পূর্বার্ধে, জনপ্রিয়সঙ্গীতশিক্ষার আসর‘-এর পরিচালক পঙ্কজকুমার যখন রেকর্ডসঙ্গীত ছায়াচিত্রের জগতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হচ্ছেন, তখন বেতারের হাত ধরে তাঁর কাছে আবারও এসেছে সুবর্ণসুযোগ শিল্পীর বয়ানে, “ধর্মপ্রাণ বাঙালি হিন্দুর ঘরে বারো মাসে তেরো পার্বণ আর, সব পার্বণের বড়ো পার্বণ দুর্গাপূজামহাদেবীর আবাহন৷ আমরা ভাবলাম, দশভূজা দুর্গতিনাশিনীর বার্ষিক আরাধনার শুভ উদ্বোধন যদি একটা সাড়ম্বর বেতার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে করা যায় তো কেমন হয়৷ বন্ধুবর বাণীকুমারই প্রাথমিক পরিকল্পনাটি আমাদের সামনে রেখেছিল আমরা তখন সকলে মিলে আলোচনা করে অনুষ্ঠানের সামগ্রিক পরিকল্পনাটি দাঁড় করিয়েছিলান ভাষ্য, স্ক্রিপ্ট গীতরচনার দায়িত্ব নিল বাণীকুমার, সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব আমার এবং ভাষ্যপাঠ চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব নিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ

pankaj_kumar_mullick_in_adhikar_1939
‘অধিকার’ ছবিতে পঙ্কজ মল্লিক



বেতারের সর্বজননন্দিতমহিষাসুরমর্দ্দিনীঅনুষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিল পঙ্কজকুমার মল্লিকের নাম এই অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য যেমন কলকাতা বেতারের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠাকে দৃঢ় করেছিল, তেমনই সুরকার সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে পঙ্কজকুমারকে এনে দিয়েছিল বহুল প্রশংসা৷ এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সুরকার পঙ্কজ মল্লিক বহু বছর ধরে সার্থকভাবে নানা অপূর্ব সাঙ্গীতিক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। কখনও প্রভাতী অনুষ্ঠানের গানগুলিকে ক্রমানুসারে সুরারোপ করেছেন সময়োপযোগী রাগরাগিণীতে, কখনও বা সমবেত সঙ্গীতে যোগ করেছেন স্বরসঙ্গতি আবার কখনও, ভাষ্যপাঠকে বেঁধে দিয়েছেন রাগের চলনে ওঁরই কথায়, “আমার পিতৃদেবের ধর্মপ্রাণতা ধারাবাহিকভাবে আমার মধ্যে কিছুটা সঞ্চারিত হয়েছিল তাই এই অনুষ্ঠানের সুর রচনায় আমার প্রাণের সমস্ত ভক্তি নিষ্ঠা আমি উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলামতিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলার বহু দক্ষ কন্ঠশিল্পী যন্ত্রশিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন কলকাতা বেতারের এই বহুখ্যাত অনুষ্ঠানে; নিয়মানুবর্তিতায় কঠোর অথচ আচরণে কোমল পঙ্কজ মল্লিকের পরিচালনায় সাগ্রহে অংশ নিয়েছেন মাসকালব্যাপী নিয়মিত মহড়ায়। 

ছায়াছবির জগতে পঙ্কজকুমারের প্রবেশ ত্রিশের দশকের গোড়ায় হলেও প্রতিষ্ঠা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেকগুলি দিন বেশ কিছু ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে যুগ্মভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করার পর ১৯৩৭ সালে, ‘মুক্তিছবির মধ্য দিয়েই একক সঙ্গীত পরিচালকরূপে প্রতিষ্ঠিত হন পঙ্কজকুমার, লাভ করেন বিপুল জনপ্রিয়তা এই ছবিতে রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে, ব্যবহৃত হয় ওঁর পঙ্কজকুমার সুরারোপিত কবিতাশেষ খেয়া‘, অর্থাৎদিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটাপরা ওই ছায়াগানটি কবিগুরুর আগ্রহে এই ছবির দু’টি দৃশ্যে ব্যবহার করা হয়আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবেতার বিদায়বেলার মালাখানিরবীন্দ্রসঙ্গীত দু’টিমুক্তি নায়িকা, স্বনামধন্যা কানন দেবীর কন্ঠে, পঙ্কজকুমারের সযত্ন প্রশিক্ষণে এই গানদুটি তুমুল জনপ্রিয় হয় কানন দেবীর স্মৃতিতে এই ছবির গান শেখার মুহূর্তগুলি পরবর্তী সময়েও ছিল উজ্জ্বল হয়ে

কাননদেবীর কথায়, “পঙ্কজবাবুর গান শেখানোর ভঙ্গীটি ছিল বড় আকর্ষণীয় সুর কথায় ব্যঞ্জনা এমন সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন যে মনের প্রতি পরতে যেন গাঁথা হয়ে থাকত ওঁর কাছে আমার প্রথম শেখা গান ছিলআজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবেশেখানোর আগে কি দরদ দিয়েই না উনি রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের দর্শন বুঝিয়ে দিতেন উনি বলেছিলেন গাইবার সময় একটা কথা সবসময় মিনে রেখসবাররঙগানটি হোলির গান নয়পুজোর গান রঙ তো খেলার রঙ নয়, হোলো প্রিয়জনের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসার রঙ সাতটি রঙের কোন রঙটি গানকে রঞ্জিত করেছে, কোন রস গানটিতে প্রধান হয়ে উঠেছে সে সম্বন্ধে ভাবতে হবে এমনি করে নানাদিক থেকে নানা অনুভবের ছবি মেলে ধরে পঙ্কজবাবু মনকে সুরে বেঁধে দিতেন সেই মন নিয়ে যা গাইতাম তাই উতরে যেত” ‘মুক্তি’ ছবির মুক্তিলাভের পরে, ‘অধিকার’ (১৯৩৯),জীবনমরণ’ (১৯৩৯), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৯৩৯), ‘ডাক্তার’ (১৯৪০), ‘মীনাক্ষী’ (১৯৪২), ‘কাশীনাথ’ (১৯৪৩), ‘মাই সিস্টার’ (১৯৪৪), ‘দুই পুরুষ’ (১৯৪৫), ‘নার্স সিসি’ (১৯৪৭), ‘প্রতিবাদ’ (১৯৪৮), ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ (১৯৫২), ‘রাইকমল’ (১৯৫৫), ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ (১৯৭২), প্রভৃতি বহু বাংলা হিন্দি ছায়াচিত্রে সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক

১৯৩১ সালে নির্বাক যুগ শেষ হয়ে সবাক ছবি আসায়, ছবিতে প্রথম গান ব্যবহারের সুযোগ আসে সঙ্গীতবিহীন ছায়াছবিতে আগ্রহ হারাতে থাকেন বাংলার দর্শক সেই সময় থেকেই, নিউ থিয়েটার্সের ছবিতে যাতে গানের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয়, সংস্থার কর্ণধার বি. এন. সরকারের অনুপ্রেরণায় সচেতন নির্দেশে, নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে স্টুডিওর মিউজিক ডিপার্টমেন্টে প্রাথমিক ভাবে কিছু বছর অভিনয় করাকালীন গান গাইতেন অভিনেতা, অভিনেত্রীরা আঙ্গিক অভিনয়, সংলাপ, গান, একইসঙ্গে রেকর্ড হয়ে যেত ক্যামেরায় পদ্ধতির সাফল্যের জন্য, ছায়াচিত্রের কলাকুশলীদের সঙ্গীতেও যথেষ্ট দক্ষ হওয়ার প্রয়োজন ছিল কিন্তু সব অভিনেতাই সঙ্গীতে পারদর্শী হবেন, তা তো সম্ভব নয় আবার সব সুকন্ঠ গায়কই অভিনয়ে দক্ষ হবেন, এও সম্ভব নয় এই সমস্যা কালে কালে বিরাট হয়ে উঠতেই পারত, যদি না, পরিচালক নীতিন বসুর হাত ধরে আবিষ্কৃত হতপ্ল্যেব্যাকপদ্ধতি ঘটনাচক্রে আবিষ্কারটি ঘটেছিল পঙ্কজকুমার মল্লিককে কেন্দ্র করেই

সে সময়ে, বাদুড়বাগানবাসী নীতিন বসু নিউ থিয়েটার্সের স্টুডিওতে আসার পথে চালতাবাগান থেকে গাড়িতে তুলে নিতেন পঙ্কজকুমারকে এমনই একদিন নীতিন বসু পঙ্কজকুমারের বাড়িতে এসে দেখেন, দূরে গ্রামোফোনে বাজছে বিখ্যাত মেক্সিকানআমেরিকান গায়ক রামো নোভারোর “Where the golden sunbeams and the lazy land dreams”, আর বেরনোর জন্য প্রস্তুত হতে হতে, নোভারোর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুনগুন করে গাইছেন পঙ্কজকুমার দূর থেকে দৃশ্য বেশ খানিক্ষণ ধরে দেখে, নীতিন বসুর মনে নতুন ভাবনা খেলে গেল পঙ্কজকুমার এসবের কিছুই তখন জানেন নাগাড়িতে উঠে বসলেন এদিকে স্টুডিওর পথে রেকর্ডের দোকান থেকে নোভারোর গানটির রেকর্ড কিনে নিলেন নীতিন বসু স্টুডিওতে গিয়ে যথাসময়ে ওঁর ঘরে ডাক পড়ল পঙ্কজকুমারের গ্রামোফোনে ঘুরতে থাকল নোভারোর রেকর্ড নীতিন বসুর আদেশ, “পঙ্কজ, শিগগিরি ওটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গা, ঠিক বাড়িতে যেমন গাইছিলিবাজতে থাকল গান, সেই শুনে শুনে চলতে থাকল পঙ্কজকুমারের গাওয়া নীতিন বসু নানাদিক থেকে দেখতে লাগলেন পঙ্কজকুমারকে গান শেষ হল, শেষ হল গুনগুন আবিষ্কারের আনন্দে নেচে উঠলেন পরিচালক নীতিন বসু৷ রেকর্ডে বাজা রামো নোভারোর গান আর পঙ্কজ মল্লিকের গুনগুন করার সময়কার ওষ্ঠসঞ্চালনএই দুই মিলিয়েই নীতিন বসু আবিষ্কার করলেন প্ল্যেব্যাক পদ্ধতি

১৯৩৫ সালে, নীতিন বসু পরিচালিত নিউ থিয়েটার্সেরভাগ্যচক্র’ ( তার হিন্দি ভার্শনধূপছাওঁ’) ছবিতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবার একটি গান গৃহীত হল প্ল্যেব্যাক পদ্ধতিতে ক্যামেরার সামনে সখী চরিত্রে নাচলেন জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রী, আর পাশেই, ক্যামেরার আওতার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে, ‘মোরা পুলক যাচি, তবু সুখ না মানি’ গানটি গাইলেন সুপ্রভা ঘোষ, পারুল চৌধুরী উমাশশী দেবী (মতান্তরে সুপ্রভা ঘোষ, পারুল ঘোষ, হরিমতী দেবী) একই দৃশ্যে, ‘ধূপছাঁও’ ছবির জন্য, তিন গায়িকার কন্ঠে গৃহীত হলম্যায় খুশ হোনা চাহুঁ, খুশ হো না সকুঁ’ গানটি দুটি ছবিতেই যুগ্মভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক রাইচাঁদ বড়াল

নিউ থিয়েটার্সের নানা ছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের সুর সঙ্গীত পরিচালনায় যাঁরা গেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কুন্দনলাল সায়গল, পাহাড়ি সান্যাল, অসিতবরণ, কানন দেবী, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), ইলা ঘোষ (মিত্র), উৎপলা ঘোষ (সেন), শচীন গুপ্ত, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গীতা রায় (দত্ত), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অজস্রর স্বনামধন্য শিল্পী রয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত ছবির নানা গানের মধ্যে কানন দেবীর কন্ঠেওগো সুন্দর, মনের গহনে তোমার মূরতিখানি’ (‘মুক্তিছায়াচিত্রের), কুন্দনলাল সায়গলের কন্ঠেকরু ক্যা আস নিরাশ ভাই’ (‘দুশমন্ছায়াচিত্রে), ‘অ্যায় কাতিবে তকদীর’, ‘দো ন্যায়না মৎওয়ারে’ (‘মাই সিস্টারছায়াচিত্রে), ‘সো জা রাজকুমারী’, ‘ম্যায় ক্যা জানু ক্যা যাদু হ্যায়’ (‘জিন্দগীছায়াচিত্রে), ইলা ঘোষের কন্ঠেআমি বন বুলবুল গাহি গান’ (‘ডাক্তারছায়াচিত্রে), বেলা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠেবনের পাখি, বনের পাখি’ (‘কাশীনাথছায়াচিত্রে), ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কন্ঠেতু ঢুঁঢতা হ্যায় জিসকো বস্তি মেঁ’ (‘যাত্রিকছায়াচিত্রে), এই গানগুলি খুব জনপ্রিয় হয়

ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের ক্ষেত্রেমুক্তিছবির পর থেকেই তৎপর হন পঙ্কজকুমার মল্লিক ১৯৩৯ সালে, ‘জীবনমরণছবিতে অবাঙালি কুন্দনলাল সায়গলের কন্ঠে কবিগুরুর গান রেকর্ড করতে আগ্রহী হয়ে কবির সম্মতিপ্রার্থনায় গেলে, সায়গলের কন্ঠে গান শুনে প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ ওঁকে গাইবার অনুমতি দেন। জীবনমরণ‘ (১৯৩৯) ছবিরআমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান‘, ‘তোমার বীণায় গান ছিলগান দু’টির সাফল্যের পর, ‘পরাজয়‘ (১৯৪০) পরিচয়‘ (১৯৪১) ছবিতেও পঙ্কজ মল্লিকের প্রশিক্ষণে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন কুন্দনলাল সায়গলমুক্তি‘, ‘পরাজয়‘, ‘পরিচয়ছবিতে বেশ কিছু রবীন্দ্রগান অসামান্য দক্ষতায় পরিবেশন করেন কানন দেবী, পঙ্কজকুমারের পরিচালনায়৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী, রবীন্দ্রস্নেহধন্যা কনক বিশ্বাসের কথায় ফুটে ওঠে এই তিন শিল্পীর প্রতিই প্রশংসাসূচক মন্তব্য – “রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে পঙ্কজবাবুর নিজের বিধিদত্ত কন্ঠ আরাধনা তো ছিলই সঙ্গে সঙ্গে দুটি শিল্পীর ভূমিকাও কম নয়৷ সায়গলের দরাজ কন্ঠ, কাননের এক্সপ্রেশন, তাঁদের অনন্য করে রেখেছে

১৯৩৫ সালে, প্লেব্যাক আবিষ্কারের পর, ১৯৩৬ সালে, ‘মঞ্জিলছবির নেপথ্যে, রাইচাঁদ বড়ালের সুরে সঙ্গীত পরিচালনায়, ‘সুন্দর নারী প্রীতম প্যারীগানে প্রথমবার কন্ঠদান করেন পঙ্কজকুমার গায়ক হিসাবে ততদিনে তিনি বিখ্যাত গানের সাফল্য তাঁকে ছায়াছবির জগতেও গায়ক হিসাবে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিল এরপর একে একেমুক্তি‘ (১৯৩৭), ‘দেশের মাটি‘ (১৯৩৮), ‘অভিজ্ঞান‘, ‘অধিকার‘ (১৯৩৯),কপালকুণ্ডলা‘ (১৯৩৯), ‘ডাক্তার‘ (১৯৪০), প্রভৃতি ছবিতে শোনা যেতে থাকল পঙ্কজকুমারের গান কখনও নিজের সুরে, কখনও বা অন্যের সুর, কখনও রবীন্দ্রগান। মুক্তিছবিতেকোন লগনে জনম নিলাম‘ (গীতিকারঅজয় ভট্টাচার্য), ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে‘, ‘আমি কান পেতে রই‘ (রবীন্দ্রগান), ‘অভিজ্ঞানছবিতে রবীন্দ্রনাথেরওরে সাবধানী পথিক‘, ‘দেশের মাটি‘-তেশেষ হল তোর অভিযান‘ (গীতিকারঅজয় ভট্টাচার্য), ‘অধিকারছবিতেএমন দিনে তারে বলা যায়‘, ‘মরণের মুখে রেখে‘ (রবীন্দ্রগান), ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া‘, ‘কোথা সে খেলাঘর‘ (গীতিকারঅজয় ভট্টাচার্য) জনপ্রিয় হয়ডাক্তারচিত্রে প্রশংসিত হয়ওরে চঞ্চল‘, ‘চৈত্রদিনের ঝরাপাতার পথে‘, ‘যবে কন্টকপথে হবে রক্তিম পদতল‘ (গীতিকারঅজয় ভট্টাচার্য), রবীন্দ্রসঙ্গীতকী পাইনি তারি হিসাব মিলাতেকপালকুণ্ডলাছবিরপিয়া মিলন কো জানাপঙ্কজকুমারকে এনে দেয় দেশজোড়া খ্যাতি কবি আর্জু লখনৌভি রচিত এই গানটির সুরারোপ করেছিলেন পঙ্কজকুমার নিজেই। এবং সুরটি তৈরি হয়েছিল কত্থক নাচের বোলের উপর ছবিতে গানের সঙ্গে নেচেছিলেন কমলেশকুমারীকপালকুণ্ডলাছবিতে এই গানের দৃশ্যে তানপুরা হাতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন গায়কসুরকার স্বয়ং!  

চলচ্চিত্রের জগতে পঙ্কজ মল্লিকের জয়ের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে নিউ থিয়েটার্সের নানা ছবিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জগতে প্রতিষ্ঠানতুল্য এই সংস্থার নানা ছবির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে মিশে থেকেছে পঙ্কজকুমারের কৃতিত্ব শিল্পীর যাত্রাপথ পোক্ত করেছে নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে একাত্মতার বোধ, গভীর ভালোবাসা ফলে, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রতিষ্ঠানের উত্থানপতনের প্রবাহ প্রভাবিত করেছে পঙ্কজকুমারের জীবনও ত্রিশের দশকের পূর্বার্ধ যদি নিউ থিয়েটার্সের ধীরে ধীরে, নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার প্রতিষ্ঠালাভের সময় হয়; তবে তার উত্তরার্ধ, উৎকর্ষ বৃদ্ধির মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার সময় ত্রিশের দশকের দ্বিতীয় অর্ধেই নিউ থিয়েটার্সের নানা সিনেমার মধ্যে দিয়ে গায়ক-সুরকার পঙ্কজকুমার তাঁর স্থায়ী আসনটি তৈরি করে নেন দর্শক-শ্রোতাদের মনে নিউ থিয়েটার্সের এই স্বর্ণযুগ ওঁর জীবনেরও এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কলকাতাই তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র

কিন্তু চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে একে একে আসতে থাকে আঘাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশজোড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের নানা ঘটনার অভিঘাত চলচ্চিত্র নির্মাণের পথে নিয়ে আসে অনিশ্চয়তা তারপর দেশভাগের ফলে বাংলার ছবির দর্শকও ভাগ হয়ে যায় চল্লিশের দশকে, স্বাভাবিক কারণে কমে আসতে থাকে নিউ থিয়েটার্স ব্যানারের ছবির সংখ্যা তবু পঙ্কজকুমার মল্লিকের জয়পতাকা উড্ডীন থাকেমীনাক্ষী‘ (১৯৪২), ‘কাশীনাথ‘ (১৯৪৩), ‘মাই সিস্টার‘ (১৯৪৪), ‘দুই পুরুষ‘ (১৯৪৫), ‘প্রতিবাদ‘ (১৯৪৮), ইত্যাদি ছায়াছবির গানের মধ্য দিয়েপ্রতিবাদছবির প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথেরহে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমানরচনায়, পঙ্কজকুমারের অনুরোধে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে সুরারোপ করেন শান্তিদেব ঘোষ ছবিতে সে গান সমবেত কন্ঠে গেয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক স্বয়ং, দেবব্রত বিশ্বাস, সুপ্রভা সরকার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, বেলা মুখোপাধ্যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়!

ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের কেন্দ্র হওয়ার পথে এগোতে থাকে বম্বে শহর বহু গুণী শিল্পীই পাড়ি দেন সেখানে নিউ থিয়েটার্সের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হতে থাকে পাঁচের দশকের মধ্যভাগে নিউ থিয়েটার্স পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু তার আগেই, ‘মহাপ্রস্থানের পথে‘ (১৯৫২) তার হিন্দি রূপান্তরযাত্রিক‘ (১৯৫৩) মাইলফলক হয়ে থেকে যায় চলচ্চিত্রের পীঠস্থানের শেষ সময়ের ইতিহাসে দুই ছবিরই অন্যতম মূল আকর্ষণ গান এই দুই ছবির গানে ভক্তির বন্যা বইয়ে দেন পঙ্কজকুমার মল্লিক ওঁর বজ্রগম্ভীর কন্ঠে কখনও ধ্বনিত হয় কুমারসম্ভবের শ্লোক, কখনও বা শিবস্তোত্র, বিষ্ণুস্তোত্র৷ সমবেতকন্ঠে সঙ্গ দেন ওঁরই কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পীরাযাত্রিকছবির সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকায় পঙ্কজকুমার প্রথমবার ভূষিত হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে চলচ্চিত্র গবেষক পিনাকী চক্রবর্তীর বয়ানে, “হিমালয় যাত্রার উপর ছবিটিকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং পঙ্কজ মল্লিকের দরাজ গলায় স্তোত্র গান এত সুন্দরভাবে লাগানো হয়েছিল যে দর্শক সাধারণ প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করলেই তাদের অনুভূতি হত তারাও যেন সেই সুদীর্ঘ তীর্থযাত্রায় পা মিলিয়েছে৷ তারাও যেন পুণ্যলাভের আশায় চলেছে কেদারনাথে, বদ্রিনাথে ছবিটি দুতিন দিন চলার পর একদিন হঠাৎ দেখা গেল দর্শন সাধারণ প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের আগে তাদের জুতো বাইরে খুলে তবেই প্রবেশ করছে কর্তৃপক্ষ হতচকিত হয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করাতে তারা জানিয়েছিল, এরকম একটা পবিত্র ছবি নাকি জুতো পরে দেখা উচিত নয় ছবি দেখে পুণ্যলাভের আশাতেই তারা জুতো খুলে প্রবেশ করছিল এরপর যতদিন চলেছিল ছবিটি ততদিনই হলএর কর্তৃপক্ষকে দর্শক সাধারণের জুতো পাহারা দেওয়ার জন্য আলাদা লোক রাখতে হয়েছিল চলচ্চিত্র ইতিহাসে ঘটনা শুধুমাত্র ভারতেই হয়, গোটা বিশ্বেও কোনওদিন ঘটেনি

sample_copy_of_pankaj_mullicks_first_film_song
পঙ্কজ মল্লিকের প্রথম ছায়াছবির গানের স্যাম্পল রেকর্ড। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

ছায়াছবির গানের পাশাপাশি, ত্রিশ-চল্লিশের দশক জুড়ে গ্রামোফোন রেকর্ডে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে পঙ্কজকুমারের বহু গানজীবনে জেগেছিল মধুমাস‘ (১৯৩৭, গীতিকারসৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়), ‘গগনে গগনে আপনার মনে‘ (১৯৩৭, রবীন্দ্রসঙ্গীত), ‘দিনগুলি মোর স্মৃতির কুসুম গাঁথি‘ (১৯৩৯, গীতিকারবাণীকুমার), ‘তেরে মন্দির কা হুঁ দীপক‘ (১৯৪০, গীতিকারপণ্ডিত বি. সি. মধুর), ইলা ঘোষের সহকন্ঠেআজি বসন্ত জাগিল কুঞ্জদ্বারে‘ (১৯৪৪, গীতিকারবাণীকুমার), ‘সঘন গহন রাত্রি‘ (১৯৪৪, রবীন্দ্রসঙ্গীত), ‘কার চারু চরণের মঞ্জীর‘ (১৯৪৫, গীতিকারশৈলেন রায়), ‘খরবায়ু বয় বেগে‘ (১৯৪৬, রবীন্দ্রসঙ্গীত), ‘ইয়ে রাতেঁ ইয়ে মৌসম‘ (১৯৪৮, গীতিকারফৈয়জ হাশমি) প্রভৃতি বহুশ্রুত গানে উজ্জ্বল ওঁর রেকর্ডতালিকা

রেকর্ড মাধ্যমে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী কাজও করেছেন পঙ্কজকুমার সুদূর ১৯৪৩ সালে ক্যাসানোভার অর্কেস্ট্রার সঙ্গে হিন্দি অনুবাদে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রাণ চাহে ন্যয়না না চাহে‘, ‘ইয়াদ আয়ে কে না আয়েগাওয়া কিংবা নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের নিজের পরিচালনায়কদম কদম বড়ায়ে যা‘, ‘শুভ সুখ চ্যান কি বরখা বরসেরেকর্ড করানো, আবার কখনও বা তেনজিং নোরগের এভারেস্ট জয়কে কুর্নিশ জানিয়ে অভিনন্দনগীতি গাওয়াসব ক্ষেত্রেই দক্ষতার স্পষ্ট চিহ্ন রেখেছেন তিনি তবে তাঁরই কথায়, “সঙ্গীত রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রে, বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেই জীবনে সর্বাধিক তৃপ্তি লাভ করেছি১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান কোম্পানিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করে যে যাত্রা আরম্ভ করেন পঙ্কজ মল্লিক, যে যাত্রা সমাপ্ত হয় এইচএমভিতে, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে চারটি গান রেকর্ডের মধ্য দিয়ে ওঁর কন্ঠেহে মোর দেবতাযে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধিরবীন্দ্রগীতি সম্বলিত রেকর্ডটি ছিল সে সময়কার সর্বাধিক প্রচারিত রেকর্ড

জীবনসায়াহ্নে পঙ্কজকুমার লিখেছিলেন, “লোকে শুধু জানুক, এই একজন অনাড়ম্বর মানুষ জীবনের সুদীর্ঘ ষাট বৎসর ধরে সংগীতের সেবা করেছে, ‘নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি’ চরণাশ্রিত হবার বাসনায় মানবসমাজের শ্রেষ্ঠ কবির সঙ্গীতরসধারাকে তৃষিত মানুষের পাত্রে পরিবেশন করার প্রয়াস পেয়েছে৷ তার কোনও তত্ত্বকথা ছিল না, বৈদগ্ধ্যের আড়ম্বর ছিল না, সে প্রধানত একটি ব্রতই পালন করেছেতা হচ্ছে সঙ্গীতপরিশীলনের সর্বোত্তম উদাহরণ যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তারই অনবরুদ্ধ প্রচারগায়ক পঙ্কজকুমার, সুরকার পঙ্কজকুমার, শিক্ষক পঙ্কজকুমার এখানে যেন একই সূত্রে বাঁধা সে যোগসূত্রটি রবীন্দ্রচেতনা যে পঙ্কজকুমার ছায়াছবির নির্বাক যুগে অর্কেস্ট্রা পিটে রবীন্দ্রগানের সুর বাজানোর কথা ভেবেছিলেন, তিনিই যখন সবাক ছবির যুগে সুরকার হিসাবে পরিচিত হলেন, তাঁর সুরে দেখা দিল মীড়প্রাধান্য ধ্রুপদ গানের চার তুকের কাঠামো বাংলা গানে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ হিন্দি গানে চার তুকের ব্যবহার প্রথম ঘটে পঙ্কজ মল্লিকের হাত ধরেই, ‘গুজর গয়া উয়ো জমানা ক্যায়সাগানে। যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পঙ্কজকুমারের পিয়ানো, অর্গান ব্যবহারের প্রতি বিশেষ দুর্বলতাও হয়ত পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতেরই প্রভাব বলা যায়

কবিগুরুর গানের প্রতি ওঁর যে দুর্বার আকর্ষণ, তার সূত্রপাত হয়েছিল ব্রাহ্মসমাজে সেখানেও অর্গানের সঙ্গতে রবীন্দ্রগান গাইবার প্রচলন ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার সময় পঙ্কজকুমারও এই যন্ত্রের সঙ্গত গ্রহণ করেছেন বারবার অর্কেস্ট্রা পরিচালনায় পঙ্কজকুমারের দক্ষতার প্রমাণ মেলে নানা ছায়াছবির গানে, প্রমাণ মেলেমহিষাসুরমর্দ্দিনী‘-তে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ওঁর অর্কেস্ট্রা ব্যবহার উজ্জ্বল হয়েও অনুচ্চকিতগানের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে সুষমভাবে গায়ক পঙ্কজকুমারের বেসব্যারিটোন কন্ঠস্বরটির ক্লাসিক আবেদনই সম্ভবত ওঁর সমকালীন অন্যান্য গায়কদের থেকে ওঁকে আলাদা করে দেয় কন্ঠস্বরের গভীরতাই শুধু নয়, ওঁর বলিষ্ঠ গায়ন ওঁর গানকে উজ্জ্বল করে তোলে এই বলিষ্ঠতায় ঔদ্ধত্য নেইআছে এক পবিত্র অনাসক্তি হয়তো তাই, উদাত্তকন্ঠে যখন পঙ্কজকুমার গেয়ে ওঠেন, ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাকিংবাচরণ বৈ মধুবিন্দতি চরণস্বাদুমুদুম্বরম্/ সূর্যস্য পশ্য শ্রেমাণং যো তন্দ্রয়তে চরণ/ চরৈবেতি চরৈবেতি‘, তখন দৃঢ়বিশ্বাসে নিজেকে অমৃতের পুত্র জেনে এগিয়ে যাওয়ার বল, গানে গানে আপনিই সংগ্রহ করে নেয় অন্তর হয়তো এমনই কোনও দিব্য অনুভূতিমহাপ্রস্থানের পথেছবির দর্শকদের একদা বাধ্য করেছিল পাদুকাজোড়ার অহঙ্কারটুকু বাইরে ফেলে এসে সমর্পিতচিত্তে পঙ্কজকুমারের কন্ঠে ভক্তিগীতি শুনতে হয়ত এই দিব্য অনুভূতির টানেই, ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী‘- সুরের কাছে আজও আত্মসমর্পণ করতে হয়

রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করার পর রেকর্ডজগত থেকে সরে যান পঙ্কজ মল্লিক ধীরে ধীরে সরে যান ছায়াছবির জগত থেকেও কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি দিনও যোগাযোগ ছিন্ন করেননি তিনি, তা হল কলকাতা বেতার শেষ দিন পর্যন্ত পঙ্কজকুমার মনে মনে ভরে থাকতে চেয়েছিলেনসঙ্গীতশিক্ষার আসরআরমহিষাসুরমর্দ্দিনী‘-কে সঙ্গী করে। কিন্তু সঙ্গীহারা হতে হয়েছিল তাঁকে ১৯৭৫ সালের  অক্টোবর আকাশবাণীর স্টেশন ডিরক্টরের চিঠি মারফৎ তাঁকে জানানো হয়, “In accordance with the decision taken to introduce many changes in programmes broadcast by All India Radio, it will not be possible for us to continue your music lessons, with effect from 2nd November, 1975.” ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর‘-এর দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছরের যাত্রা সহসা স্তব্ধ হয় ১৯৭৬ সালে মহালয়ার ভোরেও এ ভাবেই, অকস্মাৎমহিষাসুরমর্দ্দিনী‘- পরিবর্তে প্রচারিত হয় অন্য অনুষ্ঠান – ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্ পরিবর্তনে শ্রোতাদের প্রবল বিরোধিতায় পরবর্তী বছরমহিষাসুরমর্দ্দিনীফিরে এলেও, পঙ্কজকুমারেরসঙ্গীতশিক্ষার আসর‘-এর প্রত্যাগমন হয়নি দুঃখেঅপমানে ক্ষতবিক্ষত অন্তর, হৃদরোগ, একের পর এক আসা মানসিক আঘাত, ক্রমে কেড়ে নিতে থাকে তাঁর সব ভাষা। জীবনের গতিপথ দ্রুত বদলে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে মৃত্যুর দিকে ১৯৭৮ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন পঙ্কজকুমার মল্লিক

এক গৌরবোজ্জ্বল জীবনের একান্ত সাধনা; সমস্ত মানঅপমান, সুখদুঃখকে সঙ্গে নিয়ে যেন স্তব্ধ হয়ে ছিল পঙ্কজকুমার মল্লিকের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ করেছিলেন, “ওঁর সঙ্গীতে, স্বভাবে, ব্যবহারে কোথায় যেন একটি ঐশ্বরিক যোগ আছেএই যোগটি বোধহয় সেই দিব্য অনাসক্তি, যা উচ্চারিত হত তাঁর কম্বুকন্ঠের গানে, আবার নৈঃশব্দ হয়ে ফুটে উঠত তাঁর ব্যবহারের স্নিগ্ধতায় অনাসক্তচিত্তের ঐকান্তিক সাধনাতেই অক্ষয় পঙ্কজকুমার মল্লিক, অবিস্মরণীয় তাঁর কীর্তি

4 Responses

  1. অসাধারণ লিখেছিস রে শৌণক! এত তথ্যে ভরা এই লেখা, যে ভয় হচ্ছিল, কোন লাইন ফস্কে গেলেই বুঝি কোন দামি তথ্য না জানা রয়ে গেলো। খুব মন দিয়ে, সাবধান হয়ে তোর পুরো লেখাটা পড়লাম। আগের লেখাটাও খুব ভালো লেগেছিল। অপেক্ষায় রইলাম এমনই আরো লেখা পড়বার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com