banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

এলোমেলো বেড়ানো: ১৭

অমিতাভ রায়

জুন ২৯, ২০২৩

Bagrakote North Bengal
Bagrakote North Bengal
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬]

বাগরাকোট

বাগরাকোট (Bagrakote)। অচেনা অজানা জায়গা নয়। শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার হয়ে কোচবিহার যাতায়াতের সময় বাগরাকোটের ওপর দিয়েই যাওয়া-আসা করতে হয়। এমনকী ডুয়ার্সের পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে যেতে গেলেও বাগরাকোটকে এড়িয়ে  যাওয়ার উপায় নেই। অর্থাৎ এক কথায় বাগরাকোট হচ্ছে ডুয়ার্সের দুয়ার।

শিলিগুড়ি থেকে রেলপথে ঘন্টা দেড়েক। গুলমা, সেবক পার হলেই পরের স্টেশন বাগরাকোট। সড়ক সফরে দূরত্ব দশ কিলোমিটার বেশি হলেও সময় লাগে সোয়া ঘন্টা।  

উছলে পড়া সবুজ। উন্মুক্ত আকাশ। ঝকঝকে রোদ্দুর। শনশন হাওয়া। রাতের আকাশে তারারা কাঁপে। আর চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে চা বাগান। দূরে দিগন্তরেখায় সাজানো হিমালয়। শীতের দিনে ঝকঝকে রোদ্দুর উঠলে এখান থেকেই দেখা যায় বহু পরিচিত পর্বতশৃঙ্গ। 

Bagrakote tea garden
বাগরাকোট চা বাগান

শান্ত  রেল স্টেশন, ব্যস্ত  জাতীয় সড়ক, বহতা নদী, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, দূষণহীন বাতাস আর বিশাল চা বাগান হল বাগরাকোটের সম্পদ। রীতিমতো বনেদী ও অভিজাত চা বাগান। দেশের প্রাচীন চা বাগানগুলির অন্যতম। ১৮৭৬-এ বাগরাকোট  চা বাগান যাত্রা শুরু করলেও এখন আর্থিক  অবস্থা ভালো নয়। বাগানের প্রাণচঞ্চল কর্মজীবন মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেয়ে থমকে গিয়ে এখন ধুঁকছে।  অপুষ্টি-অনাহার-আত্মহননে গত কয়েক বছরে অন্ততঃ জনা  পঞ্চাশ শ্রমিক অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যের জীবনাবসান হয়েছে। 

বাগরাকোটে আর রয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ। তিস্তা ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ (Teesta Field Firing Range)। অনেককালের পুরনো চাঁদমারি। দেশের পঞ্চাশটি ফায়ারিং রেঞ্জের অন্যতম।  দিনের পারাবারে রাত্রি মিশে যাওয়ার লগ্নে কানে ভেসে আসে ‘ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রুম’। অর্থাৎ  শুরু হয়ে গেছে চাঁদমারির কর্মব্যস্ততা। পদাতিক সৈন্যের দল গুলি করতে করতে এগোতে থাকে। কামান দাগে  গোলন্দাজ। গুলি ছোটে। মর্টার থেকে ছিটকে পড়ে গোলা। সবমিলিয়ে এক ধুন্ধুমার পরিস্থিতি।  

এই পরিসরে অকুস্থলে উপস্থিত আরেক বাহিনী। এদের পরনে নেই ফৌজি উর্দি। দেখলেই বোঝা যায় এরা কোনও সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য নয়।  এদের বয়সের কোনও বাঁধন নেই।  বাচ্চা-বুড়ো-নবীন-প্রবীণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী এই বাহিনীর সদস্য। ক্ষুধায় ক্লান্ত শুকনো মুখ। শতচ্ছিন্ন ময়লা পরিধান। অথচ উদ্দেশ্যে অবিচল।  দায়িত্ব পালনে অনিশ্চল। মৌনতা মুখর নৈর্ব্যক্তিক আচরণ।  

চাঁদমারিতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দুটো ভাগ। একদল তোপ দাগে। আরেকদল না-ফাটা গোলাগুলি নিষ্ক্রিয় করার কাজে নিযুক্ত। সকলেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। যান্ত্রিক নিয়মে কাজ চলে। 

একেক লপ্তে চার বার বিস্ফোরণ। প্রথম তিনবার নিয়মের নিগড়ে উত্তেজনাবিহীন ভাবেই হয়ে গেল  বিস্ফোরণ। আর একবার হলেই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় দল না-ফাটা গোলাগুলি নিষ্ক্রিয় কাজ শুরু করে দেবে। না-ফাটা বোমা-গোলা-গুলি সবচেয়ে বিপজ্জনক।  যে কোনও মুহুর্তে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিপদ ডেকে আনতে পারে।   

Teesta Field Firing Range
বাগরাকোটে আর রয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ

তবে তৃতীয় বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে পড়ে নিয়মের শৃঙ্খল। এতক্ষণ নিস্পৃহ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মূক-মলিন বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে চাঁদমারির ময়দানে। রীতিমতো আলোড়ন।  ব্যবহৃত গুলির শেল, কার্তুজের আবরণ, মর্টারের টুকরো  কুড়িয়ে নিয়ে নিজের নিজের ঝোলায় ভর্তি করার জন্যে সে এক ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা।  নাকি প্রতিদ্বন্দ্বিতা? চতুর্থ বারের বিস্ফোরণ এখনও কিন্তু বাকি আছে। কার নিষেধ, আর কে-ই বা শুনছে!

প্রত্যেক লপ্তের শেষ বা চতুর্থ  তোপ দাগার  আগে  সেনাবাহিনী যথেষ্ট সতর্ক। ময়দানে হুটোপাটি করতে থাকা শতখানেক বা শ’-দেড়েক মানুষের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় সৈনিকের অবস্থান বদলায়। আগের জায়গা থেকে অনেকটা পিছিয়ে এসে তোপ দেগে পালিত হয় নিয়ম রক্ষার দায়িত্ব।  

বাগরাকোট চাঁদমারিতে বিমানবাহিনীও মহড়া দেয়।  এক সঙ্গে নীল দিগন্তে উড়ে যায় চার চারটে ফৌজি বিমান। আকাশে ভাসতে থাকা বিমান থেকে এক সঙ্গেই  বোমা বর্ষণ করে প্রতিদিন যাচাই হয় বিমান এবং বোমা কতটা  সক্রিয়। একই সঙ্গে বৈমানিকের দক্ষতারও পরীক্ষা হয়ে যায়। সারাদিনে অন্তত বারো-চোদ্দো বার বিমানগুলি আকাশে ওড়ে। এবং উড়ন্ত বিমান থেকে চাঁদমারির ময়দানে আছড়ে পড়ে বিভিন্ন ওজনের বোমা।  

বাগরাকোটে আর রয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ। তিস্তা ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ (Teesta Field Firing Range)। অনেককালের পুরনো চাঁদমারি। দেশের পঞ্চাশটি ফায়ারিং রেঞ্জের অন্যতম। দিনের পারাবারে রাত্রি মিশে যাওয়ার লগ্নে কানে ভেসে আসে 'ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রুম'। অর্থাৎ শুরু হয়ে গেছে চাঁদমারির কর্মব্যস্ততা। পদাতিক সৈন্যের দল গুলি করতে করতে এগোতে থাকে। কামান দাগে গোলন্দাজ। গুলি ছোটে। মর্টার থেকে ছিটকে পড়ে গোলা। সবমিলিয়ে এক ধুন্ধুমার পরিস্থিতি।

শুধু দিনের আলোয় নয় রাত্রির অন্ধকারেও অনেক সময় গুলি-গোলা, বোমা-মর্টার পরীক্ষার কাজ চলে। এবং সবসময়ই অকুস্থলে উপস্থিত থাকে স্থানীয় মানুষের মূক-মলিন বাহিনী।   

বিধি মেনে মহড়ার আগে স্থানীয় থানায় খবর পাঠালে মালবাজার থানা থেকে একজন হোমগার্ড চাঁদমারিতে আসেন। বেচারি! সমবেত মানুষের বাহিনীকে সামলানো কি একাকী মানুষের পক্ষে সম্ভব? আবার থানা থেকে সুবিশাল পুলিশবাহিনী পাঠানোও সম্ভব নয়। থানায় আর কতজন পুলিশ থাকে!

firing range in Bagrakote
গুলি-গোলা, বোমা-মর্টার পরীক্ষার কাজ চলে

কাজেই মহড়ার সময় সেনা আধিকারিকরাই রীতিমতো আশঙ্কায় থাকেন। বহিরাগতদের সংখ্যা বেড়ে গেলে বাধ্য হয়েই মহড়ার সঙ্গে সমঝোতা না করে উপায় কী! যে দূরত্ব থেকে গুলি ছোঁড়ার কথা, সময় বিশেষে তা কমিয়ে আনতে হয়।  কারও  গায়ে কার্তুজের সামান্য আঁচড় কেটে গেলেও চতুর্দিকে হইচই পড়ে যাবে। সেই হট্টগোল ক্ষণেকের মধ্যে আইন শৃঙ্খলার সমস্যায় পরিণত হতে পারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রত্যন্ত এলাকার ছাউনিতে দায়িত্ব পালন করতে এসে অযাচিত সমস্যায় জড়িয়ে না পড়ে সামান্য সমঝোতা করে কার্যোদ্ধার অনেক সহজ।  

যাঁদের নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা তাঁরা কিন্তু নির্ভীক। তাঁদের জীবন যেন শাঁখের করাত। পেটের জ্বালা তাঁদের চাঁদমারিতে টেনে আনে। আবার এখানে সামান্য অসতর্ক হলেই প্রাণ নিয়ে টানাটানি। জীবনধারণের জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যে মানুষগুলি প্রতিদিন এক ভয়ঙ্কর আপস করে দিন কাটায় তা বোধ হয় সামরিকবাহিনীর নিয়ম রক্ষার সমঝোতার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  

সামরিকবাহিনী আধুনিক  অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। স্থানীয় মূক-মলিন বাহিনীর সদস্যদের কাছে অস্ত্র নেই।  প্রত্যেকের কাঁধে ঝোলা আর হাতে শিক। রাতের বেলায় হাতে ওঠে একটা টর্চ। বাগরাকোট চাঁদমারিতে মাঝে-মধ্যে রাত-বিরেতেও আকাশ থেকে বোমা বর্ষণের মহড়া হয়। তখনও যে তড়িঘড়ি ছুটে আসাটা একান্তই প্রয়োজন। রাত পোহালে যে কিছুই পড়ে থাকবে না।  

নৈশ অভিযানের আগাম খবর পেয়ে গেলে অনেকে আবার একটু বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে চাঁদমারিতেই রাত কাটানোর আয়োজন করে। অবশ্যই গোপনে।  সারারাত নয়।  বোমা বর্ষণ পর্যন্ত।  মহড়া শেষ হলেই ব্যাগ-বস্তা ভরে, যদি কিছু পাওয়া যায়, রাস্তায় নামা।  চাঁদমারির ময়দানের কোনও এক প্রান্তে কোনও এক গর্তে কানে আঙ্গুল চাপা দিয়ে প্রতীক্ষা।  কখন মহড়া শেষ হবে।     

গর্ত কে খোঁড়ে? আকাশ থেকে ঝরে পড়া বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত চাঁদমারির ময়দান। সেই গর্তগুলিকেই আড়ে-বহরে আর গভীরতায় একটু বাড়িয়ে নিলেই হয়ে যায় মাথা গুঁজে, হাঁটু দুমরিয়ে,  কোমর মুচড়িয়ে লুকিয়ে থাকার সাময়িক ঠাঁই।     

সামরিকবাহিনীর  আধুনিকতম আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোঁড়া গুলি বা কামানের গোলা কিংবা মর্টার চাঁদমারির কোন বিন্দুতে গিয়ে পড়ল সেদিকে সকলের তীক্ষ্ণ নজর। ছুঁড়ে দেওয়া গুলি-গোলা বা মর্টারের ধাতব খোল মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একাধিক দাবিদার। অনেক সময় বিস্ফোরণের সাদা-কালো ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে  পাকিয়ে ওপরে ওঠা বন্ধ হওয়ার আগেই একাধিক হাত দখল নিতে চায় শূন্য খোলের দখল। ধাতব খোল হয়তো তখনও গনগনে গরম। হাত পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে ভ্রূক্ষেপ না করেই কোনও এক দাবিদার পরম আদরে খোলটিকে তুলে নিয়ে সরাসরি কাঁধের ঝোলায় চালান করে। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে বিজয়ীর হাসি। 

মাটির ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়া খোলটিকে উদ্ধারের জন্যে কাজে লাগে হাতের শিক। সদ্যব্যবহৃত খোল উদ্ধারে অনেক দাবিদার একসাথে হানা দেওয়ায় অনেক সময় একটু আধটু গালিগালাজ, হাতাহাতি, মারামারি হয় বইকি। তা হোক, খোলটার পাতাল প্রবেশ তো আটকানো গেল।  

রাতের বিমান মহড়ায় ব্যবহৃত বোমার খোল খুঁজতে একটু অসুবিধা হয়। ওজন-গতি এবং বিস্ফোরণের মাত্রা বেশি হওয়ায় খোলগুলি তাড়াতাড়ি মাটির গভীরে গেঁথে যায়। অন্ধকারে ধোঁয়ার কুন্ডলীও ভালো করে নজরে আসে না। তখন কিছুটা আওয়াজে, খানিকটা আন্দাজে আর বাকিটা অভিজ্ঞতায় খুঁজে নিতে হয় অকুস্থল। বাঁ হাতের টর্চ আর ডান হাতের শিক কাজে আসে। রাতে ঝুঁকি বেশি হলেও প্রতিদ্বন্দী কম।  

গোলা-গুলি-বোমা-মর্টারের খোল থেকে কী মেলে? লোহা, পিতল, সিসা, সিলভার এবং অন্য কিছু সঙ্কর ধাতব পদার্থ। সিলভার মানে কিন্তু রুপো  নয়। স্থানীয়রা যাকে সিলভার বলতে অভ্যস্ত তা আসলে  খুব ভালো মানের অ্যালুমিনিয়াম। বিক্রি করতে অসুবিধা নেই। মালবাজারে নিয়ে গেলেই হাতে হাতে নগদ টাকা। ব্যবসার প্রয়োজনে অনেক ক্রেতা  চাঁদমারির বাইরেই দাঁড়িপাল্লা সাজিয়ে বসে থাকেন। এক কেজি লোহা আট থেকে দশ টাকা। পিতল দুশো। কখনও আরও বেশি। সরাসরি বাসনপত্র তৈরি করা যায় বলে পিতলের দাম একটু চড়া। সিসা একশো দেড়শো। আর সিলভার সত্তর-আশি টাকা।              

সাহসে ভর করে উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজ করতে পারলে দিনে একশো দেড়শো টাকা রোজগার কোনও ব্যাপার  নয়। শক্তিশালী, কর্মক্ষম এবং সাহসী কমবয়সীদের জন্যে এত সহজ রোজগারের কোনও বিকল্প আছে কি? বয়স্কদের অবিশ্যি বেশির ভাগ দিনই খালি হাতে ফিরতে হয়।  তবু যেতে হয়। কথায় আছে– আশায় বাঁচে চাষা।

গোলা-গুলি-বোমা-মর্টারের খোল থেকে কী মেলে? লোহা, পিতল, সিসা, সিলভার এবং অন্য কিছু সঙ্কর ধাতব পদার্থ। সিলভার মানে কিন্তু রুপো নয়। স্থানীয়রা যাকে সিলভার বলতে অভ্যস্ত তা আসলে খুব ভালো মানের অ্যালুমিনিয়াম। বিক্রি করতে অসুবিধা নেই। মালবাজারে নিয়ে গেলেই হাতে হাতে নগদ টাকা। ব্যবসার প্রয়োজনে অনেক ক্রেতা চাঁদমারির বাইরেই দাঁড়িপাল্লা সাজিয়ে বসে থাকেন। এক কেজি লোহা আট থেকে দশ টাকা। পিতল দুশো।

নদীর ধারের এই চাঁদমারিতে কোনও সীমানা প্রাচীর নেই। সেনা ছাউনির মতো স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। যে কোনও দিন বড়োসড়ো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ছোটোখাটো আঘাত লাগা, হাত পুড়ে যাওয়া বা আহত হওয়া তো নিত্যকার ঘটনা। না-ফাটা গুলি-গোলা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়ার সময়ও দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণহানিও হয়।   ঘটনাস্থলে না হলেও গুরুতর আহতদের অনেকেই পরে মারা যায়। নিয়মিত  সীসা ঘাঁটাঘাঁটি থেকে শরীরে যে সংক্ৰমণ ছড়ায় তার  হিসেব কে রাখে?    

বছর কয়েক আগে ওরাওঁ জনজাতির চার কিশোর, সকলেরই বয়স বারো-চোদ্দো বছর, চাঁদমারির এক দুর্ঘটনায় আহত হয়। চাঁদমারির ময়দানে কুড়িয়ে পাওয়া এক ধাতব গোলক নিয়ে ওরা লোফালুফি করছিল। বস্তুটি যে না-ফাটা কোনও গোলা সেটা বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে। আহত চারজনকে  একই সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করা  হয়েছিল। একজনের মৃত্যু হয়। পাড়া-পড়শিরা ক’দিন কান্নাকাটি করল।  পুলিশ গ্রামে এল।  স্থানীয় খবরের কাগজে একটা খবর ছাপা হল। তারপর, যে কে সেই। পেশাগত ব্যাধির মতো এ হল পেশার ঝুঁকি।  

বাগরাকোট চাঁদমারির মতো দেশের অন্যান্য চাঁদমারিগুলিও দূর দূরান্তের প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। সত্যি বলতে কী, অন্যান্য অনেক চাঁদমারির তুলনায় বাগরাকোটের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। সড়ক ও রেল পরিষেবার সুবাদে বাগরাকোট দুর্গম নয়। কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে শিলিগুড়ির মতো ব্যস্ত শহর। জেলা শহর জলপাইগুড়ির দূরত্ব মাত্র সত্তর কিলোমিটার। 

Bagrakote railway station
সড়ক ও রেল পরিষেবার সুবাদে বাগরাকোট দুর্গম নয়

অন্য কোনও চাঁদমারিতে এমনটা ঘটে কিনা বলা মুশকিল। অন্তত তেমন কোনও খবর নেই। অথচ সেইসব চাঁদমারিরও আশপাশে ছড়িয়ে আছে চূড়ান্ত দারিদ্র। শুধুমাত্র বাগরাকোট চাঁদমারিতেই  কেন স্থানীয় মানুষের এমন আগ্রাসী অন্বেষণ? 

উত্তর খুঁজতে সরেজমিনে তদন্তে নামলে জানা যায় যে অন্যত্র চাঁদমারির চারপাশে বসবাসকারী মানুষদের সামান্য হলেও চাষবাসের সুযোগ আছে। যেখানে কৃষিকাজ নেই সেখানে অন্য পেশায় যুক্ত থাকার সুযোগ আছে।  কোথাও মাছ ধরার কাজ আবার কোথাও রয়েছে অরণ্যের সম্পদ আইনি প্রথায় সংগ্রহের সুযোগ। পাথরের খাদান খোঁড়া বা নদীর বালি সংগ্রহের অবকাশও অনেক চাঁদমারির  আশপাশের এলাকায় রয়েছে। বাগরাকোটে কিন্তু সেই ভাবে কোনও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ  নেই। 

বাগরাকোট চাঁদমারির পাশেই সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল চা বাগান। শুরুর সময় থেকেই পূর্ব ভারতের নানান এলাকা থেকে বিভিন্ন জনজাতির মানুষকে এখানে এনে বাগিচার কাজে জুতে দেওয়া হয়েছিল। এখনকার ওডিশা, ঝাড়খন্ড, বিহার এবং পশ্চিম বাংলার কয়েকটি জেলা থেকে নিয়ে আসা সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ থেকে শুরু করে পাহাড় থেকে নেমে আসা গোর্খা জনজাতির মানুষ প্রায় দেড়শো বছর ধরে একসঙ্গে একই পেশায় যুক্ত থাকার ফলে তাঁদের একটাই পরিচয়,– চা শ্রমিক। চা বাগানের কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজেই তাঁদের পারদর্শিতা নেই। এখানে কোনও কৃষিকাজের সুযোগও নেই। কাজেই চাঁদমারির পাশের সোনালী বা সাতগাঁও  থেকেই নয়, প্রাণের ঝুঁকি  নিয়েও রোজগারের আশায় বহুদূরের  ময়নাগুড়ি থেকে শুরু করে ওদলাবাড়ি, এলেনবাড়ি, ফুলবাড়ি, শিকারপুর, ডামডিম থেকেও   লোক আসে।          

 একশো চল্লিশ বছরের পুরোনো চা বাগানকে বনেদী বা অভিজাত যা-ই আখ্যা দেওয়া যাক না কেন বাস্তবে এখন তা ধুঁকছে। অন্য কোনও কাজের সুযোগ না থাকায়  স্থানীয় মানুষ হানা দেয় চাঁদমারির ময়দানে। লুটপাট নয়, চুরিচামারিও নয় নেহাতই বর্জ্য সংগ্রহ। জীবন বাজি রেখে রোজগারের এমন রোজনামচা আরও কতদিন চালু থাকবে বলা কঠিন। 

ডুয়ার্সের অন্যত্র পর্যটনের প্রসার হলেও বাগরাকোট সেই মানচিত্রে জায়গা পায়নি। আশার কথা, বাগরাকোট থেকেই শুরু হবে সরাসরি গ্যাংটক যাওয়ার নতুন জাতীয় সড়ক। হয়তো তখনই এখানকার জনজীবনে আসবে এক নতুন মাত্রার পরিবর্তন। এবং খুলে যাবে  জীবনের  ঝুঁকি না  নিয়ে রোজগারের  কোনও এক নতুন রাস্তা।

ছবি সৌজন্য: Twitter

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com