মঞ্জরী তখন গড়বেতার কিছু দূরে ঘাটালের পথে চন্দ্রকোনা শহরের এক গৃহবধূ, প্রাইমারি শিক্ষিকা, অবসর নিয়েছেন সদ্য। দুই সন্তানের মা। স্বামীও ইস্কুল মাস্টার। তিনি বছর দুই আগে ফেসবুকে এসেছেন। কন্যা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। সে থাকে দিল্লিতে। কথা বলার সুবিধে হবে, তাই। আর মা একা করবে কী? পুত্র ইঞ্জিনিয়ার। থাকে কলকাতায়। তাঁরা স্বামী স্ত্রী চন্দ্রকোনা শহরে ছোট একটি বাড়িতে থাকেন। বিবাহের পর নিজেরা করেছিলেন। সংসার গড়েছিলেন। বাড়িটির ছবিও আছে টাইমলাইনে। সামনে ফুলের বাগান। স্বামী স্ত্রীর কাজ সেই বাগান পরিচর্যা করা। তাঁর একটুও মনে পড়ে না চঞ্চলচন্দ্রর কথা। লোকটাকে ঘৃণা করতেন, কিন্তু এই বয়সে এসে ঘৃণা চলে গেছে। চঞ্চলচন্দ্রকে অবশ্য তিনি ভোলেননি, কেন না তিনি শুভাননকে ভোলেননি। শুভানন কেন আত্মহত্যা করতে গেল? নির্দোষ কেন নিজেকে মারল। তাহলে কি শুভানন ভুল করেছিল। লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিল। শুভানন বেঁচে থাকলে তিনি বিশ্বাসই করতেন, শুভানন নির্দোষ। সে একটি চিঠি দিয়েছিল ডাকে। একটিই পংক্তি, “আমি নির্দোষ, যা শুনেছ সব মিথ্যা।”
আত্মহত্যার পর শুভানন আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি। লোকে বলেছিল, তাহলে কথাটা সত্যি। সে অপরাধ করে অনুশোচনায় মরেছিল। মঞ্জরী নিজেকে ধিকৃত করছিল। শুভাননকে দোষ দিচ্ছিল, মরলি কেন তুই? এখন তুই কী করে প্রমাণ করবি, তুই দোষ করিসনি শুভ? শুভাননের কথা তিনি তাঁর স্বামীর কাছে গোপন করেননি। স্বামী শুভাননের পক্ষেই বলেছিলেন। অপমানিত মানুষও নিজেকে শেষ করে দেয়। স্বামী তাঁকে ভাল বেসেছিলেন। স্ত্রীর প্রতি করুণায় তাঁর মন ভরে গিয়েছিল।
আত্মহত্যা করল শুভানন। অপমানিত এবং লাঞ্ছিত। শুভাননের বাবা মা মঞ্জরীকে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠিতে তাঁরা লিখেছিলেন, “শুভকে ভুলে যাও মা, নিজের জীবনকে অবহেলা করও না, আস্তে আস্তে সকলেই তাকে ভুলে যাবে। আমরা ভুলতে পারব না। সন্তানশোক কয়েক জন্ম ধরে বইতে হয় মা…”।
শহর ছেড়ে আসার আগে মঞ্জরী দেখা করেছিল তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা বলেছিলেন, শুভাননের বইগুলি নিয়ে যেও মা। তোমার জন্যই ঘর সাজাচ্ছিল সে। ভাবতে পারেনি একটা লোক বেঁচে থাকতে দেবে না তাকে।
ভীরু তো ছিল না সে। মঞ্জরী বলেছিল, আমি যদি আগে জানতাম, ছুটে যেতাম তার কাছে।
একদিন এক মুহূর্তের জন্য ভয় ঘিরে ধরেছিল নিশ্চয়, অপমান সহ্য করতে পারেনি, আমাদের ছেলে সৎ মানুষ ছিল, তার জীবনের আদর্শ ছিল একটা, কী থেকে কী হয়ে গেল যে।
মঞ্জরী বলেছিল, শুভর মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ সে, সে না থাকলে শুভ বেঁচে থাকত।
মঞ্জরীর হাত ধরে শুভর মা বলেছিল, তা কি সত্য মা, পৃথিবীতে প্রেম কি হয় না, তার জন্য মরতে হবে কেন, ছেলেটাকে অন্যায়ভাবে হাজতবাস করাল ওর অফিসাররা, আসলে সব ঘটল ওই ভয়ানক ছেলের জন্য, একটা মানুষ এত খারাপ হয়!
আমাকে খুব শুনতে হচ্ছে মা। মঞ্জরী বলেছিল, বলছে আমার জন্য মরেছে সে, আমিই সব কিছুর জন্য দায়ী।
কী যে বলিস মা, তুই তাকে বাঁচিয়েই রাখবি জানি, তুই কত প্রলোভন ছাড়লি তা কি জানিনে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল শুভর মা।
কী নিষ্ঠুর মা, লোকটা এখনও বলছে বিয়ে করতে চায়, পারলে মুখে থুতু ছিটিয়ে দিই। ঘৃণাভরে বলেছিল মঞ্জরী। ভয়াবহ প্রত্যাখানের ভাষা শুনতে হয়েছিল চন্দ্রবাড়ি থেকে আসা প্রস্তাবককে। তিনি মঞ্জরীর মুখেই শুনেছিলেন। একটা খুনির সঙ্গে কি সারাজীবন ঘর করতে পারা যায়? শুভানন আত্মহত্যা করেনি। তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। মহকুমা শাসক দায়ী। এমারজেন্সি না হলে আদালতে যেত মঞ্জরীর বাবা। কিন্তু আদালতে যাওয়ার অনুমতি পাননি তিনি তাঁর উপরওয়ালার কাছ থেকে।
সবই শুনেছিলেন স্বামী নিরঞ্জন। তাঁর অন্তরটি নির্মল। শুনতে শুনতে ব্যথিত হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল বিমর্ষ ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। নাহলে গভীর অবসাদে প্রবেশ করবে সে। তাইই হচ্ছিল, অবসাদ ঘিরে ধরছিল মঞ্জরীকে। সেই সময় নিরঞ্জন পাশে না দাঁড়ালে মঞ্জরীও হয়ত একদিন নিজেকে শেষ করে দিত। সে ভুলতে পারছিল না শুভাননকে। পৃথিবীর প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। এমন খারাপ মানুষের হাতে ক্ষমতা?
নিরঞ্জন হাত ধরেছিলেন মঞ্জরীর, বলেছিলেন, আমাকে ভালবাসতে পারবে কি না জানি না, কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসব, কোনও ত্রুটি হবে না। নিরঞ্জন চক্রবর্তী মানুষটির রুচির সঙ্গে মৃত শুভাননের রুচি মিলে গিয়েছিল। তিনি বই পড়তে ভালবাসেন। কবিতা লেখেন। আশ্চর্য, নিরঞ্জন চক্রবর্তী প্রায় সেই শুভাননের মত। নিরঞ্জন তাঁর সঙ্গে গল্প নিয়ে উপন্যাস নিয়ে আলাপ করেন। বই কিনে কিনে বাড়িতে একটা লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। সেই লাইব্রেরিতে শুভাননের সঞ্চয় করা বইও আছে। সেই সব বইয়ে শুভাননের স্বাক্ষর আছে। সবই নিরঞ্জন জানেন। হাসিমুখে সবই মেনে নিয়েছেন। মৃত শুভানন কখনওই তাঁর প্রতিপক্ষ হয়নি। অদেখা শুভাননের প্রতি মায়া জন্মেছিল নিরঞ্জনের মনে। তবে তার ছবি ছিল না কোনও। তখন ছবি ছিল দুর্লভ।
শুভাননের মৃত্যুর পর সেই শহর ছেড়ে গড়বেতা এলে, কয়েকজন তাঁর পাণিপ্রার্থী হয়। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। শোক ভুলতে সময় লেগেছিল। অবশেষে নিরঞ্জন চক্রবর্তীর কাছেই নিজেকে তিনি সমর্পণ করলেন। হ্যাঁ, নিরঞ্জন খুব ভালবাসেন তাঁকে। সংসার জীবনে কোনও খাদ ছিল না। চঞ্চলচন্দ্র তাঁর ল্যাপটপে দেখলেন বিভাময়ী মঞ্জরী বসে আছেন বৃদ্ধ স্বামীর পাশে। স্নিগ্ধ মুখখানি। লাল পাড়ের বুটিদার জামদানি হতে পারে শাড়িটি। গলায় সীতাহার, হাতে চুড়ি বালা। মাথা ভর্তি চুল, সিঁদুরের রেখা, মাথার দুপাশের চুলের কিছুটা অংশ শাদা হয়েছে। স্মিত হাস্যে চেয়ে আছেন সমুখে। এই বয়সেও যেন আলো করে বসে আছেন তিনি এক সভার দর্শকাসনে। চঞ্চলচন্দ্রর মনে হয় তাঁর দিকেই চেয়ে আছেন মোহময়ী গুণবতী নারী। স্বামী মানুষটি বেশ লম্বা মনে হয়। শান্ত প্রকৃতির। টাইমলাইনে কয়েকটি ছবি আছে। দুটি শিশু তাঁকে জড়িয়ে আছে। নাতি, নাতনি। ছবির নিচে তাঁর মন্তব্য, ওরা আমায় ছাড়ে না। তারপর এক একজন এক এক মন্তব্য করেছেন। তিনি উত্তর দিয়েছেন সব ক’টির। চঞ্চল দেখলেন লিখেছে একজন, মাসি আস না কতদিন।
যেতে পারি না রে, আমার কি কম কাজ, আটকে গেছি।
……তোমার সেই পোষ্যরা আছে?
আছেরে, করব কী, সব সময় মনে হয় ওদের জন্য কিছু করি।
……মাসি তুমি দিন দিন কী সুন্দর হচ্ছ, মা দুর্গা মনে হয়।
অমনি বলতে নেই।
…মাসি তোমার পথবাসী ইস্কুলে নতুন কতজন হল?
চল্লিশজন, আট থেকে আট চল্লিশ।।
…মাসি পুরোন জামা-কাপড় নেবে, জামাকাপড় ছেঁড়ে না যে?
কেচে ইস্ত্রি করে দিস।
…টাকা পয়সা সব ওখানে খরচ করো?
হ্যাঁ করি, এসব একজনের উদ্দেশে নিবেদিত।
…সে কে মাসি?
সে বেঁচে নেই।
…আচ্ছা, তুমি পুণ্য করছ অনেক।
সামান্য, জীবনে ভাল কাজ তো কিছু করিনি, আমরা সবই করি নিজেদের জন্য, তাই, কিছুটা ঋণ যদি শোধ হয়।
…কী যে বলো মাসি, তোমার মন কত উচ্চ, আমরা এভাবে ভাবতেই পারি না।
তোরা আসিস, ২৫শে বৈশাখ আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করছি খালপাড়ে।
…মাসি তুমি পারো বটে।
ঈশ্বরের আরাধনা করছি সুচেতা, আমরা যে বেঁচে আছি সুস্থভাবে, এত কিছু পেয়েছি, কেন রে?
তাঁর একটুও মনে পড়ে না চঞ্চলচন্দ্রর কথা। লোকটাকে ঘৃণা করতেন, কিন্তু এই বয়সে এসে ঘৃণা চলে গেছে। চঞ্চলচন্দ্রকে অবশ্য তিনি ভোলেননি, কেন না তিনি শুভাননকে ভোলেননি। শুভানন কেন আত্মহত্যা করতে গেল? নির্দোষ কেন নিজেকে মারল। তাহলে কি শুভানন ভুল করেছিল। লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিল। শুভানন বেঁচে থাকলে তিনি বিশ্বাসই করতেন, শুভানন নির্দোষ। সে একটি চিঠি দিয়েছিল ডাকে। একটিই পংক্তি, “আমি নির্দোষ, যা শুনেছ সব মিথ্যা।”
আমি চুপ করে আছি। শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিল। আমি যেন এক মৃদু নারীকন্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি নই, প্রতি রাতে নিভৃত গোপনে শুনতে পান চঞ্চলচন্দ্র। লিখিত বাক্যগুলো শব্দ হয়ে বাজে তাঁর কানে। প্রতিদিন তিনি একবার করে মঞ্জরী চক্রবর্তীর ফেসবুক-টাইমলাইন খুলে দেখে্ন। একদিন সেই ফেসবুকে পোস্ট করা আবদাল্লার ছবিও যেন দেখতে পান তিনি। হ্যাঁ, পথবাসী আবদাল্লা, তাঁর ঈশ্বরকে ভার্চুয়াল জগত থেকেই তিনি বাস্তবের পৃথিবীতে খুঁজে পেয়েছিল। ইশ্বর ওইভাবেই আবির্ভূত হয়ে থাকেন, স্বপ্ন আর কল্পনা থেকে পথের ধারে, খালপাড়ে, হেথাহোথা। কিন্তু এই সব মৃত শুভাননকে মনে রেখে। তাকে তিনি ভোলেননি। নিরঞ্জনকে নিয়ে তিনি সেই শহরে গিয়েছিলেন। শুভাননের বাবা মা চলে গেছে গ্রামে। গ্রামের নাম কেউ জানে না। তার ভাই গেছে মিলিটারিতে। বর্ডারে থাকে। মঞ্জরী কাউকে পাননি।
এত খবর কে দিল? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এসব তো লেখকের কলমে ভেসে আসে। সুমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হয়েছে গল্পটি ?
এসব কথা সত্যি? আমি কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
জানি না, আমি ভেবে বের করলাম। সুমিতাভ বললেন, গল্প এইভাবে হয়।
হয় যে তা আমি জানি। না হলে শ্যামাশ্রী ফিরে আসে ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর… গান নিয়ে। আমি বলতে যাচ্ছিলাম, আমার সঙ্গে মিলে গেছে অনেকটা, কিন্তু বললাম না। আমি কাকলি গানের বাড়ি এই নামের ইস্কুলের জন্য টাকা দিচ্ছি গোপনে। জীবনে তো কিছুই করিনি, কিন্তু শ্যামাশ্রীর কথা ভেবে কিছু করি। শ্যামাশ্রী ফিরে এসেছে তার কাকলি গানের বাড়ি নিয়ে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হয় না। জুড়ান বলেছে গানের ইস্কুলের ছবি সে ফেসবুকে পোস্ট করবে। জুড়ান বলেছে চল্লিশ বছর অশান্ত হয়ে কেটেছে তার। এখন সে প্রত্যেক দিন রাতে লিপিকাকে কাকলি গানের বাড়ির কথা শোনায় মনে মনে। মোবাইলে সেদিন রেকর্ড করে এনেছিল শ্যামাশ্রীর গান…এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর…। সেই গান শুনলে তার চোখ ভিজে যায়। লিপিকাকে যদি শোনাতে পারত, সে বেঁচে থাকত ঠিক। তবে নীলমাধব কাকে নিয়ে দেহরাদুন গেছে, সেইটা তাকে জানতে হবে ফেসবুক থেকে। তাদের বলে দিতে হবে রাজাকার অতীতের কথা। জুড়ানের মাথার ভূত এখনও যায়নি। আবার তা যে সত্যি নয় তা-ই বা বলবে কে?
সমাপ্ত
অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।