banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

চা বাগিচার কড়চা: পর্ব ৭- ছেঁড়াখোঁড়া স্মৃতিরা

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Memories of Tea Garden

আমার শৈশব স্মৃতিগুলির মধ্যে যেগুলি এখনও অমলিন, তার একটির সঙ্গে এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিনের সংযোগ রয়েছে। সেদিন ছিল আমার ছ’বছরের জন্মদিন। আমার ঠাকুর্দা তাঁর নাতি-নাতনিদের জন্ম তারিখ বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে একটি লাল রঙের ছোট বাঁধানো খাতায় লিখে রাখতেন। দাদুর কোনও স্মৃতি আমার নেই। আমাদের বাড়ির দরজার উপরে দেওয়ালে তাঁর একটি বাঁধানো ফোটোগ্রাফেই তাঁকে ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি।

দাদুর মৃত্যুর সময় আমি নিতান্ত শিশু। ঠাকুমা বলতেন, দাদুর মৃত্যুর দিনে আমাকে পাশের ‘বড়বাবু’দের কোয়ার্টারে রেখে আসা হয়েছিল। দাদুকে মনে না থাকলেও তাঁর সেই  লাল মলাটের খাতা কৈশোরে আমার দখলে এসেছিল। তাতে অন্যান্য ভাই-বোনেদের সঙ্গে আমার জন্ম তারিখও লেখা ছিল ১৩ই জৈষ্ঠ্য ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ। একারণে বাংলা মতে ১৩ই জৈষ্ঠ্যই আমার জন্মদিন পালনের তারিখ হিসেবে ধার্য হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ২৭-২৮ মে তারিখটি সাধারণভাবে এ দিনটির সঙ্গে মেলে। তাই ১৯৬৪ সালের মে মাসের ২৭ তারিখে দুপুরবেলায় আমার মা-ঠাকুমা আমার জন্মদিনের আয়োজন করেছিলেন। দুপুরবেলা আয়োজন করার দুটো কারণ ছিল সম্ভবতঃ। প্রথমত, আমি জন্মেছিলাম দুপুরে। আর দ্বিতীয়ত, আমার বাবা-কাকারা দুপুরে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে খেতে বাড়ি আসতেন।

যাইহোক, সেদিন দুপুরে নতুন জামা-টামা পরে আমাকে ঘরের মাঝখানে একটি আসনে বসানো হয়েছে। মা বোধহয় মালাও গেঁথেছিলেন একটা। আমি পায়েস ইত্যাদির আগমনের অধীর প্রতিক্ষায়  ছিলাম। পাশের ঘরে, বাবা যে ঘরে থাকতেন, সেখানে বেঁটে একটি শোকেস-এর মাথায় থাকত আমাদের ‘মুলার্ড’ কোম্পানির রেডিয়োটি। সেটা চলছিল। হঠাৎ বাবা রেডিয়োতে একটা খবর শুনে প্রায় আর্তনাদ করে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বললেন। আমার দুই কাকাও তখন বাড়িতে ছিলেন। অতঃপর বাবা-কাকা-মা-ঠাকুমার সমবেত হা-হুতাশ থেকে বুঝতে পারলাম, জহরলাল নেহেরু, আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন। আমার জন্মদিন  বাতিল হওয়ার প্রাথমিক দুঃখ ম্লান হয়ে গিয়েছিল বাবার শোকের গভীরতার কাছে।

 

আরও পড়ুন: বুদ্ধদেব গুহর কলমে: আমার ছেলেবেলার পুজো

 

বাড়ির আর সকলে কতটা জানি না, তবে বাবার শোক ছিল আন্তরিক। কারণ, বাবা চিরকাল কংগ্রেস  সমর্থক ছিলেন। তাঁর আদর্শের মা্নুষ ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। বাবাকে কংগ্রেস-সমর্থন বিষয়ে একবারই বিচলিত হতে দেখেছিলাম, ১৯৭৫ সালে এমারজেন্সির সময়। ১৯৭৭  সালে জনতা পার্টিকে ভোট দিতে তাঁর হাত কেঁপেছিল। পরে এ কথা তিনি আমাদের নিজের মুখে বলেছিলেন।

জন্মদিন ভেস্তে গেল বলে আমার সে দিন জহরলালের উপর তেমন রাগ হয়নি, কারণ, কৈশোর ও যৌবনের এলোমেলো চিন্তা-ভাবনার  দিনগুলি বাদ দিলে জহরলালকে আমার পরে মন্দ লাগেনি। রাজনীতিতে সফল হতে গিয়ে নিজের আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে, বামপন্থীদের বারবার হতাশ করে, তিনি গান্ধীর অনুগামী হয়েছিলেন ঠিকই, তবে তাঁর উদারনৈতিক চিন্তা ও আচরণ, পাণ্ডিত্য এবং আসাধারণ লেখনী আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর রোম্যান্টিকতা ও প্রেমগুলি নিয়ে নিন্দেমন্দও আমাকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রভাবিত করেনি বিশেষ।

আমাদের অবিভাবকেরা চা-বাগানের ‘বাবু’র চাকরিসূত্রে মোটামুটিভাবে একই অর্থনৈতিক শ্রেণিভুক্ত হলেও পদমর্যাদার নিরিখে বাবুদের মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। যেমন বড়বাবু, ডাক্তারবাবু ও বড় গুদামবাবু, এঁদের পদমর্যাদা একটু উপরের দিকে ছিল। বিশেষতঃ আমদের বাগানের ডাক্তারবাবুর, চিকিৎসক হিসেবে শুধু নয়, একজন সমাজমনস্ক সংস্কারবাদী মানুষ হিসেবে সুদূরপ্রসারী সুনাম ছিল। তাঁর সম্মানের পেছনে পদমর্যাদার চেয়ে বেশি কাজ করত এ অঞ্চলের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতির একজন রূপকার পরিচয়টি। স্থানীয় কালচিনি ‘ইউনিয়ন একাডেমি’ উচ্চবিদ্যালয়টি তাঁরই হাতে গড়া। তাঁর নাম ছিল হরকুমার সান্যাল, আমরা ডাকতুম জ্যাঠামশায় বলে। স্থিতধী, উদারমনা, দীর্ঘদেহী মানুষটি সর্বদা ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন, পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন।

আসলে তখন বাগানের বাবুদের ‘বাহন’ বলতে সাইকেলই ছিল ভরসা। বাড়ি থেকে কারখানা ও অফিসের দূরত্ব তেমন বেশি না হলেও অনেকেরই সঙ্গী ছিল সাইকেল। তাছাড়া দু’দিকে চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটি ধরে নানা প্রয়োজনে তাঁদের কালচিনি যেতে হত, সাইকেলই ছিল সেখানে সবচেয়ে বড় সহায়। আমাদের কোয়ার্টারগুলিতে বিজলিবাতি থাকলেও সন্ধ্যাশেষে বাগানের বাইরে বের হলে, শুক্লপক্ষ বাদ দিলে, ওৎ পেতে থাকত গভীর অন্ধকার। জোনাকি আর তারার আলোয় সেসব রাত্রিগুলি রূপসী ছিল ঠিকই, তবে বাবুদের সাইকেলগুলিতে ডায়নামো বাতির ব্যবস্থা রাখা ছিল অনিবার্য, যেমন নাকি পায়ে চলা মানুষের হাতে টর্চবাতি।

Cycle was main Vehicle
এ রাস্তায় সাইকেল ছাড়া অন্য বাহনের উপর ভরসা করা যেত না

ডাক্তার জ্যাঠামশায় ও বড়বাবুর কোয়ার্টার দুটির সামান্য হলেও কিছু বিশেষত্ব ছিল। ডাক্তার জ্যাঠামশায়ের কোয়ার্টারটি ছিল কাঠের তৈরি দোতলা। বাঙালি বাবুদের এই কোয়ার্টারগুলির মধ্যে দু’তিনটি ছিল অবহেলায় তৈরি এবং তুলনায় ক্ষুদ্র। সেগুলি পদমর্যাদায় নিচু এবং নিচুজাতের কর্মীদের জন্য দেওয়া হত। এঁরা সাধারণত ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করতেন। ব্রিটিশ সাহেবেরা চা-বাগান পত্তনকালে কুলি-বাবু-সাহেবদের শ্রেণিগত নিপুন ব্যবধান বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু জাত ব্যবস্থার ভেদাভেদের উপরও নজর রেখেছিলেন। নইলে ছুতোর মিস্ত্রিদের বাসস্থান হয়তো হত কুলি লাইনে। কিন্তু কুলিরা তো উপজাতি, তাই তাঁদের সামাজিক অবস্থান ছুতোরদের থেকেও নীচে ছিল।

আমার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন আমাদের বাগানেরই প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারমশাই বিভূতিকান্ত সরকার। বাগানের অন্যান্য বাবুদের জ্যেঠু, কাকু ইত্যাদি সম্বোধন করলেও তাঁকে মাস্টারমশাই বলেই ডাকার রেওয়াজ ছিল। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ মানুষটিকে কখনও শিক্ষকতার বাইরে অন্য কোনও বিষয়ে নাক গলাতে দেখিনি, বিশেষত বাবুদের পলিটিক্সে তিনি একেবারেই থাকতেন না। তখন চা বাগানের প্রাথমিক স্কুলগুলির দায়িত্ব নিতেন বাগান কর্তৃপক্ষ। মাস্টারমশাই মায়না পেতেন চা-বাগান থেকেই। বেতনক্রমের বিন্যাসে বড়বাবু, ডাক্তারবাবু ও বড় গুদামবাবু  ছিলেন ‘গ্রেড ওয়ান’ স্কেলের প্রাপক। চাকরিতে সময়সীমার ভিত্তিতে স্কেলগুলি নির্ধারিত হত। বাকি বাবুরা ছিলেন ‘গ্রেড টু’ তে। ‘গ্রেড থ্রি’ স্কেল নব-নিযুক্তদের জন্যে বরাদ্দ ছিল।

সরস্বতী পূজোর দিনটিকেই আমার হাতে খড়ির উপযুক্ত দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যথারীতি মাঝের ঘরে আয়োজন। আমরা বলতাম মধ্যের ঘর। সেখানে সরস্বতী ঠাকুরের মাটির মূর্তি সাজানো হয়েছে। সামনে ফল, ফু্‌ল, মিষ্টি ইত্যাদি উপাচার সাজানো। ধূপের, ফুলের, এবং প্রদীপের সলতে পোড়া গন্ধ মিলিয়ে আশ্চর্য এক সৌরভে চারদিক ম ম করছিল। তখন তো উত্তরবঙ্গে বেশ শীত থাকার কথা তবু আমার স্পষ্ট মনে আছে মাস্টারমশাই পরিষ্কার ধুতি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরে আমাকে কোলে নিয়ে বসে মাটির থালার পেছন দিকে খড়ি দিয়ে অ, আ লিখিয়েছিলেন।

সেদিন দুপুরে নতুন জামা-টামা পরে আমাকে ঘরের মাঝখানে একটি আসনে বসানো হয়েছে। মা বোধহয় মালাও গেঁথেছিলেন একটা। আমি পায়েস ইত্যাদির আগমনের অধীর প্রতিক্ষায়  ছিলাম। পাশের ঘরে, বাবা যে ঘরে থাকতেন, সেখানে বেঁটে একটি শোকেস-এর মাথায় থাকত আমাদের ‘মুলার্ড’ কোম্পানির রেডিয়োটি। সেটা চলছিল। হঠাৎ বাবা রেডিয়োতে একটা খবর শুনে প্রায় আর্তনাদ করে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বললেন।

মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধামিশ্রিত একটা দূরত্ব থাকলেও তাঁর স্ত্রী ছিলেন আমাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ,  আমরা তাঁকে বড়পিসি বলে ডাকতাম। এই নৈকট্যের একটা কারণ ছিল। আমার বাবা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে চা-বাগানের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তাঁর যুবা বয়স। তাঁর মতো বয়সের আরও কয়েকজন অবিবাহিত বাবু তখন একটি কোয়ার্টারে মেস করে থাকতেন। সেসব দিনের মেস জীবনের গল্প বাবার মুখে অনেক শুনেছি। একবার নাকি মেসে বাঘও হানা দিয়েছিল। যাইহোক, দেশভাগের বছরেই আমার দাদু-ঠাকুমা, কাকা-পিসি আর তাঁদের বরিশালের যৌথ পরিবারের আরও বেশ কয়েকজন সদস্যদের নিয়ে এ দেশে চলে আসেন। সে সময়ে বাবাকে বরাদ্দ করার মতো ফাঁকা কোয়ার্টার না থাকায় আমাদের পরিবারের এতজন মানুষকে নিয়ে বাবা মাস্টারমশাইদের কোয়ার্টারে ওঠেন। বেশ কয়েকমাস একসঙ্গে থাকার পর বাবা আলাদা কোয়ার্টার পেয়েছিলেন। সেই থেকে দুই পরিবারের অন্তরঙ্গতা।

ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর আনন্দে আমরা মেতে উঠতে শুরু করতাম পুজোর প্রায় মাসখানেক আগে থেকে। আমাদের যে খেলার মাঠ, তার একদিকে আমাদের মন্ডপ সারা বছর পড়ে থাকত অবহেলায়, আমাদের গোলপোস্টের পেছনে। পুজোর মাসখানেক আগে দুটো মোষের গাড়ি প্রতিমা গড়ার  মাটি এনে যেই ফেলত মন্ডপের সামনে, আমরাও তখনই নেচে উঠতাম। তারপর একসময় দু’জন মানুষ আসতেন কোচবিহার থেকে। এঁরা তিনচার দিন আস্তানা গাড়তেন আমাদের বাগানে, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হত আমাদের ক্লাবে। সারাদিন ধরে তাঁরা খড়, মাটি, বাঁশের কঞ্চি ও সুতলি দড়ি দিয়ে প্রতিমা তৈরি করতেন। আমরাও যতক্ষণ পারি সেখানে হাজিরা দিতুম। তারপর একদিন মুণ্ডহীন মূর্তিগুলি ফেলে রেখে তাঁরা চলে যেতেন। সেই ফেলে রাখা কাজটি আবার যখন তাঁরা ফিরে এসে শেষ করতেন,  সেটাই ছিল সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ। আমাদের আবার দিন গোনা শুরু হত, কবে বার এসে মূর্তির মুখ তৈরি করবেন আর রঙ চাপাবেন। বলবার অপেক্ষা রাখে না যে এরই মধ্যে বেশ সাড়ম্বরে শরৎকাল চলে এসেছে, রোদ্দুরে সোনার রঙ লেগেছে, আকাশও আশ্চর্য নীল, সেখানে সাদা মেঘেরা ভাসছে।

Shade tree in Tea garden
বর্ষার শেষে এক আশ্চর্য কমলা রঙের রোদ এসে পড়ত শেড ট্রিগুলির মাথায়

এরই মধ্যে, পূজোর মুখোমুখি কোনও রবিবার আমাদের বাগানের হলুদমুখো ছোট লরি এসে দাঁড়াত বাড়ির সামনে। সবাই আজ যাবে পুজোর বাজার করতে সেই আলিপুরদুয়ার। পুজোর  জন্য  যা যা লাগে, সে সব তো কেনা হবেই, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের পুজোর জামা-প্যান্ট-জুতোও কেনা হবে আজ। ইতিমধ্যে বোনাস হয়ে গেছে। বাবুদের পকেটের অসুবিধে তেমন নেই। লরির পেছনের ডালা খুলে দেওয়া হয়েছে, সামনে মাটিতে পেতে দেওয়া হয়েছে একটা টুল। বাড়ির মহিলারা টুলে পা রেখে  লরিতে  উঠবেন। যুবকদের কৃতিত্ব দেখাবার ব্যাপার রয়েছে। তারা চাকার দিক থেকে পাশের ডালার উপর দিয়ে উঠবে। লরিতে সতরঞ্চি পাতা, মহিলারা সেখানে বসবেন, অল্পবয়সী ছেলেরা বসবে ডালায়। 

নটার সময় গাড়ি ছাড়ার কথা, কিন্তু সবাই  এসে পৌঁছতে দশটা বেজে যায়। যাদের জন্য দেরি হয় তারা এসে পৌঁছলে সকলে বলে, আজই যদি এত সাজগোজ করবি তো পুজোয় কী হবে? যে পিচের পথ ধরে গাড়ি চলে, তার দু দিকে নানা  চা-বাগান– শালবাড়ি, গারোপাড়া, আটিয়াবাড়ি…। আর পথের সঙ্গে সঙ্গে চলে মিটারগেজ রেল-লাইন। কয়েকটি রেলস্টেশনও–গারোপাড়া, রাজাভাতখাওয়া। বোধহয় কোনওকালে কোচবিহারের রাজা এখানে ভাত খেয়েছিলেন। ভাগ্যিস মুঘল কোনও সম্রাট ভাত খাননি, নইলে ভবিষ্যতে কোনওদিন এই সুন্দর নামটি পাল্টে যাবার সম্ভবনা থাকত!

মেস জীবনের গল্প বাবার মুখে অনেক শুনেছি। একবার নাকি মেসে বাঘও হানা দিয়েছিল। যাইহোক, দেশভাগের বছরেই আমার দাদু-ঠাকুমা, কাকা-পিসি আর তাঁদের বরিশালের যৌথ পরিবারের আরও বেশ কয়েকজন সদস্যদের নিয়ে এ দেশে চলে আসেন। সে সময়ে বাবাকে বরাদ্দ করার মতো ফাঁকা কোয়ার্টার না থাকায় আমাদের পরিবারের এতজন মানুষকে নিয়ে বাবা মাস্টারমশাইদের কোয়ার্টারে ওঠেন। বেশ কয়েকমাস একসঙ্গে থাকার পর বাবা আলাদা কোয়ার্টার পেয়েছিলেন। সেই থেকে দুই পরিবারের অন্তরঙ্গতা।

তারপর সারাদিন ধরে এ দোকান থেকে সে দোকান ঘোরা চলত আমাদের। মা-বাবা আমাদের জামা প্যান্ট পছন্দ করতেন, শেষে আমাদের অনুমোদন করিয়ে নিতেন, কিরে নেব তো এটা? তবে আমাদের বেশি উৎসাহ ছিল বাটার দোকানের প্রতি। পুজোর কিছুদিন আগেই খবরের কাগজ-জুড়ে বিজ্ঞাপন বের হত, ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’। সে দোকানে আবার আমাদের ছোটদের জন্য ছিল রঙিন মুখোশ, উপহার হিসেবে। সব সেরে যখন লরি ফের বাগানে ঢুকত, তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। রাত্রে আমি আর দাদা সদ্যক্রীত ‘নটি-বয়’ জুতোটিকে আমাদের শয্যাসঙ্গী করে নিতাম।

সে সময়ে এক মস্ত সুবিধা ছিল, পড়াশুনোর জন্য তেমন কোনও চাপ আমাদের ছিল না। স্কুলে এবং বাড়িতেও। মোটামুটি নম্বর পেয়ে পরের ক্লাসে উঠে গেলেই সকলে সন্তুষ্ট। সে কারণেই পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিষয়গুলিতে নজর দেবার সময়ের অভাব হয়নি। ঋতু পরিবর্তন তাই আমাদের চোখে গভীরভাবে ধরা পড়ত। আসলে ধরা পড়তে বাধ্য হত বলা চলে, কেননা তাদের আগমন-উল্লাস ও বিদায়-মেদুরতা এত সুস্পস্ট ছিল যে, সেদিকে নজর না পড়াটাই একটা আশ্চর্যের কথা। বিশেষত বর্ষা। যেমন দুর্মরবেগে তার আসা তেমনি মহিমান্বিত তার সুদীর্ঘ উপস্থিতি। এমনও হয়েছে পাঁচ-সাতদিন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। এত বৃষ্টি এত বৃষ্টি, তবু অবাক কাণ্ড, রাস্তাঘাটে চা-বাগানের মধ্যে কোথাও জল জমত না। আমাদের চারপাশের নদীগুলি– কালজানি, ডিমা, তোর্সা, এবং নাম-না-জানা ঝোরাগুলি তখন পাগলের মতো ডালপালা-পাথর নিয়ে ছুটছে, কিন্তু তাদের পাগলামি নিজস্ব খাতের মধ্যেই থাকতে দেখেছি। পাড়ে উঠে পাগলামির খবর ছিল না।

Sunshine in tea garden
চা-বাগানের রোদ্দুরে রোদ্দুরে সোনার রঙ লেগেছে

বৃষ্টি বিদায় নিলে এক আশ্চর্য কমলা রঙের রোদ এসে পড়ত আমাদের মাঠে, বাগানে, শেড ট্রিগুলির মাথায় মাথায়। মন্ডপের আশপাশ থেকে শুরু করে সমস্ত বাবুবাসার চারিপাশ পরিষ্কার করতে লেবারেরা কোদাল, ঝুর্নি ইত্যাদি নিয়ে নেমে পড়ত। ঠাকুর রঙ আর প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেলে চূড়ান্ত আনন্দ এসে আমাদের একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। ইতিমধ্যে কোয়ার্টারগুলির অনেক দরজা জানালায় নতুন পর্দা উড়ছে। মেয়েরা যথাসম্ভব গোপন রেখেছে পুজোর চারদিনের পোশাকের খবর। যারা কলেজে পড়তে কলকাতায় গিয়েছে, তারা একে একে হাজির হচ্ছে। তাদের চুলের নতুনত্ব, পোশাকের বিশেষত্ব আমাদের অবাক করে দিত। যারা বাইরে চাকরি করে তারা নিয়ে আসে এমন সব জিনিস, যা চা-বাগানে নতুন। আমার ছোটকাকা, কলেজে চাকরি পেয়ে নিয়ে এল এইচএমভি-র রেকর্ড প্লেয়ার। ব্র্যান্ডের নাম ‘ফিয়েস্তা’। সঙ্গে লং-প্নেয়িং ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের রেকর্ড। সে আনন্দ বর্ণনার অতীত।  

পুজোর চারদিনের বিস্তারিত বিবরণ এড়িয়ে শুধু বলি, দু’দিন কি তিনদিন সেই হলুদমুখো লরি চেপে আমরা যেতাম আশপাশের বাগানের পুজো দেখতে। সেইসব বাগানে সহপাঠিনীদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল বিশেষ আকর্ষণ। তবে তারা যতই আকর্ষণীয় হোক, তাদের বাগানের ঠাকুরের মুখ আমাদের পুজোর তুলনায় যে কিছুই নয় এবং পুজোপ্যান্ডেলের তোরণটা যে আমাদের তোরণের পাশে দাঁড়াতেই পারেনি, সে  ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত থাকতাম।

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক

অপূর্ব দাশগুপ্ত 'পুরোগামী' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক।

3 Responses

  1. ‘শেষ হয়ে হইলো না শেষ ‘… খুবই মনোহারী ও রসগ্রাহী স্থান থেকে হঠাৎ বিচ্যুতি হোলো মনে হচ্ছে… আরো একটু বিস্তারিত খন্ড খন্ড লেখাগুলো বেশ চলছিল…. চলুক না

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com