banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

চা বাগিচার কড়চা: পর্ব ৪- চা-বাগানের ভূমি-ইতিহাস

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Tea Garden of Dooars

চিনের আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই চা-পানের প্রচলন ছিল। আমাদের দেশের অসমে সিংফো উপজাতিদের প্রিয়  পানীয় ছিল এই চা, যাকে তারা বলত ‘পাইন-আপ’। আর আজ সভ্য মানুষের এই  উষ্ণ পানীয়  বিনে দিন চলে না। ভারতবর্ষে চায়ের উৎপাদন ও বানিজ্য উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজীবনে, অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল।

ওয়ারেন হেস্টিংস জানতেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে উপমহাদেশে টিকে থাকতে হলে কলকারখানা প্রতিষ্ঠার দিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি কীভাবে নতুন নতুন চাষ-আবাদ করা যেতে পারে, সে সমস্ত সম্ভবনাও ভেবে দেখা চাই। চিন ও জাপানের অভিজ্ঞতায় জানা গেল ভারতবর্ষের বিশেষ কতগুলি অঞ্চলে চা চাষ করার সম্ভবনা রয়েছে। চিনে উৎপাদিত চা রফতানির ব্যবসা পুরোটাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে থাকায় প্রথমদিকে ভারতে চা চাষের বিষয়টি কোম্পানির কর্তারা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ১৭৮৮ সালের পর কোম্পানি ভারতে চা চাষের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করে কেননা এ সময় থেকে তাদের চা রফতানির একচেটিয়া ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। 

এর আগে অবশ্য ১৭৭৪ সালে কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে চিন থেকে চা-গাছ এনে রোপণ করান ওয়ারেন হেস্টিংস। অসমে যে দেশি চা গাছ জন্মায়, এ তথ্য সাহেবরা জানতেন না। ১৮২৫ সালে প্রথম ভারত-বর্মা যুদ্ধের পর অসম রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আসে। ১৮২৩ সালে রবার্ট ব্রুস নামে একজন দুঃসাহসী ইংরেজ উদ্যোগপতি অসমের শিবসাগর জেলায় চায়ের গাছ দেখতে পান। এর কিছুদিন পরে রবার্ট ব্রুসের ভাই সি.এ ব্রুস অসমের সাদিয়া নামক স্থানে কামানবাহী নৌকা-সহ হাজির হন। ব্রুস মণিরাম দেওয়ান নামে একজন স্থানীয় রাজার কাছ থেকে চায়ের বীজ সংগ্রহ করেন ও তা পাঠিয়ে দেন কর্তৃপক্ষের কাছে।

ভারতবর্ষের চায়ের ইতিহাসে রবার্ট ব্রুসকে চায়ের জনক বলা হলেও অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অসমের মণিরাম দেওয়ানের নামও একইসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে। মণিরামই সিংফোদের প্রধান বিসা গ্যামের  সঙ্গে ব্রুসের সাক্ষাত করিয়ে দিয়েছিলেন।বিসা গ্যামের সহায়তাতেই রবার্ট মারা যাবার পর তাঁর ভাই চায়ের বীজ সংগ্রহ করে  বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছিলেন।মণিরাম নিজে ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা দেশভক্ত মানুষ। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পরে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বিসা গ্যামের মৃত্যু হয়েছিল জোড়হাট জেলে।

১৮৩৪ সালে ১৪ জন সদস্য নিয়ে একটি চা কমিটি প্রস্তুত করেন লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক। কমিটি প্রথমে হিমালয়ের পাদদেশে কুমায়ুন জেলায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়। চিন দেশে পার্বত্য অঞ্চলে চা উৎপন্ন হয়, এ কারণেই হয়তো  এই প্রয়াস। তবে এ প্রয়াস ব্যর্থ হয় এ অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের দরুণ। এরপর বেন্টিঙ্কের কাছে খবর আসে যে, অসমের সাদিয়া ও বিশা অঞ্চল থেকে শুরু করে চিনের ইউনান পর্যন্ত চা গাছের ঝোপ রয়েছে। তিনি তখন অচিরাৎ সেখানে চা চাষের সম্ভবনা খতিয়ে দেখতে আর একটি কমিশন নিযুক্ত করেন। ১৮৩৫ সালের কোনও এক সময়ে কমিশনের সদস্যরা দিশি নৌকায় চেপে অসমের উদ্দেশে রওনা হন এবং প্রায় সাড়ে চার মাস পরে তারা সাদিয়ার মাটিতে পা রাখেন। 

 

আরও পড়ুন: পার্থ বসুর কলমে: অলীক অলকেন্দু

 

এই কমিশনের সুপারিশ অনুসারে এরপর সরকারি উদ্যোগে অসমের লখিমপুর জেলার সাদিয়ার নিকটবর্তী কুদিল ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থলে চায়ের চাষ শুরু হয়। এরপর চা কমিটির সুপারিশে দক্ষিণ ভারতেও চায়ের চাষ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত চিনা ও অসমের গাছের সংমিশ্রনে ভারতবর্ষে এক সংকর জাতের চা গাছের জন্ম হয়। এরপর ১৮৩৯ সালে বেশ লাভজনক দামে ভারতীয় চা লন্ডনের নিলামে বিক্রি হয়। ১৮৩৯ সালেই, মতান্তরে ১৮৪০-৪১ সালে দার্জিলিংয়ে চা চাষের সূচনা হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ১৮৪০ সালে এবং সিলেট ও কাছাড়ে চায়ের উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৫ সালে।

আমাদের ডুয়ার্সে চা-চাষের পত্তন ১৮৭৪ সালে। সে সময় ডুয়ার্স ছিল ম্যালেরিয়া এবং ব্ল্যাক-ওয়াটার রোগের কারণে বিভীষিকার রাজ্য। আর একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল ডুয়ার্সকে নিয়ে– This was a land for saints or the satans. ব্রিটিশ চা-সাহেবদের অবশ্য সাধু বা শয়তানকে গ্রাহ্য করলে চলবে না। তারা শুধু বুঝেছিল এই অঞ্চলের জমি চা-চাষের উপযোগী। ১৮৭৪ সালে দার্জিলিং এর চা-সাহেব ডাঃ ব্রুহাম জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় প্রথম চা-বাগানের পত্তন করেন। বন্যার কারণে সেবারের প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হয় ফুলবাড়িতে।

প্রথম বেশ কয়েক বছর ইংরেজরাই চা-বাগান খোলার জন্য জমি গ্রান্ট পেতেন। ১৮৭৭ সালে মুন্সি রহিম বক্স নামে একজন ভারতীয়  প্রথম চা-বাগান খোলার অনুমতি পেলেন। এর পরের বছর আর একজন ভারতীয় তথা বাঙালি কাঠের ব্যবসায়ী চা-চাষের জন্য জমি গ্রান্ট পেলেন। এই দু’জনের প্রতিষ্ঠিত বাগানদুটির নাম জলঢাকা ও আলতাডাঙা। তিস্তার পাড়ে অনেকগুলি চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ধীরে ধীরে তা ডামডিম, মাল হয়ে নেমে আসে ভুটানের কোলে নাগরাকাটায় ১৮৭৯ সালে। মিস্টার ওয়ল্টার ডানকান ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসে চিলৌনি বাগানের শেয়ার কেনেন। এগুলো সব ইংল্যান্ডে স্থাপিত কোম্পানি হলেও ডুয়ার্সের চা-শিল্পে এদের বহু অবদান রয়েছে।

Tea Garden of Dooars
কালচিনিতে চা-বাগান খুলেছিল বক্সা ডুয়ার্স টি কোম্পানি

কালচিনিতে চা-বাগান খুলেছিল বক্সা ডুয়ার্স টি কোম্পানি।আমরা কালচিনি, রায়মাটাং, চিনচুলা ও ডিমা– এই চারটি বাগান নিয়ে বক্সা ডুয়ার্স টি কোম্পানির অবস্থান দেখেছি। যতদূর মনে পড়ছে, এর মালিক আদিতে ছিল শ-ওয়ালেস কোম্পানি। যতদূর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, ১৮৯৬ সালে এ কোম্পানির কালচিনি আগমন। আমার বাবা ও এক কাকা এই কোম্পানিতেই আজীবন কাজ করেছেন। আমার জেঠু ও বড়কাকা ছিলেন হাসিমারা টি কোম্পানির ভার্নাবাড়ি চা-বাগানে।

আমাদের ডিমা চা-বাগানের জমির পরিমান ২৯৯৯.৯৯ একর। হাসিমারার সাঁতালি চা-বাগানের জমির পরিমান ১২৬৭.৬৪ একর। এই বিপুল পরিমাণ জমি চা-বাগানগুলির হাতে কেমনভাবে এসেছিল, তাও একবার জেনে নিতে হয়। সে আমলে  ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বাগিচা অর্থনীতির দু’টি সাধারণ চাহিদা ছিল। প্রথমটি বিস্তৃত জমির জোগান এবং দ্বিতীয়টি সস্তায় শ্রমের উপস্থিতি। এছাড়াও আর একটি অবশ্যম্ভাবী শর্ত ছিল, এ দুটোই যেন ঔপনিবেশিক সরকার খুব সুলভে এবং সুবিধায় বাগানের মালিকের হাতে তুলে দেয়। ভূমি ও শ্রমশক্তি কতটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহৃত  হচ্ছে, তার উপরেই নির্ভর করে রাজস্ব আদায় ও ব্যবসার মুনাফার পরিমান। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই ইংরেজ আমলে এবং স্বাধীনতার পরেও বারংবার পরিবর্তিত হয়েছে জমি নীতি ও শ্রমনীতি। আমরা এখানে জমি নীতিটি সংক্ষেপে একবার দেখে নিতে পারি।

১৮৪০ সাল থেকেই প্রথমে অসম, পরে দার্জিলিং এবং আরও পরে ডুয়ার্সে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ বা ভার্জিন ল্যান্ডগুলিকে প্রায় বিনা খাজনায় চা-বাগান পত্তনের জন্যে দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা ছিল ‘নন-রেগুলেটারি ডিসট্রিক্ট’ অর্থাৎ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আইন এখানে খাটত না। ফলে জেলা দু’টি ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতার বাইরে। ১৮৭৪ সালের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড অ্যাক্ট’ ডুয়ার্সে চা-বাগান পত্তনের সুবিধা করে দিয়েছিল। উল্টোদিক থেকে আবার বলা যায় যে অস্বাস্থ্যকর শ্বাপদ-সংকুল এই অঞ্চলে ইংরেজ নিয়োগকারীদের চা-বাগান পত্তনে উৎসাহী করার উদ্দেশ্যেই এই আইনটির প্রণয়ন হয়েছিল। এই আইনের বলে চা-বাগানে ব্যবহৃত জমির জন্যে কোনও খাজনা লাগত না। জমিগুলি পরিচালিত হত ১৮৯৬ সালের ওয়েস্ট ল্যান্ড রুলসের দ্বারা, যে নিয়মগুলি আজও কমবেশি টিকে আছে।

এই আইন অনুসারে দরখাস্তকারীকে ডেপুটি কমিশনার এবং রেভিনিউ বিভাগের কর্তাদের মূলধনের জোগান সম্পর্কে সন্তুষ্ট করতে হবে। এ ছাড়াও প্রস্তাবিত জমি জরিপের জন্য একরপিছু এক টাকা করে জমা দিতে হবে। এরপর ডেপুটি কমিশনার জমি পরিদর্শনের আদেশ দেবেন। চা-বাগান পত্তনের জন্য জমি দেওয়া হবে, এই সিদ্ধান্ত গৃহিত হবার পর অধিগ্রহনের জন্য নির্ধারিত জমিতে গাছের দাম নির্ধারিত করবে বনবিভাগ। এরপর প্রারম্ভিকভাবে লিজ দেওয়া হবে পাঁচ বছরের জন্য। প্রথম এক বছরের জন্য ভূমিরাজস্ব মকুব থাকবে। এরপর সরকার সন্তুষ্ট হলে পরবর্তীতে ত্রিশবছরের জন্য পুনর্বার ওই জমি লিজ  দেওয়া হবে। এইভাবে লিজ দেওয়া শুরু হবার পর  ১৯০৬-০৯ সালের মধ্যে ওয়েস্ট ল্যান্ড লিজ দেওয়া শেষ হয়ে যায়। এরপর হাত পড়ে জোত জমিতে, অর্থাৎ চাষের জমিতে। চাষের জমি চা-বাগানে রূপান্তরিত হবার কাজ চলতে থাকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। এইভাবে তৎকালীন জলপাইগুড়িতে কমবেশি দেড়শোটির মতো চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। দার্জিলিং এবং ডুয়ার্সে চা-বাগান পত্তনের সময় সার্ভে বা জরিপের কাজ গুরুত্ব দিয়ে করা হয়নি। অধিগৃহীত জমি সঠিকভাবে চিহ্নিত করাও হয়নি। ফলে স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হন। 

 

আরও পড়ুন: ঈশানী রায়চৌধুরীর গল্প: নীল পাখি

 

জলপাইগুড়িতে ব্রিটিশ আমলে জমি ছিল তিন ধরনের।
(১) চা-বাগানের জন্য নির্দিষ্ট লিজে দেওয়া জমি।
(২) বনাঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট  জমি এবং
(৩) কৃষিযোগ্য জোত জমি।
কৃষিযোগ্য জোত জমি নির্দিষ্ট ছিল ময়নাগুড়ি, ফালাকাটা, আলিপুর ও ভল্কা অঞ্চলে। এই চারটি সরকারি এস্টেটকে বলা হত তহশিল। এই তহশিলগুলিকে জোত হিসেবে ভাগ করে  জোতদারদের লিজ দেওয়া হত। এই জমিগুলিকে ‘রায়তওয়ারি ট্র্যাক্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হত। ব্রিটিশ আমলে রায়তওয়ারি জমি বারকয়েক জরিপ করা হয়েছে এবং দেশি ব্যবসায়ীদের চা-বাগান পত্তনের জন্যে লিজ দেওয়া হয়েছে। কৃষিজমিতে চা-বাগানের পত্তন কিন্তু করেছিল স্বদেশী বিনিয়োগকারীরাই।  বিদেশি শাসকেরা সে সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে মুনাফার কথা বিবেচনা করে অসম, দার্জিলিং এবং ডুয়ার্সের জমিতে চায়ের চাষ বাড়িয়ে যেতে অবাধে জমি লিজ দিয়ে গিয়েছিল।এর পরিণাম কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের অন্যান্য চা-বলয়ের মতো ডুয়ার্সের জমি ব্যবহারের উপরেও প্রভাব ফেলেছে। কৃষিজমি, বনবিভাগের জমি ও চা-বাগানের জমি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে আজ,  তা এই অনিয়ন্ত্রিত জমি লিজ দেওয়ার প্রতিফল। 

ঔপনিবেশিক আমলে চা-বাগানের জমি যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নেওয়া যায় তার চেষ্টা শাসকেরা করেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৫৩ সালে বলবৎ হল ‘টি অ্যাক্ট।’ এই কেন্দ্রীয় আইনে বলা হল, চা-বাগানগুলিকে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা সরকারের উপর বর্তাবে। টি-বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে তার উপর চায়ের উৎপাদন, গুণমান, রফতানি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও শ্রমিকদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ দেবার বিষয়ে নজর রাখার দায়িত্ব দেওয়া হল। রাজস্ব সংগ্রহ এবং ভূমি অধিকার সংক্রান্ত বিষয় ব্রিটিশ আমলে নির্ধারিত হত ১৭৩৯ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা।

Tea Garden of Dooars
ঔপনিবেশিক আমলে চা-বাগানের জমি যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নেওয়া যায় তার চেষ্টা শাসকেরা করেছিল

এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে বাংলায় যে আইনগুলির পরিবর্তন ও প্রবর্তন করা হয়েছিল সেগুলি হল: রেন্ট অ্যাক্ট ১৮৫৯, বেঙ্গল টেনেন্সি অ্যাক্ট ১৮৮৫, ওয়েস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজ়িশন অ্যাক্ট ১৯৫৩ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড রিফর্মস অ্যাক্ট ১৯৫৫। একথা সকলেরই জানা যে ওয়েস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজ়িশন অ্যাক্ট ১৯৫৩-এর উদ্দেশ্য ছিল, ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারি ও মধ্যস্বত্ত্বাধিকারীর স্বত্ব বিলোপ করা। এই আইনের ৬ নং ধারায় মধ্যসত্ত্বাধিকারীরা কতটুকু জমি রাখতে পারবে, সে সম্পর্কে বলা আছে। চা-বাগানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল ৬(৩) ধারা। সেখানে বলা আছে, লিজগ্রহণকারী চা-বাগান ততটাই জমি রাখতে পারবে, যতটা কিনা সরকারের মতে চাষের জন্যে প্রয়োজন। উদ্বৃত্ত জমি সরকারের ঘরে বর্তাবে। কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রেই চা-বাগানের মালিকরা উদ্বৃত্ব জমি ফেরত দিতে এবং রাজস্ব জমা দেবার বিরোধিতা করে কোর্টের দ্বারস্থ হত। তাদের যুক্তি ছিল, ওয়েস্ট ল্যান্ড খাজনা মকুবের আওতায় পড়ে।

অন্যদিকে ওয়েস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজ়িশন অ্যাক্ট, ১৯৫৩-এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চা-বাগান থেকে উদ্বৃত্ত চাষযোগ্য জমি উদ্ধার। যদিও এই উদ্ধার হওয়া জমি পুনঃবন্টনের ব্যবস্থা এই আইনে ছিল না। পরবর্তী সময়ে  ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড রিফরর্মস অ্যাক্ট, ১৯৫৫, আইনে সরকারে খাস হওয়া জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তাছাড়া চা-বাগানের লিজের জমি নবীকরণের পূর্বে সার্ভে বা জরিপ করার কথা বলা আছে।কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে সার্ভের কাজ না করার ফলে জমির হাল সঠিকভাবে নির্ধারিত করা হয়নি। ফলে জমি ব্যবহারের প্রকৃত চিত্রও স্পষ্ট হয়নি। চা-বাগান থেকে উদ্বৃত্ত জমি উদ্ধারও করা যায়নি। গরিব ও প্রান্তিক চাষিরা সে জমি পাট্টা হিসেবে পায়ওনি। 

কৃষিজমি বন্টিত হয়ে যাবার পর চা-বাগান সম্প্রসারণের জন্য জমি দুর্লভ হয়ে পড়ে। এরপর পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার আইন কাজে লাগিয়ে চা-চাষের জন্য কৃষিজমি প্রজেক্ট টি গার্ডেন  বা ছোট ছোট চা-বাগান তৈরির জন্য সরকারি মদতেই দেওয়া হয়। এই চা-বাগানগুলির কারখানা নেই। এরা শুধু কাঁচা চা-পাতা কারখানাওয়ালা চা-বাগানগুলিতে যোগান দেবে। এই সময়ে ব্যাপক চাষের জমি চা-বাগালে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ১৯৯৯-২০০০ এবং ২০০০-২০০১ সালের মধ্যে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুরে প্রচুর পরিমানে কৃষিজমি চা-বাগানের দখলে চলে যায়। এর ফলে অন্যান্য ফসল উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়।

তবে অবস্থা কিছুটা পাল্টায় তারপরে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড রিফর্মস অ্যাক্ট ১৯৫৫-এর ২০০১ সালের সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, চা-বাগানের জমিতে কোনও  ‘সিলিং লিমিট’ থাকবে না। কতটা জমি চা-বাগানের জন্য দরকার তা ঠিক করে দেবে সরকার। এই সংশোধনীর ফলে সরকার চা-বাগানে প্রচুর পরিমানে জমি ক্ষতিপূরণ দিয়ে অধিগ্রহনের সুযোগ পেয়ে যায়। চা-বাগান কর্তৃপক্ষও কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজস্ব থেকে রেহাই পেতে জমি ফেরত দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং অন্য নামে সেই জমি আবাসন ইত্যাদি কাজে লাগাবার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে শিলিগুড়ির কাছে চাঁদমণি চা-বাগানের জমি স্যাটেলাইট টাউনশিপ তৈরির কাজে ব্যবহার করার প্রসঙ্গ এখনও ডুয়ার্সের মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।  

*চিত্রঋণ: লেখক
*তথ্যঋণ: 

১.সান্যাল মানিক/ চা-শিল্প ও শ্রমিক আন্দোলন /পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮।
২.তিরকি মনোহর / জলপাইগুড়ির আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি/ পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮।
৩.চক্রবর্তী সমীর / উত্তরবঙ্গের আদিবাসী চা-শ্রমিকের সমাজ ও সংস্কৃতি/মনীষা/অক্টোবর ১৯৯২।

অপূর্ব দাশগুপ্ত 'পুরোগামী' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক।

5 Responses

  1. ভারতে চা শিল্পের ক্রমবিকাশের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা সুন্দর ভাবে পরিবেশিত হয়েছে। একটি সংশোধনী। প্রথম ইন্দো বার্মা যুদ্ধের পর ১৮২৬-এর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইয়ানদাবো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারপর অসম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮২৫ নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com