আগুন, বই আর গোলাপ
আগের পর্বের লিংক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮]
পরীক্ষা শেষ হতেও আর এক সমস্যা। কলেজ, ইউনিভার্সিটি নেই, নিত্য দেখা-সাক্ষাৎ নেই বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে। সন্ধেটা না হয় কখনও কাটাচ্ছি শ্যামল, চন্দন, খোকনের সঙ্গে রামসীতার মন্দিরের উঠোনে আড্ডা মেরে, গলায় বনি স্কট হুইস্কি ঢেলে, যা না জুটলে নিখাদ বাংলায় চুমুক দিয়ে। হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়ছে গৌতমও (ঘোষ)। তখনও ওর প্রথম ছবি করা হয়নি, পুরো ছবিটা মাথায় পাক খাচ্ছে; সেই সব কল্পনার কথা বলে। রাতে শুতে যাবার সময় প্রুস্তের ‘সোয়ানস্ ওয়ে’ উপন্যাসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি। কারণ, ‘রিমেমব্রেন্স অফ থিংগজ পাস্ট’-এর আর কোনও খণ্ড বাজারে খোঁজ করে পাই না। কফি হাউজে কখনও-সখনও গিয়ে বসি, আর চেনা মুখ না পেয়ে বুকটা দমে যায়। এই সময়েই হঠাৎ একদিন হাতে এসে গেল জর্জ ‘সিমেনো’র অপূর্ব গোয়েন্দা উপন্যাস ‘মেইঘ্রে ইন এগজাইল’, আর একটা নতুন জগতই যেন খুলে গেল চোখের সামনে। এতদিন ডিটেকটিভ স্টোরি বলতে মনে ভাসত শার্লক হোমস, অ্যার্কুল পোয়ারো ও মিস মার্পল। সেখানে সহসা নতুন এক সত্যসন্ধানীর উদয় হল। গোয়েন্দা গল্পই পড়ছি, ইন্সপেক্টর মেইঘ্রে নামের গোয়েন্দাও হাজির, কিন্তু পড়ার স্বাদ যেন এক জটিল মধুর সামাজিক উপন্যাসের। ঠোঁটে পাইপ ঠাসা, স্বল্পবাক এই গোয়েন্দা খুনের সূত্র খোঁজেন লিপস্টিকের দাগ, সিগারেটের টুকরো বা ট্রাউজার্সের ছাপছোপে নয়, বরং কথা বলে বলে, কথা শুনে শুনে চরিত্রদের মনের গলিঘুঁজিতে। অর্থাৎ মনস্তত্ত্ব দিয়ে অপরাধীর মনে প্রবেশ করতে করতে মেইঘ্রে পাঠকের মনের গভীরেও চলে আসেন। জর্জ সিমেনোর এই সব উপন্যাসের মুগ্ধ পাঠক আঁদ্রে জিদ ওঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মানুষ যতটা তোমাকে চেনে-জানে তুমি তার চেয়েও অনেক বড়।’
প্রুস্তের পরে পরেই আমার নতুন আবিষ্কার হল তাই সিমেনো। ‘মেইঘ্রে ইন এগজাইল’ শেষ হতে পড়া ধরলাম ‘মেইঘ্রে অ্যান্ড দ্য টয় ভিলেজ’, তারপর ‘দ্য ইয়েলো ডগ’, আর এভাবেই চলতে থাকল। বাড়ির থেকে বেরলেই তখন একটা না একটা সিমেনো নিয়ে ফিরছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা না একটা হা-হুতাশ থেকেই যাচ্ছে। আর কী করার? আর কী করার? এই সময়ই মায়ের দয়া মাথায় পড়ল দু’ভাবে। একবার সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদারদের নিজস্ব লাইব্রেরির দুটো বই ফেরত দিতে গেছিলাম। চামড়ায় বাঁধানো আলব্যের কামুর উপন্যাস ও প্রবন্ধ সংগ্রহ। বই ফেরত দিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেছিলাম ভাইস প্রিন্সিপাল ফাদার হুয়ার্টের সঙ্গে। উনি আমায় দেখেই একটা কৌতুক মিশ্রিত হাসি হেসে বললেন,
– কী? কেমন কাটছে অঢেল ছুটি? ক্লাস নেই, পরীক্ষা নেই, পড়া নেই।
আমি বিনীত স্বরে বলললাম,
– ক্লাস বা পরীক্ষা নেই ঠিকই, তবে পড়া নেই বলছি না। পড়ে পড়েই সময় কাটাচ্ছি।
ফাদার ফের হেসে হেসে বললেন,
– সময়টা তো অনেকখানি। তাহলে তার সঙ্গে পড়ানোটাও যোগ করে নাও।
– পড়ানো?
আমি রীতিমতো স্তম্ভিত। বললাম,
– আমি আর কোথায়, কাকে, কী পড়াব ফাদার?
ফাদার হুয়ার্ট এবার ওঁর বহু পরিচিত শান্ত, সুন্দর হাসিটা হেসে বললেন,
– কেন, এখানে— সেন্ট জেভিয়ার্সে। ফাদার গোমস মারা গেলেন, প্রফেসর পিন্টো অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেট করে গেছেন, তুমি জানো। নতুন যে প্রফেসর এসেছিলেন মিস্টার সরকার তিনিও ছেড়ে গেছেন। আমি কিছু নতুন ট্যালেন্ট আনতে চাই টিচিং স্টাফে। তুমি আসবে?
এ কথা শুনে আমি তো আরওই অবাক, প্রায় বাকরুদ্ধ। তাও কোনওমতে উগরোলাম,
– কিন্তু ফাদার, আমার এমএ-র রেজাল্ট তো বেরতে সময় লাগবে।
– জানি। ততদিন তুমি উইকে একটা-দুটো ক্লাস নিয়ে সড়গড় হয়ে যাও। কিছু ফিজও পাবে। আর রেজাল্ট বেরোলে তোমাকে স্টাফে অ্যাবজর্ব করে নেব।
কী বলব, আমার চোখের সামনে তখন স্বর্গ নেমে এসেছে। মায়ের বড় স্বপ্ন আমি অধ্যাপনা করি, এবং সেন্ট জেভিয়ার্সে। কারণ ওই স্কুলে বাবা আমাকে ভর্তি করতে গেছিলেন। এসবই ভাসছিল চোখের সামনে যখন ফের কানে এল ফাদারের কণ্ঠ,
– সামনের মাসেই শুরু করো। তোমার প্রথম ক্লাসে ব্যাকবেঞ্চে ফাদার লুইস থাকবেন। তোমার পড়ানোর রিপোর্ট দেবেন। আশা করছি তোমার রেজাল্ট বেরোলে তুমি আমাদের স্টাফে আসছ।
আমার চোখের সামনে তখন লম্বা, চশমা পরা, আইরিশ পাদ্রি ফাদার লুইসের চেহারাটা ভাসছে। কড়া মানুষ, আমাদের রেটোরিক অ্যান্ড প্রমোডি পড়াতেন। বেশ টেনে টেনে নম্বর দিতেন। অলিভার গোল্ডস্মিথের কমেডি নাটক ‘শি স্টুপস টু কংকার’ পড়িয়েছিলেন। আর প্রফেসর পিন্টো চলে যেতে ওঁর হয়ে শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ শেষ করেছিলেন। এইসব ভাবনার মধ্যে ফের শুনলাম ফাদার বলছেন,
– কোন পেপার পড়াবার ইচ্ছে?
অন্যরা কে কী পড়াচ্ছেন জানি না, কোন পেপারের কী পড়ানো বাকি আছে তাও জানি না, শুধু নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসার কথাটা একটা শব্দে উচ্চারণ করে দিলাম— ‘ম্যাকবেথ’।
ফাদার বললেন,
– তাই হবে। যাও বাড়ি গিয়ে ‘ম্যাকবেথ’ নিয়ে পড়াশুনো করো। এটা পড়ানোর জন্য পড়াশুনো।
প্রথম লেকচারের দিন ছেলেদের সিলেবাসের তিনটি টেক্সট নিয়ে একটা ভূমিকা গোছের বক্তব্য রেখেছিলাম। কারণ এই তিনটে টেক্সট নিয়েই আগামীতে পড়ানোর ছিল আমার। ‘ম্যাকবেথ’ নাটক, ডিকেন্সের উপন্যাস ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ এবং কিটসের দুটি কবিতা ‘ওড টু অটাম’ এবং ‘ওড টু দ্য নাইটিঙ্গেল’। আমার লেকচারটা সেরা ইংরেজি সাহিত্যেরই একটা ভূমিকার মতো হয়ে গিয়েছিল। ‘ম্যাকবেথ’ শেক্সপিয়ারের অপরূপ ও নিখুঁততম কাজ, ওঁর নাটক লেখার জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে কাজটার একটা প্রেক্ষাপট তুলে দিয়েছিলাম। জানি না, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি করেই বলে দিয়েছিলাম যে এই নাটকটি অল্প বয়েসে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ। তা শুনে একটি ছেলে কী একটা প্রশ্নও করেছিল মনে আছে।
‘ডেভিড কপারফিল্ড’ ডিকেন্সের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলে ডবলিউ এইচ হাডসনের সেই উদ্ধৃতিটা শুনিয়েছিলাম, যেখানে তিনি বলছেন যে, কোনও মানুষ যদি গুছিয়ে তার নিজের জীবনের কথা বলে যেতে পারে তবে তাতেই একটা উপন্যাস দাঁড়িয়ে যাবে। অন্যভাবে বললে, সব মানুষই তার জীবনে একটা উপন্যাস ধারণ করে। ডিকেন্সের জীবন থেকে উঠে এসেছে ‘ডেভিড কপারফিল্ড’। কান্নাহাসির দোলদোলানিতে মেতে থাকা যায় এই উপন্যাস পাঠের সময়টায়। গোটা ডিকেন্স যেন হাজির তাঁর নিজের রচনাবলির মধ্যে প্রিয়তম এই কাজে। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সমারসেট মম তাঁর ‘দ্য ওয়র্ল্ডজ টেন গ্রেটেস্ট নভেলজ’ বইয়ে ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’, ‘দ্য ব্রাদার্জ কারামাজোভ’, ‘মাদাম বোভারি’, ‘মবি ডিক’, ‘দ্য রেড অ্যান্ড ব্ল্যাক’ ইত্যাদি উপন্যাসের সঙ্গে এক গোত্রে রেখেছেন ‘ডেভিড কপারফিল্ড’কে। তারপর ফের একবার বাড়াবাড়ি করেই বলেছিলাম, ‘‘তোমরা কলেজ, ইউনিভার্সিটি পাস করে আরও একটা মহৎ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস পড়বে যা সাত-সাতটি মস্ত খণ্ডে লেখা। মার্সেল প্রুস্তের সেই ফরাসি উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘রিমেব্রেন্স অফ থিংগজ পাস্ট’।’’ কিটসের ভূমিকাতে ‘ওড টু দ্য নাইটিঙ্গেল’ কবিতাটা সুন্দর করে পড়ে বলেছিলাম ‘এ কবিতা এতই সূক্ষ্ম ও সুন্দর যে যতই পড়া যায় ততই রহস্যময় হয়ে ওঠে। এ কবিতা গানের মতো, যা যখন পড়ব আমরা তখন আবিষ্কার করব।’
মোটামুটি এই সব বলে প্রথম দিনের লেকচার শেষ করেছিলাম। সারাটাক্ষণ ফাদার লুইস লাস্ট বেঞ্চে বসে শুনেছিলেন। মাঝেমধ্যে মুখে হাসি ফুটতেও দেখেছি। ক্লাস শেষ হতে তিন-চারটি ছেলে আমার পিছু নিল। তাদের সবার প্রশ্ন:
– এরপর কবে ফের ক্লাস নিচ্ছেন স্যর? আর কোন বইটা পড়াবেন?
আমি তখন শুধু একটাই উত্তর জোগাতে পারছি,
– এটা তো আমি বলতে পারব না। তোমরা ফাদার লুইসকে জিজ্ঞেস করো। উনি বলতে পারবেন।
দু’ভাবে মায়ের দয়া ঝরে পড়ার একটা ভাব বললাম এতক্ষণ। দ্বিতীয় ভাবটাও ঝরল এরই মধ্যে যখন ছেলেদের পরীক্ষা, পুজোর ছুটি ইত্যাদি চলছে। শীত এল বলে। আর তখনই একটা ফোন এল। অরূপ সরকারের। যিনি তখন প্রায় ভগবান বিশেষ আমার জীবনে। ফোনে ডাকলেন অফিসে আর এক অভিনব প্রকল্পের কথা বললেন। সারারাত সরোদ। নানা হাতে নয়, শুধু একজনের হাতেই, উস্তাদ আমজাদ আলি খান। আমার করণীয় ছিল ব্রোশিওরের ব্যাপারে, আর আমার সহপাঠিনীদের থেকে তিন সুন্দরীকে অনুষ্ঠানে আনা যারা ব্রেকে ব্রেকে সরোদশিল্পীকে ফুলের বোকে তুলে দেবে। ও হ্যাঁ, সরোদিয়া একজনই। কিন্তু তবলা সঙ্গতে সন্ধেতে পরপর উস্তাদ কেরামতুল্লা খান, বড় আসরে প্রথম ব্রেক পাওয়া কেরামতপুত্র সাবির খান এবং শেষরাত থেকে পণ্ডিত কিষেণ মহারাজ। আর হায়, হায় কী বাজনা সারারাত জুড়ে! সন্ধে সাতটা থেকে বারোটা পর্যন্ত চলল একেবারে গায়কী অঙ্গে ইমন ও খাম্বাজ। কেরামত সাহেবের মধুর রেলা, কায়দা, ঠেকার সঙ্গে আমজাদ ভাইয়ের সরোদের গান। মাঝরাতে সাবির বসতে বাগেশ্রীর রকমারি তান তোড়া গৎকারী। গানের পরে যেন নাচ এল। শেষ রাতে কিষেণজি বসতে আমজাদ তোড়ির ধ্রুপদ আলাদ করে ধরলেন ধামার তালবিস্তার। পাণ্ডিত্য এবং তৈরি মিশে একেবারে Connoisseur’s treat! গোটা রাত জুড়ে এক তদবধি অদেখা, অভাবিত কলাকৈবল্য। যে-তিনটি সুন্দরীকে ফুল দেবার জন্য এনেছিলাম সেই বৈশাখী, পূর্ণিমা ও পিয়ালি তো আমায় ধন্যবাদ দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
শহরে একটা নতুন রব সৃষ্টি হয়েছিল এই বাজনায়। সে-সময় আনন্দবাজার ও স্টেটসম্যানের মধ্যে একটা রেষারেষি চলত আমজাদকে নিয়ে। খুব টিপে টিপে প্রশংসা করত ওঁর স্টেটসম্যান। আর সারারাত সরোদের কোনও সমালোচনায় যেতে না পেরে একটা অদ্ভুত হেডিং দিয়ে ক্ষোভ মেটালো। শিরোনাম করল সমালোচনার ‘Endurance sarod’! বাজিয়ে আমজাদ চলে গেলেন দিল্লি। কিন্তু আবেগে আত্মহারা অরূপ একটা সেলিব্রেশন প্ল্যান করলেন। পার্ক স্ট্রিট কোয়ালিটির দোতলায় এক অপূর্ব ককটেল ডিনার। বাবলুদা, মানে সেতারি সুব্রত রায়চৌধুরী এলেন স্ত্রী উমাকে নিয়ে, পিয়ালি ও পূর্ণিমা শান্তিনিকেতন ফিরে গিয়েছিল বলে শুধু বৈশাখী এল এবং এই অধম। অরূপ সেদিন সেরা আইটেমের সঙ্গে সমানে অর্ডার করে গেলেন ডিম্পল স্কচ। অমন সুন্দর একটা সন্ধ্যা প্রায় আমজাদের সরোদের মতো সুরেলা হয়ে উঠেছিল। বাড়ি ফেরার পথে অরূপ দু’দিন পর সোমবার বিকেলে ওঁর অফিসে দেখা করতে বললেন। তখনও থোড়াই জানি এ হল মায়ের দয়ার দ্বিতীয় বর্ষণ! (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৩০ নভেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Osho News, Amazon, Wikipedia
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।